সামাদ সাহেবের ছায়া

সামাদ সাহেবের ছায়া

আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে না পেয়ে আরিফা ভয় পেয়ে গেলেন। ঘরের বাকি সবকিছু দেখা যাচ্ছে, শুধু তার শরীরের জায়গাটাই শূন্য – যেন আরিফা স্বচ্ছ একটা কাঁচ, আর সেজন্য তার পেছনের সব কিছুই দেখা যাচ্ছে।

গত সপ্তাহেই সামাদ আয়নাটা কিনে এনেছে। পুরোনো ফার্নিচারের দোকান থেকে। আয়নাটা দেখেই সামাদ সাহেবের নাকি মনে হয়েছিল এটা তারই জন্য অপেক্ষা করছে ওখানে। বনেদি ঘরানার আসবাব হিসেবে দামটাও ছিল ধরাছোয়ার মধ্যেই।

আরিফা কিছুক্ষন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আয়নাটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর একটা চিৎকার দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। সামাদ সাহেব দৌড়ে শোয়ার ঘরের সামনে এসে দেখেন, আরিফা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে থর থর কর কাঁপছেন। কিন্তু ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে ভদ্রলোক অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পেলেন না।

বাংলা ভাষায় কোন শব্দটা সবচেয়ে মধুর, এই প্রশ্নের উত্তরে বেশির ভাগ মানুষই বলবে – ‘মা’। কিন্তু সামাদ সাহেবের ধারণা, এই দাবীটা পুরোই ভুয়া। মুখে মায়ের কথা বললেও মনে মনে সবার কাছে সবচেয়ে মধুর শব্দ হচ্ছে ‘আমি’- সামাদ ভাবলেন। মানুষের কাছে ‘আমি’-র চেয়ে মধুর শব্দ আর কি হতে পারে, সামাদ সাহেবের বুঝে আসে না। ‘আমি’, ‘আমার’, ‘আমাকে’ – এই প্রতিটা শব্দ বলার সময়ই মন কেমন যেন করে ওঠে, মন ভালো হয়ে যায়, ঠিক কিনা!

বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চিনি ছাড়া চায়ে চুমুক দিতে দিতে এসব আবোল-তাবোল কথাই ভাবছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। সাধারণত ফুরফুরে মেজাজে থাকলেই এসব দার্শনিক ভাবনা আসে তার মাথায়। আজ তেমনি একটা দিন।   

গত সাতদিন কি ধকলটাই না গেছে!

মসজিদে দৌড়ানো, হুজুর জোগাড় করা, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে জনে জনে খবর দেয়া, তারপর আবার গলার আওয়াজ ভারী করে প্রত্যেকবার বিষন্নতার ভাব করা – পুরো জানের ওপর দিয়ে গেলো এই কয়টা দিন।

বিকেলের রোদে বারান্দার বেতের চেয়ারটায় বসে সিগারেটে ছোট ছোট টান দিতে দিতে আর গত কয়দিনের ঝুট-ঝামেলার কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আব্দুস সামাদ আরেকবার শিউরে উঠলেন। এই যে আরাম করে যে সিগারেটে দুইটা টান দেবেন, বাসায় স্রোতের মতো অতর্কিতে হাজির হওয়া শত শত আত্মীয়-স্বজনের যন্ত্রনায় সেটাও করতে পারেন নি তিনি গত কয়েকটা দিন।

ঘটনাটা ঘটে অবশ্য একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, শেষের দিকে আরিফার যন্ত্রনা চরমে উঠেছিল – কথা নেই বার্তা নেই চিৎকার করে উঠতো, সারারাত ঘুমাতো না আর তাকেও ঘুমাতে দিতো না। অনেকদিন পর গতকাল রাতে সামাদ সাহেব শান্তি মতো ঘুমিয়েছেন, পুরো সাড়ে আট ঘন্টা বেঘোরে ঘুম দিয়ে উঠেছেন। 

