১
মারা যাওয়ার পর জাহিদ ভেবেছিলো, তাকে আগুনের কোন কুন্ডে ফেলা হবে – এমন আগুন এক হাজার বছর ধরে জ্বলে জ্বলে যা রক্তবর্ণ হয়েছে, তারপর আরো বাড়তি এক হাজার বছর ধরে জ্বলে জ্বলে যা কৃষ্ণগহ্বরের মতো ঘর অন্ধকার হয়েছে। বিশেষ করে, কবরে ভয়ঙ্কর দুই জীব দেখার পর সে নিশ্চিত ছিল, নরকই হবে তার শেষ বাসস্থান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো, তেমন কিছুই হয় নি। জাহিদ জেগে উঠেছে নিজের ঘরে, নিজের বিছানায়।
শুধু একটাই সমস্যা, সবকিছু সে সাদা-কালো দেখছে। পুরোটাই যেন একটা ব্ল্যাক-এন্ড-হোয়াইট মুভি। ও, আরেকটা সমস্যা। কোনকিছুর গন্ধ পায় না সে। হয়তো অকারণেই কোন খাবারে কোন স্বাদ নেই। সেদিন আনারকলি মার্কেটের পুরীর দোকানে গিয়ে ডিম আর পারাটা অর্ডার দিলো, সাথে অতিরিক্ত চিনি দিয়ে এক কাপ দুধ-চা। কাউন্টারে একটা মাত্র লোক বসা ছিল, আব্দুল মতিন। এ তো সেই মতিন, যার শুকনো শরীরটা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছে জাহিদ নিজে। সে তো জানতো, মতিন মারা গিয়েছিলো মালিবাগ মোড়ে সেই মিনিবাসের ধাক্কায়।
জাহিদকে দেখে মতিন কাউন্টারের পেছন থেকে উঠে দাঁড়ালো – “আরে মামা, আপনি কবে আইলেন এইহানে?”
জাহিদ কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো – “বেশ কয়দিন হলো এসেছি। আপনার সাথে দেখা হয় নি, এই যা। আপনি তো ওই একসিডেন্টে মারাই গিয়েছিলেন, তাই না? যেভাবে মাথাটা থেতলে গিয়েছিলো, ভাবলে এখনো মাথা ঘুরে যেতে চায়।”
মতিন ময়লা দাঁত বের করে হাসলো – “মানুষ কি আর অত সহজে মরে!”
“তা অবশ্য ঠিক।” – জাহিদ সায় দিলো, তারপর হঠাৎই বললো – “সব চুপচাপ কেন, মতিন? মনে হয় কার্ফু চলছে।”
মতিন হাসলো জাহিদের প্রশ্ন শুনে। “আইজকাল মনে হয় লোকজন মরতেসে না। দেশে মনে হয় ডাক্তার বাড়ছে।” – হতাশ গলায় বললো সে।
“হতে পারে। তারপরও অনেককেই দেখি না, যাদের আমি নিশ্চিত জানি মারা গেছে। আপনি কি নিশ্চিত, যারা মারা যায় সবাই বেহেশতেই আসে? নাকি কেউ কেউ দোজখেও যায়?”
