চা খেতে পছন্দ করে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দিনের শুরু থেকে আরম্ভ করে, সারাদিনের কর্ম ব্যাস্ততায়, বন্ধুদের আড্ডায়, অতিথি আপ্যায়নে চা যেন অত্যাবশ্যকীয় একটি উপাদান। পাতার ধরন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতির বিভিন্নতার কারণে, বিভিন্ন রকম চা হয়। যেমন গ্রিন টি, ব্ল্যাক টি, উলং টি, হারবাল টি, মাসালা টি, ফ্রুট টি ইত্যাদি।
চা কে পানীয় হিসেবে বেশ স্বাস্থ্যকর ধরা হয়। চা এর মধ্যে রয়েছে প্রচুর এন্টি এক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও অন্যান্য যৌগ। চাতে ক্যাফেইনের পাশাপাশি ক্যাটেচিন নামক এন্টি এক্সিডেন্ট এবং পলিফেনোল (ফ্ল্যাভোনলস ও ক্যাটেচিনস) ইত্যাদি। এইসব উপাদান গুলোতে রয়েছে হার্ট সুরক্ষা প্রদানকারী গুণাগুণ। চা দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উন্নত করতে সাহায্য করে। দেহ থেকে বিষাক্ত ও বর্জ্য উপাদান নিঃসরণে সহায়তা করে। রক্তের সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণ করে করতেও চা সহায়ক ভুমিকা পালন করে।
কিন্তু, এই স্বাস্থ্যকর চা এ, দুধ মেশালে চায়ের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। দুধের প্রোটিন, চায়ের এন্টি এক্সিডেন্ট এর ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। চায়ের সঙ্গে দুধ মেশানো হলে, দুধের প্রোটিন আর চায়ের ক্যাটেচিন রিঅ্যাকশন করে, এন্টি অক্সিডেন্টের গুণ নষ্ট করে দেয়। সেই সঙ্গে এটি চা-কে এসিডিক করে ফেলে। আর চিনি যোগ করলে সেই ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়ে যায়।
সকালের নাস্তার পর দুধের চা পান করলে, তা শরীরের হজম প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে, এমনকি সকলে এটি পান করার ফলে মুখের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একটি গবেষণা থেকে জানতে পারা গিয়েছে যে, ব্ল্যাক টি বা রং চাতে তে দুধ মেশালে, এর হৃদরোগের হাত থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
চায়ের তিক্ত-কষ স্বাদ এবং কালো রং, ট্যানিন নামক একটি উপাদানের জন্য হয়। চা পাতা অনেকক্ষণ ফুটালে এই ট্যানিন বেশি বের হয়, যেটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর এবং হজমে সমস্যা তৈরি করে। আর হজমের সমস্যার কারণে, বমি বমি ভাব সহ পেটের নানা সমস্যা দেখা দেয়।
দৈনন্দিন পানের জন্য জ্বাল না দিয়ে, টি ব্যাগ দিয়ে রং চা, স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তাই চা বানানো ও পান করার সময় কিছু নিয়ম মেনে চললে ট্যানিনের ক্ষতিকর প্রভাব কমানো সম্ভব।
আমরা মনে করি, চা পান মাথাব্যথার টনিক হিসেবে কাজ করে। ক্ষেত্রবিশেষে এটি একটি ভুল ধারণা। কারণ অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ মাথাব্যথা কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়ে দিতে পারে। আর চা পান যদি অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়, তখন বেশিক্ষণ চা না খেয়ে থাকলেও মাথাব্যথা হতে পারে।
যারা দিনে প্রচুর পরিমাণে চা খান, তাদের কোষ্টকাঠিন্যের সমস্যা দেখা দেয়। কোষ্টকাঠিন্যের কারণে পেট ফেঁপে যায়, ভালোভাবে পায়খানা হয় না আর এতে গ্যাস এর সমস্যা বেড়ে যায় বহুগুন।
