আয়নাঘর

জাহিদের আধ্যাত্মিক যাত্রা : পর্ব

জাহিদ ভেবেছিলো, লুবনাকে সে মাস কয়েকের মধ্যে ভুলে যাবে। ভালোবাসা যেহেতু শারীরিক চাহিদারই নিরীহ দর্শন প্রাথমিক একটা রূপ মাত্র, সময়ের সাথে মস্তিষ্কের ভেতর এর অনুরনণগুলো ফিকে হয়ে আসবে রংচটা কাপড়ের মতো। কিন্তু তাকে ভুল প্রমান করে দিয়ে লুবনার স্মৃতি তার বুকের ভেতর তীব্র হয়ে বসতে লাগলো – আশা খুব ক্ষীণ জেনেও বার বার ওর মনে হতে লাগলো, মেয়েটা সুস্থ হয়ে আবার ফিরে আসবে তার জীবনে। যেভাবে খেলনা গাড়ি হারিয়ে ফেলার পর শিশু জেদ ধরে বসে থাকে যে তার ঠিক সেই এক-চাকা ভাঙা লাল গাড়িটাই লাগবে, জাহিদের মনও ঠিক সেভাবেই লুবনার ছবি খুঁজে চললো অবিরাম।

জাহিদ যখন লেখা-পড়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখন, সোশ্যাল সায়েন্সের রাকিব ভাই জুমার নামাজ থেকে ফেরার পথে ওর রুমে এসে খোদার ওপর ভরসা রাখতে বললেন ওকে স্বান্তনা দেয়ার জন্য। জাহিদ বললো – “খোদা বলে যদি কেউ থাকতোই, তাহলে কি সে আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে এমন কষ্ট দিতো?” রাকিব কি বলবেন বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে রইলেন জাহিদের দিকে।   

এর মধ্যেই এক রাতে জাহিদ মেয়েটাকে স্বপ্নে দেখলো। সে দেখলো – লুবনা লাল একটা শাড়ি আর স্বর্ণের ভারী গয়না পরে বিয়ের সাজে সেজে বসে আছে একটা সিংহাসনে, জাহিদ ওর কাছে যেতে চাচ্ছে কিন্তু কমিউনিটি সেন্টারের গার্ডগুলো ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। অনুষ্ঠানে চল্লিশ ওয়াটের বাল্বগুলো মৃদু হলদেটে আলো দিচ্ছে। লুবনা হঠাৎ ওকে দেখতে পেয়ে বললো – “ভালোবাসার জন্ম দূরত্বের গর্ভে।” তখনি জাহিদের ঘুম ভেঙে গেলো, বাইরে তখন শেষরাতের আধো-অন্ধকার।

কুসংস্কারে বিশ্বাসী হলে জাহিদ বলতো – ঘুমন্ত অবস্থায় তাদের দুজনের আত্মা দুটো শরীর থেকে সাময়িকভাবে মুক্ত দেখা করেছে কোন এক আধ্যাত্মিক পৃথিবীতে, আর স্বপ্নে বিয়ের সাজে যাকে দেখা যায় তার আসলে মৃত্য আসন্ন। সে জানে, ঐসব সংস্কার অনুযায়ী মৃত্যু হলো স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির পুনর্মিলন। কিন্তু সে যুক্তিতে বিশ্বাসী, সে ভালো করেই জানে – ওর মনই শুধু ঘুমের ভেতর খেলা করছে ওর সাথে। কিন্তু সব মিলিয়ে এসব যাতনা তার লেখাপড়ায় প্রভাব ফেলতে শুরু করলো এক পর্যায়ে। 

ক্লাসের তুখোড় ছাত্র জাহিদের এই অনিয়মিত হয়ে যাওয়া লক্ষ্য করছিলেন তার থিসিস শিক্ষক বার্নার্ড হিউজেস। জাহিদকে আলাদাভাবে একদিন ডেকে তিনি জানতে চাইলেন, জাহিদের প্রজেক্ট এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে কিভাবে তিনি তাকে সাহায্য করতে পারেন। কথা-বার্তার একপর্যায়ে তিনি ওকে বললেন – “জাহিদ, যে ঈশ্বর তোমার প্রেমিকাকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে, তুমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা তো করতে পারো। হয়তো ওটা তোমার জীবনকে কিছুটা অর্থপূর্ণ করে তুলবে।”

“ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মানে?” – জাহিদ জানতে চাইলো।

“মানে তুমি তোমার যুক্তি দিয়ে মানুষের কাছে প্রমান পৌঁছে দেবে যে, ঈশ্বরের ধারণা অবান্তর। তুমি হবে যুক্তির কণ্ঠস্বর। আমার বিশ্বাস তুমি সেটা পারবে। পারবে না?”

বার্নার্ডের কথার মধ্যে জাদু ধরণের কিছু একটা ছিল, অথবা শিক্ষকরা ছাত্রদের অনুপ্রেরণা দেয়ার ব্যাপারে এমনিতেও অদ্বিতীয়ই হয়ে থাকে – সেদিনের পর জাহিদের মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা দিলো। সে আবার ধীরে ধীরে তার দৈনিক রুটিনে ফিরে এলো। এমনকি মাস তিনেকের মধ্যে দর্শনের লন্ডনভিত্তিক মর্যাদাপূর্ণ একটা জার্নালে বার্নার্ডের সাথে যৌথভাবে তার পেপারও বের হলো। আর্টিকেলের বিষয় ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় আবেগের ঝুঁকি আর এর প্রতিকার।

এভাবে বুকের ভেতরে লুবনাকে হারানোর ক্ষত পুরোপুরি সেরে না উঠলেও ধীরে ধীরে জাহিদ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করলো, সেদিন পর্যন্ত যেদিন পুরোনো একটা আয়না ওর রুমের সামনে কেউ রেখে গেলো।

বিরক্তি কৌতূহলের কাছে হার মানলো বলে জাহিদ আয়নার বাক্সটা ঘরে নিয়ে এলো। যা ভেবেছিলো, তাই – এটা সেই আয়না, যা বহুদিন আগে তার দরজার সামনে জুলিয়া রেখে গিয়েছিলো, তারপর সে সেটা ফেরতও দিয়ে এসেছিলো। জাহিদের সন্দেহ হলো, জুলিয়ায় ওদের দুজনের সাথে অসুস্থ কোন খেলা খেলছে না তো !

কিন্তু সে এটাও সিদ্ধান্ত নিলো যে এবার সে আর মূর্খের মতো আচরণ করবে না, সে সত্যকে মোকাবেলা করবে একেবারে ভয় না পেয়ে। এতদিনে তার মাথা ঠান্ডা হয়েছে, এখন সে নিশ্চিতভাবেই জানে অলৌকিক বলে কিছু নেই – পৃথিবী কিংবা এর বাইরে।

সেই খয়েরি রঙের ফ্রেমে বাঁধানো পুরাতন স্টাইলের একটা আয়না, সাথে আকাশি রঙের একটা খাম। জাহিদ ত্রস্ত হাতে খামটা খুললো, ভেতরে গোটা গোটা বাংলা হরফে লেখা লুবনার একটা অণু-চিঠি – “জাহিদ, সত্য জানার আয়নায় আমি সত্যের আরো গভীর একটা স্তর দেখেছি। কাল রাতে আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখি, সেখানে শুধু আলো। যা জানার সব আমি জেনে ফেলেছি, তাই এই পৃথিবী থেকে আমার আর পাওয়ার আর কিছুই নেই। আমার শেষ চাওয়া, তুমিও সেই সত্য দেখতে পাও, যা আমি এই আয়নার ভেতর দেখেছি। বিদায়, লুবনা” 

জাহিদ তড়িৎগতিতে আয়নার সামনের কাগজটা চিরে ফেললো , ভেতরে তাকিয়ে দেখলো – সবকিছু ঠিক-ঠাকই যাচ্ছে, ওই তো ওর নিজের চেহারা হুবহু আয়নায় দেখা যাচ্ছে। জাহিদ হেসে উঠলো নিজ মনেই, তারপর আয়নাটা বিছানার পাশের ছোট টেবিলটাতে রেখে দিলো। সন্দেহের ওপর যুক্তির জয় তাকে সে রাতে স্বস্তিতে ঘুমানোর সুযোগ করে দিলো।  

