কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা পাইলস রোগীদের করণীয়… ।।

……………….

পথে-ঘাটে পাইলস বা অর্শ রোগের চিকিৎসার নানান হোমিও প্যাথি, ইউনানি, আয়ুর্বেদী, কবিরাজি ও নানা ধরনের দ্রুত সমাধানের সাইনবোর্ডের সমাহার দেখা যায়। সাধারণ মানুষ না জেনে, না বুঝে এসব চিকিৎসা গ্রহণ করছে, এবং নানান ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছে। পাইলস রোগটি আমাদের নিকট অর্শ নামেই পরিচিত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলি হেমোরয়েডস। এ রোগে মলদ্বার থেকে মাঝে মধ্যে রক্ত যায়। কখনো বেশি, কখনো কম। মলত্যাগের সময়, অনেকের মলদ্বার ফুলে ওঠে আবার কারো কারো মাংশপিন্ড ঝুলে পড়ে যা আবার আপনা আপনি ভেতরে ঢুকে যায় অথবা চাপ দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে হয়।

মূলত কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীদেরই পাইলসের সমস্যা দেখা দেয়। কারণ, এদের মলত্যাগের সময়ে অকারণ বেগ প্রদানের বা কোঁত দেয়ার বদভ্যাস থাকে। কোঁত দিলে, খাদ্যনালীর দেয়ালে চাপ পড়ে, ফলে রক্তনালীতে, রক্ত চলাচলে বাঁধা পরে, এবং রক্তনালী অস্বাভাবিকভাবে ফুলে উঠে। এই ফুলে উঠা রক্তনালী হল পাইলস, যা থেকে রক্ত ক্ষরণ হয়। রক্তনালী ফুলে থাকলে, মলত্যাগের সময় সেখানে ঘষা খায়, কেটে যেতে পারে, একই সঙ্গে ব্যথা হয়। কাজেই, মল যদি নরম হয় তাহলে এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে না। আর তাই পাইলস রোগের মুল সমাধানই হল পায়খানা নরম রাখা এবং পায়খানা করতে বসে কোঁত না দেয়া।

পাইলসের প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি। কিছু কিছু সমস্যা থাকলে পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যেমন, মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত কোঁত দেয়া, অনিয়মিত পায়খানার অভ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া ইত্যাদি। এছাড়া অন্য কিছু কারণ আছে যার জন্য পাইলস হতে পারে যেমন, বংশগত, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা, অনেকক্ষণ গরমে থাকা, ভারী ওজন তোলা, গর্ভাবস্থা, আঁটসাঁট পোশাক পরা, হরমোনের প্রভাব, আঁশ জাতীয় বা শাক সবজী খাবারের অভাব ইত্যাদি।

তাহলে আসুন জেনে নেই, কিভাবে পায়খানা নরম ও নিয়মিত করা যাবে….

১। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই খালি পেটে ২ গ্লাস ( আস্তে আস্তে অভ্যাস করতে হবে) কুসুম গরম পানি ও ২ পিস লেবু চিপে পান করে নিন। যারা লেবু পানি পান করতে পারেন না, তারা শুধুমাত্র ২ গ্লাস কুসুম গরম পানি পান করুন।
তারপর হালকা হাটা হাটি করুন, নামাজ পড়ুন, নিজের নাস্তা নিজে বানান, দেখবেন ৩০/৪৫ মিনিট পর টয়লেট চেপে যাবে। আর যদি টয়লেট নাও চাপে, তবুও টয়লেটে গিয়ে বসে থাকবেন প্রতিদিন। দেখবেন এতে শরীর তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় টয়লেট ক্লিয়ার করতে চাইবে।
যেহেতু সারারাত আপনার শরীর ঘুমে ছিল, সেহেতু এই কুসুম গরম লেবু পানি পান, আপনার খাদ্য নালিকে জাগ্রত করবে এবং কিছুক্ষণ পর টয়লেট চেপে যাবে।

২। দিনে ২/৩ লিটার পানি পান করুন। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি আপনার মলকে নরম রাখবে, শরীরে যত পানির অভাব হবে, মলও তত শুকনা ও শক্ত হতে থাকবে। তাই মল নরম করতে পানির কোন বিকল্প নেই।

