অস্তিত্ববাদী জাহিদের পরাবাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো: পর্ব ৪
১
ঘুমাতে যেতে ভয় লাগে জাহিদের।
রাত এগারোটা বাজলে তার মনে হয়, মাত্র সন্ধ্যা হলো, এখনো অনেক কাজ বাকি। সাড়ে এগারোটার দিকে সে তার যাবতীয় কাজকর্ম শুরু করে – গতমাসের বিলের হিসাব মেলানো, বাড়িভাড়ার রশিদ গোছানো, ফেলে রাখা বাকি কাজ অফিসের, ইত্যাদি। ইউটিউব আর ফেসবুক তো আছেই।
এই করতে করতে রাত আড়াইটা বেজে যায় কখন, সে জানে না। এরপর একরকম অপরাধবোধ আর অনুশোচনা থেকেই বিছানায় যাওয়া, এরপর আরো আধা-ঘন্টার মতো আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা ঘুমের জন্য – সেই ঘুম, যা জাহিদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে প্রতিদিন অন্তত একবার করে।
দিনের পর দিন যেতে যেতে তার সমস্যা এমন গেড়ে বসেছে যে দিনে সে দুই থেকে তিন ঘন্টার বেশি ঘুমাতে পারে না। যাও বা ঘুমায়, পুরো নিদ্রা জুড়ে থাকে দুঃস্বপ্ন – পরীক্ষার দিন সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার ঠিক আগে এডমিট কার্ড আর আইডি খুঁজে না পাওয়ার স্বপ্ন, হাফপ্যান্ট পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে যাবার স্বপ্ন, ইত্যাদি। একবার শেষরাতে আধা-ঘুমে সে দেখলো সে কবরস্থানে বসে সে হাজির বিরিয়ানি খাচ্ছে আর খোলা একটা কবর থেকে মা তাকে বলছে আরেকটু বিরিয়ানী নিতে।
জুলাইয়ের সেই সোমবার রাত থেকেই জাহিদের এই ছোট্ট সমস্যাটার শুরু। কিন্তু তার এই গল্পটা কেউ বিশ্বাস করবে কিনা, সে জানে না।
ভুতের গল্প মানুষ বিশ্বাস করে, কারণ অনেকেই বিশ্বাস করে যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের পাশাপাশি আছে একটা অতীন্দ্রিয় জগৎ – ফেরেশতা, শয়তান, জীন, আর আত্মা যে জগতের বাসিন্দা; পাপ-পুণ্যের বিচার হয় যে জগতে; ভাববাদী দার্শনিকেরা জীবনের অর্থ খুঁজে পান যে পৃথিবীতে। এদের কথা হলো, এই দুইটি জগৎ একে অন্যকে কোনোদিনই অতিক্রম করবে না, ফলে বিজ্ঞানীরা কোনোদিনই আত্মা জাতীয় জিনিসের অস্তিত্ব প্রমান করতে পারবে না। সব মিলিয়ে তারা জানে না, তাদের ঈশ্বরের কোন করুণাটিকে তারা অস্বীকার করবে।
সুতরাং এই গল্পটা বিশ্বাস করানো ওর জন্য সহজ হতো, যদি জীন-পরী জাতীয় কোন শরীয়তসম্মত ব্যাখ্যা সে সবাইকে জানাতে পারতো। কিন্তু সম্ভবত বিষয়টা এর চেয়েও গভীর, এমনকি এও হতে পারে যে এই ঘটনাটা প্রমান করে দৃশ্যমান আর অদৃশ্য জগতের বাইরে তৃতীয় একটা পৃথিবীর অস্তিত্ব, যেখান থেকে নির্ধারিত হয় এই দুই জগতের ভাগ্য, আর নির্ধারিত হয় মানুষের অস্তিত্বের থাকা কিংবা না থাকা।
ঘুমাতে যেতে আসলেও ভয় লাগে জাহিদের ইদানিং। তার শুধু মনে হয়, ঘুমিয়ে পড়লে আর সেই ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারবে না।
অনেকেই তো ঘুমের মধ্যে মারা যায়। যায় না? লুবনাই তো এভাবে মরলো। আরো মর্মান্তিক বিষয় হলো, ওকে সিডাক্টিভ দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল। অর্থাৎ ওই ঘুমে তার কোন সম্মতিই ছিল না। বেচারি যে ঘুমটার ভেতর মারা গেল, সেটাও তার ইচ্ছাকৃত কিংবা ক্লান্তিজনিত কোন ঘুম না। আফসোস !
