আর উত্তরও তো জানা (পর্ব ২)
যারা ধর্ম প্রচার করতে যান, তাদের অনেকেই বিশ্বাস করেন তারা স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমান দিতে সক্ষম। তাদের কেউ কেউ আমের গায়ে কালেমা দেখতে পান, আর বলতে থাকেন এটাই খোদার অস্তিত্বের প্রমান। কেউ কেউ আবার আস্তিকতা প্রমান করতে গিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য জোগাড় করতেও কার্পণ্য করেন না, তাদের মতে – সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়া জায়েজ আছে।
অন্যদিকে দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলিম মনীষীরা যুগ যুগ ধরে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে করিয়ে নাস্তিক বস্তুবাদীদের বিরুদ্ধে রীতিমতো জিহাদ করে গেছেন। শত শত বছরের পুরোনো সেই যুক্তিগুলোকে আমরা মূলত চারভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে পারি।
১. আস্তিকতার প্রথম যুক্তি: কালাম কসমোলোজিক্যাল আর্গুমেন্ট।
ব্যাখ্যা: সব কার্যেরই কারণ থাকে। কারণ ছাড়া কিছু হয় না। আমার জন্মের কারণ আমার পূর্বপুরুষ, তাদের উৎপত্তির কারণ পৃথিবী, পৃথিবীর কারণ বিশ্বজগত। কিন্তু বিশ্বজগৎ এলো কথা থেকে, এটা তো শূন্য থেকে উৎপত্তি হতে পারে না – ইউনিভার্স বলেন, আর মাল্টিভার্স বলেন, এর সৃষ্টির তো একটা কারণ থাকতে হবে। এই কারণটা ঈশ্বর ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
অন্য কথায়, বিশ্বের যদি কোন শুরু না থাকতো, তাহলে এই কার্য-কারণের ধারা অতীতের দিকে যেতেই থাকতো, যেতেই থাকতো, কোনোদিন শেষ হতো না। কিন্তু প্রকৃতিতে অসীম কোন কিছু দেখা যায় না, তার মানে অতীতও অসীম হতে পারে না – সবকিছুর একটা শুরু থাকবে, থাকবে শুরুর কারণও। আর সেই শুরুর কারণ হচ্ছেন ঈশ্বর, তিনিই সব কিছু শুরু করেছেন সৃষ্টির মাধ্যমে।
প্রশ্ন: নাস্তিকরা তখন আপত্তি করে বলে – সব কারণের প্রথম কারণ যদি ঈশ্বর হয়ে থাকেন, তাহলে ঈশ্বরের কারণ কি? ঈশ্বরের স্রষ্টা কে?
উত্তর: স্রষ্টার কারণহীন কারণ, স্রষ্টা আর সৃষ্টি একরকম হতে পারে না – কার্য-কারণের নীতি সৃষ্টির জন্য প্রযোজ্য, স্রষ্টা এ দুর্বলতা থেকে মুক্ত।
২. আস্তিকতার দ্বিতীয় যুক্তি: ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন আর্গুমেন্ট।
ব্যাখ্যা: আমাদের ইউনিভার্স এমন সূক্ষ্ম করে ডিজাইন করা, যেন সেটা মানুষের উৎপত্তি আর টিকে থাকার জন্যই কেউ বানিয়েছে। পৃথিবীটা মানুষের বসবাসের উপযোগী হওয়ার জন্য একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে অস্বাভাবিকরকম কাকতালীয়ভাবে, যেমন:
– এই ইউনিভার্সে পদার্থবিজ্ঞানের ধ্রুবকগুলোর মান একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই বিগ ব্যাঙের পর বস্তু তৈরী হতো না;
– প্রাথমিক পৃথিবীতে পানিবাহী ধূমকেতুগুলো আছড়ে পড়েই প্রাণের উৎস মহাসাগরগুলো তৈরী হয়েছে;
– গ্রহাণুর আঘাতে ডাইনোসোরকুল ধ্বংস হয়েছে বলেই মানুষের উত্থানের পরিবেশ তৈরী হয়েছে। – সৌরজগতে বৃহস্পতির মতো বড় গ্রহ আছে বলে সেটা লক্ষ-কোটি গ্রহাণুকে গ্রাস করে ফেলে, নাহলে সেগুলো পৃথিবীতে আছড়ে পড়তো আর আমরা ধ্বংস হয়ে যেতাম।
এই ঘটনাগুলো ঠিক সময়মতো ঘটেছিলো বলেই পৃথিবীতে মানুষজাতির অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল।
সুতরাং এর পেছনে ঈশ্বরের মতো কোন স্বত্বা না থেকে পারেই না ।
প্রশ্ন: নাস্তিকরা তখন আপত্তি করে বলে – এইসব হয়েছে বলেই মানুষ জন্মেছে, নাহলে তো জন্মাতোই না, মাল্টিভার্সে এমন অসংখ্য ইউনিভার্স আছে যেগুলোতে জীবের বেছে থাকার মতো পরিবেশ নেই ।
উত্তর: মাল্টিভার্স বিজ্ঞানীদের মনপ্রসূত একটি তত্ত্ব মাত্র, এটার কোন প্রমান নেই, প্রমানের কোন উপায়ও নেই।
৩. আস্তিকতার তৃতীয় যুক্তি: ঈশ্বর ছাড়া নৈতিকতার কোন উৎস থাকতে পারে না।
ব্যাখ্যা: চুরি করা খারাপ, মিথ্যা বলা পাপ, মানুষ হত্যা মহাপাপ – ঈশ্বর না শেখালে এগুলি কে মানবজাতিকে শেখালো?
