অস্তিত্ববাদী জাহিদের পরাবাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো : পর্ব ২
১
জাহিদ যখন ইংল্যান্ডে পিএইচডি করছে, তখন লুবনা সিদ্দিকার সাথে তার পরিচয় হয় – ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। লুবনা সাহিত্যে মাস্টার্স করছিলো এডিনবার্গ-এই। জাহিদ একদিন ক্যান্টিনে বসে স্টারবাকস-এর কালো কফি খাচ্ছিলো আর দর্শনের একটা জার্নালে চোখ বুলাচ্ছিলো। লুবনা এসে তার সামনে বসলো, তারপর স্পষ্ট বাংলায় বললো – “আপনি বাঙালি, তাই না?” তারপর সে নিজের পরিচয় দিয়ে বক বক করতে শুরু করলো।
কথা-বার্তার এক পর্যায়ে লুবনা জাহিদকে জিজ্ঞেস করলো তার সাবজেক্ট-এর কথা। জাহিদ স্কুল অফ ডিভিনিটিতে দর্শনে পিএইচডি করছেন শুনে লুবনা হেসে উঠলো – “ও, আপনারাই তাহলে ঈশ্বর আছে কি নেই এসব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করেন?”
“হ্যা।” – জাহিদ হেসে উত্তর দিলো।
“তা ওই দু দলের মধ্যে আপনি কোন দলের সাপোর্টার?” – লুবনা ততক্ষনে সামনের চেয়ারে নিজের জন্য একটা জায়গা করে নিয়েছে।
“আমি বিশ্বাস করি, ঈশ্বর মানুষের কল্পনা।”
সিঁথি করা পিঠ পর্যন্ত লম্বা কালো চুল একপাশে সরিয়ে মেয়েটা একটু সামনে ঝুকে এলো, তারপর কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো – “এমন যদি হয়, মানুষ জাতিটাই বরং ঈশ্বরের কল্পনা?”
লুবনা বললো – সে স্পিনোজা পড়েছে। সব বিশ্লেষণ করে তার মনে হয়েছে – সৃষ্টি হলো স্রষ্টার কল্পনা, অর্থাৎ কেবল স্রষ্টার অস্তিত্বই বাস্তব আর আমাদের অস্তিত্ব অবাস্তব।
যুক্তিবিদ্যায় দক্ষ জাহিদ জানতো লুবনার এ ধরণের চিন্তার ফাঁক-ফোকড়গুলো, কিন্তু তার কেন যেন মেয়েটার জন্য মায়া হলো। সে লুবনাকে কিছুই বললো না, শুধু মিটি মিটি হাসলো আর ওর অনর্গল কথা শুনে গেলো।
সেই থেকেই শুরু। জাহিদ কম কথা বলতো বলেই হয়তো লুবনার সাথে তার বন্ধুত্বটা ভালো জমে গেল। তাদের দুজনকে প্রায়ই দেখা যেত ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসের ওপর হাতে হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে, কিংবা একসাথে বসে লাঞ্চ করতে, এমনকি উইকেন্ডে মুভি থিয়েটারে পপকর্ন হাতে হাজির হতে।
লুবনা ছিল প্রজাপতির মতো, অত-শত চিন্তা করার সময়ই যেন ছিল না তার, শুধু উড়ে বেড়াতো একটা দিন থেকে আরেকটা দিনের রঙে। একদিন জাহিদ জানতে চাইলো, প্রমান না থাকা স্বত্তেও কেন সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। উত্তরে লুবনা তার ঘুম ঘুম দু’টো চোখ জাহিদের দিকে তুলে বললো – “কারণ এই জগতের জন্য ঈশ্বরের চেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যা আর কিছু হতে পারে না।”
জাহিদের পড়ালেখার বিষয়ই হলো আস্তিকতা আর নাস্তিকতা, কিন্তু লুবনার সরল এই উক্তির কোন সদুত্তর সে তাৎক্ষণিকভাবে দিতে পারলো না।
জাহিদ আর লুবনার এডিনবার্গের দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিলো দুপুরের রোদে পাথর-বাঁধানো রাস্তায় পাশাপাশি হেটে আর সন্ধ্যার ঝিকিমিকি আলোতে ক্যাফেগুলোতে বসে আড্ডা দিয়ে – সেদিন পর্যন্ত, যেদিন জাহিদ লুবনাকে বিয়ের কথা বললো।
২
ভালোবাসা জিনিসটা আসলে কি? এটা কি শুধুই দুইটা শরীরের ভেতর টান, যেমন ফ্রয়েড বলেছিলো? নাকি এটা দুই আত্মার মধ্যে অলৌকিক কোন বাঁধন, যখন কিনা জাহিদ এসব ভাববাদী কোন কিছুতেই বিশ্বাস করে না?