ইশ, কি হতো, যদি ঐদিন ওই ঘুমের ইনজেকশন তাকে না দেয়া হতো? হয়তো সে বেঁচে যেত। বেচারির শরীর এমনভাবে কাজ করতো যে, ঘুমের মধ্যে তার মৃত্যু হতো না।
ঘুমাতে যেতে ভয় লাগে জাহিদের, এমনকি ঘুমন্ত কাউকে দেখলেও ভয় পায় সে।
জাহিদের সেই সরল স্বীকারোক্তি শুনে কামরুল হেসে ফেললেন। বললেন – “এটা অনেকেরই হয়, আমার নিজেরও হয় মাঝে মাঝে। এ আর এমন কি?”
“ঘুমাতে যেতে ভয় লাগে কেন মানুষের?”
“লাগবে না কেন, তুমিই বল। তুমি তো নিজেকে বুদ্ধিমান বলে মনে করো। তাহলে তুমি কেন এটা বলতে পারছোনা। মূল কথা হল, ঘুম হলো ছোটোখাটো একটা মৃত্যু। ঘুমের মধ্যে আমাদের চেতনার কি হয়, আমরা জানি না। যে মানুষ ছাদে পৌঁছে গিয়ে এখন মঙ্গল গ্রহে যাবার পায়তারা করছে, যে মানুষ আজকাল অনু-পরমাণুকে পর্যন্ত দূষিত করে ফেলছে, সে মানুষ কিনা চেতনার প্রশ্নে পুরোই অজ্ঞ। সব মিলিয়ে ঘুমকে ভয় করা অযৌক্তিক কিছু না, বরং বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ। তুমি কবে থেকে ঘুমাতে পারছো না?”
জাহিদ উত্তর দিলো না। আসলে দিতে পারলো না। বলবে কি করে? সেই কথা বললে কেউ কি তাকে বিশ্বাস করবে?
“কবে থেকে ঘুমাতে পারো না?” – রকিব আবার জিজ্ঞেস করলেন।
উত্তরে এবারো চুপ রইলো জাহিদ। এই কথাটা না হয় গোপনই থাকুক। সব কথাই যে সবাইকে বলে বেড়াতে হবে, এমন তো না।
“কামরুল ভাই, আমি মরতে চাই না।” – হঠাৎ ব্যাকুলভাবে বলে উঠলো জাহিদ, যেন আচমকা তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে – “আমার কেন যেন মনে হয়, আমি মারা যাবো ঘুমের মধ্যে। আমি জানি, এটা আগে থেকে বলার বিজ্ঞানসম্মত কোন পদ্ধতি নেই, কিন্তু বহু মানুষ তো ঘুমের মধ্যে মারা যায়, তাই না?”
কামরুল হাসলেন, স্নেহের হাসি – “মারা যাওয়া তোমার কাছে এত ভয়ের কারণ কি?”
“মরলে তো সবকিছুর শেষ। আপনি চিন্তা করতে পারেন, হঠাৎ একদিন আপনার অস্তিত্ব নাই হয়ে গেলো?”
কামরুল আবার হাসলেন, তাকে খুব একটা বিস্মিত মনে হলো না।
“অস্তিত্ব থাকলেই না সেটা বিলীন হবে?” – নির্জীব কণ্ঠে বললেন তিনি – “এই যে আমরা খামোখাই শুধু ‘আমি’, ‘আমি’ বলি, ‘ফার্স্ট পার্সন এক্সপেরিয়েন্স’-এর কথা বলি, বিজ্ঞান প্রমান করেছে যে এগুলি সবই ডিলুশন।”
“আমার কোন অস্তিত্ব নেই? আমিত্বের ধারণা ডিলুশন?”