আরিফার বড় কোন অসুখ ছিল না, কিন্তু মাস ছয়েক আগে কি হতে কি হলো – সে উল্টা-পাল্টা কথা বলা শুরু করলো। সারাদিন ওই আয়নাটার সামনে বসে থাকতো আর বলতো আয়নাটার নাকি জান আছে, এই আয়না নাকি তার সাথে কথা বলে। 

প্রথম প্রথম সামাদ সাহেব এসব কথা খুব একটা পাত্তা দেন নি, আর এমনিতেও তিনি আরিফার সব কথা মন দিয়ে শুনতেন না – মেয়েছেলের বেশির ভাগ কথাই ‘হাবি-জাবি’, কিন্তু দিন যত গেলো আরিফার সমস্যা ততই বাড়তে লাগলো। শেষের দিকে সে আয়নাটা ভাঙার চেষ্টা করেছিল, সামাদ সাহেব ওটা ঘর থেকে সরিয়ে নিয়েছেন সাথে সাথে – পুরাতন ফার্নিচারের দোকান থেকে এত দাম দিয়ে কেনা জিনিস, ‘পাগল-ছাগল’-দের সেটা ধ্বংস করতে দেয়ার কোনো মানেই হয় না, তাই না !  

জুন মাসের প্রথম দিকে আরিফা বলা শুরু করলো, সে তার নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছে না, আর এটার জন্য নাকি সামাদ সাহেবই দায়ী – আরিফার ঘর থেকে তিনি আয়না সরিয়ে ফেলার পর থেকেই নাকি আরিফার কাছ থেকে তার ছায়া হারিয়ে গেছে, বা পালিয়ে গেছে।

স্ত্রীকে নিয়ে সামাদ সাহেব কি বিপদেই না পড়েছিলেন! লোকের কাছে মুখ দেখানোর জো ছিল না।

সিগারেটের ধোয়ার সাথে সাথে ওই দুঃসহ স্মৃতিগুলো সামাদ সাহেবের মনের পাঁজর থেকে মুক্ত হয়ে ঊর্ধ্বাকাশে বিলীন হয়ে যেতে লাগলো সে বিকেলে এসব কারণেই।

বিনা নোটিশে স্ত্রী মারা যাওয়াতে সামাদ সাহেব যে শোকে-দুঃখে ভেঙে পড়েছেন, সেটা পুরোপুরি ঠিক না। হ্যা, খাবার-দাবারে একটু সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু সেটা তো কাজের লোক দিয়েই চালিয়ে নেয়া যায়। বাসাটা একটু খালি খালি লাগে, কিন্তু সেটা তো একটা পোষা বিড়ালের জন্যও মানুষের লাগতে পারে। একসময় নিশ্চয়ই এতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে যাবেন, হয়তো এমনকি ব্যাপারটা ভালোও লাগতে শুরু করতে পারে।

আরিফা মারা যাওয়ার পর অনেকেই এসে তাকে স্বান্তনা দিতে চেষ্টা করেছে। যেমন, ঘটনার ঠিক আটদিনের মাথায় সামাদ সাহেবের সাথে দেখা করতে এলেন ফখরুল ইসলাম। ড্রইংরুমের বেতের সোফায় মুখোমুখি বসতে বসতে ফখরুল বলে উঠলেন – “বন্ধু, মন খারাপ করো না, ভাবী তো খোদার কাছে গেছে, তার মানে সে ভালোই আছে।  বান্দাকে খোদার চাইতে কে বেশি ভালোবাসে, বলো?”

সামাদ একটা সিগারেট ধরালেন – ” এই যে খোদার কথা বললে, তিনি কে? তিনি কোথায় থাকেন? কি তার অস্তিত্বের প্রমান? তুমি বলতে পারবে, প্লিজ,?”