জাহিদ কোনদিন প্রেমে বিশ্বাস করে নি। সে খুব ভালোভাবেই জানতো যে, সমবয়সী কোন মেয়েকে দেখলে মনের মধ্যে যে প্রজাপতি উড়তে থাকে, সেই প্রজাপতি মূলত এক পতঙ্গ – এমন এক পতঙ্গ, যে কিনা ফ্রয়েডকে গুরু মেনে বসে আছে, যে কিনা ফুল দেখামাত্রই ওটাকে আলিঙ্গন করে ফলে পরিণত করার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে নেবে। তাই যুক্তিসঙ্গত কারণে সে শরীর ছাড়া মানবী-প্রেমের আর কোন উপলক্ষ খুঁজে পায় নি – লুবনাকে দেখার আগে পর্যন্ত।
প্লেটোনিক প্রেমে ভরসা নেই বলেই হয়তো নারী শরীরের সাথে জাহিদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল খুব অল্পবয়সে, কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার আগেই – সেই যে এক চৈত্রের নির্জন দুপুরে ঢাকাই ছবির উঠতি নায়িকা রুনা আপা তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো নিজের স্নানঘরের দিবাস্বপ্নে। এরপর জাহিদ অনেক মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়েছে – দু’পক্ষের সম্মতিতেই – কিন্তু লুবনা ছিল ওর বান্ধবীদের মধ্যে একেবারেই ব্যতিক্রম।
বিলেতের ভার্সিটি ক্যাম্পাসে পরিচয় হওয়া ছোটোখাটো এই মেয়েটাকে ও শারীরিক কারণে কখনোই কাছে চায় নি। জাহিদ খুব ছোটবেলায় তার মা-কে হারিয়েছে, তাই সে জানে না মায়ের মমতা ঠিক কিরকম। কিন্তু ও কেমন করে যেন বুঝতে পেরেছিলো, লুবনা মায়ের মতোই ভালো কেউ একজন। লুবনা যেন ছিল অন্য ধাতে গড়া ভিন্ন জগতের কোন এক দেবী।
জাহিদের বাবা আফতাব সাহেব সবসময় জাহিদকে বলতেন – মানুষের ভেতরে আছে একজন স্রষ্টাকে খোঁজার চিরন্তন প্রবণতা, যারা নাস্তিক হওয়ার চেষ্টা করে তারা আসলে অন্য কোথাও তাদের উপাস্য খুঁজে নেয় – তাদের কেউ কাজকে পূজা করে, কেউ সংগীতকে, কেউ বা আবার নিজের বাসনাকে। ইউরোপের পুরোনো এক শহরের ইট-পাথরে বাঁধানো রাস্তায় হাটতে হাটতে জাহিদ অনেকদিন ভেবেছে – সম্ভবত নিজের অজান্তেই লুবনা মেয়েটা হয়ে উঠেছে ওর জীবনের একমাত্র অর্থ।
লুবনাও কিন্তু জাহিদের পিছু পিছুই ঘুর ঘুর করতো। কোন না কোন অজুহাতে জাহিদের সাথে দেখা করে সে যথারীতি তার আবোল-তাবোল কথা বলতে শুরু করতো। জাহিদের মতো নিরুপদ্রব শ্রোতা সে জীবনে আর কখনো বোধ হয় পায় নি। এসব কারণে জাহিদ জানতো যে সে চাইলেই মেয়েটার সরলতার সুযোগ নিতে পারে। কিন্তু কেন যেন মেয়েটার সাথে কোন ফস্টি-নস্টি করার কথা চিন্তাও করতে পারতো না সে।
এডিনবার্গের ক্যাম্পাসে লুবনার সাথে দেখা হওয়ার পর জাহিদের প্রথমবারের মতো প্রিয় মনীষী ফ্রয়েডকে সন্দেহ হলো। তার মনে হলো, এই মেয়েকে না পেলেও সে সুখী হবে – জীবনে শুধু একবার তার সাথে দেখা হয়েছে বলে।