“অবশ্যই ডিলুশন। আচ্ছা তুমি কি তোমার দুই বছর বয়সের স্মৃতি মনে করতে পারো? পারো না। কেন পারো না? কারণ, তখন পর্যন্ত তোমার ডিলুশনটা পুরো তৈরী হয় নি। হতে পারে, সমস্যাটা আসলে তৈরী করেছে তোমার মা-বাবা। জন্মের পর থেকে তোমাকে এত অসংখ্যবার তারা আনিস নামে ডেকেছে যে তোমার মনে একটা ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছে যে তুমিই সেই আনিস। আসলে আনিস বলে কেউ নেই। পুরোটাই মনোবৈকল্য।”
খুব একটা দ্বিমত করতে পারলো না জাহিদ রকিবুলের দুর্দান্ত যুক্তির সাথে। কাপের চা পুরো শেষ না করেই হালকা মাথা ব্যথা নিয়ে বেরিয়ে এলো ক্যান্টিন থেকে।
রিক্সায় উঠে তার মনে পড়লো, কামরুল ভাই জানতে চেয়েছিলেন ঠিক কবে থেকে তার সমস্যার শুরু, কিন্তু তাকে সেটার উত্তর বলা হয়নি। অবশ্য বলবেই বা কি করে, এটা কি কোন বিশ্বাসযোগ্য কথা যা মানুষকে বলা যায়?
২
জীবনে প্রথম এতটা ভয় পেল জাহিদ।
বাথরুমে দাঁড়িয়ে ছিল সে, দাঁত ব্রাশ করবে। ব্রাশ খুঁজে পেলো সে সহজেই, এমনকি ড্রয়ারের ভেতর দলিত-মথিত টুথপেস্টের প্যাকেটও পেলো একটা, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সে খুঁজে বের করতে পারলো না আয়নাতে তার নিজের প্রতিবিম্ব। বাথরুমের সমস্ত কিছু আয়নাতে প্রতিফলিত হচ্ছে, শুধু তার ছায়াটা ছাড়া।
মেঝেতেও খুঁজে দেখলো সে। ষাট পাওয়ারের বাল্বটা আড়াল করে দাঁড়িয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখলো। না, নেই, কোথাও তার ছায়াটা নেই।
মারা যাওয়ার আগের রাত্রে লুবনাও এই একই কথা বলেছিলো। সে তার কেবিনের নার্স মহিলাকে ডেকে বলেছিলো, সে তার ছায়া খুঁজে পাচ্ছে না। নার্স, ডাক্তার, কেউ সেদিন লুবনাকে বিশ্বাস করে নি। বরং তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। আর সেই ঘুম থেকে সে আর জেগে উঠতে পারে নি। যে লুবনা ছিল আস্ত একটা মানুষ, কয়েক ঘন্টার মধ্যে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।
জাহিদও তার ছায়া দেখতে পাচ্ছে না। জুলাইয়ের ওই সোমবার রাত্র থেকে সে তার ছায়াটাকে খুঁজে পাচ্ছে না। কেউ এটা বিশ্বাস করবে না, যেমন বিশ্বাস করে নি লুবনাকে – কিন্তু এর অর্থ তারও মৃত্যু হবে, তারও অস্তিত্ব বিলীন হবে – ঠিক লুবনার মতো, কোন একদিন ঘুমের মধ্যে।
এজন্যইতো জাহিদ ঘুমাতে যেতে ভয় পায়, এমনকি ঘুমন্ত কাউকে দেখলেও ভয় পায়। আর এই আতঙ্কের শুরু তার ছায়া হারিয়ে যাওয়ার দিন থেকে। কিন্তু এটা কি কাউকে বলার মতো কোন কথা? অবশ্যই না, এই কথা কাউকে বললে কেউই বিশ্বাস করবে না।
জীন-পরীর কাহিনী মানুষকে বিশ্বাস করানো সহজ, কারণ ধর্মীয় উপকথায় সেগুলি আছে – কিন্তু সুস্থ মস্তিষ্কের কে বিশ্বাস করবে যে তার ছায়া হারিয়ে গেছে? ছায়া কি মোবাইল, নাকি চশমা যে সাময়িক কিংবা স্থায়ীভাবে হারিয়ে যাবে? এই জিনিস কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হিন্দি সিরিয়ালে আক্রান্ত নিরীহ কোন গৃহিণীর দলকেও তো বিশ্বাস করানো যাবে না, কামরুল ভাইকে বিশ্বাস করানো তো দূরের কথা।
হতে পারে, এটা তার একধরণের মনোবিকার, কিন্তু এটা এমন একটা বিকার, যাকে মানসিক বিকৃতি বলেও কেউ মর্যাদা দেবে না। এরকম ভীষণ ঝামেলাতে জীবনে কখনো পড়ে নি জাহিদ।