মতিন চোখ-মুখ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইলো, যেন জাহিদ কোন মিথ্যা বা ভুল কথা বলেছে। জাহিদ তার দিকে তাকাতেই সে বললো – “এইটা ভাই বেহেশত না। এইটা কি জায়গা, আমি নিজেও জানি না।”
সেদিন মতিনের দোকানে ডিমভাজা কিংবা পারাটা কোনোকিছুরই কোন স্বাদ পেলো না জাহিদ – রুটিকে তার মনে হলো নিউজপ্রিন্টের দলা, আর ডিমের অমলেটকে মনে হলো এ-ফোর সাইজের সাদা কোন কাগজ চিবাচ্ছে। চা-টাকেও তার স্বাদহীন গরম পানি মনে হলো। জাহিদ শুনেছে, করোনা ভাইরাসে ধরলে কখনো কখনো গন্ধের অনুভূতি চলে যায়। কিন্তু তার মনে হলো, এই ব্যাপার এই দুনিয়ার বৈশিষ্ট্য।
মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর পরকালের প্রথম অধ্যায়ে জাহিদের ছিল একটা স্বস্তি আর একটা আনন্দ। স্বস্তি এজন্য যে, সে ভেবেছিলো মৃত্যুতে সবকিছুর শেষ, আর জীবন যথারীতি অর্থহীন। আর আনন্দ এজন্য যে, লুবনা বেঁচে আছে এবং তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। সে চিন্তাই করতে পারে নি, আর কখনো লুবনাকে সে ফিরে পাবে।
কিন্তু বেশ কয়েকদিন লুবনাকে দোতলা সাদা বাসাটার সামনে ঘোরাঘুরি করেও ওই বারান্দায় সে কারো ছায়া পর্যন্ত দেখতে পেলো না। শেষে এক বিষন্ন বিকেলে সে সাহস করে গেট খুলে কম্পাউন্ডের ভেতরে ঢুকে গেলো। উঠোনের ছোট্ট বাগানটা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা, কিন্তু কোন মানুষকে কোথাও চোখে পড়লো না। সিঁড়িকোঠার দরজা খোলা দেখে জাহিদ সোজা দোতলায় উঠে গেলো, সেখানেও দেখা গেলো ঘরের দরজায় কোন তালা নেই। জাহিদ কিছুক্ষন কড়া নাড়লো, কয়েকবার বেল বাজালো, তারপর কোন সাড়া পেয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। ড্রইংরুম ফাঁকা, কিন্তু বেতের সোফা পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা। ততক্ষনে জাহিদের সাহস বেড়ে গেছে, সে বেশ কয়েকবার লুবনার নাম ধরে ডাকলো, শেষে উত্তর না পেয়ে মন খারাপ করে ফিরে এলো মৃত এই শহরের জনশূন্য পথে।
জাহিদ যখন বাইরের গেট খুলে ওর বাসাটার ভেতর ঢুকছিল, ঠিক তখনি সেই তরুনীটা ওর চোখে পড়লো। মুখটা খুব চেনা চেনা। ওর সাথে চোখাচোখি হতেই মেয়েটা মুখ টিপে হাসতে শুরু করলো, যদিও ওর চোখ দুটো সেভাবে হাসছিলো না। ও ইশারা করতেই জাহিদ হাটতে শুরু করলো, তারপর খুব দ্রুতই তাদের দুজনের পথ শেষ হলো তাদের গলির শেষমাথায় পুরোনো তিনতলা বাসাটায়। আর তখনি জাহিদের মনে পড়ে গেলো রুনার কথা। ওকে দেখে জাহিদের ভেতর হঠাৎ করেই পুরোনো একটা নেশা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইলো, রুনার ওপর থেকে ও যেন চোখ সরাতেই পারছিলো না।
ওকে দেখে জাহিদ আরেকবার নিশ্চিত হলো যে এটা স্বর্গ। যে করেই হোক, সে এখানে চলে এসেছে। জাহিদ ধরে নিলো, হয়তো কোথাও স্বর্গীয় কোন ভুল হয়েছে। ওর অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না, ঐশ্বরিক শক্তিতে অবিশ্বাসের জন্য তাকে যে শাস্তি পেতে হচ্ছে না, এটাই আপাতত ভীষণ স্বস্তির সংবাদ।
“তুমি আবার এসেছো? তোমার সমস্যা কি?” – রুনা হেসে বললো তাকে।
“আবার এসেছি মানে?”
“এই নিয়ে তো তিনবার হলো। আর তুমি কিছুই জানো না?”
