অস্তিত্ববাদী জাহিদের পরাবাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো

অস্তিত্ববাদী জাহিদের পরাবাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো : পর্ব 

মতি মিয়া বুঝতে পারছিলো তার সময় শেষ হয়ে এসেছে।

ওস্তাদ শমসের আলীর কাছে সে যখন কালো জাদু শেখা শুরু করে, তখন থেকেই সে জানতো এর শেষটা ভালো হবে না। কিন্তু তার যেন কিছুই করার ছিল না, যেন তাকে এটা করতেই হতো।  এ যেন এক নেশা, তাই কিছুতেই এর থেকে তার মুক্তি নেই। অথবা সে যেন এক নাচের পুতুল, আর অন্য কেউ সুতো দিয়ে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাকে।

কফটা বেড়েই চলেছে। একেকবার মনে হচ্ছে কাশির সাথে ফুসফুসটা পুরোটাই বের হয়ে আসবে। শেষবারের মতো চোখ বন্ধ করার আগে আয়নাটা চোখে পড়লো মতির।

বেশ দামি এক আয়না, দেখেই বোঝা যায়। কালো কাঠের ফ্রেমে কি সুন্দর কারুকাজ করা ! আর গ্লাসটা যেন কাঁচ না, গোপন কোন পৃথিবীর গভীর এক দীঘির কাকচক্ষু নিটোল জলপৃষ্ঠ যেন ওটা।

ওস্তাদ শমসের তাকে আয়নাটা দিয়ে গিয়েছিলো পালিয়ে যাওয়ার আগের রাতে। দেয়ার সময় বলেছিলো – “মতি, তরে এইডা দিয়া গেলাম। স্পিশাল জিনিস, মনে রাখিস।”

“স্পিশাল জিনিস?”  

“হ। স্পিশাল জিনিস। এই আয়নার জান আছে।”

“জান আছে?” – মতি অবাক হয়েছিল। অনেক তন্ত্র-মন্ত্র শিখেছে সে ওস্তাদের কাছে, জাদু শেখার জন্য ভয়ঙ্কর জঘন্য সব কাজ করেছে সে জীবনে। কিন্তু এরকম আজব কথা আজ পর্যন্ত শোনে নি সে।

“সব কিছুরই জান আছে। আমরার যেই সাধনা, হের শেষ ঘাঁটি হইলো পাথ্থরের ভিতর থিকা জান টাইনা বাইর কইরা আনা। আমি পারলাম না, তুই পারবি।  তুই এলেমদার আসোত।”      

“সব কিছুরই জান আছে?” – মতির বিস্ময় যেন কাটে না। 

“আমাগো নবীর লগে ওহুদ পাহাড় কথা কইছিলো, জান না থাকলে পাহাড় কথা কইতে পারতো? তুই এইডা যত্ন কইরা রাখবি। মরার আগে তোর সাগরেদরে বুঝাইয়া দিয়া যাবি। পারবি না?”

মতি সেদিন অনিশ্চিতভাবে মাথা নেড়েছিলো। কিন্তু সে সাগরেদ জোগাড় করতে পারে নি। আজকালকার দিনে পোলাপান কষ্ট করতে চায় না, সাধনা তো দূরের কথা। সারাদিন এরা এক যন্ত্রের মধ্যে মাথা গুঁজে পড়ে থাকে, আর শুধু বড় বড় কথা বলে। আরে, অন্ধকার দুনিয়ার জ্ঞানও তো  একরকম বিজ্ঞানই – পরিশ্রম না করলে, ত্যাগ স্বীকার না করলে এর আদ্যোপান্ত তারা জানবে কি করে !

রুমন নামে বড়োলোকের এক ছেলেই শুধু কয়েকদিন মতি মিয়ার সাথে শক্ত করে লেগে ছিল। ছেলেটার সাহস ছিল, গোরস্থান থেকে কবর খুঁড়ে চুরি করে এনেছিল যক্ষা রোগে মারা যাওয়া এক মহিলার মাথা। সেটাতে তখন চামড়া আর চুল ছিল ঝুলে, দিব্যি ওই মাথায় চোলাই মদ ঢেলে ঢক ঢক করে খেয়ে নিলো ছোকরা।

এই নিষ্পাপ চেহারার রুমন ছেলেটাকে নিয়ে খুব আশাবাদী ছিল মতি, কিন্তু সেও টিকলো না বেশিদিন। যেদিন মতি জানতে পারলো, এক মেয়েছেলেকে বশ করার জন্য ছোকরা জাদু শিখছে, সাথে সাথে তাকে সে বের করে দেয়। নারীর নেশা যে ছাড়তে পারে নাই, সে কি সাধনা করবে?

