অস্তিত্ববাদী জাহিদের পরাবাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো : পর্ব ৫
১
সম্ভবত মৃত্যু আর তৎপরবর্তী কবর ধরণের অভিজ্ঞতার পর পর যখন তার চেতনা ফিরে এলো তার কাছে, জাহিদ চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করলো একটা চৌরাস্তার মোড়ে।
আকাশে ঘোলাটে একটা আলো, তাই বোঝা যাচ্ছে না এটা কি ভোর নাকি সন্ধ্যা, আর কোন একটা কারণে সবকিছু সে সাদা-কালো দেখছে – সবকিছু সাদা-কালো। তবে তারপরও সে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারলো, এটা ঢাকা শহরেরই কোন রাস্তা হবে।
জাহিদ ততক্ষনে ধরে নিয়েছে, তার মৃত্যু ঘটেছে আর এটা তার মৃত্যু পরবর্তী জীবন। চেতনার জগতের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতার পর সে প্রথমে স্বস্তি পেয়েছিলো এজন্য যে, মৃত্যুর মাধ্যমে তার অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায় নি। মৃত্যুর পরও যে আত্মাগুলো টিকে থাকে, সেটাই ছিল নাস্তিক অবিশ্বাসপন্থী জাহিদের জন্য একটা বিশেষ সংবাদ – যদিও সে সংবাদকে দুই ভয়াবহ অশরীরী দ্রুতই দু:সংবাদে পরিণত করেছিল, তাকে জানিয়ে দিয়েছিলো তার চিরস্থায়ী বাসস্থান হবে নরক।
নরকের সেই কীট দুটোকে আশে-পাশে কোথাও দেখতে না পেরে জাহিদ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। সে যে কোনোভাবে মুক্তি পেয়েছে মাটির নিচের লাশের মতো ওই ঘরের অন্ধকার থেকে, এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড়ো খবর ওর জন্য।
নরক সম্পর্কে জাহিদ তার মাদ্রাসার দিনগুলোতে যা যা শিখেছিল, তার কোন কিছুই আশে-পাশে দেখতে না পেরে সে স্বস্তির একটা বড়ো নি:শ্বাস ফেললো। এখানে কোন কালো আগুন নেই, নেই নরকের দ্বাররক্ষী কোন ভীষণদর্শন ফেরেশতা। এই যদি হয় নরক, আশা করা যায় জাহিদ এখানে টিকে যেতে পারবে। মনে হচ্ছে এখানে তার একমাত্র সমস্যা হবে সবকিছু সাদা-কালো দেখা, কিন্তু মৃত্যুর পরের জীবনকে সারাজীবন অস্বীকার করার তুলনায় এটা যে তেমন কোন শাস্তিই না সেটা বলা বাহুল্য।
জাহিদের ততক্ষনে সন্দেহ হওয়া শুরু করেছে, ভুল করে কোনভাবে তাকে বরং স্বর্গেই চালান করে দেয়া হয়েছে। ফেরেশতা বলে যদি কোন প্রাণী প্রজাতি সত্যিই থেকে থাকে, তাদের পক্ষে ভুল করা অসম্ভব না – বিশৃঙ্খলা প্রকৃতির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যই।
চারিদিকে আরেকবার চোখ ফেলে জাহিদ লক্ষ্য করলো – রাস্তা-ঘাট খুব পরিচ্ছন্ন, আর কালো এসফল্ট-এর বদলে উজ্জ্বল কোন একটা কিছু দিয়ে ওগুলো মোড়ানো। জাহিদ কোন রং দেখতে পাচ্ছিলো না, তবে ধারণা করে নিলো রাস্তাগুলোর ওপরটা সোনালী রং দিয়েই প্রলেপ দেয়া। সে বুঝতে পারলো না, এ কোন পরাবাস্তবতার ঢাকা শহর? আশে-পাশের বিল্ডিংগুলোও যে একেকটা একেক রঙে উজ্জ্বল, সাদা-কালো দৃষ্টি দিয়েও সেটা বুঝে নিতে জাহিদের কোন সমস্যা হলো না।
সব মিলিয়ে ওর ততক্ষনে সন্দেহ হওয়া শুরু করেছে, ভুল করে কোনভাবে তাকে বরং স্বর্গেই চালান করে দেয়া হয়েছে। ফেরেশতা বলে যদি কোন প্রাণী প্রজাতি সত্যিই থেকে থাকে, তাদের পক্ষে ভুল করা অসম্ভব না – বিশৃঙ্খলা প্রকৃতির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যই।
