…………………………..
বাঙালির খাদ্যাভ্যাস সারা বিশ্বের থেকে বেশ আলাদা। আর তার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল তেল ও মশলা। আর এই তেলের মধ্যে একটি উপাদান রয়েছে, যা মানুষকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক রোগ- হৃদরোগের দিকে ধাবিত করে, তা হলো কোলেস্টেরল। শরীরে বেশি কোলেস্টেরল জমে গেলে, তা হার্টের রক্তনালী এবং ব্রেইনের রক্তনালীতে রক্ত চলাচলে বাঁধা দেয়। এই কোলেস্টেরল অতিরিক্ত গ্রহণের ফলাফল- হার্টের নানান রোগ, হার্ট অ্যাটাক, ও স্ট্রোক। তাই বর্তমান স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা, সাধারণ মানুষকে চর্বিদার লাল মাংস ও তেল এড়িয়ে নিরামিষভোজী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
আপনি কি জানেন, আমাদের খাবারের প্রায় ১০০ ভাগই, এক ফোঁটা তেল ছাড়া রান্না করা যায়? এমনকি মচমেচে ও সুস্বাদু খাবার তৈরি করতেও কোনো তেলের দরকার পড়ে না। যদিও অধিকাংশ রাধুনীই জানেন না যে, তেল ছাড়াও মজাদার খাবার রান্না করা যায়। বর্তমানে হৃদরোগীদের জন্য বিনা তেলে রান্না খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
চলুন প্রথমে জেনে নেই কিভাবে বিনা তেলে খাবার রান্না করা যায়…
তেল ছাড়া কি রান্না করা সম্ভব? এটা একটা অবাস্তব প্রশ্ন মনে হলেও, বিজ্ঞান এই অসম্ভব কে সম্ভব করে তুলেছে। খাবারে তেলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে অনেক রোগের প্রকোপ কমিয়ে আনা সম্ভব। যেখানে তেল ব্যবহার না করেও সুস্বাদু খাবার রান্না করা যায়। এতে খাবারের স্বাদ থাকে অটুট, আবার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকরও নয়। আর এই যন্ত্রের নাম হল এয়ার ফ্রায়ার। আপনি চাইলে বিনা তেলেও এই এয়ার ফ্রায়ারে কোলেস্টেরলমুক্ত নানা রকম সুস্বাদু খাবার রান্না করে নিতে পারেন, যা প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত চর্বিমুক্ত রান্না করতে সক্ষম। আধুনিক বিশ্বে স্বাস্থ্যসচেতন ক্রেতাদের কাছে গৃহস্থালি এই পণ্যটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই ঈদে প্রচুর রান্নার কাজে অবিশ্বাস্য কম তেল ব্যবহারের জন্য বেছে নিতে পারেন এ যন্ত্র।
কনভেকসন ওভেনের মতো, গরম বাতাসে খাবার রান্না হয় এয়ার ফ্রায়ারে। এয়ার ফ্রায়ার এক ধরনের ফ্যানের মাধ্যমে গরম বাতাস সরবরাহ করে। ফ্রায়ারের ভেতরে থাকা ট্রেতে খাবার রাখলে, এই গরম বাতাসে খাবারের ভেতর ও বাইরের অংশ চমৎকারভাবে সেদ্ধ হয়ে যায়। তেল ছাড়াই খাবার মচমচে করতে পারে এটি। ফলে স্বাস্থ্য সচেতনদের মধ্যে এটি তুমুল জনপ্রিয়।
কী কী রান্না করা যাবে এয়ার ফ্রায়ারে?