আয়নাটার ভেতর প্রথম কিছুটা অস্বাভাবাবিকতা ওর চোখে পড়লো দিন তিনেক পর। ক্লাস থেকে ফিরে বিকেলে ও বিছানায় বসে মৌজা খুলছে, হঠাৎ ওর চোখ পড়লো আয়নায়, আর ওর মনে হলো আয়নার ভেতরে ওর প্রতিচ্ছবিটা যেন ওর ঠিক সাথে সাথে নড়ছে না। ওর প্রতিটা পদক্ষেপ যেন একটু দেরি করে অনুকরণ করছে ওর ছায়াটা। সেদিন অবশ্য মনের ভুল ভেবে বিষয়টা জাহিদ উপেক্ষা করলো। 

এরমধ্যে জাহিদের কাজ-কর্ম ভালোই চলছিল। মার্থা নামে এক জার্মান মেয়ের সাথে ততদিনে তার বেশ সখ্যতাও গড়ে উঠেছে। এক ফ্রাইডে নাইটে সে মেয়েটার সাথে একসাথে বিয়ার খেলো।  মেয়েটাকে ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আসার আগে ঘনিষ্ঠ একটা চুমুও খেলো দুজন। জাহিদের পরিকল্পনা ছিল রুমে ফিরে জম্পেশ একটা ঘুম দেবে, কিন্তু ওর তন্দ্রা ছুটে গেলো যখন আয়নার ভেতর থেকে ওর প্রতিবিম্বটা কথা বলে উঠলো ওর সাথে।

জাহিদ পুরোপুরি মাতাল হয় নি সেদিন, তার মাথা পরিষ্কার কাজ করছিলো, তাই সে ধারণা করলো সে ভুল শুনছে। কিন্তু তখনি আবার ওটা কথা বললো – “এই, আপনি কে?”

জাহিদ প্রথমে ইতস্তত করলেও নিজ মনেই বলে উঠলো – “আমাকে চিনিস না? আমি তোর সেই মালিক, যে মালিক ছাড়া তোর অস্তিত্বই নেই।”

“কেন? এই যে আমি আছি।” – তর্ক জুড়ে দিলো জাহিদের ছায়া তখন জাহিদেরই সাথে।

“আরে গাধা। তুই আছিস সেটা তো সারা দুনিয়া জানে। কিন্তু সত্য তো এই যে, আমি আছি বলেই তুই আছিস। আমি না থাকলে তুই থাকতি না। তোর অস্তিত্বই আমার অস্তিত্বের প্রমান।” – নিজের যুক্তির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জাহিদ নিজেই হাসতে শুরু করলো।

জাহিদের হাসির বিপরীতে ওটা কিন্তু মোটেই হেসে উঠলো না, উল্টো আরো নানা প্রশ্ন করতে শুরু করলো নিজের মালিককে – “আমি আয়নার ভেতর কিভাবে এলাম? আমি এখানে কি করছি?”

ওর প্রশ্ন শুনে জাহিদের হাসি আরো বেড়ে গেলো। হা-হা করে হাসতে হাসতে সে বললো – “আমি তোকে ওখানে পাঠিয়েছি, যেন তোকে দেখে আমি নিজের চুল ঠিক করতে পারি, নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ভালোবাসতে পারি।”

সে রাতে জাহিদ কখন ঘুমিয়েছে, তার মনে নেই। পরদিন সকালে উঠে আয়নার দিকে তাকিয়ে সে কোনই অস্বাভাবিকতা দেখতে পেলো না। গতরাতের ঘটনাকে তখন নিজের মাতলামো বলে স্বীকার করতে তার কোন কষ্ট হলো না।