শেষ নিশ্বাস ত্যাগের আগে কয়েক মুহূর্তের ভেতর সবগুলো দৃশ্য যেন সিনেমার দৃশ্যপটের মতো ভেসে উঠলো মতি মিয়ার চোখের সামনে।

আয়নাটা নিয়ে সে চেষ্টা কম করে নি। একজন কালো জাদুকর যা যা করতে পারে, তার সবই সে করেছ। কিন্তু আফসোস – না সে তার প্রেতসাধনার ফলাফল দেখে যেতে পারলো, না তার পরিশ্রমের ফসল কারো হাতে তুলে দিয়ে যেতে পারলো। 

মতি মিয়া চোখ বুজে ফেললো, সব ভুলে নিজের শরীরের দিকে মন দিতে চেষ্টা করলো। তার মৃত্যু শুরু হয়ে গেছে, পা থেকে মৃত্যুযন্ত্রণা অমোঘ নিয়তি হয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার বুকের দিকে। তা মনে হচ্ছে কেউ যেন তার শরীরের মাংস আর চামড়া টেনে ছিলে নিচ্ছে। দম বন্ধ করে সে অপেক্ষা করতে লাগলো যন্ত্রনাটা বুক পর্যন্ত আসার জন্য। তারপরই তো সব শেষ হয়ে যাবে, যদিও সেই যন্ত্রণার রেশ তাকে তারা করে ফিরবে মৃত্যু-পরবর্তী পঞ্চাশ বছর।

আয়নাটা তখন যেন মতি মিয়ার দিকেই অপলক তাকিয়ে ছিল।    

আয়না।

ভিনিসিয়ান এক আয়না।

কারুকাজ করা কালো কাঠে বাধাই করা প্রাচীন ধাঁচের এক আয়না। 

স্মৃতি আর বিস্মৃতির একটা অদ্ভুত একটা চক্রের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো আয়নাটা, ছোট ছোট অসংখ্য জীবনকে অনুভব করতে পারছিলো সে – নিজের ভেতর।

কোন জীবনে সে এক যুবক, অফিসে যাওয়ার আগে চুল আচড়াচ্ছে।

আরো কোন এক জীবনে সে এক অষ্টাদশা কুমারী, ঠোঁটে লিপস্টিক মাখছে আর কি ভেবে যেন মিটি মিটি হাসছে। 

অন্য কোন জীবনে আবার সে এক বৃদ্ধা, নিজের বিগত যৌবনের কথা ভেবে যে হু হু করে কেঁদে ওঠে। 

আরো এক অদ্ভুত জীবনে সে হয়েছিল বাউল, জলসার প্রস্তুতির জন্য যে গাইছিলো রহস্যময় এক গান –

“কে কথা কয় রে, দেখা দেয় না;

নড়ে-চড়ে হাতের কাছে,

খুঁজলে জনম ভর মেলে না”

এরকম আরো কত জীবন! মিনিট খানেকের জীবন, তবুও কত মধুর এ বেঁচে থাকা, কত চাঞ্চল্যকর কিছু না কিছু একটা অনুভব করতে পারা !

প্রতিবার যখন এরকম একটা কিছু হয়, আর সে জীবন খুঁজে পায়, আয়না ভাবে – আমার ভেতর কে যেন নড়াচড়া করে ! আমি বোধহয় জীবিত তাহলে, এ কাঠ নিয়েই আমার শরীর; আর নড়াচড়া করছে যে জিনিসটা – ঐটাই আমার আত্মা।

কিন্তু ভেতরে নড়াচড়া করা জিনিসটা যেমন হঠাৎ করে আসে, তেমনি হঠাৎ করেই চলে যায়। ফলে রহস্যের সেই আয়না বার বার জীবিত হয়, তারপর আবার অতর্কিতেই বার বার আবার মরে যায়।

জীবন-মৃত্যুর অবিরাম এক চক্রের এই রহস্যটার পাঠোদ্ধার বেচারি আয়না কিছুতেই করে উঠতে পারে না।

রিক্সায় বসে থেকে জাহিদ অসম্ভব ক্লান্তি অনুভব করছিলো। যতবার কপাল থেকে ঘাম বেয়ে ওর ভারী কালো ফ্রেমের চশমার কাঁচে পড়ছিলো, ততবার তার নিজেকে চরম ব্যর্থ মনে হচ্ছিলো। 