বেশ কয়েকদিন অস্তিত্ব সংক্রান্ত নিজের দারিদ্র্য নিয়ে ভোগার পর জাহিদের হঠাৎ মনে পড়লো মহিউদ্দিন এলাহীর কথা। সে একজন বিশ্বাসী ধার্মিক লোক, কিন্তু রাতের পর রাত ঘুমাতে না পেরে জাহিদের পরিস্থিতি এতোই খারাপ হলো যে, অস্তিত্ববিষয়ক এই মহাসংকট থেকে সাময়িক মুক্তির আশায় তার কাছে যেতেও জাহিদের আপত্তি ছিল না। এমন তো অনেক সময় হয়ই, মিথ্যা বিশ্বাস মানুষকে প্লাসিবো ওষুধের মতো স্বস্তি দিতে পারে।
নাস্তিকতার চেতনাকে ধর্মের চেতনানাশক দিয়ে অবশ করার নিয়তে এক দুপুরে জাহিদ সত্যি সত্যিই চলে গেলো মহিউদ্দিন ভাইয়ের সেগুনবাগিচার ডেরায়। আলমগীর মহিউদ্দিন একসময় ছাত্র রাজনীতি করতেন, এখন সব ছেড়ে-ছুড়ে মসজিদে যাতায়াত শুরু করেছেন। গুজব আছে, তিনি কোন এক ফাঁকে তিন চিল্লা দিয়ে এসেছেন। তিনি যে বিয়ে করেছেন, সেটাও তার দলের আমির সাহেবের মেজো মেয়েকে – যেই মেয়ে জন্মের পর থেকে ভালো করে সূর্যের আলো দেখেনি, পুরোটা সময় কাটিয়েছে কঠোর পর্দার আড়ালে।
মহিউদ্দিন ভাই বাসাতেই ছিলেন। জাহিদকে দেখে সুন্নতি হাসি দিয়ে ঘরে অভ্যর্থনা করলেন, দস্তরখান বিছিয়ে মাটিতে বসিয়ে পূর্ণ এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেতে দিলেন।
জাহিদ ক্লান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো – ধর্মের বিশ্বাসের ভেতর মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে কি ব্যাখ্যা আছে।
“জিনে আসর করা কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকের শরীরে যেমন জীন লুকিয়ে থাকে, জীবন্ত মানুষের শরীরের ভেতর কি তেমনি ভাবে কোন আত্মা লুকিয়ে থাকে, মহিউদ্দিন ভাই? আপনার কি মনে হয়? জিনে আক্রান্ত মানুষকে যেমন জিন-গ্রস্ত বলে, জীবিত মানুষকে কি সেরকম আত্মা-গ্রস্ত বলা যাবে? মা মারা গেলো, তারপর আমার এক ছাত্রী ছিল লুবনা সেও মারা গেলো, তাদের আত্মাগুলি কি তাহলে জীন-পরীর দেশে গিয়ে তাদের সাথে মিলে গেছে? ইসলাম এ সম্পর্কে কি বলে?”
জাহিদ হয়তো ভেবেছিলো, তার এই কথা শুনে মহিউদ্দিন ভাই জেহাদের জোশে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াবেন দস্তরখান ছেড়ে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তিনি স্থির থাকলেন, চোখ বন্ধ করে কি যেন ভাবতে লাগলেন। এমনকি একসময় জাহিদের মনে হালকা আশংকা হলো, তিনি ঝিম মেরে থাকতে থাকতে নিজেই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বেন শেষ বিকেলের এই কমলা রঙের আলো-আধারিতে।
বেশ কিছুক্ষন পর তিনি চোখ খুলে তাকালেন জাহিদের চোখে, যেন মোরাকাবা থেকে এইমাত্র জেগে উঠেছেন, অদৃশ্যের জগৎ থেকে ইলহাম নিয়ে হাজির হয়েছেন আমার ভুলে যাওয়ার মতো সামান্য অস্তিত্বের সামনে। অপার্থিব কণ্ঠে বললেন – “কে বলেছে তোমার আত্মা আছে? কে বলেছে তুমি জীবিত? তোমার তো আসলে কোন অস্তিত্বই নেই। একমাত্র স্রষ্টাই বাস্তব, আর সৃষ্টি মাত্রই অবাস্তব। তোমার একটা অস্তিত্ব আছে, কিন্তু সেটা অবাস্তব ধরণের অস্তিত্ব।”
“আমার অস্তিত্বের কোন মূল্য নেই? পুরোটাই বিরাট বড় একটা শূন্য?”