জাহিদের বাবা বলতো – সৃষ্টির আদিতে ঈশ্বর যখন শুধু আত্মাগুলোকে সৃষ্টি করেন, তখন যারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে খোদার বাণীগুলো শুনছিলো, তারাই এ পৃথিবীতে খুব ভালো বন্ধু হতে পারে একজন আরেকজনের। জাহিদ যদি ঐশীবানীতে বিশ্বাস করতো, তাহলে নিশ্চিতভাবেই ধরে নিতো যে লুবনা আর সে সৃষ্টির প্রথম প্রহরে পাশাপাশিই ছিল এমনকি হয়তো হাতে হাত ধরে ঘুরাঘুরিও করছিলো সেই আরাফার ময়দানে।
কিন্তু একটা জিনিস ততদিনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল জাহিদের কাছে, এই মেয়েকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না। কেন পারবে না, সে জানে না – কিন্তু এটাই তখন তার কাছে সত্য। সে কারণেই লুবনাকে হঠাৎ করে ওর বিয়ের প্রস্তাবের সিদ্ধান্ত।
৩
সেদিন ছিল ভ্যালেন্টাইন ডে। আংটি হাতে নিয়ে হাটু গেড়ে বসে রীতিমতো নাটক করে জাহিদ লুবনাকে প্রস্তাবটা দিলো। লুবনা ওকে হাত ধরে উঠে দাঁড় করায়, প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলে –
“কিন্তু একটা সমস্যা যে রয়ে গেছে।”
“কি সমস্যা?” – জাহিদ ভ্রু জোড়া উঁচিয়ে জানতে চাইলো।
“একটা মুসলমান মেয়ে হয়ে আমি কিভাবে একটা নাস্তিককে বিয়ে করবো, বলো?” – লুবনা তখন বলে।
“যদি আমি তৌবা পড়ে কলেমা পড়ি, তাহলে হবে না?” – জাহিদ তামাশা করে জিজ্ঞেস করলো।
“বিশ্বাস এত সহজ জিনিস না। বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে পরীক্ষা দিতে হয়।” – লুবনা উত্তর দেয়।
জাহিদের কুঁচকে যাওয়া ভ্রু জোড়ার দিকে তাকিয়ে লুবনা আবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো, বললো – “শোনো, ভেবোনা, আমি এরমধ্যেই তোমার-আমার এই সমস্যার একটা সমাধান চিন্তা করে ফেলেছি। আমি তোমাকে প্রমান করে দেব যে খোদা আছে, তখন তোমার আর মিথ্যামিথ্যি মুসলমান সাজতে হবে না। বুঝেছো, মিস্টার?”
জাহিদ সেদিন দীর্ঘ পথ একা হেটে ওর ডর্মে ফিরে এলো। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো লুবনার ফোনে। “হ্যালো” বলতেই ওপাশ থেকে শুরু হয়ে গেলো তার বকবকানি – “আমাদের চিন্তার আর কিছু নেই। কাল শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে আমি নামাজ পরে খোদার কাছে প্রার্থনা করেছি, তিনি যেন আমাকে এমন একটা নিদর্শন দেখান যেটা তোমার সাথে শেয়ার করে তোমাকে আমি আস্তিক বানিয়ে ফেলতে পারবো।”
“তুমি কি করে নিশ্চিত হলে, তোমার খোদা তোমাকে নিদর্শন দেখাবেনই?”