আজ চাং-পাই চাইনিজে তার সংবাদ সম্মেলন পুরোই ভণ্ডুল হয়ে গেছে। এত গবেষণা করে, এত পরিশ্রম করে সে তার স্বপ্নের “ঢাকা ঘোষণা”-টার খসড়া তৈরী করলো – অথচ সেটা অর্ধেক পড়তে না পড়তেই তিনজন সাংবাদিকের মধ্যে দুজন রুম থেকে ত্রস্তে বেরিয়ে গেলো।

কালান্তরের আসিফ ছেলেটা যাও বা রইলো, বার বার সে ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগলো আর হাই তুলে চললো। ঘোষণা পড়া শেষ হতে না হতেই সে জানতে চাইলো – খাবার কখন দিবে।

অথচ জাহিদের ধারণা ছিল, এইটা হতে যাচ্ছে ঢাকা শহরের প্রথম দার্শনিক আন্দোলনের এক শুভ সূচনা। তার বিশ্বাস ছিল, ‘ধর্মান্ধ’ সাধারণ মানুষের দল না বুঝলেও ‘মুক্তমনা’ সাংবাদিক সমাজ তার স্বপ্নটাকে নিজেদের মধ্যে ক্ষনিকের জন্য হলেও ধারণ করতে পারবে। কিন্তু তার পুরো চিন্তাটাই সম্ভবত ভুল ছিল। মাঝখান থেকে নিজের পকেট থেকে চলে গেলো কষ্টের কয়েক হাজার টাকা।

জাহিদ বুঝতে পারে না, সেকুলার বাঙালি কেন মেনে নিতে পারবে না যে ঈশ্বর মৃত। ফ্রেডেরিক নিৎসে তো সেই ১৮৮৮ সালে ইয়োরোপে ঈশ্বরকে মৃত ঘোষণা করতে পেরেছিলেন, কিন্তু এ বিষয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ এখনো কেন এত পিছিয়ে থাকবে – সে ঠিক বুঝতে পারে না। 

অথচ সেকুলার সমাজব্যবস্থার কারণেই পাশ্চাত্য বিশ্ব আজ উন্নতির শিখরে, আর ধর্মীয় আবেগ আঁকড়ে ধরে রাখার কারণেই আমরা আজও এত পিছিয়ে। আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত তার নিজস্ব গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় হানাহানির মূল কারণ রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈজ্ঞানিক সত্যকে প্রাচীন সব ধর্মের বাণীর ওপর স্থান না দেয়া।

পুরো ব্যাপারটাই চরম হতাশার জাহিদের জন্য, খুব খারাপ একটা দিন আজ।

সিদ্ধেশ্বরীর কালীমন্দিরের সামনে রিক্সা থেকে নেমেই জাহিদের চোখ আটকে গেলো আনারকলি মার্কেটের নিচতলার ঘিঞ্জি দোকানগুলোর একটাতে। কালো কাঁচের দরজাটা দেখে তার মনে হলো, এখানে তো এই দোকানটা চোখে পড়েনি কখনো, এখানে তো এই দোকান থাকার কথা না। স্রেফ কৌতূহলের বশেই দোকানটাতে ঢুকে পড়লো সে সেই পড়ন্ত বিকেলে।

পুরোনো ফার্নিচারের দোকান একটা। ভেতরে ঢুকতেই নাকে ধাক্কা দিলো পোড়া কর্পূরের তীব্র গন্ধ। শূন্য পরিসরে সেই একমাত্র কাস্টমার, এমনকি কোন দোকানদারকেও দেখা যাচ্ছে না। টিমটিমে অল্প আলোতে প্রাচীন নক্সাকাটা কয়েকটা আলমারি, একটা সোফা সেট, আর অসংখ্য আয়না। সেগুলোর মধ্যে একটা স্টাইলিশ বনেদি তিন-ফিট-বাই-দুই-ফিট আয়নার দিকে তার চোখ আটকে গেলো।

ছমছমে ভুতুড়ে সেই পরিবেশে ওই আয়নাটা যেন তাকে সম্মোহিত করে ফেললো, তার মনে হতে লাগলো – ওটা কিনে না নিলে তার জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে। সে যখন ওটার দিকে তাকিয়ে, শূন্য থেকে যেন উদয় হলো এক সেলসম্যান, জাহিদের কাঁধে টোকা দিয়ে বললো – “ওটা সেলে আছে, মাত্র একশো এক টাকা। আপনার জীবন বদলে দেবে, স্যার।” জাহিদ পেছনে ফিরে দেখে, লম্বা একহারা গড়নের রোগা কালো একটা ছেলে, কথা বলার সময় যার কণ্ঠার হাঁড়ের ওঠা-নামা দেখতে পাওয়া যায়।