“শূন্যও একটা সংখ্যা, তারও মূল্য আছে। শূন্য ছাড়া কি অশূন্যকে প্রকাশ করা যায়, বলো?”
সেদিন ভীষণ মাথাব্যথা নিয়ে ফিরে এলো জাহিদ বাসায়। সেরাতে সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলো সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে।
৩
কারো ছায়া যদি তাকে ছেড়ে চলে যায়, তাহলে তার প্রাত্যহিক জীবনে ছোটোখাটো কিছু সমস্যা দেখা দেয়া শুরু করে। জাহিদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলোনা। যেমন আয়নাতে সে নিজের চেহারা দেখতে পেতো না বলে দাড়ি শেভ করা তার জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। এমনকি শেষপর্যন্ত চুল আঁচড়ানোর মতো সামান্য কাজগুলোর জন্যও তাকে মোবাইলের ক্যামেরা ব্যবহার শুরু করতে হলো।
তাছাড়া আয়নাতে নিজের জায়গাটা শূন্য দেখা গেলে নিজের চিন্তার সুস্থতা নিয়ে যে সন্দেহ দেখা দেয়, সেটা তো আছেই। আপনি যদি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে না পারেন, তাহলে কিসের ওপর ভিত্তি করে আপনার বাস্তবতাকে পরিমাপ করবেন, তাই না?
স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা অবশ্য বাদ দিলো না জাহিদ। ছায়া তার হারিয়ে যেতে পারে, কিন্তু তাতে তো তার বিশেষ কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হচ্ছে না। ছায়া আমাদের কি কাজে লাগে, সেটাও একটা গবেষণার বিষয় বটে।
কিন্তু বিধি ছিল বাম। সে একসময় লক্ষ্য করলো, তার শরীরে একধরণের পরিবর্তন আসছে। যেমন, দিনকে দিন তার স্পর্শের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে আসছে। মশা বসে কামড়াচ্ছে তার হাত সমানে, সে টের পাচ্ছে না। ঠান্ডা পানিতে গোসল করার সময় মনে হচ্ছে, গা গরমে জ্বলে যাচ্ছে।
স্পর্শের সাথে স্বাদেরও হয়তো কোন সম্পর্ক আছে। শুক্রবার সকালে আনারকলি মার্কেটের নিচতলা থেকে পারাটা আর ডিমভাজি নিয়ে এলো, সাথে সুজি। পারাটা মুখে দিয়ে মনে হলো নিউজপ্রিন্টের কাগজ চিবাচ্ছে। ডিমভাজিকে মনে হলো রুলটানা সাদা কাগজ যা দামি খাতা থেকে এইমাত্র ছিড়ে আনা হয়েছে। সুজিরও কোন স্বাদ পাওয়া গেলো না। অকস্মাৎ আতঙ্ক ঘিরে ধরলো জাহিদকে, তাহলে কি খাওয়াটাও বন্ধ হয়ে গেল !
আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন এই জীবন অবশ্য জাহিদকে বেশিদিন বয়ে বেড়াতে হলো না। আগস্ট মাসের আঠারো তারিখে একটা রোড একসিডেন্টে জাহিদের মৃত্যু হয়।
৪
সে রাতে থার্টি ওয়ান এভেন্যুর সিগনালটা যখন ছাড়লো, তখনো ট্রাফিক সিগন্যালগুলোর ওপর জাহিদের বিন্দুমাত্র কমে নি, ফলে নিজমনেই সে গজ গজ করছিলো – “জীবনের অর্থ যদি যে যার মতো করে বের করে নিতে পারে, তাহলে সামান্য ট্রাফিক লাইটের অর্থ কেন আমি নিজের মতো বের করে নিতে পারবো না? জীবনের অর্থই যদি একেকজনের জন্য একেকরকম হয়, তাহলে লাল লাইটের অর্থ কেন একেকজনের জন্য একেক রকম হবে না – বিশেষ করে যখন অন্যদিকে থেকে এত রাতে কোন গাড়ি আসার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না?”