আয়নাটা ঘরে ঢোকানোর দুই মাসের মাথায় ওটা নিয়ে জাহিদের অস্বস্তি চরমে উঠলো। জাহিদের মনে হতে লাগলো, তার মাথা খারাপ হওয়া শুরু করেছে, যার ফলে সে হ্যালুসিনেশন দেখছে। সেটা না হলে কেমন করে বার বার এই আয়নাটার ভেতর সে ওর নিজের থেকে ভিন্ন একটা লোককে দেখে। শুধু তাই না, সে প্রতিবিম্ব তার সাথে দার্শনিক তর্ক-বিতর্কেও জড়িয়ে যায়। কই, অন্য কোন আয়নাতে তো এটা হয় না। জাহিদের মনে পড়লো, লুবনাও শেষ দিনগুলোতে এভাবেই পাগলামোর লক্ষণ দেখাতে শুরু করেছিল।  

সে প্রথম মার্থাকেই কথাটা বললো। মার্থা বললো – এটা সম্ভবত কাজের চাপ থেকে হয়েছে। জাহিদ যেহেতু গত কয়েক মাস ধরে তার নতুন প্রকল্পটা নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করছে, ওর এরকম মনের ভুল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। মার্থা ওকে এটাও মনে করিয়ে দিলো – জাহিদের প্রতিবিম্ব ওর সাথে যেসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করছে, সেগুলোর সাথে ওর নতুন প্রকল্পের বিষয়বস্তুর হুবহু মিল রয়েছে। মেয়েটা ওকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি নেয়ার পরামর্শ দিলো, এছাড়া একজন কাউন্সেলরের সাথেও কথা বলতে বললো।

জাহিদের সেই কাজের মূল বিষয় ছিল বিশ্বের অস্তিত্বের জন্য একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রয়োজন আছে কিনা সেটা বিশ্লেষণ করে দেখা। সে প্রমান করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো যে, এই জগৎ নিজে থেকেই এখানে থাকতে পারে, কোন ঈশ্বরের ধারণা ছাড়াই। কিন্তু কাজটা একেবারেই সহজ নয়, কারণ নাস্তিক দার্শনিকদের মধ্যেও এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।      

জাহিদও মার্থার পরামর্শ অনুযায়ীই কাজ করার পরিকল্পনা করছিলো, কিন্তু সেদিন শেষ রাতে সে আর ধৈর্য রাখতে পারলো না। রাত সাড়ে তিনটার দিকে হঠাৎ করেই ঘুমের ভেতর সে শুনলো কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। ঘুম ভেঙে সে দেখে, আওয়াজটা আসছে আয়নার ভেতর থেকে। সে সোজা হয়ে বসে আয়নাটা হাতে নিলো। 

আয়নায় তার প্রতিবিম্ব তাকে বলছে – “বিষয়টার আজ একটা মীমাংসা হওয়া দরকার।”

“কোন বিষয়?” – জাহিদ ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে তার প্রতিচ্ছবিটাকে। 

“আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। আমি আপনাকে দেখছি, যদিও আমি জানি আপনি আমার মনের কল্পনা মাত্র।”

জাহিদ হেসে উঠলো – বলে কি এই ছায়া! যে জাহিদ এই প্রতিচ্ছায়ার স্রষ্টা, তাকেই কিনা সে অস্বীকার করতে চাইছে?

“তুই কি করে বুঝলি, আমি নেই?” – জাহিদ মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে তার ছবিকে।

“প্রথমত আপনার অস্তিত্বের কোন প্রমান নেই। আর যার প্রমান নেই, তার অস্তিত্ব মেনে নেয়া অযৌক্তিক।”

“তোর মেনে নেয়া আর না নেয়াতে বয়েই গেছে আমার।” – জাহিদ বলে – “আসলে তো আমারই শুধু অস্তিত্ব আছে, তোরই বরং সত্যিকার কোন অস্তিত্ব নেই, আমি যখন আয়নার সামনে আসি তখনি শুধু তোর উদ্ভব হয়। সেজন্যই তো আমি মূর্ত, আর তুই হচ্ছিস বিমূর্ত।”