এগুলো ভাবতে ভাবতে জায়গাটা সে হঠাৎ করেই চিনতে পারলো, এটা মালিবাগ মোড় – পুরো এলাকাটা অত্যাধুনিক আর সুসজ্জিত বলে ছোটবেলার এই শহরকে সে এতক্ষন চিনতে পারছিলো না। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে সে প্রধান সড়ক থেকে ডানদিকে ওদের বাসার গলিটাও চলে যেতে দেখলো। এমনকি সিদ্ধেশ্বরী লেনের সেই গলি ধরে ভেতরে গিয়ে সে নিজের চারতলা বাসাটাও খুঁজে পেলো।
২
জাহিদ যখন বাইরের গেট খুলে ওর বাসাটার ভেতর ঢুকছিল, ঠিক তখনি সেই তরুনীটা ওর চোখে পড়লো। মুখটা খুব চেনা চেনা। ওর সাথে চোখাচোখি হতেই মেয়েটা মুখ টিপে হাসতে শুরু করলো, যদিও ওর চোখ দুটো সেভাবে হাসছিলো না।
মেয়েটা জাহিদের দিকে এগিয়ে এসে “জাহিদ, তুমি?” বলতেই জাহিদের মনে পড়ে গেলো, এ তাদের গলির শেষমাথায় পুরোনো তিনতলা বাসাটায় থাকতো। রুনাকে দেখে জাহিদের ভেতর হঠাৎ করেই পুরোনো একটা নেশা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইলো, রুনার ওপর থেকে ও যেন চোখ সরাতেই পারছিলো না।
ওকে দেখে জাহিদ আরেকবার নিশ্চিত হলো যে এটা স্বর্গ কিংবা নিদেনপক্ষে স্বর্গের ওয়েটিং রুম বা অন্ততপক্ষে ডেমো। যে করেই হোক, সে এখানে চলে এসেছে – চলে এসেছে এমন এক পৃথিবীতে যেখানে শুধুই ভোগ আর ভোগ। জাহিদ ধরে নিলো, হয়তো কোথাও স্বর্গীয় কোন ভুল হয়েছে। ওর অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না, ঐশ্বরিক শক্তিতে অবিশ্বাসের জন্য তাকে যে শাস্তি পেতে হচ্ছে না, এটাই আপাতত ভীষণ স্বস্তির সংবাদ।
“তুমি আবার এসেছো? তোমার সমস্যা কি?” – রুনা হেসে বললো তাকে।
“আবার এসেছি মানে?”
“এই নিয়ে তো তিনবার হলো। আর তুমি কিছুই জানো না?”
জাহিদ বুঝতে পারলো না, কেন রুনা এভাবে হেয়ালি করে কথা বলছে। এটা সাদা-কালো পৃথিবী বলে জাহিদ ওর শাড়ির রং বুঝতে পারছিলো না, কিন্তু গাঢ় ছাই রং দেখে সে আন্দাজ করলো – এটা আসলে সবুজ রঙের একটা শাড়ি, যেটা এই মুহূর্তে এক লোলুপ যুবকের মত মেয়েটার রোমাঞ্চকর শরীরকে আষ্টে-পৃষ্ঠে জাপ্টে ধরে আছে।
রুনা আপা সিনেমা করতো। তার বাসায় চলচ্চিত্র জগতের অনেককেই আসতে দেখা যেত। তাদের কাউকে কাউকে আবার গভীর রাতে ওর ঘর থেকে বের হয়ে চলে যেতে দেখা যেত। এই সেই রুনা, যে মারা গিয়েছিলো অল্পবয়সে, আত্মহত্যা করে।
তাহলে এটা কি সেই আশির দশকের সিদ্ধেশ্বরীর একটা প্রতিরূপ, যা খুব যত্ন করে কেউ তৈরী করেছে, আর সেখানে জায়গা করে নিয়েছে সে সমস্ত লোক, যারা পৃথিবী থেকে ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে – অপঘাতে? চিরসন্ধ্যার এই শহরে সে শুধু তাদেরই দেখা পাবে, যারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে – অসময়ে অকালে অথবা অপঘাতে?
৩
ঠিক কৈশোরের দিনগুলোর মতো চোখের কোনা দিয়ে বার বার জাহিদ তাকাচ্ছিলো রুনার উদ্ধত বুকের দিকে, যদিও কথা চালিয়ে যাচ্ছিলো এমনভাবে যেন কিছুই হয় নি – “রুনা আপা, আমি এখানে আসার পর থেকে কোন রং দেখতে পাচ্ছিনা। আপনি কি জানেন কেন?”