জাহিদ বুঝতে পারলো না, কেন রুনা এভাবে হেয়ালি করে কথা বলছে। এটা সাদা-কালো পৃথিবী বলে জাহিদ ওর শাড়ির রং বুঝতে পারছিলো না, কিন্তু গাঢ় ছাই রং দেখে সে আন্দাজ করলো – এটা আসলে সবুজ রঙের একটা শাড়ি, যেটা এই মুহূর্তে এক লোলুপ যুবকের মত মেয়েটার রোমাঞ্চকর শরীরকে আষ্টে-পৃষ্ঠে জাপ্টে ধরে আছে।
রুনা আপা সিনেমা করতো। তার বাসায় চলচ্চিত্র জগতের অনেককেই আসতে দেখা যেত। তাদের কাউকে কাউকে আবার গভীর রাতে ওর ঘর থেকে বের হয়ে চলে যেতে দেখা যেত। এই সেই রুনা, যে মারা গিয়েছিলো অল্পবয়সে, আত্মহত্যা করে। তাহলে এটা কি সেই আশির দশকের সিদ্ধেশ্বরীর একটা প্রতিরূপ, যা খুব যত্ন করে কেউ তৈরী করেছে, আর সেখানে জায়গা করে নিয়েছে সে সমস্ত লোক, যারা পৃথিবী থেকে ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে – অপঘাতে? চিরসন্ধ্যার এই শহরে সে শুধু তাদেরই দেখা পাবে, যারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে – অসময়ে অকালে অথবা অপঘাতে?
ঠিক কৈশোরের দিনগুলোর মতো চোখের কোনা দিয়ে বার বার জাহিদ তাকাচ্ছিলো রুনার উদ্ধত বুকের দিকে, যদিও কথা চালিয়ে যাচ্ছিলো এমনভাবে যেন কিছুই হয় নি – “রুনা আপা, আমি এখানে আসার পর থেকে কোন রং দেখতে পাচ্ছিনা। আপনি কি জানেন কেন?” উত্তরে রুনাও কিন্তু হাসলো, মোহময় সে হাসি – “তুমি যা চাও, তাই যদি পাও, তাহলে রং দিয়ে কি করবে?”
“তার মানে কি আমরা কি এখন স্বর্গে আছি?” – জাহিদ বলে উঠলো। রুনা উত্তর দিলো না, শুধুই হাসলো। কিন্তু জাহিদের কেন যেন সে হাসিকে খুব শুকনো মনে হলো।
“আমি একজন মানুষকে খুঁজছি, কিন্তু পাচ্ছি না। আমি তার বাসায় গিয়েছি, ওখানে সে নেই। ওর বাসার সামনে বসে থেকেছি, তাকে দেখি নি। অথচ আমি নিশ্চিত জানি, সে মারা গেছে। আমি নিজে তাকে কবর দেয়ার সময় সামনে ছিলাম। রুনা আপা, তুমি কি জানো হারিয়ে যাওয়া মানুষকে এই দুনিয়াতে কিভাবে খুঁজে বের করতে হয়?”
রুনার কপালে ভাঁজ পড়লো – “তোমাকে কে বলেছে, মারা গেলে সবাই এখানেই আসবে? পরকালের জীবনে এরকম কত ঢাকা শহর আছে! তোমার বন্ধু কোন ঢাকা শহরে গেছে, কে জানে?”
রুনার কথায় জাহিদের প্রশ্নগুলো যতটা না উত্তর পেলো, তার চেয়ে বেশি উত্তররা প্রশ্ন পেলো।
ওর অবস্থা দেখে রুনা মিটি মিটি হাসছিলো। জাহিদ সেটা লক্ষ্য করতেই মেয়েটা বলে উঠলো – “এই পৃথিবীটাতে ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, তাই কোন খাবারেই মজা নেই। চিন্তা করো না, আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে।” – শেষ কথাগুলো বলার সময় মেয়েটার কণ্ঠ কেমন যেন বিষন্ন শোনালো।
জাহিদ তখন হঠাৎই বুঝতে শুরু করেছে – সেই বাস্তবতায়ই খাবারের স্বাদ পাওয়া যায়, যে বাস্তবতায় শরীরের জন্য পানাহারের প্রয়োজন আছে। মৃতদের এই নগরীতে যেহেতু শারীরিক কোন প্রয়োজন নেই, তাই এখানে খাবারেরও কোন স্বাদ নেই।
যদিও এটা স্বর্গ, এর মধ্যে কোথায় যেন একটা সমস্যা আছে – জাহিদ ভাবলো। সমস্যাটা সে ঠিক ধরতে পারছিলো না, কিন্তু বুকের ভেতর ভাঙা কাঁচের মতোই ওটা বার বার খোঁচাতে শুরু করলো ওকে।