“অবশ্যই দেখাবেন। তুমি হয়তো জানো না, শেষ রাতের প্রার্থনা কবুল হয়। আর এমনিতেও খোদা সব কিছু শুনতে পান। তাকে যখন একবার বলতে পেরেছি, তখন চিন্তার আর কিছু নেই। নিদর্শন এই এলো বলে।”
জাহিদ বুঝতে পারছিলো না, এই পাগলকে কি বলে থামানো যাবে।
কিন্তু সেদিনের পর থেকে লুবনার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ্য করলো জাহিদ। সে কথা বলা কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে, সন্ধ্যার পর বেশির ভাগ সময়টা লাইব্রেরিতে কাটাচ্ছে । কিছু জানতে চাইলে বলে – “তথ্য-প্রমান জোগাড়ের কাজ চলছে।”
মার্চের মাঝামাঝি সময় লুবনা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেলো, পুরো এক মাসের জন্য – ফোন করলে ফোন ধরে না, বাসায় গেলে দরজা খোলে না। প্রায় দিন সাতেক পর ক্যাম্পাসে তাকে দেখা গেলো, বার্চ গাছটার নিচের বেঞ্চিতে একা বসে আছে আর শূন্য দৃষ্টিতে কোথায় যেন তাকিয়ে আছে। জাহিদ যখন পাশে গিয়ে বসলো, তখনো তার কোনো ভাবান্তর হলো না।
জাহিদ উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইলো কি হয়েছে, কিন্তু লুবনা কোন উত্তর দিলো না। তিন বার জিজ্ঞেস করার পর সে জাহিদের দিকে এমনভাবে তাকালো, যেন ওর ভেতর দিয়ে ওপাশের সব দৃশ্য সে দেখতে পাচ্ছে। সে শান্তভাবে জানিয়ে দিলো – খোদার কাছ থেকে নিদর্শন এসে গেছে, কিন্তু সে নিদর্শন দুর্বোধ্য।
“কি সেই নিদর্শন?” – জাহিদ জানতে চাইলো।
“বিচ্যুতি, বিশ্বজগতের মূল নকশায় বিচ্যুতি।”
“মানে কি?”
“মানে হলো ডিজাইনের ভেতর লুকিয়ে লুকিয়ে থাকা হঠাৎ ভেরিয়েশন।”
এরপর সে যা বললো, তা এতটাই অবাস্তব যে জাহিদ নিশ্চিত হয়ে গেলো লুবনার মাথা খারাপ হতে শুরু করেছে।
৪
লুবনার জন্মদিন ছিল সাতাশে ফেব্রুয়ারি, সেদিন জাহিদ ওকে দিয়েছিলো বিশেষ একটা উপহার – নীলচে কাগজে মোড়ানো একটা কাঠের ভারী একটা আয়না, অনেকদিন আগে জাহিদ ওটা পেয়েছিলো এক রহস্যময় দোকানে। সেই আয়না নিয়েই নাকি যত সমস্যা।
প্রথম দিন আয়নাটার ভেতর লুবনা কোনোই অস্বাভাবিকতা দেখতে পায় নি। কিন্তু যতই সময় যেতে থাকলো, ততই যেন আয়নাটা লুবনাকে সম্মোহিত করে ফেলতে লাগলো, যেন ওর সবকিছুই আবর্তিত হচ্ছে ওই আয়নাটাকেই ঘিরে।
তারপরই ঘটলো সেই ঘটনা। সেদিন ছিল শুক্রবার। ক্লাস থেকে ফিরে লুবনা টেবিলের পাশে নীল ব্যাগপ্যাকটা দাঁড় করিয়ে রেখে বিছানায় বসেছে মাত্র, আর তখনি সেই প্রাচীন আয়নায় ওর চোখ পড়ে গেলো। আর সাথে সাথে সে চমকে উঠলো, কেননা আয়নায় তাকে দেখা যাচ্ছে না।
আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে না পেয়ে লুবনা ভয় পেয়ে গেলো। ঘরের বাকি সবকিছু দেখা যাচ্ছে, শুধু ওর শরীরের জায়গাটাই শূন্য – যেন সে স্বচ্ছ একটা কাঁচ, আর সেজন্যই তার পেছনের সব কিছুই দেখা যাচ্ছে। এমনকি লুবনা যে জামা পড়ে আছে সেটাও দেখা যাচ্ছে, শুধু তার মুখ আরে হাতের জায়গায় কিছু নেই।
লুবনা কিছুক্ষন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আয়নাটার দিকে তাকিয়ে থাকলো তারপর একটা চিৎকার দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ওর রুমমেট জুলিয়া পাশের রুমে বসে বই পড়ছিলো, সে দৌড়ে লুবনার রুমের সামনে এসে দেখে ও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। কিন্তু সে লুবনার ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পেলো না।
“নিজের চেহারা দেখতে পাচ্ছো না মানে?” – পুরো কাহিনী শোনার পর জাহিদ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিল।
“মানে শূন্য। কিন্তু আমি জানি, কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু সেটা সমস্যা না। আসল সমস্যা হলো, জাহিদ – তোমাকে মনে রাখতে হবে – এটা সত্যকে দেখার আয়না। আমাকে এখানে যে দেখা যাচ্ছে না, তার একমাত্র মানে এই যে আমার আসলে অস্তিত্বই নেই। হয়তো পুরো পৃথিবীটাই আস্ত একটা বিভ্রম – আমাদের কারোই কোন অস্তিত্ব নেই, শুধু স্রষ্টারই অস্তিত্ব আছে।”
এরপর যত দিন যেতে লাগলো, লুবনা এই চিন্তাটাতে ডুবে যেতে থাকলো।
সেরকম এক বিকেলেই জাহিদ ওকে নিয়ে পুরোনো আমলের এক কফির দোকানে গেলো। দুজনের জন্য ব্ল্যাক কফি অর্ডার দিয়ে টেবিলে ফিরে এসে সে লুবনার মুখোমুখি বসে বললো – “আচ্ছা, ধরে নিলাম, তুমি কোনোভাবে বিশ্বজগতের ডিজাইনে একটা ত্রুটি বা বিচ্যুতি ধরে ফেলেছো, কিন্তু তাতে এমন কিই বা প্রমান হলো?”