যেসব খাবার ডুবো তেলে রান্না করতে হয়, সেগুলো এ যন্ত্রে তৈরি করা যায়, যেমন রোস্ট, কাবাব, কাকলেট, মাছ ও মাংসের গ্রিল, মাছ ভাজি, সমুচা, সিঙ্গারা, পুরি, পিয়াজু, বেগুনি, চপ, পরাটা, মোগলাই পরাটা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ইত্যাদি।
এছাড়া কেক, বিস্কুট, পিঠাও বানাতে পারেন এয়ার ফ্রায়ারে। এছাড়া তান্দুরী বানানোর পাশাপাশি যেকোনো ফ্রাই ধরনের খাবার বানাতে পারবেন। সবজি, মাছ বা মাংস তেল ছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে রান্নাকরা যায় এখানে।
কোন ধরনের খাবার কত তাপমাত্রায়, কতক্ষণ ধরে রান্না করতে হবে, তার জন্য প্রতিটি এয়ার ফ্রায়ারে দেওয়া থাকে নির্দেশনা। ফলে এই এয়ার ফ্রায়ার ব্যবহার সাধারণ মানুষের জন্য খুবই সহজ।
এই যন্ত্রে রেডিয়েশনের কোন ভয় নেই। টাইমার অনুযায়ী এটি অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়। ফলে খাবার অতিরিক্ত রান্না হবে না বা পুড়েও যাবে না।
গবেষণায় জানা গেছে, অন্য উপায়ে ভাজা খাবারের তুলনায়, এয়ার ফ্রায়ারে ভাজা খাবারে অ্যাক্রিলামাইড এর পরিমান ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। অ্যাক্রিলামাইড হলো একটি রাসায়নিক পদার্থ। বেশি তাপমাত্রায় রান্না করলে এই অ্যাক্রিলামাইড ভেঙে যায়। ফলে সেখান থেকে ক্ষতিকারক কার্সিনোজেন তৈরি হয়, যা শরীরে ক্যান্সার রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
এয়ার ফ্রায়ারর তেমন কোন অসুবিধা এখনও পাওয়া যায় নাই, তবে কখনও কখনও এয়ার ফ্রায়ার খাবারকে অতিরিক্ত শুকনো করে ফেলে। তাই এয়ার ফ্রায়ারের নির্দেশনা অনুযায়ী রান্না করা উচিত, মাঝে মধ্যে খাবার এপিট ওপিট করে দিলে এবং সামান্য তেল স্প্রে করে দিলে ভাল হয়।
এবার চলুন জেনে নেই কিভাবে একেবারে অল্প তেলে খাবার রান্না করা যায়…
এজন্য প্রথমেই দরকার হবে নন স্টিকি ফ্রাইপেন, যেনো কম তেল বা তেল ছাড়াই রান্না করা যায়।
১। মাছ-মাংস টক দই দিয়ে ম্যারিনেট করে রাখুন। যদি ৭-৮ ঘণ্টা মাংস ম্যারিনেট করতে পারেন, তা হলে মাংসও নরম হবে এবং রান্নার সময় অনেকটাই তেল ছা়ড়বে। তাতে তেল কম লাগবে। মাছ বা কোনও সব্জিও একই ভাবে রান্না করতে পারেন।
২। যে কোনও খাবার ভাপিয়ে রান্না করলে তেল লাগবে না। এতে পুষ্টিগুণ বজায় থাকবে এবং খাবার অনেক বেশি স্বাস্থ্যকরও হবে। এখন বাজারে নানা রকম স্টিমার পাওয়া যায়। বাড়িতে রাইস কুকার থাকলেও স্টিম করতে পারেন। না থাকলে একটি কড়াইয়ে পানি ফুটিয়ে তাতে একটি স্ট্যান্ডে বাটি বসিয়ে দিন। সেই বাটিতে রান্না করুন।
৩। তেল ছাড়া বা একদম কম তেলে রান্না করতে চাইলে খানিকটা অলিভ অয়েল ব্রাশ করে সব্জি বা মাছ-মাংস সহজেই বেক বা রোস্ট করে নিতে পারেন।
৪। রান্নায় তেলের ব্যাবহার কমানোর জন্য, তেল স্প্রেয়ের বোতলে ঢেলে নিয়ে, তারপর রান্নার সময় তেল স্প্রে করে নিন। এতে অল্প তেলেই রান্না করতে পারবেন।
৫। বিনা তেলে পেঁয়াজ ভাজতে চাইলে, তেলের বদলে ২ চামচ করে পানি দিয়ে ভাজতে থাকুন। অল্প অল্প পানির ছিটা দিয়ে পেয়াজ ভাজতে হবে। । তবে বেশি পানি দিবেন না, এতে পেঁয়াজ সেদ্ধ হয়ে যাবে।
৬। মসলা কষাতে তেলের পরিবর্তে পানি ব্যবহার করুন।
৭। রান্নায় বাড়তি স্বাদ আনার জন্য, অতিরিক্ত তেলের পরিবর্তে ধনে পাতা, পুদিনা পাতা, কারি পাতা সহ নানা ধরনের হার্ব ব্যাবহার করতে পারেন।
৮। ডুবো তেলে না ভেজে, ওভেনে বেক করে নিতে পারেন, কিংবা গ্রিল বা বারবিকিউ করেও খেতে পারেন।
আমরা সাধারণত যে সকল খাবার খাই, সেগুলো থেকেই আমরা প্রাকৃতিকভাবে তেল পেয়ে থাকি। তাই বাড়তি তেল গ্রহণ না করলেও চলে। রান্নার স্বাদ ও পুষ্টিমান নির্ভর করে মসলায়, তেলে নয়। গবেষক ও শেফরা এসব কথা স্বীকার করেছেন।
আপনি চাইলে বাড়িতে একদিন তেল ছাড়া এক পদের রান্না, পরীক্ষামূলক ভাবে করতে পারেন। আর পরিবারের সদস্যদের না বলে পরিবেশনও করাতে পারেন। দেখবেন তারা বিনা তেলে রান্নার তফাৎটা একেবারেই ধরতে পারবে না।
বিনা তেলে রান্নার নানান পদ্ধতি জানতে চাইলে, ইউটিউবে দেখতে পারেন।
এই লেখার উদ্দেশ্য চিকিত্সা নয়, শুধুমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধি করা। কোন ভাবেই এটিকে প্রেসক্রিপসন বা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যাবেনা।
যেকোনো রোগ বা সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
…….. তিনা শুভ্র ।।
