নহ মানবী, নহ অশরীরী

ঠোঁটের ডানদিকে ছোট্ট একটা কালো তিল, এই একটা জিনিসই ফাহিমের জন্য যথেষ্ট পরীকে চেনার জন্য। হাজারো মেয়ের ভিড়েও যদি ফাহিমকে হারিয়ে যেতে হয়, আর শুধু ওদের ঠোঁট দেখতে দেয়া হয় তাকে, ফাহিম নিশ্চিত সে পরীকে ঠিকই খুঁজে বের করতে পারবে – ওই হট্টগোলের ভেতর থেকে – শুধুমাত্র ওই ছোট্ট কালো তিলটার কারণে।

এতো যে সুন্দর ও – পশ্চিম ইরানের মেয়েদের মতো উন্নত নাক, ভারতীয় মেয়েদের মতো টানা চোখ, জাপানি মেয়েদের মতো গোলাপি গাল, রাশান মেয়েদের মতো তনু, আর বাঙালি মেয়েদের মতো রহস্যময় মন – তবু কেন যেন ওর ঠোঁটের পাশের ওই ছোট্ট তিলটাই ফাহিমের মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে থাকে সারাটা ক্ষণ।

কেউ কেউ হয়তো বলবে – তিল মানে ত্রুটি, ঘাটতি। কিন্তু ফাহিমের কাছে তিল হল নাটকের সেই জোকার, যে সবসময় নায়কের অপূর্ণতাকে আড়ালে ঢেকে রাখে। মোটকথা, তিল ফাহিম ভালোবাসে, আর সেটা যদি হয় পরীর ঠোঁটে তাহলে তো কথাই নেই।               

ওর আসল নাম ফাহিমের জানা নেই বলে ওকে সে নাম দিয়েছিল ‘পরী’। পরীর সাথে ফাহিমের পরিচয় হয়েছিল কৈশোরের দিনগুলোতে, সেই যখন ওরা বিজ্ঞান বইয়ে ডাইনোসরের ইতিহাস পড়তো। বহু বহু বছর আগের কথা সেটা।

ফাহিমের তখন আসলে চৌদ্দ কি পনর বছর বয়স। লম্বা-ফর্সা ফুটফুটে একটা ছেলে হওয়ার পরও – শুধু কারো সাথে মিশতে পারতো না বলে – বন্ধু-বান্ধব তেমন ছিলো না তার। আর আত্মীয়-স্বজনও ফাহিমকে অসামাজিক বলেই জানতো। ফাহিম বলতে গেলে একা একাই থাকতো। প্রায়ই দুপুর রোদে ছাদে চুপচাপ বসে থেকে অনেক দূরের বাসায় শুকাতে দেয়া কাপড়গুলোর বাতাসে ওড়া দেখতো সে। সেরকম এক দুপুরেই প্রথম ঘটেছিলো সেই ঘটনাটা।

ছাদের যে দিক থেকে মেয়েটা হেটে আসছিলো, ওদিক দিয়ে ছাদে ওঠার কোন রাস্তা ছিলোনা। কিন্তু ফাহিমের তখন সে কথা একবারও মনে হয়নি, সে এতোটা মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো। মেয়েটা ফাহিমের থেকে বয়সে বড়ো, ওর বয়স পঁচিশ এমনকি ত্রিশ পর্যন্ত হতে পারে। এতো সুন্দর কোন মেয়ে ফাহিম কোনদিন কোথাও দেখেনি।

মেয়েটা ফাহিমের কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাসলো, যেন অনেকদিনের পরিচিত। ফাহিমও হাসলো, যেভাবে খুব কাছের কাউকে দেখে কেউ হাসে। ফাহিমের খুব ভালো লাগছিল। ফাহিম ওর হাত ধরলো, তখন মেয়েটা তার পাশে এসে বসলো।

ফাহিম ওর নামটাও জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলো। ওরা দুজন অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলো পাশাপাশি – নির্জন ছাদে।