উত্তরে রুনাও কিন্তু হাসলো, মোহময় সে হাসি – “তুমি যা চাও, তাই যদি পাও, তাহলে রং দিয়ে কি করবে?”
কথা বলতে বলতে ওরা দুজন একসাথে বাসায় ঢুকছিল, জাহিদের বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করছিলো ওপরে কি আছে ভেবে। প্রায়ান্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ওরা দুজন তিনতলার ঘরে ঢুকতেই জাহিদ দেখলো, ড্রইং রুমে টেবিলে তার সব প্রিয় খাবার থরে থরে সাজানো আছে – বরফ দেয়া মিষ্টি দইয়ের লাচ্ছা শরবত, সবজি-পরোটা, পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ভাজা ডিম, আর মিষ্টি সুজি।
“রুনা আপা, আমরা কি মারা গেছি? আর এটা কি আসলে স্বর্গ?” – ভোগের সব জিনিস-পত্র একে একে ওর সামনে আসছে দেখে জাহিদ তখন কিছুটা স্বস্তি পেতে শুরু করেছে।
রুনা উত্তর দিলো না, শুধুই হাসলো। কিন্তু জাহিদের কেন যেন সে হাসিকে খুব শুকনো মনে হলো।
জাহিদের কোন ক্ষুধা ছিল না, এমনকি পিপাসাও না, শুধু চোখের ক্ষুধার কারণেই সে খাওয়াগুলোর ওপর একরকম ঝাঁপিয়ে পড়লো – যদিও কেন যেন লাচ্ছাটা ওর কাছে পানির চেয়েও স্বাদহীন মনে হচ্ছিলো, পরোটা খেতে গিয়ে মনে হচ্ছিলো সে শুকনো কাঠ চিবোচ্ছে, আর ডিমভাজাটা যেন একেবারে নিউজপ্রিন্ট কাগজ।
ওর অবস্থা দেখে রুনা মিটি মিটি হাসছিলো। জাহিদ সেটা লক্ষ্য করতেই মেয়েটা বলে উঠলো – “এই পৃথিবীটাতে ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, তাই কোন খাবারেই মজা নেই। চিন্তা করো না, আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে।” – শেষ কথাগুলো বলার সময় মেয়েটার কণ্ঠ কেমন যেন বিষন্ন শোনালো।
জাহিদ তখন হঠাৎই বুঝতে শুরু করেছে – সেই বাস্তবতায়ই খাবারের স্বাদ পাওয়া যায়, যে বাস্তবতায় শরীরের জন্য পানাহারের প্রয়োজন আছে। মৃতদের এই নগরীতে যেহেতু শারীরিক কোন প্রয়োজন নেই, তাই এখানে খাবারেরও কোন স্বাদ নেই।
যদিও এটা স্বর্গ, এর মধ্যে কোথায় যেন একটা সমস্যা আছে – জাহিদ ভাবলো। সমস্যাটা সে ঠিক ধরতে পারছিলো না, কিন্তু বুকের ভেতর ভাঙা কাঁচের মতোই ওটা বার বার খোঁচাতে শুরু করলো ওকে।
রুনা তখন দাঁড়িয়ে ছিল সোফাটার সামনে, শাড়ি ঠিক করতে গিয়ে বার বার তার আঁচল পড়ে যাচ্ছিলো মাটিতে – ঠিক যেভাবে করে সাদা কিংবা নীল ওড়না পড়ে যেত ওর বুকের ওপর থেকে, ওর কিংবা ওদের প্রথম মৃত্যুর আগে, শেওলাধরা দেয়ালের পুরাতন এক শহরের আবছায়ায়।
এই সেই শরীর, একদিন যে পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলো দুরন্ত এক কিশোর রৌদ্রের এক শহরে। এই সেই রহস্যময় শরীর, এক জোড়া তরুণ চোখ যাকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলো গ্রীষ্মের সেই এক দুপুরে।
