মুখের দুর্গন্ধ… কেন হয় এবং করনীয় কি ………

…………………..

আপনি দেখতে, শুনতে, বিদ্যা, বুদ্ধিতে যতই স্মার্ট হন না কেন, শুধুমাত্র মুখের দুর্গন্ধ আপনাকে নামিয়ে ফেলতে পারে একেবারে জিরো লেভেলে।

অনেকেই মুখে দুর্গন্ধজনিত সমস্যায় ভোগেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে তো বটেই, সারা দিনই মুখে দুর্গন্ধ হয়ে থাকে। দিনে কয়েকবার দাঁত ব্রাশ বা মাউথ ওয়াশ ব্যাবহার করার পরেও দুর্গন্ধ যেন থেকেই যায়। মুখ ঢেকে কথা বলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। মুখোমুখি কথা বলতে গেলে বিব্রত হতে হয়, হাসতেও পারেন না প্রাণ খুলে। তার চেয়েও দুঃখজনক হল, যার মুখে দুর্গন্ধও হচ্ছে, সে নিজেও টের পাচ্ছে না। তখন তাকে জানানো টাও একটা বিরাট অস্বস্তিকর ও অভদ্র ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

চলুন জেনে নেই, কেন মুখে দুর্গন্ধ হয় এবং করনীয় কিঃ

১। মুখের ভিতরটা কিছুক্ষণ ধরে শুকনা থাকলে বা মুখের লালা কমে গেলেই সাধারণত মুখে দুর্গন্ধ দেখা দেয়।

আমাদের মুখের ভিতরে বাস করে হাজার হাজার ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস সহ নানা জীবাণু এবং এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এরা আমাদের উপকারও করে আবার দাঁতের ক্ষয় ও মুখে দুর্গন্ধও সৃষ্টি করে। আমাদের মুখের লালা বা থুথু, আমাদের মুখের ভিতরের অংশকে আর্দ্র রাখতে সাহায্য করে এবং মুখের ভিতর পরিষ্কার রাখে। মুখের ভিতরে চারপাশে রয়েছে বেশ কিছু লালা বা থুথুর গ্ল্যান্ড, যেখান থেকে, মুখে সব সময় লালা আসতে থাকে। জাগ্রত অবস্থায় যেহেতু সবসময় মুখে লালা আসতে থাকে, সেহেতু ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস ইত্যাদি জীবাণু, মুখে এক জায়গায় জমে থাকতে পারে না। জীবাণু গুলো লালার মাধ্যমে দেহের ভিতরে চলে যায়। ফলে মুখও থাকে সুরক্ষিত। সমস্যা তৈরি হয় মুখ শুকিয়ে গেলে। মুখ শুকিয়ে গেলে, সেখানে বিভিন্ন রকম ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু জমা শুরু করে। আর তখনই সৃষ্টি হয় দুর্গন্ধ। আর এ কারণেই যখন আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠি, তখন আমাদের মুখে তৈরি হয় দুর্গন্ধ। কারণ ঘুমের মধ্যে সারারাত আমদের মুখে কোন লালা আসে না। তখন ঐ ব্যাকটেরিয়াগুলো গন্ধ তৈরি করে থাকে।

এ জন্য দিনের বেলা চেষ্টা করতে হবে যেন মুখ বারবার শুকিয়ে না যায়, এক্ষেত্রে আপনি…

. সারাদিন প্রচুর পানি পান করুন, যেমন, ২/৩ লিটার।

. চিবিয়ে খেতে হয়, এ ধরনের খাবার খান, যেমন, গাজর, শসা, আপেল, পেয়ারা ইত্যাদি। প্রতিবার কোন কিছু খাওয়ার সময়, খাবার যথাসম্ভব চিবিয়ে খান। এতে মুখে প্রচুর লালা আসবে, যা আমাদের জন্য উপকারী।

. চাইলে চিনি ছাড়া চুইঙ্গাম চাবাতে পারেন।

. প্রচুর পরিমাণে টক জাতীয় বা ভিটামিন সি জাতীয় ফলমূল ও শাকসবজি খান। যেমন, লেবু, জাম্বুরা, কমলা, টমেটো, জলপাই, আমলকী ইত্যাদি। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, লেবুর ভেতরে থাকা অ্যাসিডিক উপাদান মুখগহ্বরে বাসা বেঁধে থাকা খারাপ জীবাণুদের মেরে ফেলে। ফলে দ্রুতই দুর্গন্ধ কমে যায়।