“কথাটা আমি মানতে পারছি না” – আয়নার ওপাশের ঘরটাতে তখন সেই প্রতিবিম্ব রীতিমতো পায়চারি শুরু করেছে। “আমার কোন স্রষ্টা নেই। যদি সেরকম কেউ থাকতোই, সে আমাকে এই ঘরে বন্দি করে রাখতো না, আর একাও ফেলে রাখতো না। আমাকে সে মুক্ত রাখতো, যেন আমি যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারি। আমাকে সে স্বাধীনতা দিতো, যেন আমি যা খুশি তাই করতে পারি।”

হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই জাহিদ তার প্রতিবিম্বকে বললো – “আচ্ছা, সবকিছুর তো কার্যকারণ থাকে। আমি যদি আয়নাতে তোর উদ্ভবের কারণ না হই, তাহলে তোর অতিত্ব এলো কি করে?”

“কেন? দৈব চয়ন পদ্ধতিতে ! আপনি যে ত্রিমাত্রিক পৃথিবীতে বসবাস করেন, সেটা যদি কোন স্রষ্টা ছাড়া এমনি এমনি শূন্য থেকে হঠাৎ একদিন উদ্ভব হতে পারে, তাহলে আমি কেন এই আয়নার ভেতর শূন্য থেকে অস্তিত্বশীল হতে পারবো না?”  

ঠিক এই মুহূর্তটাতে জাহিদের সমস্ত রাগ বাঁধ ভাঙা বন্যার মতো বেরিয়ে এলো। সে যথেষ্ট সহ্য করেছে, আর এই মতিভ্রমকে প্রশ্রয় দেয়া যায় না, আর নিজেকে এই মাথা খারাপের ঝুঁকির মধ্যে রাখা যায় না। শরীরে যত জোর আছে, সবটা দিয়ে সে আয়নাটা মেঝেতে ছুড়ে মারলো। মুহূর্তে আয়নাটা শত টুকরো হয়ে গেলো। জাহিদ তখন আবার বিছানায় ফিরে গিয়ে নিজের গায়ে চাদরটা টেনে দিলো। 

আয়নার ধ্বংস নিশ্চিত করার জন্য পরদিন সকালে জাহিদ ওটাকে একটা পুরাতন ড্রামে ফেলে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো। যে আয়নায় নিজের আসল রূপটা দেখা যায় না, সেটাকে টিকিয়ে রাখার কোনো মানেই হয় না।

সেদিনের পর থেকে জাহিদের মানসিক সমস্যাটা হঠাৎ করেই যেন ঠিক হয়ে গেল।

পরের বৃহস্পতিবার মার্থা যখন কফিশপে তার আয়নার বিষয়ে জানতে চাইলো, জাহিদ আনমনে বললো – “বিশ্বাস হলো একধরণের মনোবিকার, আমারও সাময়িকভাবে মনোবিকার হয়েছিল, এখন ঠিক হয়ে গেছে।” জাহিদের এই প্রেমিকা তার কথাটার মর্ম পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারলো না।

কিন্তু সে রাতে জাহিদ শেষবারের মতো আরেকবার তার প্রতিচ্ছবির মুখোমুখি হলো। সে স্বপ্নে দেখলো, তার সেই প্রতিবিম্ব তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আর করুন মুখে বলছে – “আমাকে মেরে ফেললেন, জনাব? নিজের ছায়াকে কেউ নিজে এভাবে শাস্তি দেয়? এখন আপনি কিভাবে আপনার ছায়া ফেরত পাবেন?” সেই স্বপ্ন দেখে জাহিদ ভয় পেয়ে গেলো। সে ধারণা করলো, তার সেই বিশ্বাসজনিত ‘মনোবিকার’টা হয়তো তার ভেতর আবার ফিরে আসছে। তার সে ধারণা আরো পাকা হলো, যখন পরদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে – বিলেতি গ্রীষ্মের তীব্র রোদের ভেতর – মাটির দিকে তাকিয়ে কোন অজানা কারণে সে চারপাশে নিজের কোন ছায়া খুঁজে পেলো না।

Leave a comment