সে যে বেঁচে আছে, সেটাকে অনুভব করার শেষ চেষ্টা হিসেবে জাহিদ রুনার দিকে এগিয়ে গেলো, তারপর ওর অবাক দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আচমকা জড়িয়ে ধরলো তাকে। ওর পরিকল্পনা ছিলো, এক ধাক্কায় মেয়েটাকে সোফার ওপর ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর ওপর – ওই শরীরটাকে জোর করে উপভোগ করে হলেও শেষবারের মতো চেষ্টা করবে মৃত এই শহরে একবারের জন্য নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে।
কিন্তু রুনাকে স্পর্শ করার সাথে সাথে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেয়ে সরে আসতে হলো জাহিদকে। কোন শরীর এত শীতল হতে পারে, ধারণা ছিল না। জাহিদের মনে হচ্ছিলো, ও যেটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ওঠার চেষ্টা করছে, সেটা আসলে একটা মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই না।
বুদ্ধিমান জাহিদের বুঝতে দেরি হলো না, যে পৃথিবীতে নতুন প্রজন্ম তৈরির কোন প্রয়োজন নেই সেখানে যৌক্তিকভাবেই যৌনতা হবে অনুভূতিশূন্য। যদিও সে বুঝে উঠতে পারছিলো না – যে পৃথিবীতে সব ধরণের ভোগ আর উপভোগ সহজলভ্য অথচ এর কোনটাই কোন অনুভূতি জাগায় না, এরকম একটা জীবনে সে কিভাবে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারবে আর কিভাবেই বা নিজের জীবনকে অর্থপূর্ণ মনে করতে পারবে।
এই অদ্ভুত পৃথিবীতে জেগে ওঠার পর প্রথমবারের মতো জাহিদ হতাশা অনুভব করতে শুরু করলো – কেন যেন তার নিজেকে মনে হচ্ছিলো একটা মৃতদেহ, যা ছায়াহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে পরাবাস্তব এক নগরে।
৪
জাহিদের চিন্তা ততক্ষনে গুলিয়ে যেতে শুরু করেছে। ওই পুরোনো ঘর থেকে সে ছুটে বেরিয়ে এলো খোলা রাস্তায়, শুধু একটু যেন দম নিতে পারার জন্য।
সে তখন দেখলো, ওর পেছন পেছন বের হয়ে এসেছে রুনা আপা – শাড়ির আচঁল ঠিক করতে করতে। কিন্তু জাহিদ তার দিকে ফিরেও তাকালো না – বর্ণান্ধ এই পৃথিবীতে কোন ভোগ, উপভোগ, কিংবা অবভোগের পেছনে ছোটা যে অর্থহীন, জাহিদ ততক্ষনে সেটা বুঝে ফেলেছে।
ঠিক তখন ওর মনে পড়লো লুবনার কথা – সেই লুবনা যাকে পৃথিবীতে সে সত্যিকার অর্থেই ভালোবেসেছিলো, সেই লুবনা যে তাকে দিয়েছিলো শরীরের ঊর্ধ্বের এক প্লেটোনিক প্রেমের অনুভূতি। এটা যদি যদি হয় অপার্থিব কোন বাস্তবতা হয়, তাহলে লুবনার সঙ্গই তাকে হয়তো দিতে পারবে বেঁচে থাকার স্বাদ, অর্থপূর্ণ করতে পারবে জাহিদের এই অপার্থিব অস্তিত্বকে। সুতরাং ওর একমাত্র আশা এখন লুবনাকে খুঁজে বের করা।
যেহেতু এটা মৃতদের নগরী, আর আগের পৃথিবীতে লুবনা মারাই গিয়েছিলো, তার মানে এই অপার্থিব ঢাকা শহরে সে লুবনাকে একসময় খুঁজে পাবেই – এটা ছিল জাহিদের দৃঢ় বিশ্বাস।
আর এই অদ্ভুত আধ্যাত্মিক বাস্তবতায় যদি মেয়েটাকে কোনোভাবে খুঁজে বের করতে পারে, তাহলে অন্তত নিজেকে সে স্বান্তনা দিতে পারবে এই ভেবে যে তার জীবনটা শতভাগ ব্যর্থ নয়।
৫
রুনা তখন তাকে ডাকছে, পেছন থেকে, শীতল কণ্ঠে – “কোথায় যাও?”
“লুবনাকে খুঁজতে।”
“লুবনা কে?”
“লুবনা মায়ের মতোই ভালো একটা মেয়ে।” – ঘাড় না ঘুরিয়েই উত্তর দিলো জাহিদ।
“ভালো মেয়েরা তো এখানে থাকে না।”
“ভালো মেয়েরা কোথায় থাকে?”