রুনা তখন দাঁড়িয়ে ছিল সোফাটার সামনে, শাড়ি ঠিক করতে গিয়ে বার বার তার আঁচল পড়ে যাচ্ছিলো মাটিতে – ঠিক যেভাবে করে সাদা কিংবা নীল ওড়না পড়ে যেত ওর বুকের ওপর থেকে, ওর কিংবা ওদের প্রথম মৃত্যুর আগে, শেওলাধরা দেয়ালের পুরাতন এক শহরের আবছায়ায়।
এই সেই শরীর, একদিন যে পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলো দুরন্ত এক কিশোর রৌদ্রের এক শহরে। এই সেই রহস্যময় শরীর, এক জোড়া তরুণ চোখ যাকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলো গ্রীষ্মের সেই এক দুপুরে।
সে যে বেঁচে আছে, সেটাকে অনুভব করার শেষ চেষ্টা হিসেবে জাহিদ রুনার দিকে এগিয়ে গেলো, তারপর ওর অবাক দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আচমকা জড়িয়ে ধরলো তাকে। ওর পরিকল্পনা ছিলো, এক ধাক্কায় মেয়েটাকে সোফার ওপর ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর ওপর – ওই শরীরটাকে জোর করে উপভোগ করে হলেও শেষবারের মতো চেষ্টা করবে মৃত এই শহরে একবারের জন্য নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে।
কিন্তু রুনাকে স্পর্শ করার সাথে সাথে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেয়ে সরে আসতে হলো জাহিদকে। কোন শরীর এত শীতল হতে পারে, ধারণা ছিল না। জাহিদের মনে হচ্ছিলো, ও যেটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ওঠার চেষ্টা করছে, সেটা আসলে একটা মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই না।
বুদ্ধিমান জাহিদের বুঝতে দেরি হলো না, যে পৃথিবীতে নতুন প্রজন্ম তৈরির কোন প্রয়োজন নেই সেখানে যৌক্তিকভাবেই যৌনতা হবে অনুভূতিশূন্য। যদিও সে বুঝে উঠতে পারছিলো না – যে পৃথিবীতে সব ধরণের ভোগ আর উপভোগ সহজলভ্য অথচ এর কোনটাই কোন অনুভূতি জাগায় না, এরকম একটা জীবনে সে কিভাবে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারবে আর কিভাবেই বা নিজের জীবনকে অর্থপূর্ণ মনে করতে পারবে।
এই অদ্ভুত পৃথিবীতে জেগে ওঠার পর প্রথমবারের মতো জাহিদ হতাশা অনুভব করতে শুরু করলো – কেন যেন তার নিজেকে মনে হচ্ছিলো একটা মৃতদেহ, যা ছায়াহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে পরাবাস্তব এক নগরে।
জাহিদ তখন হঠাৎই হাসতে শুরু করলো। প্রথমে মৃদু হাসি হলেও একপর্যায়ে দ্রুতই সে হাসি বাড়তে বাড়তে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো। হাসতে হাসতে শেষে যখন তার চোখ বেয়ে নেমে এসেছে কলমের কালির মতো গাঢ় কালো দু’ফোটা অশ্রু, তখনি কেবল সে থামলো।
জাহিদ ততক্ষনে বুঝে ফেলেছে – অর্থহীনতার বেহেশতই হলো মূলত দোজখ। মৃত্যুর পর মানুষ হিসেবে তার তিন রকম পরিণতি হতে পারতো – অস্তিত্বহীনতা, নিঃসঙ্গ একটা অস্তিত্ব, আর স্রষ্টার সান্নিধ্যে অর্থপূর্ণ একটা অস্তিত্ব।