আয়নাটার ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলো না জাহিদ। সাত-পাঁচ ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, কিনবে সে ওটা। প্রাচীন টাইপের জিনিস ঘরের ভেতর দেখতে বেশ লাগে।    

আয়নাটা হাতে নিয়ে কাউন্টারে আসতেই দেখা গেলো, সেলসের ছেলেটা আবার উধাও হয়ে গেছে – যেন এখানে সে ছিলই না কোনোদিন। প্রায় মিনিট পাঁচেক ডাকাডাকি করেও যখন কাউকে আসতে দেখা গেলো না, জাহিদ অগত্যা একশো টাকার একটা নোট আর পাঁচ টাকার আরেকটা নোট কাউন্টারে রেখে আয়নাটা নিয়ে বেরিয়ে এলো।

এভাবে দাম দিতে হলো বলে চার টাকা বেশি দিতে হলো জাহিদ কে, কারণ তার কাছে ভাংতি এক টাকা ছিল না – কিন্তু কি আর করা! ওর অবশ্য ধারণা, তারপরও ওটা কিনে সে আজ ভালোই জিতেছে – আয়নাটা যে আসলে এর অন্তত দশগুণ বেশি দামি, এ বিষয়ে তার নিজের অন্তত কোন সন্দেহ নেই।

৪         

আয়নাটা বসার ঘরে একপাশে রেখে জাহিদ ফুলস্পিডে ফ্যানটা ছেড়ে দিলো, তারপর বেতের সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। আধো-অন্ধকার ঘরে ফ্যানের বাতাসে ঘাম শুকাতে শুকাতে কখন যে তার ঝিমানি এসে গেছে, সে নিজেও জানে না।

ক্লান্ত শরীর নিয়ে পুরোই ঘুমিয়ে পড়েছিলো জাহিদ। কিন্তু হঠাৎ করেই তার মনে হলো কেউ তাকে ডাকছে, ধড়মড় করে উঠে বসলো সে, আর তখনি লক্ষ্য করলো শব্দটা আসছে সদ্য কেনা আয়নাটার ভেতর থেকে।

বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, ঘরের ভেতর অন্ধকার বেশ গাঢ়। আচমকা ঘুম ভেঙে জাহিদ যখন এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, আয়নাটার ভেতর থেকে আবার কেউ কথা বলে উঠলো – হুবহু তার নিজের কণ্ঠে। 

“আমার অস্তিত্ব আছে।” – জাহিদ নিশ্চিত হলো, এটা তার নিজেরই গলা। সম্ভবত ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখছে সে, তা না হলে তো এরকম আজব ঘটনা ঘটা সম্ভব না।     

জাহিদ জানতো, এসব তার মনের ভুল – তবু সে কথা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। প্রথমে ভড়কে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে সে বললো – “তুমি একটা জড়বস্তু। সেই অর্থে তুমি আসলে মৃত। তোমাকে আমার মতো জীবিত কেউ বানিয়েছে।”

আয়না তখন আফতাবের সাথে তর্ক জুড়ে দিলো – “আমি যে জীবিত, তার প্রমান হলো – আমার ভেতর কিছু একটা নড়া-চড়া করছে।” 

জাহিদ তখন হেসে ফেলে বললো – “তোমার ভেতর যেটা নড়া-চড়া করছে, সেটা আমারই ছায়া। সুতরাং আয়না বাবাজি, তুমি যাকে তোমার অস্তিত্ব ভাবছো সেটা আসলে তোমার একটা বিভ্রম মাত্র। আসলে এই ঘরে আমি আর কয়েকটা মশাই শুধু জীবিত, আর তুমি হচ্ছো একটা আয়না মাত্র, বুঝলে বন্ধু?”  

“আমি তোমাকে ধরতে পারি না কেন, তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে পারি না কেন? তার মানে তুমি নিশ্চয়ই আমার দেখার ভুল – আমিই আছি, তুমিই নেই।” – দাম্ভিক আয়নাটা ওকে বলে সেই সে গভীর সন্ধ্যায়।

জাহিদের তখন মনে হলো, নিজের সাথে এই অসুস্থ খেলাটা বন্ধ করা প্রয়োজন। সে আয়নার সামনে থেকে সরে এলো, আর কি আশ্চর্য – আয়নাটাও কথা বন্ধ করে দিলো। ওটার সামনে গেলেই উন্মাদ এই আয়না ভাবে সে জীবিত, অদ্ভুত তো!

