মুসলমানের দীন-দুনিয়ার ব্যালেন্স কি হবে?

প্রশ্নগুলো সহজ (পর্ব ২)

চাকরি করে যারা, তারা প্রত্যেকেই জানে ‘ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স’ বলে একটা কথা আছে – অর্থাৎ বাসা আর অফিসের কাজের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে, অফিসে দিন-রাত পড়ে থাকলে চলবে না।

ধর্ম পালন করে যারা, তারাও প্রত্যেকেই জানে ‘দীন-দুনিয়ার ব্যালেন্স’ বলে একটা কথা আছে – কিন্তু এক্ষেত্রে কি আমরা আসলেও ভারসাম্য বজায় রেখে চলি? মসজিদে দিন-রাত পড়ে থাকাই কি ইসলাম?

ছোটবেলা থেকে বাঙালিদের শেখানো হয়:

– “মাটির উপরের জীবনের চেয়ে মাটির নিচের জীবন বেশি লম্বা” (যেন মৃতের আত্মা পচে যাওয়া দেহের সাথে ওই গোরোস্থানেই আটকা পড়ে আছে);

– “দুনিয়া আর আখিরাত হল পূর্ব আর পশ্চিমের মতো, যত পূর্ব দিকে যাবে পশ্চিম থেকে ততই দূরে সরে গেলে” (অথচ পৃথিবীটা গোল, ফলে পূর্বদিকে যেতে থাকলে একদিন আমরা পশ্চিমে গিয়ে উপস্থিত হবো কলম্বাসের মতো);     

– “এই দুনিয়া ফানা হবে, জেনেও জানো না”;

– “হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস” (যেন আখিরাত বলে কিছু নেই)।        

এদের কথা হলো – “সারাদিনে সাত ওয়াক্ত নামাজ পড়” (তাহাজ্জদ আর ইশরাক সহ), “জিহবা ভেজা রাখো জিকিরে”।

এদের অনেকেই বিশ্বাস করে – “রিজিকের মালিক খোদা, ভাগ্যে থাকলে এমনিতেই আসবে” (চেষ্টা করতে হবে না), “কপালে যা আছে, তা তো হবেই” (যেন দুনিয়াতে ভদ্রলোককে দর্শক করে পাঠানো হয়েছে)।

এই লোকসকল আসলে ধর্মের ‘রিচুয়াল’ মানে আনুষ্ঠানিকতার অংশটাকেই মূল-ধর্ম মনে করে।        

অন্যদিকে এইসব জীবনবিমুখ মতবাদের মনমরা বাণীতে কর্মে বিশ্বাসী অনেক মানুষ স্বাভাবিকভাবেই বিরক্ত হন আর ভাবেন ধর্ম জিনিসটাই আসলে সমস্যা। তারা তখন চলে যান আরেক চরম পন্থায়, বলেন – “আরে, নামাজ-কালামের দরকার নেই। সততা থাকলেই চলবে, ভালো কাজ করলেই হবে। বেঁচে থাকতে কারো ক্ষতি করবো না, পারলে উপকার করবো – তাহলেই আল্লাহ খুশি হবেন।”

ফলে আমার মতো সাধারণ বাঙালি মুসলমানের মনে প্রশ্ন থেকে যায়:

– কোন দলে আমরা নাম লিখাবো?

– ‘রিচুয়াল’ই কি মূল-ধর্ম? নাকি ‘কর্ম’ই সব?

আশার কথা হলো, একটা ছোট উপদল আছে যারা বলে:

– দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র, দুনিয়ার মাধ্যমেই আখিরাতকে পেতে হবে;

– হালাল উপার্জন, সন্তানের প্রতি ধৈর্যধারণ, আর স্ত্রীর সাথে সুন্দর ব্যবহারও বড় ইবাদত;

– বাড়তি নামাজ-রোজা না করেও বেহেশতে যাওয়া সম্ভব হতে পারে, যদি তার ঈমান-আকিদা ঠিক থাকে।

এই উপদলকে অনুসরণ করতে গিয়ে একটাই সমস্যা হয়েছে আমার ব্যক্তিগতভাবে – আনুষ্ঠানিকতাকে কম গুরুত্ব দিতে গিয়ে দেখলাম, আমি দুনিয়াদারীতে ডুবে যাচ্ছি, আমার মধ্যে খোদার স্মরণ আনুপাতিক হারে কমে যাচ্ছে।

অথচ পৃথিবীতে আমরা এসেছিই খোদাকে হৃদয়ে ধারণ করতে। আমাদের ধর্মেও আছে – যে খোদাতায়ালা আর তার রাসূল (সা:)-কে ভালোবাসে, তার কোন চিন্তা নেই।

আনুষ্ঠানিকতা না করলে কেন যেন খোদাতায়ালা আর তার রাসূল (সা:)-এর ভালোবাসা কমে আসে।

শেষপর্যন্ত মনে হলো – ভালো নিয়তে মানুষের কল্যাণ করার যেমন দরকার আছে, তেমনি দরকার আছে আনুষ্ঠানিক ইবাদতের।

নামাজ-রোজার মতো আনুষ্ঠানিকতা খোদা আমাদের দিয়েছেন, কারণ তিনি জানেন এগুলি ছাড়া তার বান্দা জীবনের মোহ আর মায়া থেকে বের হতে পারবে না।

দিনশেষে ইবাদত খোদাকে পাওয়ার পথ, গন্তব্য তো খোদার সান্নিধ্য – রিচুয়াল-কে তাই ব্যবহার করতে হবে মাধ্যম হিসেবে, নামাজ-রোজার ইবাদত করলে চলবে না।

নামাজ-রোজা সেই অর্থের আসলে বান্দা প্রতি খোদার উপহার – যেন আমরা পথভ্রষ্ট হয়ে না যাই।    

মুসলমানের দীন-দুনিয়ার ব্যালেন্স কি হবে, এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা কি তাহলে একটা ফর্মুলা অনুসরণ করতে পারি?
যে কাজ আপনাকে খোদার কথা মনে করিয়ে দেয়, সেটাই আপনার জন্য ইবাদত, আপনি সেটাকেই ম্যাক্সিমাইজ করুন:

  • সমাজসেবা করে যদি আপনার খোদার স্মরণ হয়, আপনি সেটাই বেশি বেশি করুন;
  • ধর্ম নিয়ে গবেষণা যদি আপনাকে খোদার নিকটবর্তী করে, সেটাতেই আপনার লেগে থাকা উচিত;
  • তেমনিভাবে মসজিদে পড়ে থেকে আর রিচুয়াল করেই যদি আপনার জিকির হয়, আপনি সেটাই করুন তবু খোদাকে মনে রাখুন।

আমি আবার ভুল বকছি না তো ভাই?

Leave a comment