থার্টি ফোর এভেন্যুর কাছাকাছি সে যখন চলে এসেছে, জাহিদ দূর থেকেই আবার দেখে সিগনালে হলুদ লাইট জ্বলে উঠছে। তার মানে এই বারও তাকে থামতে হবে – চতুর্থবারের মতো, পর পর চারবার এরকম হলো আজ, আশ্চর্য তো! এবার ওর সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো মুহূতের ভেতর।
তার মাথার ভেতর কেউ চিৎকার করে উঠলো – “সবুজ লাইটের অর্থে যে গাড়ি চালানো আর লাল লাইটের অর্থ যে গাড়ি থামানো, সেটা তো মানুষের আরোপ করা অর্থ। আসলে তো লাল কিংবা সবুজের মূলত কোন অর্থ নেই। সুতরাং এগুলো কে অমোঘ নিয়তির ভেবে মেনে নেয়ারও কোন কারণ থাকতে পারে না।”
এসব ভাবতে গিয়ে যে কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে, গাড়ি ততক্ষনে চলে এসেছে ইন্টারসেকশনের মাঝামাঝি। আর যেহেতু গতির কারণে তার ডানপাশটা সে পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছিলো না, আর যেহেতু মানুষের সীমিত চিন্তাশক্তির পক্ষে সব সম্ভাবনা যাচাই করে দেখা ঐতিহাসিকভাবেই অসম্ভব, সেকেন্ডের ব্যবধানে ওপাশ থেকে লাল একটা ফোর্ড তার গাড়িতে আছড়ে পড়লো – ঠিক তার দিকের দরজায়, ঠিক তার গায়ের ওপর।
এরপর থেকেই সব অন্ধকার।
৫
মারা যাওয়ার পর জাহিদের মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই, কোথাও কোন একটা ভুল হচ্ছে।
সারাজীবন জাহিদ বিশ্বাস করে এসেছে, মৃত্যুতে সবকিছুর শেষ। তার এই বিশ্বাসের পেছনে শক্ত যুক্তিও ছিল – কবরে ফেলে দেয়ার পর মানুষের লাশ পচে-গলে যায় কয়েক মাসের ভেতর।
অনেক দ্বৈতবাদী অবশ্য স্বতন্ত্র একটা অপার্থিব জগতের কথা বলে থাকে, যে জগতে আত্মা, ফেরেশতা, শয়তান, মৌলিক সৃষ্টি তথ্য, আর কার্য-কারণের বাস। কিন্তু সেগুলোতেও ডক্টর জাহিদের বিশ্বাস করার কোন কারণ ছিল, মূলত সেই পৃথিবীর কোন প্রমান নেই বলে। আর কে না জানে, প্রমান ছাড়া কোন কিছুতে বিশ্বাস করলে হাজারো কুসংস্কারকেই আসলে মনের ভেতর জায়গা দেয়া হয়।
সুতরাং মারা যাওয়ার পর যখন সে তার মনে হলো সে তার শরীরের বাইরে দাঁড়িয়ে তার নিজের শরীরটাকে দেখছে, ভীষণরকম অপ্রস্তুত হয়ে গেল সে। তাহলে কি সে মারা যায় নি? স্বপ্ন জাতীয় কিছু দেখছে? কিন্তু অন্য সব স্বপ্ন থেকে এটাকে এত অন্যরকম মনে হচ্ছে কেন?