জাহিদ চিৎকার করে বলে উঠলো জনশূন্য ঘরের ভেতর – “এই যে আমি সরে গেছি, আর তোর কথাও বন্ধ হয়ে গেছে।  এখন প্রমান হলো তো, কে আসলে জীবিত আর কে মৃত?”

সে রাতে কোন কারণে জাহিদের ঘুম আসতে চাইলো না। সে কোন অবৈজ্ঞানিক জিনিসে বিশ্বাস করে না, তবু অজানা এক আতঙ্ক কেন যেন তাকে বার বার ঘিরে ঘিরে ধরতে চাইলো।

পরদিন জাহিদ আনারকলি মার্কেটের ওই চিপাগলিতে আবার আবির্ভুত হলো। সেই সেলসম্যানকে যদি খুঁজে পাওয়া যায়, হয়তো আয়নাটা সম্পর্কে আরো কিছু বাড়তি তথ্য জানা যাবে হয়তো। তাছাড়া টাকাটা যে সে কাউন্টারে রেখে চলে এলো, ওরা ওটা পেয়েছিলো কিনা সেটাও তো জানা দরকার। 

কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখা গেলো, ওই দোকানটা নেই। অদ্ভুত, পুরো দোকান যেন উধাও হয়ে গেছে ওটা এক রাতের মধ্যে। বা ব্যবসাটাই হঠাৎ গুটিয়ে গেছে – এক রাত্রে? কে বলতে পারে? মাঝখান থেকে ওর ঘাড়ে ওরা চাপিয়ে দিয়ে গেছে আস্ত এক কুসংস্কার।

এদিকে ঢাকা ভার্সিটির লেকচারার জাহিদের সেই “ঢাকা ঘোষণা” কোন পত্রিকাতে কেউ ছাপলো না, অথচ কেমন করে যেন তার এই সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে কিছুদিনের মধ্যেই তার নাম ধরে গালি দেয়া শুরু হল। ধর্মভীরু এক ইউটুবার তাকে “মুরতাদ জাহিদ” টাইটেল দিলো। এমনকি রাজধানীতে নতুন বাবা-মায়েদের মাঝে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর নাম হিসেবে ‘জাহিদ’ শব্দের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেল।

বদনামের পাশাপাশি জাহিদের আরেকটা যে জিনিস হলো – ভয়, জীবনের ভয়, সব কিছু হারানোর ভয়। সে যেখানে যেত, জাহিদের মনে হতো কে বা কারা তাকে অনুসরণ করছে – আলোতে ও অন্ধকারে, রাতে ও দিনে। রাস্তায় চলতে গিয়ে মনে হতো, কালো আলখাল্লা পরা কেউ তার পেছনে পেছনে আসছে। রাতে ঘরের লাইট নেভালেই মনে হয়, ঘরের এক কোনায় অন্ধকারটা একটু বেশি জমাট বাধা – কেউ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

তার খুব ভেতর থেকে অজানা কেউ বলতে লাগলো – তার মরণ ঘনিয়ে এসেছে, আর মরলেই শেষ পৃথিবীর সব মজা। চোখের আলো নিভলেই অবসান হবে চা-কফি, বিস্কিট-রুটি, নারী-পুরুষ, অস্তিত্ব-স্বাধীনতা, সব। অবস্থা একপর্যায়ে এত খারাপ হলো যে, রাতে ঘুমের জন্য চোখ বন্ধ করতে তার ভয় লাগতো – যদি সকালে ঘুম থেকে উঠতে না পারে, ঘুমের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় এই আনন্দঘন জীবন।

ঢাকা ভার্সিটির দর্শন বিভাগে ডক্টর আহমদুল কবির ছিলেন লেকচারার জাহিদের একমাত্র সিনিয়র বন্ধু। ভদ্রলোক জাহিদকে খুবই প্রতিভাধর বলে মনে করতেন, জুনিয়র কলিগ হওয়া স্বত্ত্বেও সম্মান করতেন তাকে পুরোদস্তুর।

সেই সোমবার বিকেলে টিচার্স ক্যান্টিনের পেছনের দিকের একটা টেবিলে জাহিদকে মনমরা বসে থাকতে দেখে তিনি এগিয়ে এসে বসলেন তার পাশে, কাঁধে হাত রেখে জানতে চাইলেন কি হয়েছে।