এরপর থেকে প্রায়ই মেয়েটা আসতো ফাহিমের কাছে – একলা দুপুরে, গভীর রাতে। হঠাৎ করেই দেখা দিত, যেন আশে পাশেই কোথাও ছিল। ওর সাথে কোনদিন কোন কথা হয়নি, ভাবলে আশ্চর্যই লাগে। সে ফাহিমের সাথে খেলত নিঃশব্দে – হাতে হাত রেখে, কিংবা চোখে চোখ।

মাঝে মাঝে যখন ওর মন খুব ভালো থাকত, সুড়সুড়ি দিত ফাহিমের পায়ে, আর মিটিমিটি হাসত। প্রায়ই ফাহিমকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকত অন্ধকারে, যেন ভয় পাচ্ছে। তখন ওর জন্য ফাহিমের খুব মায়া লাগত। সে প্রায়ই মিষ্টি আর ফুল নিয়ে আসতো ফাহিমের জন্য। এমন ফুল ফাহিম কখনো কোথাও দেখেনি। অনেককে সে দেখিয়েছে ফুলগুলো, কেউই বলতে পারেনি ওগুলোর নাম।

কিন্তু যে রাতে ও ফাহিমকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে গেল, এরপর থেকেই বাসার সবাই কেমন যেন আচরন করতে লাগল ফাহিমের সাথে। সেসময় ফাহিম নাকি টানা এগারোদিন নিরুদ্দেশ ছিলো। কিন্তু ফাহিমের মনে হয়েছিলো – সন্ধ্যার পর অলিগলি পার হয়ে একটা বাগানের মত জায়গায় গিয়েছিলো ওরা দুজন। সেখানে ফাহিম মেয়েটার হাত ধরে অনেকক্ষণ হেটেছে। বাগানে আরো অনেকে ছিল, সবাই দেখতে খুব সুন্দর। ওরা যেন জ্যোৎস্নার আলোয় অনন্তকাল হাটছিলো।

তারপর একসময় কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলো ফাহিম। ঘুম ভেংগে দেখে – মেয়েটা ওর পাশে নেই, আর ফাহিম একা খোলা ছাদে শুয়ে আছে। সে বুঝতে পারছিলো না, সে কিভাবে ছাদে এলো। যখন নেমে এসে ঘরে ঢুকলো, সবাই একসাথে ওর দিকে ছুটে এলো – যেন ফাহিম বড় ধরণের কোন অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।

আজম সাহেব পরদিনই এক হুজুরকে ডাকলেন। সব শুনে সেই মাওলানা ফাহিমকে বললেন, সবার সাথে বন্ধুত্ব করা যায়না। উনি দোয়া পড়লেন, জাফরানের রং দিয়ে সাদা প্লেটে দোয়া লিখে দিলেন ধুয়ে খাবার জন্য, ফাহিমের গায়ের ওপর লেবু কাটলেন, ওকে জোয়ার ভাটার পানি খেতে দিলেন, আর গোসল করতে বললেন বালতিতে সেই পানি মিশিয়ে। যাবার আগে বিচিত্র সব নিয়মে কালাম পড়ে, পিন মেরে আর পানি ছিটিয়ে ছাদসহ ফাহিমদের পুরো বাড়ি বন্ধ করলেন।

ফাহিমকে তাবিজও দিয়েছিলেন হুজুর, যদিও ওই তাবিজ হারিয়ে ফেলেছে সে বহুদিন হয়। কিন্তু আসলে ফাহিম যেটাতে আশ্চর্য হয়েছিলো, সেটা হল – ঐদিনের পর থেকে মেয়েটা কখনো আর তার কাছে আসেনি। কতদিন ছাদে বসে থেকে সে ভেবেছে, এই বুঝি মেয়েটা আসবে। অথবা গভীর রাতে ঘুম না এলে মনে মনে ওর কথা ভেবেছে, কিন্তু পরী আসেনি।

কারো জন্যই কোন কিছু থেমে থাকে না, মহান প্রেমও একসময় হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে, সুতরাং সময়ের একমুখী পথ ধরে ফাহিমের জীবনও গড়িয়ে চললো সাইকেলের চাকার মতো। এমনকি ভার্সিটিতে পড়ার সময় সহপাঠিনী রুমানার প্রেমে হবু-ডুবু খেতে খেতে কিছু বোঝার আগেই তাকে বিয়ে করে ফেললো সে।

