আর উত্তরও তো জানা (পর্ব ১)
যারা ধর্মত্যাগ করতে চাচ্ছেন, কিংবা যারা ইতোমধ্যে ঐশীবাদ পরিত্যাগ করে নব্য-নাস্তিক হয়েছেন, তারা তাদের মতের পক্ষে কিছু যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। তাদের বক্তব্যগুলোকে মূলত চারটা ভাগে ভাগ করা যায়। নিচে তাদের প্রতিটা যুক্তি আর তার সম্ভাব্য উত্তর তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।
১. নাস্তিকতার প্রথম আপত্তি: স্রষ্টা আছে, এর কোন প্রমান নাই।
উত্তর: প্রথমে দেখতে হবে, প্রমান বলতে আমরা কি বুঝি। মানুষের কাছে সেটাই প্রমান, যেটা সে তার ইন্দ্রিয় (চোখ, কান, ইত্যাদি) দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে পারে, আর যেটার তত্ত্ব সে পরীক্ষা করে সত্য বলে জানতে পারে। কিন্তু মানুষের পর্যবেক্ষণ শক্তি সীমিত (যেমন, আলোর গতি দিয়ে বাধা বলে আমরা চাইলেও এই ইউনিভার্সের বাইরে কিছু পরীক্ষা করতে পারি না), তার চিন্তাশক্তিও অসীম নয় (যেমন, আমরা অসীম কিছু কল্পনা করতে পারি না), তার জ্ঞান সসীম (যেমন, আমাদের গণিতেরও সীমাবদ্ধতা আছে)।
আমাদের জ্ঞানই যদি সীমিত হয়, তাহলে আমরা কি করে সেই জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে বলতে পারি – আমরা যা জানি, এর মধ্যেই সব আছে, এর বাইরে কিছু নেই?
আসলে এটা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে কোন যুক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারে না।
২. নাস্তিকতার দ্বিতীয় আপত্তি: যার প্রমান নাই, তা যদি আমরা মেনে নেই তাহলে তো সমাজে প্রচলিত সব কুসংস্কারকেও মেনে নিতে হবে, শুরু হবে বিশৃঙ্খলা আর অন্ধকার যুগ। প্রমান ছাড়া যদি ধর্মকে মানতে হয়, তাহলে সব ধর্মকেই (যেমন, পৌত্তলিক হিন্দু ধর্ম আর একত্ববাদী ইহুদি ধর্ম) একসাথে সত্য বলতে হবে – যদিও তারা পরস্পরবিরোধী হয়।
উত্তর: ধর্ম আর কুসংস্কার এক জিনিস না – পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলো টিকে আছে হাজার হাজার বছর ধরে, কিন্তু কুসংস্কারগুলো জ্ঞান বিকাশের সাথে সাথে সমাজ থেকে দূর হয়ে গেছে।
একই ভাবে ধর্ম আর ঈশ্বর এক জিনিস না – ঈশ্বর একজনই, বিভিন্ন ধর্ম তাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছে (কেউ ঠিক ব্যাখ্যা করেছে, কেউ আংশিক ব্যাখ্যা করেছে, কেউ বা আবার ভুল ব্যাখ্যা করেছে)।
আপনি যদি কোন ধর্মের মধ্যে অসঙ্গতি খুঁজে পান, সেটা সেই ধর্মের সমস্যা, কিংবা সেই ধর্মকে বোঝার বা ব্যাখ্যা করার সমস্যা – এর সাথে স্রষ্টার থাকা না থাকার কোন সম্পর্ক নেই।
৩. নাস্তিকতার তৃতীয় আপত্তি: খোদা যদি ন্যায়বিচারক আর দয়াময় হয়, তাহলে পৃথিবীতে নিষ্পাপ-নিরীহ জনগোষ্ঠীর এত দুঃখ-কষ্ট কেন?
উত্তর: প্রথম কথা হলো – এটা স্রষ্টার বিরুদ্ধে কোন প্রমান না, এটা একটা অভিযোগ মাত্র। আপনি যদি স্রষ্টাকেই না মানেন, তাহলে অভিযোগটা করছেন কার বিরুদ্ধে?
