প্রশ্নগুলো সহজ (পর্ব ৩)
১৯৮০ সালে জামিল ৩০০০ টাকা ধার দিলো আপনাকে। জামিল ধর্মভীরু – সে আপনাকে বিনা সুদে ধারটা দিলো, আর বললো যখন খুশি আপনি এটা শোধ করতে পারবেন। সেসময় আপনি গরিব ছিলেন, আর আপনার বন্ধু জামিলের অঢেল অর্থ ছিল।
২০২০ সালে এসে আপনার পরিস্থিতি বদলে গেছে। আপনি এখন আর গরিব নেই, একটা মাল্টিন্যাশনালে শীর্ষ পদে চাকরি করেন। হঠাৎ একদিন পুরোনো ডাইরি ঘটতে গিয়ে আপনার মনে পড়লো – ওহ হো, জামিলের ৩০০০ টাকা তো কখনো ফেরত দেয়া হয় নি। আপনি অনেক খুঁজে তাকে বের করলেন, কিন্তু আপনার মন খারাপ হয়ে গেলো যখন জানলেন – এর মধ্যে জামিলের অবস্থা ভীষণ খারাপ হয়েছে, পর পর কয়েকটা ব্যবসাতে সে পুরো ধরা খেয়ে সে একদম পথে বসেছে, নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা এখন তার।
আপনি মহানুভব, তাই জামিলকে বললেন – সে সময়কার তিন হাজার টাকা এখন কমপক্ষে ৩০,০০০ টাকা, তাই যে যেন আপনার কাছ থেকে পুরো ত্রিশ হাজার টাকা ফেরত নেয়। কিন্তু সে রাজি হলো না – যত কষ্টেই থাকুক সে সুদ নেবে না, তিন হাজার টাকার এক পয়সাও বেশি সে আপনার কাছ থেকে ফেরত নেবে না।
আপনারা দুজন ঢাকার একজন প্রখ্যাত মাওলানার কাছে গেলেন, তিনিও জামিলের মতোই বললেন – জামিল মাত্র তিন হাজার টাকাই ফেরত পাবে, তবে আপনি চাইলে বন্ধুকে সাদাকা করতে পারেন। জামিলের এখনো আত্মসম্মানবোধ যথেষ্ট আছে – সে ধৈর্য ধারণ করবে, কিন্তু পুরোনো বন্ধুর কাছ থেকে দান নেবে না।
আপনার কি মনে হয়? জামিলের প্রতি কি এখানে ন্যায্য আচরণ করা হলো? ১৯৮০ সালে তিন হাজার টাকা দিয়ে একটা মধ্যবিত্ত ছোট পরিবার এক মাস চলতে পারতো, ২০২০ সালে সেই পরিবার তিন হাজার টাকা দিয়ে তিন দিনও চলতে পারবে কিনা সন্দেহ।
তাহলে সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে?
ইসলাম কি আমাদের ভুল বিধান দিলো?
নাকি ইসলাম সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক বিধানই দিয়েছিলো, আমরাই আসলে ভুল করছি – সেই বিধানকে আক্ষরিক অর্থে নিয়ে, কিংবা তার ভুল অর্থ করে, তারপর সেই ভুল সংজ্ঞা জোর করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করতে গিয়ে?