চায়ের এতো জনপ্রিয় হওয়ার মূলে রয়েছে ক্যাফেইন নামক উপাদান। ক্যাফেইন একটি মৃদু উত্তেজক উপাদান, যার ফলে চা পান করলে, শরীর চাঙা হয় ও ঝরঝরে লাগে। এই ক্যাফেইনের ফলে আমাদের বারবার প্রস্রাব পায়। ঘন ঘন চা খেলে ঘুমের সমস্যা হয়, উত্তেজনা বাড়ে, অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়, হার্ট রেট বাড়িয়ে দেয়।
অন্যদিলে, রং চা কেই স্বাস্থ্যকর ধরা হয়। চায়ে থাকা ক্যাটেচিন রক্তনালির প্রসারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রক্তনালির প্রসারণ হাই ব্লাড প্রেশার ও হার্টের রোগ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত জরুরি। দুধ চায়ে রক্তচাপ উঠানামা করে। আর যারা ব্লাড সুগারের রোগী, তাদের দুধ চায়ে, সুগারের মাত্রা বেড়ে গিয়ে শরীর খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অন্যদিকে দুধ চা, রক্তনালির প্রসারণ ঘটাতে ব্যর্থ হয়। কারণ, দুধের মধ্যে থাকে ক্যাসেইন নামের একটি পদার্থ, যা চায়ের মধ্যে থাকা ক্যাটেচিনকে বাধাগ্রস্ত করে। এতে চায়ে দুধ মেশালে চায়ের রক্তনালি প্রসারণের ক্ষমতা একবারেই চলে যায়।
ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে রং চা উপকারী,কারণ এটি কোষ থেকে সাধারণের তুলনায় প্রায় ১৫ গুণ বেশি ইনসুলিন নিঃসৃত করে এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
ব্লাক-টি বা রং চা, হৃদরোগীদের করোনারি ধমনীর সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করে। রং চা অ্যাজমা রোগীদের জন্য অত্যন্ত উপকারী, কারন এটি শ্বাস গ্রহনের পথকে প্রসারিত করে, যা রোগীকে আরো সহজে শ্বাস নিতে সাহায্য করে। রং চা, খাদ্যনালীর নানান রোগ নিরাময় করতে সাহায্য করে, হৃদযন্ত্রের সমস্যার ঝুঁকি কমিয়ে দেয় এবং বিশেষ করে মেনোপজ পর্যায়ে মহিলাদের স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
ব্লাক-টি একটি বিশেষ এনার্জি বুস্টার। এটি আপনার ত্বক ও চুলের জন্য উপকারি এবং আপনাকে মানসিকভাবে উজ্জীবিত রাখে। রং চা মানসিক চাপ দূর করে এবং হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে, যা আর্থ্রাইটিসের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
মানুষকে চায়ের সঠিক প্রস্তুতপ্রণালি, সংরক্ষণ এবং এর সাথে কি কি যোগ করে খাওয়া শরীরের জন্য উপকার, সে সম্পর্কে যথাযথভাবে সচেতন করতে পারলে, চা হয়ে উঠবে আপনার একান্ত পরম বন্ধু।
চায়ে কোনো ক্যালরি নেই। এমনকি এতে উপস্থিত রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণ খুবই কম। চায়ের ক্যালরি নির্ভর করে কতটুকু চিনি মেশানো হয় তার ওপর এবং দুধ চায়ে কতটুকু দুধ মেশানো হচ্ছে তার উপর। অর্থাৎ দুধ ও চিনি ছাড়া চা পান করলে, তা হবে ক্যালরি ফ্রি স্বাস্থ্যকর চা।
এই লেখার উদ্দেশ্য চিকিত্সা নয়, শুধুমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধি করা। কোন ভাবেই এটিকে প্রেসক্রিপসন বা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যাবেনা।
যেকোনো রোগ বা সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
…….. তিনা শুভ্র ।।
