সুলতানার অদ্ভুতুড়ে মাথাব্যথা  

মাথাব্যথার এই সমস্যাটা দীর্ঘদিন ধরে ভোগাচ্ছে সুলতানা ভাবীকে। ব্যথাটা সবসময় মাথার বাঁ-দিক থেকে শুরু হয়, তারপর ভোঁতা একটা যন্ত্রনা ছড়িয়ে পড়ে সারা করোটি জুড়ে।   

কয়েকবার ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান দেখিয়েছে ও, একবার স্পেশালিস্টও দেখালো। কেউই কোন সমাধান দিতে পারলো না।

আলবার্টা আসার পর থেকেই সুলতানার এই সমস্যার শুরু। একে তো বাবা-মা, ভাই-বোনকে ছেড়ে চলে আসার মানসিক কষ্ট, তার ওপর আবার এই শারীরিক সমস্যা। ওরা বলে, এসবেরই কারণ শিনুক, প্রচন্ড শীতের মধ্যে পশ্চিম দিক থেকে ভেসে আসা হঠাৎ উষ্ণ হাওয়া – যা কিনা অনেকেরই শরীর নিতে পারে না।

কানাডা আসার আগে সুলতানার চিন্তা ছিল এদেশের মাইনাসের ঘরের তাপমাত্রা নিয়ে।  কিন্তু পশ্চিম কানাডার এই আলবার্টাতে এসে দেখা গেলো, শীতের চেয়েও বড়ো সমস্যা দিন-রাতের আবর্তন। জুন মাসে দিন হয় সাড়ে আঠারো ঘন্টা লম্বা, আর ডিসেম্বরে দিন ছোট হয়ে নেমে আসে মাত্র সাত ঘন্টায়। সুলতানা ঠাহর করতে পারে না, কোনটা তার মাথাব্যথার জন্য দায়ী – ঠান্ডা আবহাওয়া, নাকি দিন-রাতের এই অদ্ভুতুড়ে রকম দ্রুত পরিবর্তন।      

দুই হাজার চৌদ্দ সালের সেপ্টেম্বরে সুলতানার ডাক্তার তাকে এক সাইকায়াট্রিস্টের কাছে যেতে বাধ্য করলো, আর আধ-পাগল সেই সাদা বুড়ো সুলতানাকে বললো তার এংজাইটি হয়েছে। সেই ডক্টর ম্যাথু তাকে কি এক ওষুধ দিলো, মাথাব্যথা তো গেলোই না, বরং সেটা খেয়ে তার ঘুম বেড়ে গেলো। সারাদিন ঝিম ধরে থাকতে হয়, অফিসের মিটিংয়ে ‘গ্লাসি আই’ নিয়ে বসে থাকতে হয়, কি এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। শেষে মিজানের সাথে পরামর্শ করে ওষুধটা ছেড়েই দিলো সে – শুরু করার মাস দেড়েক পর। 

মিজানের বন্ধু আসিফ ভাই মসজিদের কাছে বাসা নিয়েছেন, সোয়াব পাওয়ার আশায় মাইনাস টোয়েন্টি ডিগ্রিতেও হেটে মসজিদে যান। তিনি সস্ত্রীক বেড়াতে এসে একদিন সুলতানাকে ‘রুকিয়া’ করার পরামর্শ দিলেন। যারা জানেন না, তাদের সুবিধার্থে বলছি – রুকিয়া হলো জীন তাড়ানোর আরবি মন্ত্র।

“আমাদের বাসায় তো জিনের উপদ্রবের কোন লক্ষণ দেখি না।” – মিজান আমতা আমতা করে বলেছিলেন।

“ভাই, জীন যখন ঘরে ঢুকতে পারে না, তখন অনেকসময় দূর থেকে স্বপ্ন দেখায়, ঘুমের ডিস্টার্ব করে। ভালো ঘুম না হলে মাথাব্যথা তো হবেই।” – হাতের আঙ্গুলগুলোকে চিরুনি বানিয়ে কাঁচা-পাকা দাড়ি আঁচড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললেন আসিফ ভাই। 

শেষপর্যন্ত একটা সমাধানের মতো এলো রুদাবা ভাবীর কাছ থেকে। নভেম্বরের এক তুষারঢাকা সন্ধ্যায় তিনি উপলধ্বি করলেন – সম্ভবত সমস্যাটা ‘কালবের’ অর্থাৎ হৃদয়ের, আর তাই এর সমাধানও হবে আধ্যাত্মিক ধরণের।

“দিন শেষে আমাদের সমস্ত সমস্যার আসল কারণ খোদার সাথে আমাদের সম্পর্কের অবনতি।” – রুদাবা মত প্রকাশ করলেন। 

তিনি সুলতানাকে এক ধর্মীয় চা-চক্রের খবর দিলেন, যেখানে গেলে হয়তো সুলতানার এই সমস্যার সমাধান হলেও হতে পারে।      