“ভালো মেয়েরা থাকে অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে।” – রুনা ম্লান হেসে বলে বলে – “যেখানে আকাশের রং নীল, কারণ ঈশ্বর তাতে রং দিয়েছেন; যেখানে ঈশ্বর মানুষকে শুধু অস্তিত্বই দেন নি, সাথে দিয়েছেন অস্তিত্বের অর্থ।”
জাহিদের চিরাচরিত বুদ্ধিমত্তা এই পৃথিবীতেও পুরোপুরি কাজ করছিলো, সুতরাং সে বুঝে ফেললো রুনার কথাগুলোর অর্থ।
এই পৃথিবীতে ভোগ আছে অবারিত, কিন্তু সে ভোগগুলো স্বাদহীন, কেননা ঈশ্বর তাতে স্বাদ দেন নি।
এই পৃথিবী অর্থহীনই থাকবে, যে পর্যন্ত না ঈশ্বর এর ভেতর দয়া করে অর্থ দিয়ে দেন।
সে এটাও বুঝে ফেললো, সে লুবনাকে চিরদিনের জন্যই হারিয়েছে, দুই পৃথিবী থেকেই। যেহেতু সরল বিশ্বাসীদের অবস্থান বুদ্ধিমান অবিশ্বাসীদের থেকে অনেক ঊর্ধ্বে, সেহেতু মৃত্যুর দরজার এপাশের অদ্ভুত এই স্থান-কালেও ওর সাথে কোনোদিনই আর দেখা হবে না জাহিদের।
সে এখন জেনে ফেলেছে, এই পরাবাস্তব পৃথিবীর শাস্তি স্বাদহীন কাগুজে খাবার না, বরফশীতল নারীদেহও না – এই নিন্দিত স্বর্গের সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো লুবনার না থাকা, এই পরাবাস্তব অভিজ্ঞতার সবচেয়ে বড় আফসোস হলো এত পথ পাড়ি দিয়ে মৃত্যুর দরজারও অন্যপাশে এসে লুবনাকে আরো একবার হারিয়ে ফেলার গল্পটা।
হঠাৎ করেই তখন কি যেন হলো জাহিদের, তীব্র আতঙ্কে তার সারা শরীর কাঁপতে শুরু করলো। তার মনে হতে লাগলো তার পেছনে ওটা আসলে রুনা না, ওটা একটা প্রেতাত্মা – আস্ত একটা মৃতদেহ ওটা, জাহিদ পেছনে ফিরে তাকানো মাত্র যেটার রক্ত-মাংস খসে খসে পড়া শুরু করবে।
ভীষণ ভয়ে অস্থির জাহিদ কি করবে বুঝতে না পেরে আচমকা দৌড়াতে শুরু করলো – যেন এভাবে ছুটে চলতে চলতে সে একসময় ছিটকে বেরিয়ে যেতে পারবে এই দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন থেকে, ঘেমে নেয়ে জেগে উঠতে পারবে মাটির পৃথিবীর কোন এক হাসপাতালে।
৬
জাহিদ তখন প্রানপনে দৌড়াচ্ছিলো মৃত্যু পরবর্তী এই অদ্ভুত পৃথিবী থেকে পালিয়ে যাবার জন্য, কিন্তু একসময় হতাশ হয়ে সে বসে পড়লো রুপোলি প্রলেপ দেয়া পিচঢালা সেই পরাবাস্তব পথে। কিছুক্ষনের মধ্যে রুনা তাকে খুঁজে বের করে তার পাশে এসে বসলো, কিন্তু মরিয়া জাহিদ তখনো আশা করছে হয়তো কোনভাবে এখান থেকে কখনো বের হওয়া যাবে।
“একটা আয়না আমাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিলো। রুনা আপা, আমার মনে হয় ওটাই বাস্তব আর পরাবাস্তবের মধ্যেকার একমাত্র যোগসূত্র, ওটাই জীবন আর মৃত্যুর মধ্যকার একমাত্র দরজা। আপা, আমাকে ওই দরজা খুঁজে পেতেই হবে, চেষ্টা করে যেতে হবে যেভাবেই হোক ওটা খুলে দরজার ওপাশে ফিরে যেতে। তুমি কি জানো, মৃতদেহের্ এই শহরে কোথাও আছে কিনা সে আয়না?”