ওরা সংসার শুরু করেছিল দুই হাজার এগারোতে। সে সময় অফিসে গেলে ফাহিমের মন পড়ে থাকতো বাসায়, ফাহিম বাসায় ফিরলে রুমানাও অস্থির হয়ে যেত কি করবে ভেবে। দুজনে মিলে কত কি পরিকল্পনা! কিন্তু এরপরই খুব দ্রুত ঘুরতে শুরু করলো সময়ের চাকা, জোয়ার পড়ে গিয়ে ভাটা আসার মতো ওদের প্রেমেও একসময় মজা পুকুরের স্থবিরতা চলে এলো। বনি ইসরাইলের কাছে স্বর্গীয় খানা-পিনাও যেভাবে একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিলো, সেই একইভাবে ফাহিম আর রুমানাও হয়ে গেলো একজন অন্যজনের কাছে অপাংতেয় – সারাক্ষন ঝগড়া করতো ওরা পিঠাপিঠি দুই ভাইয়ের মতো।

সংসার শুরু করার পর এরকম সময়গুলোতে একটা নতুন মুখ সাধারণত প্রাণ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে ঘরে, কিন্তু সেটা হলো না ডাক্তাররা দীর্ঘদিন ওদের সমস্যাটার কোন সমাধান দিতে পারলেন না বলে। ওদের অবস্থা আন্দাজ করতে পারা বন্ধু-বান্ধব বললো – “কক্সবাজার বা জাফলং গিয়ে ঘুরে আসো”, কিন্তু কোথাও যাওয়া হলো না বায়িং হাউস থেকে ফাহিম লম্বা ছুটি পেলো না বলে।

সুতরাং রুমানার ওপর ফাহিমের মনের বিনিয়োগ শেষপর্যন্ত একরকম বিফলই হলো, সংসার-ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য একপর্যায়ে ওকে নিয়মিত ঋণ নেয়া শুরু করতে হলো স্মৃতির এলবাম আর এড়িয়ে চলাগুলো থেকে।

এরমধ্যে শুরু হলো রুমানার মনোবিকার। সে সন্দেহ করতে শুরু করলো ফাহিমকে – সে রুমানার আড়ালে কোন মেয়ের সাথে পরকীয়া করছে কিনা, পাশের ফ্ল্যাটের স্বর্ণা ভাবী কেন সেদিনই বাসায় থাকে যেদিন ফাহিম ছুটি নিয়ে বাসায় থাকে, ইত্যাদি। ক্যান্সারের মতো সেই সন্দেহ খুব অল্প সময়ের ভেতর তার পুরো মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়লো – রুমানার রাত কাটতো ফাহিমকে হারানো সংক্রান্ত দুঃস্বপ্নে, আর দিন কাটতো সন্দেহের পেছনে দৌড়া-দৌড়ি করে।

দিনের পর দিন রুমানার সন্দেহগুলো বিশ্রী থেকে আরো আরো বিশ্রী হতে শুরু করলো। মতির মা ঘর ঝাড়ু দেয়ার সময় নাকি ফাহিম তার পেছন দিকে তাকিয়ে থাকে, তামান্নার বৌভাতের অনুষ্ঠানে ফাহিম নাকি সামিনা আপার বুক দেখছিলো, ইত্যাদি। একদিন সে ফাহিমের বায়িং হাউসে পর্যন্ত চলে গেলো ফ্রন্ট ডেস্কের লাবনীর সাথে হাতে-নাতে স্বামীকে ধরবে বলে। সেদিন অফিসে সব কলিগদের সামনে চিল্লাচিল্লি করে সে যে কি এক কেলেঙ্কারি ! এসবের ফলে ফাহিম জীবনের প্রতি ক্লান্তি অনুভব করতে শুরু করলো। বাসায় ফিরলেই ঘুমিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো, কষ্টের দিন যত ছোট হয় ততই ভালো।