ফখরুল অবাক হলেন না। বন্ধুর গতি-প্রকৃতি বহু বছর থেকেই তার জানা। বললেন – “সবকিছুর কি প্রমান থাকে? তোমার ভেতর যে একটা প্রাণ আছে, যে প্রাণটা চলে গেলে তুমি মরে পড়ে থাকবে, সেই প্রাণ জিনিসটা তো একটা ধারণা মাত্র। এর কি প্রমান আছে, বলো? এই যে সারাদিন ‘আমি’, ‘আমি’ করো, এই ‘আমি’ও তো অদৃশ্য একটা জিনিস, একটা ধারণা মাত্র। এরই বা প্রমাণ কি? তোমার মন, তোমার আনন্দ, তোমার ব্যথা, এগুলো তো ধরা-ছোয়া যায় না, তাই বলে কি এগুলি নেই? এগুলি মিথ্যা?”

সামাদ নিজের ডান হাতটা উঁচু করে চোখের সামনে তুলে ধরলেন। নিজের শরীরের দিকে তাকালেন। তারপর উদাস হয়ে বললেন – “এই যে আমি এই মুহূর্তে মস্তিষ্কের ভেতর বসে থেকে চোখের জানলা দিয়ে আমার অধিকারে থাকা শরীর নামের এই যন্ত্রটাকে দেখছি। আমি চিন্তা করতে পারছি, এটাই তো প্রমান করে আমি আছি। ব্ল্যাসফেমি করতে চাই না, কিন্তু ঈশ্বরের বিষয়ে সেরকম প্রমানগুলি কোথায়?”

“আরে বন্ধু, তোমার অস্তিত্বই তো ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমান। তোমার মৃত শরীরে যে আত্মা জীবন দেয়, সেই আত্মা তোমার শরীরের আয়নায় ঈশ্বরের গুণাবলীর প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কি!”

“ভাই, হয় আমার দেহের ভেতর ঐশ্বরিক কোন আয়না নেই, না হয় আমি এক ধরণের অন্ধ।” – সামাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন – “যেকোন কারণেই হোক, এসব আজগুবি তত্ত্ব আমার পক্ষে বোঝা কোনোমতেই সম্ভব না। কি আর করা !”

পুরোনো ফার্নিচারের দোকান থেকে কেনা সেই আয়নাটাতে প্রথমবার অস্বাভাবিকতা দেখলেন  সামাদ সাহেব পরের সপ্তাহের রোববার সন্ধ্যায়। 

গরম বেশি পড়েছিল বলে সামাদ ফুলস্পিডে ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে তার বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলেন। আধো-অন্ধকার ঘরে ফ্যানের বাতাসে ঘাম শুকাতে শুকাতে কখন যে তার ঝিমানি এসে গেছে, তিনি নিজেও জানেন না।

কিন্তু হঠাৎ করেই তার মনে হলো কেউ তাকে ডাকছে, ধড়মড় করে উঠে বসলেন তিনি, আর তখনি লক্ষ্য করলেন শব্দটা আসছে আয়নাটার ভেতর থেকে।

বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, ঘরের ভেতর অন্ধকার বেশ গাঢ়। আচমকা ঘুম ভেঙে সামাদ যখন এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন, আয়নাটার ভেতর থেকে আবার কেউ কথা বলে উঠলো – হুবহু তার নিজের কণ্ঠে – “এই, আপনি কে?” 

সামাদ সাহেবের মাথা পরিষ্কার কাজ করছিলো, তাই তিনি ধারণা করলেন তিনি ভুল শুনছেন। কিন্তু তখনি আবার ওটা কথা বললো – “এই যে, ব্রাদার, আপনাকেই বলছি। আপনি কে, ভাই?”

সামাদ নিশ্চিত হলেন, এটা তার নিজেরই গলা। সম্ভবত মনের ভুল জেনেও শুধুই কৌতূহলের কারণে কথা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। প্রথমে ভড়কে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠলেন – “আমাকে চিনিস না? আমি তোর সেই মালিক, যে মালিক ছাড়া তোর অস্তিত্বই নেই।”

“কি বলছেন ভাই? আমার অস্তিত্ব নেই? এই যে আমি আছি।” – তর্ক জুড়ে দিলো সামাদের ছায়া তার সাথে।

“আরে গাধা। তুই আছিস সেটা তো সারা দুনিয়া জানে। কিন্তু সত্য তো এই যে, আমি আছি বলেই তুই আছিস। আমি না থাকলে তুই থাকতি না। তোর অস্তিত্বই আমার অস্তিত্বের প্রমান।”

