কেউ একজন মারা গেছে।
ফেসবুকে সমানে সবাই লিখে চলেছে – “ইন্না-লিল্লাহে-ওয়া-ইন্না-ইলাইহে-রাজেউন”।
নাফিস নিশ্চিত, এদের বেশির ভাগই কপি-পেস্ট করে লিখে দিয়েছে “ইন্না-লিল্লাহে—–“।
সে এটাও নিশ্চিত, এই নেটিজেনদের অনেকেই এমনকি এটাও জানে না, কে মারা গেছে। সুতরাং দিনের শেষে এটা একটা “সমবেদনা-মূলক” কমেন্ট, অনেকটা “উৎসাহ-মূলক” লাইকের মতো – মানুষ অনেকসময় পোস্ট না পরেই লাইক দেয় শুধুই বন্ধুকে খুশি করার জন্যে।
নাফিসের তখন মনে পড়লো, সে নিজেও তো জানে না – কে মারা গেছে।
সে স্ক্রল করে ওপরে ওঠার চেষ্টা করলো, যেন বোঝা যায় কে মারা গেছে। কিন্তু এত শত শত “ইন্না-লিল্লাহে—–” কমেন্ট যে, মিনিট কয়েক ঘাটাঘাটি করেও বোঝা গেল না, কে মারা গেছে।
আসলে স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলা এই ফেসবুক-গ্রূপে এত শত শত মানুষ যে, অর্ধেক কমেন্ট করলেও সেটা হয়ে দাঁড়ায় রেশনের লাইনের মতো দীর্ঘ এক লাইন।
কিন্তু নাফিসের জানা খুবই প্রয়োজন, কে মারা গেছে।
যে মারা গেছে, নিশ্চয়ই সে তার ব্যাচমেট। হয়তো খুব কাছের কেউ। শান্ত না তো আবার? শান্ত কয়েক বছর ধরে কিডনি সমস্যায় ভুগছে। নাকি সানোয়ার?
নাকি রুমানা? নাফিসের মনে আছে, ক্লাস এইটে পড়ার সময় বিদ্যানন্দ হাই স্কুলের তিনতলার বারান্দার পাশের সেই তিনশো বারো নাম্বার রুমে নাফিস সবসময় রুমানার এক বেঞ্চ পেছনে বসত, যেন পেছন থেকে ওর চুলের বেণী আর ঘাড়-গলার কিছু অংশ দেখা যায়।
শান্ত আর সানোয়ার সবসময় ওই বেঞ্চটা নাফিসের জন্য দখল করে রাখতো। কি দিন ছিল সেগুলো!
গত বছর যখন কারা যেন এই গ্রূপটা খুললো ফেইসবুকে, অনেকদিন পর রুমানাকে খুঁজে নিলো চল্লিশোর্ধ নাফিসের চোখ।
কিন্তু বিস্ময়, অথবা বিস্ময়হীনতা – ভীষণ মুটিয়ে গেছে মেয়েটা, মানে মহিলাটা। ল্যাপটপের পর্দায় রুমানার দ্বিমাত্রিক চোখের দিকে তাকিয়ে নাফিস তার অতীত স্বপ্নগুলোকে ছুতে ব্যর্থ হলো সেদিন বারে বার। তার চুলের দুই বেনীর জায়গায় এখন শ্যাম্পু আর ডাই করা কৃত্রিমতা, অসম্ভব না যে ওটা মূলত একটা উইগ।
সেদিন অনেকদিন পর ডিজিটাল রুমানাকে দেখে নাফিসের কল্পনায় বার বার উঁকি দিয়ে গেলো রুমানার চুল ছাড়া বেল মাথার কল্পিত ছবি।
কিন্তু যত যাই হোক না কেন, এই রুমানা মারা গেলেও নিশ্চয়ই তার কষ্ট হবে – ঘোলাটে আলোর মেঘলা সকালটাতে ভিড় করবে নানা রকম স্মৃতি আর দুশ্চিন্তা।
আবার মুশফিক মারা যায় নি তো? মুশফিক ছিল স্কুলে নাফিসের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, কিন্তু সে আমেরিকা চলে গেলো, আজ বছর দশেক হয় কোনো যোগাযোগ নেই।
লোকমুখে শুনেছে, বিদেশে গিয়ে মুশফিক মৌলানা হয়ে গেছে – বুক পর্যন্ত দাড়ি ঝুলিয়ে সান দিয়াগোর মসজিদ থেকে মসজিদে দৌড়-ঝাঁপ করে।
পশ্চিমা দেশে গিয়ে মানুষ ধর্মকে আঁকড়ে ধরে, এরকম জীবনে শোনেনি নাফিস।
নাফিস নিজে তো বাংলাদেশের ধর্মীয় ডামাডোলের মধ্যে থেকেও পরকাল কিংবা বেহেশত-দোজখ নিয়ে চিন্তিত না।
এই পশ্চাৎপদ লোকগুলো জানেও না বিজ্ঞান কতটা এগিয়ে গেছে, আর এটা প্রমান হয়ে গেছে যে আত্মা বলে আলাদা কিছু নেই যেটা মানবমৃত্যুকে অতিক্রম করে বেঁচে থাকবে অন্য কোন আধ্যাত্মিক ডাইমেনশনে।