শুধু বাঙালি মহিলাদের নিয়ে মাসিক এই হালাকা অর্থাৎ ইসলামিক আলোচনা সভাটা সুলতানার খুব ভালো লেগে গেলো। ফেরেশতাদের মধ্যস্থতার কারণেই হোক, বা ধর্মভীরু আপাদের দোয়ার কারণেই হোক, কেমন করে যেন সুলতানার মাথাব্যথা একেবারেই কমে গেলো। প্রতি সন্ধ্যায় সে তাফসীর আর হাদিসের পড়া নিয়ে বসে, আর প্রতি সপ্তাহান্তে সিস্টারদের নাস্তা পার্টিতে যায় – ভালোই তো লাগে সবার সাথে মিশতে।    

আসলে প্রবাস জীবনে নিজের কৃষ্টি বা কালচারগুলো নিয়ে চর্চা করার সুযোগ বেশ উপভোগ করে সুলতানা – সে পহেলা বৈশাখের পিঠা উৎসবে যেমন যায়, তেমনি এই হালাকাতেও সুযোগ পেলেই চলে আসে। সত্যি কথা বলতে মহিলা-হালাকাতে যেসব জিনিস নিয়ে আলোচনা হয়, ধর্মের বাইরেও এগুলোর উপযোগিতা রয়েছে বলে সে মনে করে।

যেমন আজকের আলোচনার বিষয়টার কথাই ধরা যাক – হালাকার আয়োজক আসমা আপা আজকে পড়াচ্ছেন গীবত বা পরচর্চা বিষয়ে।  কি সুন্দর করেই না বিষয়গুলো বুঝিয়ে বললেন তিনি! কেউ একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল – কারো পেছনে তাকে নিয়ে কথা বলাকে ধর্ম কেন এতো বড় ইস্যু বানিয়েছে? এটাতে তো ওই লোকের কোনো ক্ষতি হচ্ছেনা।

আসমা আপা তখন বুঝিয়ে বললেন – প্রথম কথা হলো, অবশ্যই যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে তার ক্ষতি হচ্ছে, মান-সম্মানের ক্ষতি আর্থিক ক্ষতির চেয়ে অনেক বড়। দ্বিতীয় কথা হলো, আমরা শুধু এক পক্ষের কথা শুনছি, আর উভয় পক্ষের কথা না শুনে কাউকে বিচার করা ধর্ম অনুমোদন করে না। তৃতীয় কথা হচ্ছে, অন্যকে নিচু করে কথা বলার অর্থ হচ্ছে নিজেকে বড় মনে করা, যেটার অন্য নাম অহংকার, আর অহংকারও কিন্তু অনেক বড় পাপ।

আরেকজন আপা বললেন – “সুন্দর বলেছেন আপা, আহা আমরা এখানে কত কিছু শিখছি মাশাল্লাহ। আমার আফসোস লাগে ওই আপাদের জন্য, যারা এখানে আসে না, দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে। আল্লাহ তাদের হেদায়েত দিন।”

বেশ কয়েকজন আপা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ‘আমিন’ বললেন। সুলতানা এ হালাকায় নতুন, সে বললো – “কিন্তু আসমা আপা, যারা এখানে আসে না তাদের কাউকে কিন্তু আমি খারাপ পাই নি, এমনকি ওদের অনেকে তো পুরোপুরি ধর্ম-কর্ম করে।”

আসমা আপা বললেন – “আপনি ঠিকই বলেছেন।”

কিন্তু সিনিয়র আপা রওশন আরা বেগম ঠিক মানতে পারলেন না, বললেন – “সুলতানা, বোন, শোনেন, উনাদের মধ্যে যারা নামাজ পরে পর্দা করে, তাদের আমিও চিনি । তারা দেখবেন আমাদের উপমহাদেশীয় মসজিদে আসে না, তারা যায় আরব মসজিদে। ওরা বোধ হয় ওহাবী, ওদের সাথে মেলা-মেশা না করাই ভালো।”

রুনা আপা সাথে যোগ করলেন – “রওশন আপা ঠিকই বলেছে, মনে রাখবেন আপনি যার সাথে মিশবেন তার সাথেই আপনার হাশর হবে।”  

মিলা ওই অন্য মসজিদেও যায় মাঝে মধ্যে, আরব মহিলারা যথেষ্ট সম্মান আর আপ্যায়নই করে তাকে, আর ওই মহিলারাও ভালো ভালো কথাই বলে। ফলে – কার সাথে হাশর হলে ভালো হবে – এটা নিয়ে সে ভীষণ দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো।

আজ হালাকা থেকে বের হবার পর মিলার কেমন যেন লাগতে শুরু করলো। সন্ধ্যায় সে কেমন যেন একটা বমি বমি ভাব নিয়ে সে বাসায় ফিরলো। রাত গভীর হবার আগেই তার মাথায় ভীষণ যন্ত্রনা হতে শুরু করলো – ব্যথাটা মাথার বাঁ-দিক থেকে শুরু হলো, তারপর সেটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো সারা করোটি জুড়ে। সম্ভবত তার মাইগ্রেনের সমস্যাটা আবার ফিরে আসছে – সেই অজানা উৎস থেকে, যেখান থেকে প্রথমবার ওটা এসেছিলো।

One thought on “সুলতানার অদ্ভুতুড়ে মাথাব্যথা  

Leave a comment