“না, ব্রাদার – আমি আছি, আপনিই বরং নেই। আপনি যদি আমার মনের ভুল না হতেন, তাহলে আমি আপনাকে ধরতে পারতাম, ছুঁতে পারতাম।” – দাম্ভিক আয়নাটা বলে চলে।

সামাদ সাহেবের তখন মনে হলো, নিজের সাথে এই অসুস্থ খেলাটা বন্ধ করা প্রয়োজন। তিনি আয়নার সামনে থেকে সরে এলেন, আর কি আশ্চর্য – আয়নাটাও কথা বন্ধ করে দিলো। ওটার সামনে গেলেই উন্মাদ এই আয়না ভাবে সে জীবিত, অদ্ভুত তো!

সামাদ চিৎকার করে বলে উঠলেন জনশূন্য ঘরের ভেতর – “এই যে আমি সরে গেছি, আর তোর কথাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন প্রমান হলো তো, কার অস্তিত্ব আসল, আর কারটা নকল?”

সন্ধ্যায় ডিমভাজি আর ডাল দিয়ে তৃপ্তি করে ভাত খেলেন সামাদ সাহেব, কিন্তু সে রাতে কোন এক অজানা কারণে তার ঘুম আসতে চাইলো না – বার বার তার চোখ চলে যেতে চাইলো ভিনিসিয়ান সেই আয়নাটার দিকে। কোন অবৈজ্ঞানিক জিনিসে তিনি বিশ্বাস করেন না, তবু অজানা এক আতঙ্ক কেন যেন তাকে বার বার ঘিরে ঘিরে ধরতে চাইলো সে রাতে।

সে সন্ধ্যার পর থেকে প্রায় প্রায়ই সামাদ সাহেব আয়নার ভেতর থেকে শব্দ শুনতে পেতেন। আয়নায় নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে মাঝে মধ্যেই তার মনে হতো, তার ছায়াটা ঠিক তার সাথে সাথে নড়ছে না, একটু যেন দেরি হচ্ছে ওটার প্রতিক্রিয়া দেখাতে।

আয়নাকে ঘিরে দিন দিন সামাদ সাহেবের আতঙ্ক বাড়তে লাগলো। একদিন শেষরাতে ঘুম ভেঙে তিনি শোনেন, হুবহু তার গলা নকল করে আয়নার ভেতর থেকে কেউ বলছে – “বিষয়টার আজ একটা মীমাংসা হওয়া দরকার।”

“কোন বিষয়?” – সামাদ ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করেন তার প্রতিচ্ছবিটাকে। 

“আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। আমি আপনাকে দেখছি, যদিও আমি জানি আপনি আমার মনের কল্পনা মাত্র।”

সামাদ হেসে উঠলেন – বলে কি এই ছায়া! যে সামাদ এই প্রতিচ্ছায়ার স্রষ্টা, তাকেই কিনা সে অস্বীকার করতে চাইছে?

“তুই কি করে বুঝলি, আমি নেই?” – সামাদ মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে তার ছবিকে।

“প্রথমত আপনার অস্তিত্বের কোন প্রমান নেই। আর যার প্রমান নেই, তার অস্তিত্ব মেনে নেয়া অযৌক্তিক।”

“তোর মেনে নেয়া আর না নেয়াতে বয়েই গেছে আমার।” – সামাদ বললেন – “বটমলাইন হলো, আমি জীবিত আর তুই মৃত একটা জড়বস্তু।”

আয়না তখন তার সাথে তর্ক জুড়ে দিলো – “ভাই সাহেব, আমি যদি জীবিত না হই, তাহলে আমার ভেতর নড়া-চড়া করছে যে জিনিসটা সেটা কি?” 