৩। প্রাণীজ উৎস থেকে আসা সকল খাবার একেবারে কমিয়ে দিন। কেননা, প্রাণীজ খাবারে উপকারী খাদ্য আঁশ বা ফাইবার না থাকায়, কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। এজন্য প্রাণীজ খাবারের সাথে অবশ্যই সালাদ ও সবজী খেতে হবে।

৪। উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে আসা সকল খাবার পরিমাণে যথাসম্ভব বাড়িয়ে দিন। কারণ, উদ্ভিজ্জ খাবারে থাকে প্রচুর উপকারী খাদ্য আঁশ বা ফাইবার, যেগুলো আপনার মলকে রাখবে নরম। তাই প্রতিদিন, প্রতিবেলায় খাদ্যতালিকায়, শাক সবজি, ফলমূল, সালাদ রাখুন।

৫। প্রতিদিন চিনি ছাড়া, লো ফ্যাটের টক দই খাওয়ার অভ্যাস করুন। কারণ টক দই এ থাকে প্রবায়টিক, যা আপনার খাদ্যনালীতে থাকা ভালো ব্যাকটেরিয়া গুলোকে সচল রাখবে। আর এই ব্যাকটেরিয়া গুলো যত সচল থাকবে, আপনার খাদ্যনালীও তত গতিশীল থাকবে এবং হজমও ভালো হবে।

৬। তেলে ভাজা কিংবা চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়া কমিয়ে দিন। কারণ, তৈলাক্ত খাবার হজম প্রক্রিয়াকে ধীরগতি করে দেয়, এতে করে মল শক্ত হতে থাকে।

৭। মিষ্টি এবং মিষ্টি জাতীয় সকল খাবার যথাসম্ভব কমিয়ে দিন। কারণ, এসব খাবারে উপকারী খাদ্য আঁশ এবং পানির পরিমাণ খুবই কম থাকে, যা আপনার মলকে অনেক শক্ত করে দিবে।

৮। প্রতিদিন নিয়ম করে ৩০/৪৫ মিনিট হাঁটুন বা ব্যায়াম করুন। কারণ হাঁটা চলা আপনার খাদ্যনালী এবং হজম প্রক্রিয়াকে চালু রাখবে। তাই চেষ্টা করুন, প্রতিবেলা খাবার খাওয়ার এক/দেড় ঘণ্টা পর, ১০/১৫ মিনিট হাঁটাহাঁটি করতে।

৯। যেকোনো মনসিক অশান্তি, স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তায় ডাক্তারের পরামর্শ নিন। কারণ যেকোনো মানসিক সমস্যায়, খাদ্যনালীর গতি কিংবা হজম প্রক্রিয়া অনিয়মিত হয়ে পরে, ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য বেড়ে যেতে পারে বহুগুণ।

১০। রাতে ৭/৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করুন। কেননা ঘুমের মধ্যেই আপনার খাবারের বিরাট অংশ হজম হয়ে থাকে। রাতের ঘুম ঠিকমতো না হলে, নানান হজমের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে।

১১। পায়খানা নরম করার জন্য বাজারে বিভিন্ন ওষুধ পাওয়া যায়। এসব ওষুধ ব্যবহারের পূর্বে ডাক্তারের পরামর্শ বাধ্যতামূলক, নতুবা রোগের জটিলতা আরও বেড়ে যাবে।

পাইলস রোগের যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি সমস্যা করে তা হলো কোষ্ঠকাঠিন্য। কোষ্ঠকাঠিন্য যেন না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকা, নিয়মিত মলত্যাগ করা, মলত্যাগে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ না করা। একজন চিকিৎসক দেখে নির্ণয় করবেন, আসলে পাইলসটি কোন পর্যায়ে আছে, এটির কোন চিকিৎসা লাগবে। কাজেই মলদ্বারে পাইলসজনিত যদি কোনো সমস্যা হয়, প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে, কোনো অপারেশনের প্রয়োজন নেই। শুধু জীবন যাপনের ও খাদ্যাভ্যাসের কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী ডায়রিয়া/ আমাশয় থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।

এই লেখার উদ্দেশ্য চিকিত্‍সা নয়, শুধুমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধি করা। কোন ভাবেই এটিকে প্রেসক্রিপসন বা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যাবেনা।

যেকোনো রোগ বা সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

…….. তিনা শুভ্র ।।

Leave a comment