দিন তিনেক পর কবরে দাফন করা পর্যন্ত সে লোকজনের কথা-বার্তাও অস্পষ্টভাবে শুনতে পেলো। তার তখন মনে হচ্ছিলো, সে দীর্ঘ একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে।
তাকে মাটি চাপা দিয়ে সবাই চলে যাওয়ার পরই সে প্রথম দেখতে পেলো সেই জীব দুটোকে। ওদের শরীর বিশাল, মুখ রক্ত বর্ণ, চোখ আগুনের কুন্ডলি, নাক দিয়ে ক্রমাগত ধোঁয়া বের হচ্ছে, সারা শরীরে ক্যাকটাসের কাটা। ছোটবেলায় ঠাকুমার ঝুলির গল্পে পড়া রাক্ষসের কথা মনে পড়ে গেল জহিরের। ওরা যেন তার জন্যই ওঁৎ পেতে বসে ছিল আর এখন সামনে উদয় হয়েছে জ্যান্ত তার চামড়া ছিড়ে মাংস কামড়ানো শুরু করবে বলে।
প্রাণীগুলো তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো, তারপর ওদের মধ্যে ডানদিকের জন কথা বলে উঠল – ওর একেকটা শব্দ যেন একটা করে বজ্রপাত, প্রতিটা ধ্বনি কান ফাটিয়ে দেয়, প্রতিটা চাহনি যেন চোখ ধাঁধিয়ে দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয়। সে আর্তনাদ করে জাহিদকে জানিয়ে দিলো সেই অনাগত শাস্তির সংবাদ। বললো – জাহিদের জন্য অপেক্ষা করছে এমন এক নিঃসঙ্গতা যাকে শুধু আগুনের সাথেই তুলনা করা চলে, সেও আবার এমন আগুন যা এক হাজার বছর জ্বলার পর লাল বর্ণ ধারণ করেছে তারপর আরো এক হাজার বছর জ্বালার পর হয়ে গেছে অন্ধকারের মতো কালো। এটাই সৃষ্টিজগতের মধ্যে সবচাইতে তীব্র একাকিত্ব, কারণ এটা স্রষ্টাকে হাতের কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলার অনুতাপে পূর্ন।
জাহিদ ততক্ষনে নিজের ভাগ্য মেনে নিয়েছে, মেনে নিয়েছে যে তার মৃত্যু হয়েছে, মেনে নিয়েছে তার শেষ ঠিকানা নরকই। দেরিতে হলেও সে তখন বুঝতে পেরেছে – ঈশ্বর বলে সত্যিই একজন আছেন, আর ইহকালের মতো পরকালও তারই সৃষ্টি।
পচে যাওয়া লাশের মতো কুৎসিত জীবগুলোর সাথে পরিচয়ের এ পর্যায়ে জাহিদ হাসতে শুরু করলো। প্রথমে মৃদু হাসি হলেও একপর্যায়ে দ্রুতই সে হাসি বাড়তে বাড়তে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো। হাসতে হাসতে শেষে যখন তার চোখ বেয়ে নেমে এসেছে কলমের কালির মতো গাঢ় কালো দু’ফোটা অশ্রু, তখনি কেবল সে থামলো।
ভয়ঙ্কর জীব দুটোর মধ্যে বাঁ দিকের জন একসময় ওর কাছে জানতে চাইলো এই অদ্ভুত হাসির কারণ। কিন্তু জাহিদ সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলো, ধন্যবাদ দিলো এই কারণে যে মৃত্যুর মধ্যেই তার অস্তিত্বের শেষ হয়ে যায় নি, ধন্যবাদ দিলো এই জন্যও যে সে এখন জানতে পেরেছে যে তার লুবনাও কোথাও না কোথাও তার মতো করেই বেঁচে আছে মৃত্যুর দরজার এপাশে এসে। জাহিদের সেই কৃতজ্ঞ উচ্চারণ কবরের এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগলো।
প্রাণী দুটো তখন নিশ্চুপ তার দিকে তাকিয়ে থাকে, হয়তো তাদের স্বর্গীয় জীবনে প্রথমবারের মতো অবাকও হয় এরা। কিন্তু ঈশ্বরের প্রতি জাহিদের এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তার হৃদয়ের গভীর থেকেই ছিল, আর সেটা এজন্য যে দয়াময় খোদা মৃত্যুর মাধ্যমে তার এবং তার একমাত্র সত্যিকার প্রেম লুবনার অস্তিত্বকে ধ্বংস করে দেন নি। লুবনা এবং সে নিজে যে কবরস্থ হওয়ার পরও কোনভাবে টিকে আছে – সেটা আত্মা হিসেবেই হোক, আর বরযখের জীবনের নতুন শরীর ধারণ করেই হোক – এই উপলদ্ধির পর তার কাছে নরকও তাই এক অর্থে স্রষ্টার করুনা বলেই মনে হলো।
ছায়াহীনতার এক নতুন পৃথিবীতে নতুন করে সে লুবনাকে খুঁজে পাওয়ার আশা করতে লাগলো, ফলে দৈব শাস্তির আসন্ন দিনগুলোকেও তার কাছে ভীষণ অর্থপূর্ণ লাগতে শুরু করলো।
প্রিয় মুখগুলো যে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে চিরতরে হারিয়ে যায় না, সেটা জানতে পারা একজন মানুষের জন্য কতটা স্বস্তির, সেটা যদি এই দেবদূতরা বুঝতো !
