………………………….
কাঁচা বা আলগা লবন খাওয়া নিয়ে আমাদের নানান প্রশ্ন বা কনফিউশন। যে লবন আমরা রান্না না করে, খাবারে ছিটিয়ে খাই, সেটাই কাঁচা বা আলগা লবন।
লবণ হলো প্রধানত সোডিয়াম ক্লোরাইড। লবণ তা সে কাঁচা, পাকা, তেলে ভেজে, তেল না দিয়েই গরমে কড়াইতে ভেজে, গুঁড়িয়ে মিহি করে, জলে গুলে যে ভাবেই খাওয়া হোক, আসল কথা, বেশি লবন খেলে, শরীরে সোডিয়ামের পরিমান বৃদ্ধি পাবে। আর আসল সমস্যা এই সোডিয়ামকে নিয়েই। এই সোডিয়াম আমাদের ব্লাড প্রেসার বাড়াবে, হার্টের ক্ষতি করবে, হাড় থেকে ক্যালসিয়াম শুষে নিয়ে, হাড়ের ক্ষতি করবে। আবার, শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ বের হবার কাজে লবণ ব্যাঘাত ঘটায়। এর জন্য ইউরিক অ্যাসিড, বাত দেখা দেয়। অতিরিক্ত লবণ খেলে কিডনির ওপর চাপ পড়ে, কিডনি দুর্বল হয়ে যায়।
কাঁচা লবণ এবং ভাজা লবণের মধ্যে গুণগত কোনো পার্থক্য নেই। দুটো লবণই অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ, শরীরের জন্য সমান ক্ষতিকর। অতিরিক্ত লবণ, যেকোনো অবস্থাতেই, শরীরে অতিরিক্ত পানি ধরে রাখে এবং রক্তের আয়তন বৃদ্ধি করে। এ জন্য বেড়ে যায় রক্তচাপ। এমনকি শরীরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্ত নালির সংকোচনও বাড়িয়ে দেয় লবণ। গবেষণায় প্রমাণিত যে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
লবণকে এক ধরনের স্ট্রেস ফুড বলা হয়। অতিরিক্ত লবণ শরীরে স্ট্রেস হরমোন বাড়িয়ে দেয়। এই স্ট্রেস হরমোন, তখন খুধা বাড়িয়ে দেয়, যেন আমরা বেশি বেশি খাবার খেয়ে মনে আনন্দ পাই। আর তখনই আমাদের অতিরিক্ত লবণ যুক্ত খাবারের প্রতি ক্রাভিং দেখা দেয়।
হয়তো ভাবছেন, তাহলে কাঁচা লবণকে কেন নিষেধ করা হয়? কারন, যখন লবণ রান্না করা হয়, তখন লবণে বিদ্যমান আয়রনের স্ট্রাকচার পরিবর্তিত হয়ে সহজতর হয় এবং খাদ্যনালীতে শোষণ প্রক্রিয়াও সহজ হয়। কাঁচা লবণের ক্ষেত্রে আয়রণ স্ট্রাকচারের কোন পরিবর্তন হয় না, তখন এটা শরীরের ওপর চাপ বাড়ায়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ ও হাইপারটেনশন সহ নানা সমস্যা বেড়ে যায়।
এছাড়া, শরীরে বেশি মাত্রায় লবণের প্রবেশ ঘটলে পাকস্থলীর আবরণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, ফলে পাকস্থলি আলসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়।
লবণ কম গ্রহণের জন্য করণীয়ঃ
১। খাবারের সঙ্গে আলাদাভাবে (পাতে) লবণ খাবেন না।
২। টেবিলে লবণদানি রাখবেন না।
৩। রান্না করার সময় খাবারে অল্প লবণ ব্যবহার করুন।
৪। রেডি-টু-ইট ফুড, ইনস্ট্যান্ট নুডুলস, সস, ফাস্টফুড, রেস্টুরেন্ট ও ক্যান্টিনের খাবারে প্রচুর লবণ থাকে, এজন্য এসব খাবার নিয়মিত খাবেন না। চেষ্টা করুন ঘরে খাবার রান্না করে খেতে।
৫। টিনজাত স্যুপ, সবজি, মাংস-মাছ, প্রক্রিয়াজাত পনির ও মাংস, হিমায়িত খাবার, শুঁটকি মাছ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। কারন খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করতে বাড়তি লবন দেয়া হয়।
৬। আচার, কাসুন্দি, মেয়োনিজ লবণে ঠাসা থাকে। এগুলো যথাসম্ভব বর্জন করুন। তবে প্যাকেটের গায়ে, ‘লো সোডিয়াম’ বা ‘নো অ্যাডেড সল্ট’ লেখা থাকলে তবে কিনুন।
৭। খাদ্য সংরক্ষণ করার জন্য লেবুর রস, ভিনেগার, কাঁচা রসুন ও মশলা ব্যবহার করুন, লবণকে বাদ দিন।