এভাবে বিয়ের চার বছরের মাথায় ফাহিম অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো রুমানার ওপর, ইচ্ছে করে দেরিতে বাসায় ফিরতে শুরু করলো অফিসের পর। এতে রুমানার সন্দেহ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে লাগলো আরো। পরিস্থিতি একসময় এরকম দাঁড়ালো যে, রুমানা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একবার কি দু’বার রাগের চোটে বাপের বাড়ি চলে যায়, তারপর দুই-এক রাত পর ফিরে আসে তার বাবা-মায়ের মধ্যস্থতায়।   

সেসময় কোন কোন সন্ধ্যায় তো এমনও হতো যে, ফাহিম বাসায় ফেরা মাত্র রুমানা শুরু করে দিলো চিৎকার আর কাঁচের জিনিস ভাঙা। ওর অভিযোগ – “অফিসে কার সাথে ডেট করে এসেছো?”, “আমি ঠিকই টের পাই”, “হঠাৎ এতো ফিট-ফাট হয়ে অফিসে গেলে কার জন্য, আমাকে বলতেই হবে আজকে তোমার”, ইত্যাদি।

এ সময়গুলোতে বাইরে এসে রাস্তার মোড়ে কিছুক্ষন সিগারেট টানলে ভালো লাগতো ফাহিমের, মনটা উদাস হতো একটু। ফাহিম জানতো – ঠিক বিশ মিনিট পর ঘরে ঢুকলে রুমানা আর কিছু বলবে না, কারণ টানা বক বক করে ততক্ষনে তার সব শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে। 

ফাহিম এটাও জানতো, এইসময় রুমানা গাল ফুলিয়ে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে থাকবে, আর ফাহিম তখন আশ্রয় নেবে ওর নিজের ঘরে, ওর নিজস্ব পৃথিবীতে – বিশাল লাইব্রেরি থেকে বেঁচে নেবে পুরোনো একটা বই, এক পৃথিবী থেকে অন্য অনেকগুলো পৃথিবীতে হারিয়ে যাবার জন্য।

এভাবেই একসময় রাত এগারোটা বাজবে। বাইরের নষ্ট স্ট্রিটলাইটটা জ্বলতে-নিভতে শুরু করলে রুমানা ভয় পাবে, সে আতঙ্ক নিয়ে বলবে ওর ঘরে ও কোন আওয়াজ পাচ্ছে। সমস্ত অভিমান ভুলে সে ফাহিমকে ডাকতে থাকবে, আর ফাহিম “আসছি” বলে আবার মন দেবে অন্য কোন গল্পে।

মন দেবে অন্য কোন গল্পে, অথবা পরীর চিন্তায়। এতবছর হয়ে গেলো, কিন্তু পরীকে ফাহিম ভুলতে পারে নি। বয়সন্ধিকালের ফ্যান্টাসি বলেই কিনা কে জানে, সেই নারীদেহের প্রতিচ্ছবি এখনো ভাসে ফাহিমের চোখে, চোখে ভাসে ওর ঠোঁটের ডান পাশে সেই ছোট্ট কালো তিলটাও।

এক বৃহস্পতিবার রাতে পরীর সাথে ফাহিমের আবার দেখা হয়ে গেলো – হঠাৎ করেই, প্রায় বিশ বছর পর।

সেই সন্ধ্যায় পর্তুগাল থেকে এক পার্টি এসেছিলো ফাহিমদের অফিসে। তাদের সাথে ডিল ফাইনাল করতে করতে রাত হয়ে গেলো এগারোটা। ওদের বিদায় করে, সব কাগজ-পত্র গুছিয়ে তারপর সাড়ে এগারোটায় রাস্তায় নেমে ফাহিম দেখে রাস্তা একদম ফাঁকা। তখন ওর মনে পড়লো, কাল হরতাল বলেই হয়তো রাস্তায় লোকজন কম। অনেক কষ্টে এক রিক্সা পাওয়া গেলো, চালক বয়স্ক এক বেচারা। ফাহিম দাম-দর না করে উঠে গেলো সে রিক্সায়।