“তাতে প্রমান হলো যে, আমাদের এই বাস্তবতা আসলে একটা ডিজাইন, আর তার একমাত্র অর্থ হলো এর পেছনে কোন ডিজাইনার আছেনই আছেন।”
এসময় একজন ওয়েটার ওদের টেবিলে দু কাপ কফি রেখে গেলো। জাহিদ মেয়েটাকে থ্যাংকস জানিয়ে আবার লুবনার চোখের দিকে তাকালো – “লুবনা, তোমার কি মনে হয়? ডিজাইনার কেন হঠাৎ করে তার ডিজাইনের সমস্যাগুলো তোমাকে দেখতে যাবেন, বলো তো।”
“কারণ আমি তাঁর কাছে শেষরাতে প্রার্থনা করে একটা নিদর্শন দেখতে চেয়েছি।” – সে নির্বিকারভাবে বললো।
জাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফিতে ক্রিম দেয়াতে মন দিলো।
সেদিন কফিশপ থেকে ফেরার পথে লুবনার হাত ধরে জাহিদ কণ্ঠে যতটুক সম্ভব আবেগ ঢেলে দিয়ে বললো – “বিশ্বাস করো, আমার জন্য তোমার এতো কিছু করার কোন প্রয়োজন নেই। আর সত্যি কথা বলতে কি, কোন নাস্তিকই পুরোপুরি নাস্তিক হয় না, নাস্তিকরা মূলত সন্দেহবাদী।” কিন্তু উত্তরে লুবনা কিছুই বললো না।
ততদিনে লুবনার স্বাস্থ্যের ওপরও এই আয়না-বিষয়ক জটিলতার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে – তার ওজন কমে যাচ্ছে , গালের নিচে হাড় বেরিয়ে পড়ছে, বড়ো বড়ো চোখের নিচে কালি পড়তে শুরু করেছে। ওকে জিজ্ঞেস করলে সে শুধু বলে – যে প্রকৃতির ডিজাইনের ত্রুটি দেখে ফেলেছে, সে জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে , ফলে এরপর তার আর বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারার কোনো কারণ নেই।
এর মাঝে আরেকদিন ওয়াটার অফ লিথের পাশ দিয়ে হাটতে হাটতে জাহিদ ওকে বললো – “আচ্ছা, মানলাম, এই বিশ্বপৃথিবী একটা ডিজাইন করে বানানো হয়েছে, এর একজন ডিজাইনারও আছে, এমনকি সেই ডিজাইনার ব্যক্তিগতভাবে তোমার সাথে যোগাযোগ করে তোমাকে একটা বার্তা দেয়ারও চেষ্টা করেছে। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো, মহাবিশ্বের মতো বিশাল আর জটিল জিনিসের যে ডিজাইনার, সে কেন তার ডিজাইনে ত্রুটি রাখতে যাবে?”