৮। খাদ্য সুস্বাদু করার জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্য যেমন- কেচাপ, সয়াসস, সালাদ বানানোর উপকরণ, আচার কম ব্যবহার করুন।
৯। কাঁচা ফলমূল বা শাকসবজি খাওয়ার সময় লবণ দিয়ে খাবেন না।
১০। লবণবিহীন ক্র্যাকার্স, পপকর্ন, সেদ্ধ ডিম ও বাদাম খান। লবণ মেশানো বাদাম, মুড়ি–চানাচুর, পাপড়, পাকোরা, চিপস খাওয়ার ক্ষেত্রেও লাগাম দিন।
১১। সপ্তাহে বেশির ভাগ সময় কম লবণে বানানো ঘরের খাবার খান। লবণ কমাতে গিয়ে শরীরে যেন পটাশিয়ামের ঘাটতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। তাই নিয়মিত সাথে রাখুন লো ফ্যাট দুধ-দই-ছানা, ফল, শাক-সবজি, মাছ, মাংস, ডাল, ডিম, কলা, ডাবের পানি ইত্যাদি।
১২। ঘরে-বাইরে খাদ্য নির্বাচনের আগে কম লবণ ও কম সোডিয়াম যুক্ত খাবার নির্বাচন করুন। আপনার সন্তানকে শৈশব থেকেই কম লবণযুক্ত খাদ্য খাওয়ানোর অভ্যাস করুন।
১৩। হোটেল বা দোকানে ‘ধূমপান নিষেধ’, এর পাশাপাশি ‘অতিরিক্ত লবণ খাবেন না’ লিখে রাখতে দোকানীকে উদ্বুদ্ধ করুন।
১৪। বাইরের খাবারের ক্ষেত্রে এমন নির্দেশনা দেয়া উচিত যেন খাদ্যে লবণের মাত্রা কম থাকে।
১৫। খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা দরকার, যাতে তারা খাবারের গায়ে ও মেন্যুতে লবণ ও সোডিয়ামের পরিমাণ লিখে রাখেন।
প্রতিদিন কতটুকু লবন খাবেনঃ
একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের রোজ এক চা চামচ লবণ খাওয়া উচিত। আর যাদের হাই ব্লাড প্রেসার রয়েছে, তারা আধা চামচের মতো লবন খাবেন।
কোন লবন ভালোঃ
ধরা হয়, “হিমালয়া পিংক সল্ট” সবচেয়ে উত্তম লবন। এটা দেখতে গোলাপি ও স্বাস্থ্যসম্মত। তবে খেতে হবে অবশ্যই পরিমান মতো।
অনেকে আবার সি সল্ট বা সামুদ্রিক লবনকে আদর্শ বলে থাকেন, যদিও সামুদ্রিক লবনে অনেক মিনারেল ও অন্যান্য উপাদান থাকে, যা সাধারণ লবণের মধ্যে থাকে না। আবার সামুদ্রিক লবণে আয়োডিন অনুপস্থিত। তাই সাধারণ লবণের চেয়ে এই লবণ খুব একটা উপকারী নয়। সামুদ্রিক লবণ খেলে খাদ্যতালিকায় আয়োডিনসমৃদ্ধ অন্যান্য খাবারও রাখুন। তাছাড়া বর্তমান সময়ে সামুদ্রিক লবনে প্ল্যাস্টিকের উপস্থিতিও পাওয়া যাচ্ছে, যার কারন হোল, সমুদ্রের পানির প্লাস্টিক দূষণ।
তবে অতিরিক্ত লবণের মতো একেবারে লবণহীন খাবার খাওয়াও শরীরের জন্য হুমকি স্বরূপ। হার্ট, লিভার থেকে শুরু করে কিডনি, অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ডের মতো শরীরের বিশেষ অংশগুলোর কাজকর্ম কিছুটা হলেও লবণের ওপর নির্ভর করে। তাই লবন একেবারে বাদ না দিয়ে, রান্নায় পরিমানে কম খাওয়া উচিত। আর আলগা বা কাঁচা লবন পুরোপুরি বাদ দিতে হবে এবং সবচেয়ে ভাল হয় যদি হিমালয়া পিংক সল্ট খাওয়া যায়।
আমরা যদি বাড়িতে কম লবণ দিয়ে খাদ্য তৈরি শুরু করি এবং আলগা লবণ না খাই, লবণাক্ত খাবার এড়িয়ে চলি, কম লবণযুক্ত খাবার কেনা শুরু করি, তাহলে সেটাই অভ্যাস হয়ে যাবে।
এই লেখার উদ্দেশ্য চিকিত্সা নয়, শুধুমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধি করা। কোন ভাবেই এটিকে প্রেসক্রিপসন বা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যাবেনা।
যেকোনো রোগ বা সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
…….. তিনা শুভ্র ।।