রমনা পার্কের সামনে নষ্ট একটা লাইটের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই রিক্সার গতি কমে গেলো। ফাহিম দেখলো, বুড়োর অনেক কষ্ট হচ্ছে গাড়ি টানতে – হঠাৎ করেই যেন ভীষণ ভারী হয়ে গেছে রিক্সাটা। ফাহিম জিজ্ঞেস করলো, উনি একটু জিরিয়ে নিতে চান কিনা। উত্তরে বুড়ো বললেন – উনি আয়াতুল কুরসী পড়ছেন, সুতরাং ভয়ের কিছু নেই।

কি হচ্ছে ফাহিম কিছুই বুঝতে পারছিলো না, কিন্তু সে লক্ষ্য করলো ওদের বাসার গলির সামনে মসজিদের গেটটা পার হওয়ার সময় হঠাৎই রিক্সাটা আবার হালকা হয়ে গেলো, আর তখনি দীর্ঘ একটা ছায়া যেন দ্রুত ওদের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেলো। রিক্সাভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢোকার সময় ওর মনে হলো, দেয়ালে যেন ও নিজের দুইটা ছায়া দেখছে – যেন এক মানুষ দুই ছায়া নিয়ে ঘরে ঢুকছে ।  

ঘরে ঢুকে ফাহিম দেখে সব লাইট নেভানো, তার মানে রুমানা শুয়ে পড়েছে। সারাদিন ছোটাছুটির পর ফাহিম এত ক্লান্ত ছিল যে ড্রইংরুমের বেতের ডাবল সোফাটাতেই সে ধপ করে বসে পড়লো, আর তখনি সে দেখলো পাশের সিঙ্গেল সোফাটায় জমাট অন্ধকার হয়ে এক নারী মূর্তি বসে আছে। ফাহিম ধড়মড় করে উঠে বসতেই মেয়েটা খিল খিল করে হেসে উঠলো, আর ফাহিমও সাথে সাথেই বুঝে ফেললো কে ফিরে এসেছে আবার ওর স্রোতহীন জীবনে – ঠোঁটের ডান পাশে অনিন্দ্যসুন্দর কালো একটা তিল নিয়ে।   

৫ 

সেই থেকেই শুরু।

এর পর থেকে প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার পরী এসে ফাহিমকে দেখা দেয়। সন্ধ্যার পর মাগরেবের আজানের ধ্বনি বাতাস থেকে মিলিয়ে যেতেই ফাহিম উত্তরদিকের জানলাটা খুলে দেয়, যেন কোন গুবরে পোকা কিংবা কোন সাপের আকৃতি নিয়ে পরী ঘরে ঢুকে যেতে পারে। সেই বৃহস্পতিবারগুলোতে ফাহিম ইচ্ছে করেই রুমানার সাথে ঝগড়া বাঁধায়, যেন রুমানা রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে যায় আর না হয় ফাহিম রাগারাগি করে তার স্টাডি রুমে এসে রাত কাটাতে পারে। তারপর সে রাতে ফাহিম সারা রাত পরীকে দেখে নয়ন ভরে, আর দেখে তার ঠোঁটের ডান পাশের সেই কালো তিল।  

কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ফাহিমের সন্দেহ হলো, পরী আসলে ওদের বাসাতেই থাকে। মাসের শেষ বৃহস্পতিবার শুধু না, প্রতি রাতেই পরী ওর আশে-পাশেই ঘোরা-ফেরা করে। ওর সন্দেহের কারণ ছিল রুমানার আচরণ। মেয়েটা সন্ধ্যা হতেই কেমন যেন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে, বেডরুমের দেয়ালে আর বাথরুমের মেঝেতে সে নাকি একটা কুৎসিত মহিলার চেহারা দেখতে পায়।   

ফাহিম বুঝতে পারে না, রুমানা কেন দেয়ালে ভয়ঙ্কর একটা চেহারা দেখে। এটার কারণ যদি পরীই হয়, তাহলে তো রুমানার সুন্দর একটা চেহারা দেখার কথা।