রুনা মাথা নাড়লো, কিন্তু তার মুখ থমথমে। “কিন্তু ওখানে তো কেউ যায় না – ওটাই তো এই অপার্থিব জগতের শেষ প্রান্ত, এর ওপাশে আর কিছু নেই – এমনকি শূন্যতাও অনুপস্থিত ওখানে।ক্ষীণস্বরে সে বললো।
“তবুও সেখানে যাবো আমি, আমাকে যেতেই হবে।” – দৃঢ় কণ্ঠে বললো জাহিদ, উঠে দাঁড়ালো সে ত্রস্তভাবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুনা ওর হাত ধরলো, তারপর ওরা হাটতে শুরু করলো ওদের ছায়াদুটোকে পেছনে ফেলে।
কিছুদূর যেতেই সিদ্ধেশ্বরী লেনের সেই গলিটা শেষ হয়ে গেল হঠাৎ করেই, আর ওদের চোখের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ালো বিশাল একটা আয়না – পার্সিয়ান এক আয়না, কারুকাজ করা কালো কাঠে বাধাই করা প্রাচীন ধরণের এক আয়না, খুব চেনা চেনা একটা আয়না – আর আয়নার ওপাশটায় ধোঁয়াটে এক ধরণের অন্ধকার দেখা যাচ্ছে শুধু।
ক্লান্ত জাহিদ হাল ছেড়ে দেয়া কণ্ঠে বললো – “রুনা আপা, জানো – একজন স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করার জন্য সারাজীবন আমাকে কত গবেষনা করতে হয়েছিল, কত পরিশ্রম করতে হয়েছিল? আর লুবনা মেয়েটা শুধু নিজের অন্তরের কথা শুনেই খোদাকে পেয়ে গিয়েছিল। আর আমি যুক্তি দিয়ে একজন ঈশ্বরকে খুঁজতে বের হয়ে সত্য থেকে আমি শুধুই দূরে সরে গেছি, শুধুই দূরে সরে গেছি।”
রুনার চেহারা দেখে মনে হলো, এই পরাবাস্তব কারাগারে এই ধরণের পাপী সে প্রথম দেখলো।
“আশ্চর্য মানুষ তো তুমি। দুনিয়াতে খোদা কি তোমাকে কোন ইঙ্গিতই পাঠান নি? অবিশ্বাস করার চেয়ে বিশ্বাস করাটাই কি তোমার জন্য বেশি সহজ ছিল না?” – সে অবাক বিস্ময়ে বললো।
৭
কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাহিদ রহস্যময় সে আয়নার সামনে বসে থাকলো, অন্তত এক হাজার বছর। তারপর তার ভেতর কিছু একটা হলো, শেষপর্যন্ত – কিছুটা দেরি করে হলেও – তার ইহকাল আর পরকাল মিলিয়ে প্রথমবারের মতো জাহিদ সেজদায় পড়লো এক না দেখা খোদার উদ্দেশ্যে, আর অনন্তকাল ধরে প্রার্থনা করতে থাকলো কায়মনোবাক্যে – এটা যেন একটা দুঃস্বপ্ন হয়, সে যেন প্রথম জীবনের কোন একটা হাসপাতালে কয়েক মিনিটের জন্য হলেও জেগে উঠতে পারে – জেগে উঠতে পারে জীবনের অর্থের স্রষ্টাকে অন্তত একবারের জন্য হলেও স্বীকার করে নেয়ার জন্য।
ডুবন্ত মানুষ যেভাবে খড়কুটোর ভেতর খোঁজে আঁকড়ে ধরার আশ্রয়, অনেকটা সেভাবে জাহিদ আয়নার দিকে তাকিয়ে ভাবলো – হয়তো ওটাই পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার গোপন দরজা, আর সে দরজার ওপাশে যেতে হলে শুধুই বিশ্বাসের ওপর ভর করে দিতে হবে অনন্ত এক শূন্যতায় ঝাঁপ। এমনকি একসময় তার মধ্যে আশা জেগে উঠলো, সে ফিরে যেতে পারবে সেই মাটির পৃথিবীর কোন এক হাসপাতালের বেডে।
অদৃশ্য কোন মহান স্বত্ত্বাকে উদ্দেশ্য করে জাহিদ বলে উঠলো – “হে আমার প্রভু, আমাকে আরেকবার পৃথিবীতে ফিরে যেতে দাও। কথা দিচ্ছি, এইবার আমি তোমার কোন নিদর্শনকে অস্বীকার করবো না। প্রভু, আমি পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাই, যেন এবারকার মতো বিশ্বাসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি,
আর ফিরে পেতে পারি আমার সেই লুবনাকে।”
অস্তিত্ববাদী জাহিদের সেই সকরুণ প্রার্থনা ভেতর প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগলো চিরসন্ধ্যার সেই পৃথিবীর ঘোলাটে এক আকাশে।