“যেন আমার মতো বোকা-সোকা মেয়েগুলো স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসের একটা পথ খুঁজে পায়।” – সে উত্তর দিলো।
“মোজেজাগুলোর ব্যাপারটাও অনেকটা তাই।” – সে যোগ করলো।
লুবনা দাবি করলো ভালো করে সুফী দর্শন পড়া শুরু করার পরই কেবল সে নবীদের মোজেজার রহস্যভেদ করতে পেরেছে।
“তা তোমার মতে মোজেজার কি ব্যাখ্যা?” – জাহিদ গম্ভীর মুখে জানতে চায়।
“পৃথিবী চলে রসায়ন-পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে। বিগ ব্যাং-এর শুরু থেকেই বিশ্বজগত অনুগত বান্দার মতো মেনে চলেছে খোদা-প্রদত্ত এইসব নিয়ম, শুধু মোজেজার ঘটনাগুলো ছাড়া। যে খোদার নির্দেশে প্রকৃতি বিজ্ঞানের সূত্রগুলো মেনে চলে, সেই একই খোদার নির্দেশে ওই সূত্রগুলো সে অমান্য করতে পারে। মোজেজাগুলো হলো সেই রকম দুর্লভ বিচ্যুতির উদাহরণ, যেরকম বিচ্যুতি আমি খুঁজে পেয়েছিলাম সেই আয়নার ভেতরের প্রতিবিম্বে।”
জাহিদ এরমধ্যে বেশ কয়েকবারই তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে যে এসব নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। উল্টো সেবছর শীত আসার ঠিক আগে আগে আগস্টের শেষ দিকে লুবনার মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে যায়।
এক বুধবার সন্ধ্যায় ও হঠাৎ করে ওর রুমমেটকে বলে, তার নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে, সে এখন সেখানে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করবে যেখান থেকে সে একদিন এই অদ্ভুত পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছিল। এরপর থেকে সে খাওয়া-দাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রস্তুতি হিসেবে।
সবাই ওকে অনেক বোঝায়, জাহিদ ওকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায়, কিন্তু কোন কিছুতেই কোন কাজ হয় না। শেষপর্যন্ত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে সেলাইন দেয়া হয়। এর কয়েকদিন পর জাহিদ জানতে পারে, লুবনাকে সাইকিয়াট্রি বিভাগে ট্রান্সফার করা হয়েছে – কতদিন ওকে ওখানে রাখতে হবে কেউ জানে না।
ওর হাসপাতালে যাওয়ার দিনটা জাহিদের আরেকটা কারণে মনে ছিল, সেদিন এডিনবার্গ শহরে সারাদিন বৃষ্টি ছিল, যে কারণে ওকে পৌঁছে দিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরতে ওদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
৫
লুবনাকে ধরে-বেঁধে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরদিনের কথা। সারারাত নির্ঘুম কাটানোর পর জাহিদ তার রুমে বসে ভাবছিলো লুবনার একটা শেষ ইচ্ছের কথা। ও যখন সুস্থ ছিল, সেসময়কার একদিন জাহিদকে লুবনা অনুরোধ করেছিলো একবারের জন্য হলেও ঈশ্বরকে সত্য ধরে নিয়ে তার কাছে সঠিক পথের জন্য প্রার্থনা করতে। মেয়েটার ধারণা ছিল, কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করলেই ঈশ্বর মানুষের কাছে ইঙ্গিত পাঠান ব্যক্তিগত ভাবে, অর্থাৎ এমনকি জাহিদের মতো সন্দেহবাদীকেও তার ইশারা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জাহিদ শেষপর্যন্ত লুবনার সে অনুরোধ রাখে নি। লুবনাকে সে ভালোবাসতো, কিন্তু তার মানে এই না যে সে কারণে তাকে অর্থহীন কোন কাজ করে বসতে হবে। অবশ্য সেদিন জানলার বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে জাহিদের মন এত নরম হলো যে, সে সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েটার শেষ ইচ্ছেটা সে পূরণ করবে।