সামাদ তখন হেসে ফেলে বললেন – “তোর ভেতর যেটা নড়া-চড়া করছে, সেটা আমারই ছায়া। আমি তোর সামনে এলেই তোর প্রাণহীন শরীরে প্রাণের একটা স্পন্দন তৈরি হয় মাত্র। এটা কিছু না, বোকা। তুই যাকে তোর অস্তিত্ব ভাবছিস সেটা আসলে তোর একটা বিভ্রম মাত্র। আসলে এই ঘরে আমি আর কয়েকটা মশাই শুধু জীবিত, আর তুই হচ্ছিস একটা আয়না মাত্র। আমি মূর্ত, আর তুই হচ্ছিস বিমূর্ত, বুঝলি গাধা কোথাকার?”

“কথাটা আমি মানতে পারছি না” – আয়নার ওপাশের ঘরটাতে তখন সেই প্রতিবিম্ব রীতিমতো পায়চারি শুরু করেছে – “আমার কোন স্রষ্টা নেই। যদি সেরকম কেউ থাকতোই, সে আমাকে এই ঘরে বন্দি করে রাখতো না, আর একাও ফেলে রাখতো না। আমাকে সে মুক্ত রাখতো, যেন আমি যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারি। আমাকে সে স্বাধীনতা দিতো, যেন আমি যা খুশি তাই করতে পারি।”

সামাদ সাহেবের আর সহ্য হলো না। যে ছায়ার স্রষ্টা তিনি, সেই ছায়াই কিনা তার মূলকে অস্বীকার করছে! ভিনিসিয়ান আয়নাটা সামাদ বগলদাবা করলেন, তারপর দরজা খুলে সোজা চলে গেলেন ছাদে। ছাদে ছিল একটা খালি ড্রাম, ওটার ভেতর আছড়ে ফেললেন তিনি আয়নাটাকে – ঝন ঝন শব্দ করে ভেঙে পড়লো কালো আয়নার দামি কাঁচ।

আয়না ভাঙার শব্দ শুনে কেন যেন নিজের ভেতর মুক্তির এক ওপর আনন্দ অনুভব করলেন সামাদ। কিন্তু কি মনে হতেই আবার ফিরে গেলেন নিচে, রান্নাঘরে খুঁজে পেতে কিছু কেরোসিন তেল আর একটা দেশলাইয়ের বাক্স নিয়ে ফিরে এলেন চাঁদের আধো আলোতে, তারপর ড্রামের ভেতর আয়নার ধ্বংসাবশেষের ওপর ভালো করে তেল ছিটিয়ে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন বার দুয়েকের চেষ্টায়। হাবিয়া দোজখ যেভাবে প্রথম এক হাজার বছর জ্বালার পর লাল হয়েছিল, তারপর আরো এক হাজার বছর পর কালো, ঠিক সেভাবে হলুদ আগুন লালচে হয়ে একসময় কালো ধোয়া ছাড়া শুরু করলো। সামাদ তখনি শুধু নিশ্চিত হলেন যে আয়নাটার মৃত্যু হয়েছে, স্ত্রীর মতো মাথা খারাপ হয়ে তাকে আর মরতে হবে না।

সে রাতে অনেকদিন পর আবার খুব গাঢ় সুন্দর ঘুম হলো সামাদ সাহেবের। শুধু শেষ রাতে

ঘুমের ঘোরে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলেন তিনি। তিনি দেখলেন, তার সেই প্রতিবিম্ব তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আর করুন মুখে বলছে – “আমাকে মেরে ফেললেন, জনাব? সত্যকে জানার একমাত্র সূত্রটাও হেলায় হারালেন? নিজের ছায়াকে কেউ নিজে এভাবে শাস্তি দেয়? এখন আপনি কিভাবে আপনার ছায়া ফেরত পাবেন?”

সেই স্বপ্ন দেখে সামাদ ভয় পেয়ে গেলেন। আশংকা তার মনকে ঘিরে ধরলো, আরিফার মতো তারও মাথা খারাপ হওয়া শুরু করেছে না তো! তার সে আতঙ্ক আরো ঘনীভূত হলো, যখন পরদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে – গ্রীষ্মের তীব্র রোদের ভেতর – মাটির দিকে তাকিয়ে কোন অজানা কারণে তিনি চারপাশে নিজের কোন ছায়া খুঁজে পেলেন না।

Leave a comment