এক শনিবার শেষ রাতে রুমানা এতো ভয় পেলো যে ওর জ্বর এসে গেলো। সেরাতে ফ্রিজ থেকে পানি আনতে গিয়ে সে দেখে, ফ্রিজের দরজা আটকে রেখেছে একটা নুপুর পরা পা, কিন্তু সেখানে হাটু পর্যন্ত একটা লম্বা কালো পা ছাড়া আর কিছু নেই – পায়ের মালকিন অনুপস্থিত। সেবার রুমানা বেচারী জ্বরে ভুগলো পুরো পাঁচ দিন।

সবকিছুর পরও ফাহিম মাসের শেষ বৃহস্পতিবারের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। ওর একঘেয়ে জীবনে ওটাই একমাত্র বিনোদন, চরম বিনোদন। সেদিন সন্ধ্যা হতেই তার স্টাডিরুম সে ঢেকে দেয় লাল পর্দা দিয়ে, বিছানায় বিছায় লাল চাদর, তারপর সারা ঘরে ঠিক ছয়টা সাদা মোমবাতি জ্বালিয়ে অপেক্ষা করে পরী দেখা দেবে বলে। ও আসার চিহ্ন হলো মোমবাতিগুলো একসাথে নিভে যাওয়া, আর তারপর হাজারো নীল ছবির বাস্তব হয়ে ওঠা – সেই অন্ধকার ঘরে।

ফাহিম তাকে একদিন বললো – “তুমি কাছে এলে আমার এমন নেশা নেশা লাগে কেন?” 

সে চোখ ছোট করে ফেললো, তারপর হেসে ফিস ফিস করে বললো – “কালো জাদু।”

পরী এভাবে সামান্য কয়েকটা শব্দেই কথা বলতো – কথা বলার সময় ওর ঠোঁট দুটো নড়তো না, তবুও কেমন করে যেন ওর ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠটা ফাহিম শুনতে পেতো নিজের মাথার ভেতরে।  

সেসব দিনগুলোরই এক বৃহস্পতিবার রাত-দুপুরে ঘন্টাখানেক টানা প্রেম করার পর পরীকে জড়িয়ে ধরে ফাহিম বললো – “আমি তোমাকে প্রতিদিনই পেতে চাই।” কিন্তু পরী রুমানার ছবিটা দেখালো আঙ্গুল উঁচিয়ে, বোঝাতে চাইলো ফাহিম বিবাহিত বলে সে ওর সাথে প্রতিদিন দেখা করতে পারবে না। 

ফাহিমের মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। তবু সে বললো – “আমি তো ওকে ছেড়ে যেতে পারবো না, ও এসব করছে শুধুই একটা মানসিক রোগের কারণে। ওর যদি আজ ক্যান্সার হতো, আমি কি ওকে ছেড়ে চলে যেতে পারতাম?” উত্তরে পরী বললো – “শাস্তি দরকার”। ফাহিম তাতে কিছুটা হলেও অস্বস্তি বোধ করে।  

আরেকবার ফাহিম পরীকে জিজ্ঞেস করেছিলো – “তুমি এত সুন্দর কেন?” উত্তরে সে রিনঝিন হেসে বলেছিলো – “চোখের ভুল।”

ফাহিমও জানতো বুঝতো, অশরীরীটা ওর চোখকে ফাঁকি দিচ্ছে, ফাহিমের মস্তিষ্ক চষে বেরিয়ে সে খুঁজে বের করেছে সেইসব নারীর চেহারা – যাদেরকে ফাহিম দেবীর আসনে বসিয়েছিলো জীবনের কোন না কোন সময়, তারপর সেই চেহারা ও বসিয়ে দিয়েছে নিজের রোমশ মুখের ওপর – যদিও ফাহিমের তাতে কিছুই যায় আসে না, চেহারা সুন্দর দেখা গেলেই আপাতত ওর চলে। আর সেই সাথে যদি থাকে ঠোঁটের ডানপাশে কালো একটা তিল, তাহলে তো কথাই নেই।