সে রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ডেস্কে এসে বসলো, দুহাত কোলের ওপর রেখে চোখ বন্ধ করলো, তারপর মনে মনে বললো – “খোদা, তুমি যদি থাকো, তাহলে আমাকে একটা নিদর্শন দেখাও।” আনুষ্ঠানিকতা সেরে ওর মনটা একটু ভালো হলো, লুবনার শেষ ইচ্ছে তো পূরণ হলো শেষ পর্যন্ত। সে তখন উঠে গিয়ে রুমের দরজা আবার খুলে দিলো, তারপর একসময় ভুলে গেলো তার এই ক্ষণিক প্রার্থনার কথা।
পরদিন বিকেলে ডর্মে ফিরে রুমে ঢুকতে গিয়ে দরজার সামনে একটা জিনিস দেখে জাহিদ সামান্য একটা হোঁচট খেলো – তার দরজার সামনে কে যেন একটা বক্স রেখে গেছে।
জাহিদ রুমের তালা খুললো, তারপর বাক্সটা নিয়ে রুমে ঢুকলো। কি মনে করে দরজা লাগিয়ে প্যাকেটটা নিয়ে ওর ডেস্কে এসে বসলো। কাঁপা হাতে মোড়কটা খুলে দেখলো – ভেতরে একটা আয়না, খয়েরি রঙের ফ্রেমে বাঁধানো পুরাতন স্টাইলের একটা আয়না। কেন যেন তার মনে পড়ে গেলো গতকাল খোদার কাছে করা তার প্রার্থনার কথা।
বাক্সটার ভেতর ছোট্ট একটা চিরকুটও পাওয়া গেলো – “আমি লুবনার রুমমেট জুলিয়া। ওর সাথে হসপিটালে আজ আমার দেখা হয়েছে। আমার কাছে ওর একটা আয়না ছিল, তুমিই নাকি দিয়েছিলে ওকে ওর গত জন্মদিনে। সে অনুরোধ করেছে, যেন এই জিনিসটা তোমার কাছে ফিরিয়ে দিই।”
যদিও সে নিশ্চিত ছিলো এটা একটা কাকতালীয় ঘটনা, তবুও তার মাথার ভেতর চিন্তার ঝড় বয়ে যেতে শুরু করলো, নানা প্রশ্ন উঁকি-ঝুঁকি দিতে লাগলো মনের নিরাপদ আড়াল থেকে। আসলেও কি আয়নাটাতে সমস্যা আছে? এই তো সেই আয়না, বহুদিন আগে ওদের সিদ্ধেশ্বরী বাসার এক সন্ধ্যায় যেটা জাহিদের সাথে জাহিদেরই কণ্ঠে কথা বলে উঠেছিল, আর জাহিদ ভেবেছিলো সেটা কেবলি তার মনের ভুল। এবারো কি তেমন কিছু হবে?
লুবনার মতো সেও কি এই আয়নার ভেতরে তাকাতে গিয়ে দেখবে, সেখানে ওর চেহারা দেখা যাচ্ছে না, আর এভাবে এই সৃষ্টিজগতের আরেকটা ত্রুটি জাহিদের সামনেও উন্মোচিত হয়ে যাবে? উন্মোচিত হবে যে, ত্রুটিই প্রমান করে একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব, যিনি ত্রুটি উন্মোচন করে করে ইঙ্গিত দেন তার সৃষ্টিদের?
নানান সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে ভাবতে জাহিদ বাক্স থেকে আয়নাটা বের করলো, কিন্তু ওটার দিকে তাকাতে গিয়েও আবার কি মনে করে সেটা সে বক্সে ফিরিয়ে রেখে দিলো। ওর চোয়াল হঠাৎ করেই শক্ত হয়ে গেছে, কিছুক্ষন রক্তলাল চোখে বক্সটার দিকে তাকিয়েও রইলো সে। যে সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে, সেটা খতিয়ে দেখতে কি জাহিদ আসলেও প্রস্তুত? যদি – কোন অদ্ভুত কারণে – আয়নাটার দিকে তাকিয়ে সে দেখে ভেতরে তার চেহারা নেই? সে কি তখন লুবনার মতোই উন্মাদ হয়ে যাবে, আর অসুস্থ হয়ে মারা পড়বে অকালে? শেষ কথা হলো, জাহিদের যে নিজেকে এই পরীক্ষায় ফেলতেই হবে, এমন তো কোন কথা নেই, তাই না?
সেদিন জাহিদ সন্ধ্যার পর পর হঠাৎ করেই ডানহাতে তার হ্যান্ডব্যাগ আর বাঁ-হাতে আয়নার আধ-খোলা বক্সটা নিয়ে তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। সে বাস ধরে সোজা লুবনাকে বিল্ডিঙে গিয়ে রিসেপশনে প্যাকেটটা দিয়ে বললো ওটা যেন জুলিয়াকে ফিরিয়ে দেয়া হয়, তারপর সেন্ট জন স্ট্রিট ধরে উদ্দেশ্যহীন হাটতে শুরু করলো।