সত্যি কথা বলতে, চেতনা হলো একটা বিভ্রম আর মন হলো মস্তিষ্কের কষ্টকল্পনা।
নাফিস দ্রুতগতিতে পোস্টের গোড়ায় যেতে শুরু করলো। তার বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করছে।
ভয় হচ্ছে, খুব কাছের কেউ মারা গেছে। আশাও হচ্ছে, অল্প অল্প – যে মারা গেছে, হয়তো তাকে নাফিস ভালোভাবে চিনতো না, হয়তো সে ছিল একজন ব্যাকবেঞ্চার – প্রায় অচেনা, ভুলে যাওয়া কোন মুখ।
মানুষ আশাতেই বাঁচে, আশংকা দূরে ঠেলে দিয়ে নাফিসকেও আশা নিয়েই বাঁচতে হবে।
এটাই পৃথিবীর নিয়ম – ডুবন্ত অবসস্থায়ও খড় কিংবা কুটোকে আঁকড়ে ধরে পানির ওপর মাথা জাগিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা।
খুব ছোটবেলায় সাইকেল চালানো শেখার সময় নাফিস হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলো – পা চালালেই সাইকেল চলে, আর পা থামালেই সাইকেল মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
নাফিসেরও হাল ছাড়লে চলবে না, জানতেই হবে কে মারা গেছে – আশংকাগুলো দূরে ঠেলে, আর আশাকে সামনে রেখে খুঁজে যেতে হবে মৃত সেই বন্ধু, কিংবা বান্ধবীর নাম।
পাওয়া গেছে। নামটা পাওয়া গেছে। নামটা খুব পরিচিত।
নাফিস শফিক।
নাফিস শফিক?
আরে, এটা তো নাফিসের নিজের নাম।
নাফিসের মাথায় রক্ত চড়ে যেতে চাইলো – কেউ তার মৃত্যুসংবাদ দিয়ে মজা করছে।
দেখা গেলো, সেই ব্যাটা হাসপাতালের কেবিনে নাফিসের একটা ছবিও দিয়েছে। মানে কি? হচ্ছেটা কি? ডিপ-ফেক করে ফেলেছে? শুধু মজা লোটার জন্য?
কোন সে হারামজাদা?
পোস্টদাতার নাম পাওয়া গেল – বেলাল। সে আবার গ্রূপ অ্যাডমিন।
বেলালটা আবার কে? নাফিসের ঠিক মনে পড়লো না।
কিন্তু কিছু একটা করা প্রয়োজন – এতগুলো কমেন্ট, এত শত “ইন্না-লিল্লাহে” মেসেজ !
নাফিস যখন এসব ভাবছিলো, তখনি পেছনে দরজা খোলার আওয়াজে ওর চিন্তায় ছেদ পড়লো। আজিজ ভাই আর স্বপনটা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
আশ্চর্য, নক করার পর্যন্ত প্রয়োজন বোধ করলো না !
দুনিয়ার হয়েছেটা কি আজকে !
সে প্রতিবাদ করে উঠতে চাইলো, কিন্তু কেন যেন ওর কোন কথাই বলতে ইচ্ছে হলো না।
কেন যেন তার নিজেকে ক্লান্ত হলো খুব।
প্রচন্ড ইচ্ছে হলো, ঘুমিয়ে পড়ে লম্বা একটা সময়ের জন্যে – পৃথিবীর সব ঝামেলা থেকে মুক্তির অন্যতম উপায় যে ঘুমিয়ে পড়া, এটা কে না জানে।
আধো-অন্ধকার ঘরটাতে ঢুকেই স্বপন আর আজিজ ভাই দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে শুরু করলো নাফিসের সিঙ্গেল খাটটার দিকে। আর সেসময়ই নাফিসের চোখ আটকে গেল বহুবছর ধরে চেনা সেই বিছানাটায়।
আশ্চর্য, নাফিসই তো শুয়ে আছে বিছানায় – চোখ বন্ধ, একঘেয়ে একটা সাদা কাপড় দিয়ে তার সারা শরীর পেঁচানো।
নাফিস বুঝতে পারলো না, সে কিভাবে একই সাথে বিছানায় শুয়ে আছে আবার টেবিলে বসে ফেসবুক পোস্টও দেখে চলেছে।
নাফিস কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলো না – কি ঘটছে চারদিকে সেই অদ্ভুতুড়ে সকালটাতে।