সে বছর মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় রুমানা বিছানার চাদর পাল্টাতে গিয়ে তোষকের নিচে খুঁজে পেলো চার চারটা তাবিজ। বিছানার চার কোনায় সুতা দিয়ে আটকানো ছিল ওগুলো।

ঝিলপাড়ের মাজারে বসতো রহিম মিয়া, সে টুকটাক ঝাড়-ফুকের কাজ করতো পান বিক্রির পাশাপাশি – সাইড বিজনেস হিসেবে। বুধবার বিকেলে তাকে জরুরি ভিত্তিতে ডেকে আনার পর সে তার যন্ত্র-পাতি দিয়ে তাবিজ খুললো, সেটা থেকে বের হলো দুর্গন্ধ আর পচে যাওয়া কিছু কাগজ যাতে হাবি-যাবি কি যেন সব লেখা।

চোখ বন্ধ করে আগরবাতির ধোঁয়ায় প্রায় অদৃশ্য হয়ে বসে ‘ইস্তিখারা’ করে রহিম মিয়া জানালো – এই তাবিজ কোন মানুষে করে নি, এটা করেছে এক খবিস-খন্নাসি। ‘খবিস-খন্নাসি’ কি সেটা জানতে চাইতেই সে বললো – এগুলো বদমাইশ নারী জ্বীন, যারা মাথা নষ্ট করে দেয় ঐসব যুবকের যারা স্ত্রী-সহবাস করে ফরজ গোসল করে না আর প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে নখ কাটে না বলে যাদের নখের নিচে কালো নাপাকি জমে যায়।

ফাহিমের বুঝতে বাকি রইলো না, পরীই এগুলো করেছে – হয়তো ফাহিমকে চিরতরে পাওয়ার জন্যই তাবিজ-কবজের আশ্রয় নিয়েছে, কুফরী কালাম করেছে রুমানাকে। অথবা হয়তো ফাহিমকে খামোখা যন্ত্রনা করে বলে রুমানাকে সে ফাহিমের হয়ে শাস্তি দিতে চেয়েছে। ফাহিম  আর রুমানার মধ্যে তিক্ততা বাড়ার কারণও সম্ভবত এই কালো জাদু। আর কে না জানে, প্রাচীন ব্যাবিলনে হারুত আর মারুত ফেরেশতা মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য যে জাদু শেখাতো, তার কিছু কিছু ফাঁস হয়ে গিয়েছিলো খারাপ জীনদের মধ্যেও। হতেও পারে, ফাহিমের পরিবার হয়েছে এসবেরই সর্বশেষ শিকার।

রহিম ওঝা আরো বললো – এই খন্নাসি থেকে খুব সাবধান, এই জাতটা একাকী পুরুষদের শিকার করে তারপর তার শরীর দিনের পর দিন ধরে শুষে শুষে খায়। ওই বেচারা যখন অকালবৃদ্ধ হয়ে মরণাপন্ন হয়, তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে খন্নাসি আবার খুঁজতে শুরু করে নতুন শিকার – আধো-অন্ধকার গলিগুলোর ঠিক মাঝখানটাতে অথবা সন্ধ্যার খোলা ছাদগুলোতে হেটে বেড়ানো একাকী যুবকদের।

রহিম কবিরাজ ফাহিমকে একটা কবজ দিলো ঘরে ঝুলিয়ে রাখার জন্য, পাঁচশো এক টাকা দিয়ে ফাহিমকে ওটা আদবের সাথে বুঝে নিলো, তারপর ওঝা চলে যাওয়ার সাথে সাথে ওটা বাথরুমের কমোডে ফেলে দিয়ে ফ্ল্যাশ করে দিলো যত্ন করে। 

ফাহিমের আসলে এছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। পুরো বিষয়টা বুঝতে পারলেও ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে – সে পুরোপুরি বাধা পড়ে গেছে পরীর প্রেমের জালে। ছোটবেলায় তাবিজ-কবজের কারণে পরীকে একবার হারিয়েছে বিশ বছরের জন্য, আরেকবার তার জীবনে একই রকম দীর্ঘ বিরহের পর্ব দেখার সাহস তার আর ছিল না।