বোঝাই যাচ্ছে, খোদার সান্নিধ্য জাহিদের ভাগ্যে নেই – বেঁচে থাকতে অনেকগুলো পরাবাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে জাহিদ গিয়েছে, প্রত্যেকটাই ছিল খোদার দিকে আহ্বানপূর্ণ ইঙ্গিত – সে ইঙ্গিতগুলো ধরতে পারেন নি তা না, আসলে তিনি সেগুলো ধরতে চায় নি। সুতরাং খোদা তাকে পরিত্যাগ করতেই পারে।
লুবনা ইঙ্গিতগুলো ধরতে পেরেছিলো, কারণ তার মনটা ছিল শিশুর মতোই সরল। আর এজন্য তার অবস্থান হয়েছে খোদার সান্নিধ্যে। আর এজন্য তার বেহেশত অর্থপূর্ণ।
২
জাহিদ ছিল ক্লান্ত, তবু সে আয়নার সামনে থেকে নড়তে পারছিলো না। তার দৃষ্টি আটকে ছিল আয়নার ভেতরে নিজের প্রতিবিম্বের চোখে।
হতাশায় ডুবতে থাকা জাহিদ সিদ্ধেশ্বরীতে নিজের বাসার শোয়ার ঘরে এসে দেখে, যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে একটা আয়না, মানুষের চেয়ে বড়ো ভিনিসিয়ান এক আয়না। জাহিদ আয়নাটাকে চিনতে পারলো। এটাই সে রাগে-দুঃখে একদিন ভেঙে ফেলেছিলো। মৃতদের এই শহরে কোনভাবে এটা তার কাছে ফিরে এসেছে।
জাহিদের অবাক হওয়ার ধৈর্য ও শক্তি ততক্ষনে শেষ হয়ে গেছে। তার শুধু মনে হলো – যে পৃথিবীতে মৃতরা জীবিত, আর জীবিতরা অনুপস্থিত, সে পৃথিবীতে ভেঙে যাওয়া জিনিস-পত্র পুনর্জীবন পাবে, এতে আর আশ্চর্যের কি আছে !
বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও আয়নার সামনে থেকে চলে যেতে ব্যর্থ হয়ে যেতে যেতে জাহিদের একসময় মনে হতে লাগলো নিজের ওপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, বরং তাকে নিয়ন্ত্রণ কছে আয়নার ভেতর তার নিজের সে ছায়া। এসব আকাশ-পাতাল সে যখন ভাবছে, তখনি আয়নার ভেতরের লোকটা কথা বলে উঠলো অতীন্দ্রিয় কণ্ঠে – “তুমি পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছো।”
“আমার ছায়া আমার সাথে কথা বলে কেন?” – ভাবছিলো জাহিদ।
“আমি তোমার ছায়া না,” – জাহিদের প্রতিবিম্ব তাকে বললো আয়নার ভেতর থেকে – “তুমি আমার ছায়া, আর তুমি পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছো। এখানে আসার আগে তোমার যে জীবনটা ছিল, সেটাতে তুমি ব্যর্থ হয়েছো, ব্যর্থ হয়েছো তোমার মূল উৎস অর্থাৎ আমাকে চিনতে।”
জাহিদ কিছু বললো না। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, শেষ পর্যন্ত নাটকটা দেখে যাবে।
“এই আয়না দিয়ে তোমাকে অনেকবার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, যেন তোমার মূল অস্তিত্বে বিশ্বাস করা তোমার জন্য সহজ হয়। কিন্তু তুমি সেটা পারলে না। এখন তোমার্ সামনে দুইটা পথ খোলা আছে – ওই জীবনে ফিরে যাওয়া, আর ওই জীবনে ফিরে না যাওয়া।
ওই জীবনে যদি তুমি ফিরে যাও, তাহলে তুমি আবার অবিশ্বাসী হয়ে জন্ম নেবে।
আর ওই জীবনে যদি তুমি ফিরে না যাও, তাহলে এখানেই শেষ তোমার অস্তিত্ব। এই আয়না অদৃশ্য হয়ে যাবে, সাথে সাথে অদৃশ্য হবে তুমি।”
জাহিদ অনেক্ষন ভাবলো, লক্ষাধিক বছর ভাবলো। তারপর সে বললো, সে ফিরে যাবে। সে ফিরে যাবে, কারণ অস্তিত্ব সবসময়ই অস্তিত্বহীনতার চেয়ে ভালো – জাহিদের দৃষ্টিকোণ থেকে অন্তত।