খোদা যেমন দয়াময়, তিনি তেমনি কঠোর বিচারক – এটা আমরা ভুলে যাই, জীবনে কষ্ট আসে দুইভাবে:
– আপনার কর্মফল হিসেবে (যেমন, অসাবধানে গাড়ি চালালে আপনার একসিডেন্ট হবেই);
– ভাগ্যের কারণে (যেমন, বন্যা, মহামারী, যুদ্ধ – যার ওপর আপনার হাত নেই)।
মনে রাখবেন, খোদা কিন্তু আপনাকে কষ্ট দিয়েও সাহায্য করতে পারেন, যেমন:
– কষ্ট কখনো কখনো আপনার ধৈর্যের পরীক্ষা, সে পরীক্ষায় পাশ করলে আপনার পুরস্কার আপনি খোদার সান্নিধ্য পাবেন (আর আপনার আখিরাত ভালো হবে);
– বিপদ দিয়ে খোদা আপনাকে সাবধান করতে পারেন, যেন আপনি আরো বড় বিপদ থেকে বেঁচে যেতে পারেন (যেভাবে, বাবা তার ছেলেকে বকা দেন যেন সে ভুল থেকে বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু সেই বকার পেছনে আসলে কাজ করে মমতা)।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ধর্মের মডেলে যেমন খোদা আছেন, তেমনি আছে পরকাল – পরকালে কষ্টের বিনিময়ে থাকবে পুরস্কার, আর এভাবে আপনার প্রতি আসলে ন্যায়বিচারই করা হবে।
৪. নাস্তিকতার চতুর্থ আপত্তি: পরকালে ন্যায়বিচার কিভাবে হবে, যখন ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত? আমার ভাগ্যে যদি থাকে পাপ করা, তাহলে আমি তো পাপ থেকে বিরত হতে পারবো না।
উত্তর: প্রথম কথা হলো – এটাও স্রষ্টার বিরুদ্ধে কোন প্রমান না, এটা তার ন্যায়বিচারকে সন্দেহ করার একটা চেষ্টা মাত্র।
খোদার অনুমতি ছাড়া কিছুই হয় না, কিন্তু তার মানে এই না যে যা হয় তার তার সবকিছুই তার পছন্দ – খোদা অনুমতি না দিলে কেউ পাপ করতে পারতো না, কিন্তু তার মানে তো এই না যে তিনি পাপ ভালোবাসেন। খোদা মানুষকে ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, দিয়েছেন ভালো-মন্দ বাছাই করার ক্ষমতা – যেই ক্ষমতা ফেরেশতাদের নেই, আর নেই বলেই তাদের বেহেশত-দোজখও নেই। মানুষ যখন পুণ্যকে বাদ দিয়ে পাপকে বেছে নেয়, তখন খোদা হয়তো ক্রোধের সাথে সে পাপের অনুমতি দেন।
হ্যা, ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত, কিন্তু আপনি তো জানেন না আপনার জন্য সেটা ভালোর দিকে পূর্বনির্ধারিত নাকি খারাপের দিকে পূর্বনির্ধারিত – তাহলে কেন আপনি ভালোর আশা করবেন না, কিংবা ভালোর দিকে চেষ্টা করবেন না?
তাছাড়া, আপনার ভাগ্যে যদি পাপ লেখা থাকে কিন্তু সেই পাপ মাফ আবার হয়ে যায় (যেমন, অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে গেছে বলে, কিংবা আপনি মন থেকে তওবা করেছেন বলে), তাহলে তো সেই অভ্যাসগত পাপ আপনাকে নরকের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না। তাহলে আপনার অসুবিধাটা কি?
শেষকথা, খোদা ন্যায়বিচারক, আমরা বিশ্বাস করি তিনি কোন না কোনভাবে শেষবিচারের দিন ন্যায়বিচার করবেন (তদুপরি অনেককে বেশুমার মাফ করে দিবেন), যদিও কিভাবে তিনি সেটা করবেন সেটা আমরা জানি না (পার্থিব জীবনে কর্তব্য পালনের জন্য সেটা জানার প্রয়োজনও আসলে নেই)।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় – নাস্তিকরা আসলে ঈশ্বরকে যতটা না ঘৃণা করে, তার চেয়ে বেশি ঘৃণা করে আনুষ্ঠানিক ধর্মকে।
আর এটা তো সত্য – ঈশ্বরকে অস্বীকার করতে গিয়ে নাস্তিকরা এতবার ঈশ্বরের নাম জপ করে, অনেকসময় যা অনেক আস্তিকও করে না।
হতেও পারে, নাস্তিকতা আসলে ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আরেকটা পথ মাত্র। আমরা আশা করি, সেই পথ খোদার নৈকট্যে গিয়ে শেষ হোক।