এদিকে সে রুমানাকেও ছেড়ে দিতে পারছিলো না, কারণ সে তো কোন দোষ করে নি। সে শুধু ছিল একজন মানসিক রোগী, যদিও সেই রোগজনিত সন্দেহ দিনের পর দিন ওদের সংসারকে কুরে কুরে খেয়ে নিচ্ছিলো।    

সব মিলিয়ে ফাহিমের দিন কাটতে লাগলো সিগারেট আর দুশ্চিন্তায়, আর রাত কাটতে লাগলো নির্ঘুম কিংবা দুঃস্বপ্নে বিভোর হয়ে। এভাবে আরো প্রায় মাস দুয়েক কাটানোর পর ফাহিমকে শেষপর্যন্ত সেই কঠিন সিদ্ধান্তটাই নিতে হলো।

সেটা ছিল আগস্ট মাসের শেষ বৃহস্পতিবার। রুমানা সে রাতে বাসাতেই ছিলো। মেয়েটা ঘুমিয়ে যেতেই ফাহিম সারা ঘর ঢেকে দিলো লাল পর্দায়, যেন বাইরের কোন আলো লালচে না হওয়া পর্যন্ত ঘরের ভেতর প্রবেশাধিকার না পায়। সন্ধ্যায় বিছানায় লাল চাদর আর লাল বালিশের কাভার দিয়েছিলো সে আগেই, মোজাইক করা মেঝেতে জ্বালিয়ে দিয়েছিলো ছয়টা সাদা মোমবাতি। 

সারা রাত অপেক্ষার পর ভোর ঠিক সাড়ে পাঁচটায় পরী এলো। ফাহিম নিশ্চিত হলো, যখন সে দেখলো সবগুলো মোমবাতি একসাথে নিভে গেছে। বিছানায় রুমানাকে দেখে পরী একটু পিছিয়ে গেলো, কিন্তু ফাহিম ওর রোমশ হাত দুটো ধরে ওকে নিয়ে গেলো বিছানার পাশে – যেখানে রুমানা তখনো বিশ্রীভাবে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলো।        

ফাহিম জানতো, সে যা করতে যাচ্ছে তার একমাত্র ফলাফল ওর অকালমৃত্যু। সে জানতো, প্রেম করতে করতে ফাহিমের শরীর খুব শীঘ্রই একসময় নিঃশ্বেষ করে দেবে না-মানবী না-অশরীরী এই উর্বশী। কিন্তু ফাহিমের এসব নিয়ে তখন চিন্তা করার কোন অবকাশ ছিল না – জীবনটা কয়েকদিনের, নিজের বুদ্ধি দিয়ে ফাহিম ওটাকে চূড়ান্ত ভাবে ভোগ করবে, এর বেশি সে কিছু ভাবতে পারছিলো না।

পরী কিন্তু ঠিক ঠিকই ফাহিমের ইঙ্গিত বুঝতে পারলো, সে জানতো তাকে ঠিক কি করতে হবে। সে রুমানার নাকের কাছে পাশবিক মুখটা নিয়ে কিছুক্ষন ওর  নিঃশ্বাসের সাথে নিজের প্রশ্বাস মেলালো, তারপর হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে গেলো ফাহিমের চোখের সামনে থেকে।

ছয়টা মোমবাতি আবার জ্বলে উঠলো একসাথে, আর জানালা থেকে খসে পড়লো লাল সবগুলো পর্দা। ঘরে প্রবেশ করলো সকালের শুভ্র আলোর স্রোত, আর সেই উজ্জ্বলতায় ফাহিম দেখলো – ওর বিছানায় রুমানার জায়গায় শুয়ে আছে সম্পূর্ণ অন্য এক নারী, যার পটে আঁকা ছবির মতো চেহারা পরী নামের সেই অশরীরিণীর মতো হুবহু একইরকম। এমনকি তার অনিন্দ্যসুন্দর ঠোঁটের ডানদিকে ছোট্ট একটা কালো তিলও ফাহিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিতে লাগলো।

Leave a comment