বেশ কয়েকবার বেল বাজানোর পর দরজা খুললো নাদিয়া। তার চোখ দু’টা লালচে, দেখে বোঝা যায় মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। সে একবার আমার মুখের দিকে আরেকবার আমার হাতে ধরে রাখা নীল খামটার দিকে তাকালো, তারপর পুরো দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়ালো। ঘরে ঢুকতেই সে আমাকে বসতে বলে ভেতরে চলে গেলো।
কতক্ষন বসতে হবে, কে জানে। মেয়েদের সময়জ্ঞান যে খুব বেশি, দেবতারাও সেটা দাবি করতে পারবে না। আমার আবার কাল একটা ইন্টারভিউ আছে, প্রস্তুতি নিতে হবে – খুব বেশি সময় এখানে থাকা যাবে না। আচ্ছা, নাদিয়াও কি চাকরির জন্য চেষ্টা করছে? ও বলেছিলো, ওর কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু সে আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী, আমি জানি – সে এখনই বিয়ে করবে না, সে ভীষণ স্বাধীনচেতা মেয়ে।
আর তাছাড়া এই নীল খামটাই তো প্রমান যে সে বিয়ে নিয়ে এখনই কিছু ভাবছে না।
আমার ধারণাকে ভুল প্রমান করে দিয়ে নাদিয়া চলে এলো মিনিট পাঁচেকের মধ্য। নীল জিন্স আর সাদা সুতো দিয়ে কাজ করা সাদা জামায় তাকে আজকের সকালটার মতোই পবিত্র লাগছিলো।
“চা খাবে?” – আমার বা-দিকের সিঙ্গেল বেতের সোফাটায় বসতে বসতে বললো সে।
“না, আমার বেশি সময় নেই। জাস্ট একটা কথা বলবো, তারপর চলে যাবো।”
“আচ্ছা বলো, কি বলবে।” – সে পুরো দৃষ্টি আমার চোখে নিবদ্ধ করলো। বলা বাহুল্য, আমি ভেতরে ভেতরে আরেকবার নিহত হলাম, যদিও জানতাম আমার কথাগুলো আমাকে আজ বলতেই হবে।
“তোমার আর আমার মধ্যে এ সম্পর্ক সম্ভব না।” – শরীর আর মনের সমস্ত শক্তি একত্র করে বললাম আমি।
“আচ্ছা?” – তার ঘন কালো ভুরু জোড়া কুচকালো।
“কারণ,” – মেট্রিক পরীক্ষার সময় মুখস্ত করা ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনার মতো গড় গড় করে আমি বলে চললাম – “কারণ আমার ধারণা, প্রেম বন্ধুত্বকে নষ্ট করে। তোমার সাথে আমার যে সম্পর্ক, সেটা আমি কোন কিছুর বিনিময়েই নষ্ট করতে চাই না। তুমি আমার কাছে প্রেম-ভালোবাসার চেয়েও বেশি ইম্পরট্যান্ট।”
“হয়েছে কি তোমার? নাটক করছো কি জন্য?” – সে গৃহিনী ধরণের একটা তেজ নিয়ে প্রশ্ন করলো, তারপর হাত দুটো উঁচিয়ে পিঠ পর্যন্ত নেমে আসা তার ঘন কালো চুলের ভেতর সাদা একটা ব্যান্ড ঢোকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
“কারণ, তুমি তোমার ছোট ভাইকে দিয়ে এই চিঠিটা পাঠিয়েছো।” – নীল খামটা আলতো করে টেবিলের ওপর ছুড়ে দেয়ার ভঙ্গি করলাম আমি।
সে খামটার দিকে একবারও তাকালো না, আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি তার চোখে কৌতুকের একটা স্পষ্ট আভাস দেখতে পেলাম, সেটা আমাকে কিছুটা অস্বস্তিতেও ফেললো বলাই বাহুল্য।
“হ্যা, নূরকে দিয়ে ওটা তোমাকে আমিই পাঠিয়েছি। কিন্তু তাতে হয়েছেটা কি?”
“‘হয়েছেটা কি’ মানে? তুমি ভুলে গেছো, ফার্স্ট ইয়ারে যখন প্রথম তোমাকে লাল গোলাপের তোড়াটা দিলাম, তুমি কি বলেছিলে?”
“কি বলেছিলাম?”
“তুমি বলেছিলে, কোনোদিন যদি আমার প্রেম তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে তুমি আমাকে নীল খামে চিঠি পাঠাবে। কিন্তু নাদিয়া, গত চার বছরে তোমার সাথে আমার যে বন্ধুত্ব হয়েছে, আমার আশংকা হয় প্রেম সেটার বারোটা বাজাবে।”
আমি আড়চোখে দেখলাম, নাদিয়া স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললো – যেন সে পুরো বিষয়টা এবার বুঝতে পেরেছে। এদিকে আমি তখনো বক বক করেই চলেছি – “ওই যে মুনির আর সোমা সাত বছর ধরে প্রেম করছে। তাদের সম্পর্কটা কি তিক্ত, দেখেছো? আমার মনে হয়, প্রেম জাতীয় জিনিস অন্য টাইপের কিছু – বন্ধুত্বের সাথে এটা গুলিয়ে ফেলাটা আমাদের দুজনের জন্য ঠিক হবে না।”
“থামো, থামো, রবিন। তুমি কি বলছো এসব? অযথা কেন ঝামেলা বাড়াচ্ছো? তার মানে তুমি খামটা খুলেও দেখো নি?”
“খাম খুলে দেখার প্রয়োজন আমার নেই।” – উত্তেজিত হয়ে উঠেছি আমি ততক্ষনে – “তুমি বলেছিলে, নীল খামে থাকবে তোমার প্রেমের সম্মতি। কিন্তু আমি তোমাকে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখার সুযোগ দিতে চাই।”
নাদিয়া তখন একটা নাটকীয় কাজ করলো। খামটা সেন্টার টেবিল থেকে তুলে নিলো, তারপর হেটে আমার কাছে এসে ওটা আমার হাতে দিয়ে নরম গলায় বললো – “তাই বলে তুমি একবার খামটা খুলে দেখবে না, রবিন?”
আমার কেন যেন সন্দেহ হলো। ত্রস্ত হাতে নীল খামটা খুললাম। সাথে সাথে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো প্রিন্ট করা একটা গাঢ় নীল কার্ড।
সেই নীল কার্ডে সাদা অক্ষরে ছাপানো কিছু আনুষ্ঠানিক কথাবার্তার নিচে কনের নামের জায়গাটায় দেখলাম নাদিয়ার নামটা ইটালিক দিয়ে বড়ো করে লেখা আছে।