২। যদি খাবার খাওয়ার পর আমরা মুখের ভিতর ভাল করে পরিষ্কার না করি, তাহলে সেই খাবারের অংশবিশেষ দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকতে পারে, যার জন্য মুখ থেকে দুর্গন্ধ বেরোতে পারে।
আবার ডেন্টাল ক্যারিজ বা দাঁতে বড় গর্ত হয়ে গেলে, সেই গর্তের ভেতর খাবার জমে, সেখান থেকে দুর্গন্ধ আরম্ভ আসতে পারে।
মুখের সুস্বাস্থ্যের জন্য, দিনে অন্তত ২ বার দাঁত ব্রাশ করুন। এতে মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী, জীবাণু বা ব্যাক্টেরিয়া দাঁতের ফাঁকে বাসা বাঁধতে পারবে না। প্রতিবার দাঁত মাজার সময় জিভও পরিষ্কার করুন। এতে জিভের ওপর জমা খাবারের কণা দূর হবে।

প্রতি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ১ বার ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার করতে হবে।

খাবার খাওয়ার সাথে সাথেই দাঁত ব্রাশ করবেন না। খাবারের পরপরই মুখের PH এসিডিক থাকে। খাবার পর থুথু প্রথম মুখের PH নরমাল করে। তাই খাবারের পরপরই দাঁত ব্রাশ করার ফলে এনামেলের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার এসিডিক PH -এ ব্যাকটেরিয়ার প্রজনন হার হয় অনেক বেশি। তাই খাবারের পর ৩০-৪০ মিনিট আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, ব্রাশ করার জন্য, যেন প্রাকৃতিক উপায়ে থুথুর মাধ্যমে খাদ্য পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে ও মুখের নরমাল PH বজায় থাকে।

৩। হজমের সমস্যার কারণেও মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। পেট পরিষ্কার না হলে এই সমস্যা আরও বাড়ে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যাঁরা নিয়মিত পেটের সমস্যায় ভোগেন, তাঁদের মুখে দুর্গন্ধ হয়। তাই মুখে দুর্গন্ধ হলে, পেটের স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না, সে দিকেও নজর দিতে হবে। খাদ্য নালিতে অ্যাসিড যাতে বেশি না হয়, সে জন্য সময় মতো বার বার অল্প করে খেতে হবে। উচ্চ ফাইবার বা আঁশ যুক্ত খাবার হজমে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। তাই আঁশ যুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে। তেল, ঝাল, মশালাযুক্ত খাবার কম খাওয়াই ভাল। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে শাকসব্জি, ফল বেশি করে খাবেন। পর্যাপ্ত মাত্রায় পানি পান করতে হবে এবং নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করতে হবে। দই খাওয়া পেটের জন্য খুবই ভাল। দইয়ের মধ্যে কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা হজমে সাহায্য করে।

৪। দেহের অন্যান্য রোগের কারণেও মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। যেমন- পরিপাকতন্ত্রের নানা রোগ, কিডনি রোগ, লিভারের রোগ, হাই ব্লাড প্রেশার, গর্ভাবস্থা, ডায়াবেটিস, এইডস, নাক, কান, গলার রোগ ইত্যাদি।

৫। সাইনাসের সমস্যা থাকলে নাকে ও গলায় মিউকাস জমে থাকে। তা থেকে দুর্গন্ধ তৈরি হয়। অ্যালার্জির কারণেও মুখে দুর্গন্ধ তৈরি হতে পারে।

৬। ধূমপান বর্জন করুন। ধূমপানের কারণে মুখের ভেতর শুকিয়ে যায় এবং মুখের মধ্যে জন্মানো জীবাণুর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ফলে মুখে মারাত্মক দুর্গন্ধ হয়।

মুখে দুর্গন্ধ হওয়ার কারণ শুধুমাত্র অপরিষ্কার দাঁত এবং বাজে খাদ্যাভ্যাস নয়। মুখে দুর্গন্ধ নানা কারণেই হয়ে থাকে, যার বেশির ভাগই নানা শারীরিক সমস্যার কারণে হতে পারে। তাই মুখে দুর্গন্ধ হলে তা অবহেলা করে এড়িয়ে যাবেন না। অতি দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

এই লেখার উদ্দেশ্য চিকিত্‍সা নয়, শুধুমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধি করা। কোন ভাবেই এটিকে প্রেসক্রিপসন বা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যাবেনা।

যেকোনো রোগ বা সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

…….. তিনা শুভ্র ।।

Leave a comment