প্রথমে একটু গাই-গুই করলেও জাহিদ একসময় ডক্টর কবিরকে খুলে বললো তার সমস্ত আতঙ্কের কথা। এমনকি সে রাতে আয়নার সাথে তার অদ্ভুত কথোপকথনের বিষয়টাও বাদ গেলো না তার বর্ণনা থেকে।

কবির তাকে আশ্বস্ত করে বললেন – অতিরিক্ত চাপ থেকে মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখতেই পারে, সুতরাং আয়নার বিষয়টা নিয়ে চিন্তার আসলে কিছু নেই। তবে জাহিদকে চোখ-কান খোলা রেখে সাবধানে চলা-ফেরা করতে হবে, কারণ দেশে চরমপন্থী লোকের অভাব নেই।

সব কথা শেষে তিনি কণ্ঠস্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে বললেন – “কিন্তু চিন্তা করে দেখো, জাহিদ। এমন যদি হয়, আমাদের শরীরটা একটা আয়নার মতো, আর আমাদের আত্মা আসলে আয়নার ভেতর অন্য কারো ছায়া – যখন সে ছায়া আয়নার ভেতর নড়ে-চড়ে তখনি আমরা নিজেদের জীবিত ভেবে থাকি? কনশাসনেসের রহস্যও হয়তো এটা।”

জাহিদ কিছুই বললো না, শুধুই হাসলো। ভাববাদী এসব দর্শনে সে বিশ্বাস করে না।

“যদি সেটা হয়” – কবির বলে চললেন – “তাহলে কিন্তু আমরা আসলে মৃত, ডেডবডি কতগুলো, আর সেই মৃতদেহগুলোর অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় ইল্যুশন হলো যে তারা জীবিত – ঠিক তোমার ওই আয়নাটার মতো তারা ভুল করে ভাবছে যে তারা বেঁচে আছে, অথচ এরাই আবার  সাংবাদিক ডেকে নিজেকে জীবিত আর স্রষ্টাকে মৃত দাবি করছে।”

জাহিদ এবার খোঁচাটা বুঝতে পারলো – যেহেতু সে ঈশ্বরকে মৃত ঘোষণা করতে চেয়েছে, তাই কবির ভাই তাকে একটা থট এক্সপেরিমেন্ট দিয়ে ডেমোন্সট্রেশন দিলেন আর কি। সে এবার হেসে উঠো হো হো করে, কবির ভাইও সে হাসিতে যোগ দিলেন।

কিন্তু সে রাতে বাসায় ফিরে জাহিদের ভালো ঘুম হলো না। তার শুধু মনে হতে লাগলো – আধো-অন্ধকারের ভেতর থেকে কেউ তাকে দেখছে, আর যে কোন মুহূর্তে সেই অজ্ঞাতনামা তাকে এসে গলা টিপে ধরবে – সব মিলিয়ে আজকেই হবে তার জীবনের শেষ সকাল, আর হার্ট এটাক হয়ে কত মানুষই তো অকালে মারা যায়, তাই না?   

এদিকে বার বার তার চোখ চলে গেলো আয়নার দিকে, যদিও অস্বাভাবিক কিছুই ঘটলো না আয়নার পক্ষ থেকে – সে রাতে। 

পরদিন ছিল এক অদ্ভুত দিন – রাতে ঘুম ভালো হয় নি বলেই কিনা কে জানে – কার্জন হলের সামনে ভীষণ ভয় পেলো জাহিদ। রিক্সার  জন্য রাস্তার ধারে অপেক্ষা করছিলো সে। ঠিক সেই সময় সেই নির্জন দুপুরের রোদে ঘামতে ঘামতে তার মনে হলো, তিনজন যুবক তাকে অনুসরণ করছে। ছেলেগুলো ছিল জিনসের প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথায় গোল টুপি। হয়তো ওদের কাছে ধারালো অস্ত্র আছে, হয়তো রাম দা।

জাহিদ কেন যেন ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো, সে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে শুরু করলো। পেছনে ওরা আসছে কিনা দেখার জন্য যেই না সে পেছন ফিরেছে – অনভ্যস্ততার কারণেই হয় তো – ফুটপাতের ধাপ বুঝতে না পেরে হোঁচট খেয়ে ছিটকে মুখ থুবড়ে পড়লো রাস্তায়, আর তার মাথার ডানপাশটা বাড়ি খেলো সামনের ফুটপাতের কোনাতে। মুহূর্তের ভেতর জ্ঞান হারালো জাহিদ। 