ঈশ্বর বলে যদি কেউ না থাকতো, তাহলে সবকিছুই হয়ে যেত আপেক্ষিক ও সাংঘর্ষিক। মানুষ যদি শুধুই উন্নত ধরণের এক পশু প্রজাতি হতো, তাহলে যে যার মতো নৈতিকতার মাপকাঠি তৈরী করে নিতো – কারণ আপনার কাছে যা ভালো, আমার কাছে তা খারাপ মনে হতে পারে – যেমন, আপনার কাছে চুরি খারাপ, কিন্তু চোরের কাছে চুরি ভালো জিনিস যেহেতু সেটা দিয়ে সে তার সংসার চালায়। কিন্তু আমরা সবাই মানি, চুরি করা অন্যায় – সেটা পেটের দায়ে করলেও অন্যায়ই।
প্রশ্ন: নাস্তিকরা তখন আপত্তি করে বলে – নৈতিকতা সামাজিক প্রয়োজন থেকে উদ্ভুত হয়েছে, যেমন চুরি সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য খারাপ বলেই ওটা সমাজে নিষিদ্ধ হয়েছে।
উত্তর: এ তর্কের ফল অমীমাংসিত।
৪. আস্তিকতার চতুর্থ যুক্তি: ঐশীবাণী ও মোজেজা সত্য।
ব্যাখ্যা: বিভিন্ন ধর্মে মোজেজার কথা বলা হয় – যেমন, যীশুর কুষ্ঠরোগীকে চিকিৎসার ক্ষমতা, বনি ইসরাইলের জন্য বেহেশতী খাওয়া মান্না ও সালওয়া অবতীর্ণ হওয়া, ইত্যাদি। এসব ঘটনা যদি সত্য হয়, তাহলে সেই সময়ের মানুষের জন্য এগুলো আস্তিকতার পক্ষে যুক্তি হিসেবে কাজ করেছে, কিন্তু আমাদের সময়ের সমস্যা হলো এসব ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই সম্ভব না।
একমাত্র ব্যতিক্রম হলো ইসলাম – এই ধর্ম একটা মোজেজার কথা বলে যেটা এখনো আমাদের চোখের সামনে আছে, আর সেটা হলো কোরান। কোরানের কিছু ব্যাখ্যাতীত বিষয়ের উদাহরণ হলো:
– কোরানে গর্ভের ভেতর ভ্রূণের বেড়ে ওঠা নিয়ে এমন বিশদ তথ্য দেয়া হয়েছে, যা সেই সময়ের কারো পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না (যেটা দেখে ড: মরিস বুকাইলি মুসলমান হয়েছিলেন);
– কোরানে রোমানদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, যা সেই আয়াত অবতীর্ণের দশ বছরের মধ্যে সত্য হয়েছিল;
– কোরানে বিগ ব্যাং ও কৃষ্ণগহবর নিয়ে বর্ণনা আছে, যা সেই আমলে কেউ চিন্তাও করতে পারতো না;
– কোরানের যে বিষয়গত স্ট্রাকচার (যেমন সূরা বাকারার রিং কম্পোসিশন), সেটা মানুষের পক্ষে লেখা অসম্ভব।
তাওরাত, বাইবেল, কোরান যে বই হিসেবে হাজার হাজার বছর টিকে আছে, সেটা মানুষের ভেতর এই পুস্তকগুলোর চিরন্তন এক আবেদনের প্রমান। মানুষের লেখা কোন বই আজ পর্যন্ত এভাবে সভ্যতাকে প্রভাবিত করতে পারে নি।
তাহলে কি আমরা দুই পাতার মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমান করে দিলাম?
মোটেই না। কারণ, খেয়াল করলে দেখবেন – উপরের সবগুলো হচ্ছে ইঙ্গিত (যদিও অত্যন্ত শক্তিশালী ইঙ্গিত), কোনোটাই সরাসরি প্রমান নয়।
স্রষ্টার আসলে প্রমান হয় না। যদি সেটা হতো, তাহলে সব মানুষই একসাথে মুমিন হয়ে যেত – ফেরেশতা আর মানুষে কোন তফাৎ থাকতো না।
আব্রাহামিক একত্ববাদী ধর্মগুলোর অন্যতম মূলকথা হলো – এই দুনিয়া মানুষের পরীক্ষার হল, আর সেই পরীক্ষার পাশ-ফেল নির্ভর করে মানুষ প্রমান ছাড়া অদৃশ্যে বিশ্বাস করে কিনা তার ওপর।
আপনি কি শুধু বিশ্বাসের ওপর ভর করে খোদার অদৃশ্য আশ্রয়ে ঝাঁপ দিতে রাজি?