চলুন অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করি।
প্রাচীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটা মৌলিক পার্থক্য হলো মুদ্রা। সে সময়ের মুদ্রা ছিল স্বর্ণ, রৌপ্য, এমনকি খেজুর – যেগুলোর নিজস্ব মূল্য ছিল। বিপরীতে, বর্তমান মুদ্রা হলো টাকা – যেটা একটা কাগজ, যার নিজস্ব কোন মূল্য নেই, সরকার এটার ওপর আইনের দোহাই দিয়ে একটা মূল্য আরোপ করেছে মাত্র। বছর বছর বেশি টাকা ছাপিয়ে যে মূল্য কমিয়েও ফেলা যায় – যার অপর নাম মুদ্রাস্ফীতি।
যারা আমার মতো অর্থনীতির ছাত্র, তারা সবাই খুব ভালো করে জানে – মুদ্রাস্ফীতি কি ভয়াবহ জিনিস। জিম্বাবুয়ে এই জিনিসের চরম রূপ দেখেছে, এখন আর্জেন্টিনা দেখছে। গত বছর আপনি যে ভোজ্যতেল ১০০ টাকা দিয়ে কিনেছেন, সেটা এই বছর কিনছেন ২০০ টাকা দিয়ে – অথচ আপনার বেতন বাড়ে নি।
গত বছর আপনি আপনার বন্ধুকে যখন ১০০ টাকা ধার দিয়েছিলেন, সে ওটা দিয়ে এক লিটার তেল কিনেছিলো। এ বছর সে যখন আপনাকে বিনা সুদে ১০০ টাকা শোধ করলো, ওটা দিয়ে আপনি কিনতে পারবেন মাত্র আধা লিটার তেল। এটা কি এমন না যে, আপনার বন্ধু আপনার কাছ থেকে ১ লিটার তেল নিলো, আর ফেরত দিলো মাত্র ১/২ লিটার। আপনার বন্ধু ধার্মিক, কিন্তু সে কি আপনার সাথে ইনসাফ করলো?
ভাই, এটাই মুদ্রাস্ফীতি। এটাই সেই জিনিস, যা প্রাচীন আরবের মুদ্রাব্যবস্থায় ছিল না কিন্তু এখনকার মুদ্রাব্যবস্থার বাস্তবতা।
শেখ ও মাওলানাদের কাছে একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমার প্রশ্ন:
- যে বিধান নবীজি (সা:) দিয়ে গেছেন দ্রব্যভিত্তিক মুদ্রাব্যবস্থার জন্য, সেই একই বিধান কি বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর প্রয়োগ করা যায়?
(উদাহরণস্বরূপ, গাধার জন্য যে ধর্মীয় বিধান, সে বিধান কি আপনি ঘোড়ার ওপর প্রয়োগ করতে পারেন – শুধু দুটোরই চার পা আছে বলে?) - বর্তমানে ইসলামিক মুদ্রাব্যবস্থা কি হতে পারতো?
ভুল বুঝবেন না, আমি সুদকে হালাল বলতে চাচ্ছি না – সুদ অবশ্যই হারাম।
আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, সেটা হলো – মুদ্রাস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে রিবার বিধানকে সম্ভবত নতুন করে দেখার সুযোগ আছে।
যেমন, আমরা যদি প্রথম উদাহরণে ফিরে যাই, আর বুঝতে চেষ্টা করি কি করলে আপনি আর জামিল তিন হাজার টাকা দেনার সেই সমস্যাটা এড়াতে পারতেন, তাহলে একটা জিনিস দেখবো। জামিল সে সময় আপনাকে “তিন হাজার টাকা বিনা সুদে ধার দিলাম” না বলে বলতে পারতো “তিন হাজার টাকা – অর্থাৎ তিন ভরি স্বর্ণের মূল্য পরিমান – ধার দিলাম” – সেক্ষেত্রে আপনি আজকে তাকে সেই পরিমান টাকা ফেরত দিতেন, যেই পরিমান টাকা দিয়ে বর্তমানে তিন ভরি স্বর্ণ কেনা যায়।
এই পদ্ধতি জাতীয় অর্থনীতিতেও প্রযোজ্য ছিল, সেই যখন উনিশশো ত্রিশের দশকে সরকার শুধু অতটুকু টাকাই ছাপাতে পারতো যতটুকু তার স্বর্ণের ভান্ডার ছিল। তাই সেই সময় অর্থনীতি আরো ভারসাম্যপূর্ণ ছিল, আর সেই সময় সুদের বিধান প্রয়োগ করাও সহজ ও যুক্তিযুক্ত ছিল।
অর্থনীতিকে ইসলামের সাথে মেলানোর অভিপ্রায়ে হলেও আমরা – মুসলিম দেশগুলো – কি সেই সময়ের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কাছাকাছি একটা কিছুটা ফিরে যেতে পারি?