জাহিদের মনে হলো তার শরীরটা মহাশূন্যের ভেতর ঝুলে রয়েছে। চারিদিকে অন্ধকার, তারমধ্যে একপাশের অন্ধকারটা বেশি গাঢ়। ভালো করে তাকাতেই জাহিদ বুঝতে পারলো, সে আসলে বিশাল এক কৃষ্ণগহ্বরের সীমানা থেকে শুধুই ওটার ভেতর থেকে আরো ভেতরে পড়ে যাচ্ছে, অনন্তকাল ধরে পড়ে যাচ্ছে। একসময় জাহিদের মনে হলো, তার শরীর কেউ টেনে লম্বা করে দিচ্ছে, একসময় সেটা সুতোর মতো সুক্ষ হয়ে যাচ্ছে।

যখন তার মনে হচ্ছিলো সে মরে যাবে, ঠিক তখনই সে নিজেকে আবিষ্কার করলো একটা অসীম বিশাল বদ্ধ ঘরে। ঘরের ভেতর অসংখ্য আয়না, পর পর সাজানো – আয়নাগুলোর ভেতর থেকে আলো আসছে, তীব্র চোখ ধাঁধানো আলো।

জাহিদের খুব ভেতর থেকে কেউ তাকে বলছিলো, ওই আলোটাকে ধরতে পারলেই ও আবার জীবন খুঁজে পাবে, আর ওটাকে স্পর্শ করতে না পারলে সে মৃতই থেকে যাবে। সে এগিয়ে গেলো ডানদিকে ওর ঠিক সামনের মানুষ সমান বড় আয়নাটার দিকে – ভিনিসিয়ান একটা আয়নাটা, কারুকাজ করা কালো কাঠের ফ্রেম, আর তার কাঁচ দীঘির জলের মতো নিটোল। 

কিন্তু যেই না ও আয়নাটার সামনে গেলো, জাহিদের নিজের চেহারা ভেসে উঠলো আয়নায় আর আলোর উৎসটা আড়াল হয়ে গেলো। ফলে আয়নায় সেই আলোটাকে ধরতে পারলো না সে।

সে আবার চেষ্টা করলো – এবার আয়নার বাঁ পাশ থেকে, কিন্তু ঘটলো একই ঘটনা – জাহিদের নিজের অস্তিত্বের ছায়াটাই আলো আর তার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াতে লাগলো।             

এভাবেই চলতে থাকলো, যেন চলবে তা অনন্তকাল ধরে – জাহিদ যতবারই পরবর্তী আয়নাটার সামনে যায়, কাঁচের ভেতরের ভীষণ তীব্র আলোটা ঢাকা পড়ে যায় ওর নিজের প্রতিবিম্বের আড়ালে। আর জাহিদও পাগলের মতো হাতড়াতে থাকে আয়নার এক পাশ থেকে আরেক পাশ, তারপর একসময় আবার ছুটতে থাকে এক আয়না থেকে আরেক আয়নায়।

আয়না থেকে আরেক আয়নায় মাথা কুটে মরা – এমন করে কতদিন চলেছে, জাহিদের মনে নেই।

কিন্তু একদিন হঠাৎ তার মনে হলো – এভাবে হবে না, এভাবে কোনোদিনই সে এখান থেকে বেরোতে পারবে না।         

ও বুঝতে শুরু করলো – এই জায়গা থেকে মুক্তি পেতে হলে আয়নার ভেতর আলোকে খোঁজার চেষ্টা ওর বন্ধ করতে হবে, কেননা ওর নিজের ছায়া সবসময়ই বাধা হয়ে দাঁড়াবে ওর আর আলোর মাঝে।   

আলোকে ছুঁতে হলে ওকে সরাসরি তাকাতে হবে আলোর দিকে, কিয়ের্কেগার্দের মতো নিতে হবে “লিপ অফ ফেইথ” – শুধুই বিশ্বাসের ওপর ভরসা করে আলো খুঁজতে হবে সেখানে যেখানে ওটা থাকার কথা না।

জীবনে প্রথমবারের জন্য সেবার জাহিদ যুক্তির সিঁড়িকে পাশ কাটিয়ে গেলো, শুধুই বিশ্বাসের পাখায় ভর করে করে ঝাপ দিলো অনন্ত সম্ভাবনার অতল কালো শূন্যতার এক গহ্বরে।

আয়নার ভেতর আলোর রেখা খোঁজা বন্ধ করে সে যখন ঘুরে দাঁড়ালো, আর তাকালো ওর ঠিক পেছন দিকে, তখন হঠাৎ করেই সে সেখানে দেখতে পেলো একটা হাসপাতালের বিছানা, যেখানে ওর শরীরটা শুয়ে আছে চোখ ধাঁধানো ধবধবে একটা বিছানায়, বেলি ফুলের মতো পবিত্র সাদা একটা পোশাক পরে।

বিভিন্ন টিউব আর তারের জালে বন্দি জাহিদের শরীরটার ওপর একজন ডিউটি ডাক্তার ঝুকে কি যেন দেখছিলেন। ওর মাথার কাছের মনিটর দেখে কি একটা দেখে নিয়ে তিনি লিখতে শুরু করলেন তার হাতের সাদা চার্টটাতে।

জাহিদ তখন অনুভব করা শুরু করেছে যে, ওই শরীরটা আসলে জাহিদ না, ওটা শুধুই হাড়-মাংসের একটা পিন্ড – অন্য সব প্রাণীদেহের মতোই সাধারণ ছোট-খাটো দুর্বল একটা দেহ, যদিও  ওটাকে মানুষ সাধারণত জাহিদ বলে ভুল করে থাকে।

সে আরো বোঝা শুরু করেছে যে – যদি জাহিদ বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব থেকেই থাকে, যদি সে একটা আস্ত বিভ্রম না হয়ে থাকে – তাহলে সত্যিকার জাহিদ আসলে এখানে একটা শূন্যতার ভেতর ঝুলে আছে, আর অন্য কোন আধ্যাত্মিক বাস্তবতা থেকে দেখতে পাচ্ছে নিজের ফেলে আসা শরীরকে – যেভাবে ময়লার ঝুড়িতে পুরোনো কাপড় ফেলে দেয়ার পর আমরা দেখতে পাই সেটার সমাপ্তিকে। 

সত্তরের দশকের মতো খোঁপা করে রাখা চুলে বড়ো একটা কাটা ঢোকাতে ঢোকাতে প্রৌঢ়া নার্স বললেন – “আজ উনচল্লিশ দিন হলো, ডাক্তার সাহেব।”

ডাক্তার হতাশভাবে মাথা নাড়লেন – “রাহেলা, আপনি তো জানেনই – মাথায় আঘাত পেলে মানুষ সেন্সলেস হতে পারে, কোমায়ও চলে যেতে পারে।”  

“হতে পারে, কিন্তু তাই বলে এতগুলো দিন ধরে?” – নার্স ভদ্রমহিলা ভুরু কুঁচকে বললেন।

অস্তিত্ববাদী জাহিদ যুক্তিবিদ্যায় তার সমস্ত পার্থিব পারদর্শিতা দিয়েও বুঝতে পারলো না, শরীরের বাইরে থেকে সে ঠিক কিভাবে নিজের শরীরকে দেখতে পাচ্ছে। শুধু ওর সপ্তম ইন্দ্রিয় তার চেতনার খুব গভীর থেকে কেউ তাকে জানিয়ে দিতে লাগলো, জীবিত হতে হলে কোনোভাবে ওকে ওর ফেলে আসা ওই শরীরের ভেতর ঢুকে যেতে হবে।

এটা দর্শনের কোন জার্নাল হলে ওকে উপসংহারে লিখতে হতো – সৃষ্টি হিসেবে মানুষ একটা নিরেট বর্ণিল পাথরের মতোই মৃত, যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ জীবনকে তার ভেতর জায়গা করে নিতে দেয়। আর যে মানবদেহকে জীবনকে ফুঁকে দেয় মায়ের গর্ভের ভেতরে, সে দৃশ্যমান পৃথিবীর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে – আর এজন্য সেই মহাশক্তিমান কোনোভাবেই মৃত হতে পারে না।

নিজের অবস্থাটা বোঝার সাথে সাথে জাহিদের আত্মার ভেতরটা কেমন করে যেন পাহাড়ি হ্রদের মতো শান্ত হয়ে গেলো, সে কৃতজ্ঞ এক চেতনা নিয়ে তার পুরো চল্লিশ দিনের অপেক্ষা পূর্ণ করলো। তারপর এক অতিলৌকিক অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথে নিজের শরীরের দিকে উড়ে উড়ে এগুতে শুরু করলো সেভাবে, ঠিক যেভাবে পশ্চিমের মেঘ থেকে ঠান্ডা একটা বাতাস ভীষণ গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরকে জুড়িয়ে দেয়ার জন্য বয়ে বয়ে চলে।

Leave a comment