প্রতিপৃথিবী

এক: অস্তিত্বের সংকট

Series 1 Episode 1

একটা খুট খুট শব্দে রাকিবের ঘুম ভেঙে গেলো। এখনো ভোর হয়নি, ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর মধ্যেই খুট খুট শব্দ হয়ে চলেছে অবিরাম। রাকিব নিশ্চিত হলো, ঘরে আবার ইঁদুর ঢুকেছে।

লীনা যখন বেঁচে ছিল, একবার রাকিব আঠার ফাঁদ দিয়ে ইঁদুর ধরলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে যখন দেখলো আঠায় আটকে ইঁদুর ছটফট করছে, জামানের অন্তরটা জুড়িয়ে গেলো – ভাবখানা এমন যে “অনেক ঝামেলা করেছো বাছা, এবার তোমাকে আরাম করে পিটিয়ে মারবো”।

কিন্তু তার পরিকল্পনায় বাঁধ সাধলো লীনা। সে বায়না ধরলো “এত্ত কিউট একটা এনিম্যাল” কে মারা যাবে না, কোনোভাবে আঠা ছাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে তারপর ওটাকে বিল্ডিঙের বাইরে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আস্তে হবে।

“লীনা, শোনো, একে ছাড়ানো যাবে না। আইদার ওয়ে তাকে মরতে হবে, পিটিয়ে মারলে ওর জন্য সহজ হবে। এমন জোরে বাড়ি দিবো, ও বোঝার আগেই মরে যাবে।’

সেই কথা শুনে লীনার সে কি কান্না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না থামাতেই পারে না। শেষে ওই আঠা-লাগানো অবস্থাতেই লীনা ওটাকে খাওয়া দিয়ে যেতে লাগলো। কি অদ্ভুত দিন ছিল সেগুলো!

খুট খুট শব্দটা থামছিল না বলে জামান বিছানাতে উঠে বসলো, আর তখনি দেখলো মেয়েটাকে। অন্ধকারের মধ্যে কিছু অংশ যেন একটু কম অন্ধকার, আর ওটা যেন এক তরুণীর আকৃতি নিয়ে ঘরের একপাশ থেকে অন্য পাশে সরে গেল। পাশের ঘর থেকে আসা মৃদু আলো অবয়বটার ওপর পড়তেই রাকিব ওকে চিনতে পারলো।

যত অবাস্তবই মনে হোক না কেন, এটা যে লীনাই সে ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ নেই। একটা সবুজ জামা পরে আছে সে। গত ঈদে কিনেছিলো। বেহেশত-দোজখ সত্য, যদিও তারা অবাস্তব। হয়তো এটা তেমনি কোন অবাস্তব সত্য – রাকিব ভাবলো।

“কি? এত ভোরে উঠে বসে আছো কেন?” – ঘাড়ের ওপর থেকে কালো চুলগুলো পিঠের পেছনে ঠেলে দিয়ে সে বললো।
“ইঁদুর। ঘরে মনে হয় ইঁদুর ঢুকেছে।”
“এগুলি সবই তোমার মনের ভুল, রাকিব। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, তুমি ঘুমাও।”

রাকিব লক্ষ্মী ছেলের মতো বালিশে মাথা রাখলো। লীনা ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো ওর বাঁ পাশে। ফ্যানের বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ে উড়ে এসে রাকিবের চোখে-মুখে লাগছিলো।

লীনা যদি মৃত হয়, তাহলে এই মেয়েটা কে? আর এই মেয়েটা যদি রাকিবের কল্পনা হয়, তাহলে কিভাবে তাকে রাকিব স্পর্শ করতে পারছে? রাকিব জানে না। ওর শুধু বার বার মনে হতে থাকে যে এই দৃশ্যমান জগতে কোথাও বড় কোন গন্ডগোল হয়েছে।

কিন্তু ওই মুহূর্তে লীনাকে জড়িয়ে ধরে রাকিবের এসব নিয়ে ভাবতে আর ইচ্ছে হলো না। হয়তো এইটাই বাস্তব, আর লীনার মারা যাওয়ার বিষয়টাই কল্পনা – কে বলতে পারে?

মেয়েটার গা থেকে বিদেশী প্রসাধনের হালকা সৌরভ পেতে পেতে কখন যে রাকিব ঘুমিয়ে পড়লো সে নিজেও জানে না। সেই ঘুম ভাঙলো কলিংবেলের শব্দে। লাল টেবিল ঘড়িতে তখন সোয়া নয়টা বেজেছে মাত্র।

ইন্সপেক্টর জয়নাল জামাল এসেছেন। একাই এসেছেন। পুলিশ সুলভ দীর্ঘকায় ভদ্রলোক, কিন্তু চোখ দুটো নিরীহ। তাকে দেখলে রাকিবের মোটেও ভয় লাগে না, কিন্তু দেখা হলেই ভদ্রলোক অনেক প্রশ্ন করেন।

এই যেমন, আজকেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন লীনার মারা যাওয়ার আগের দিন কে কে এসেছিলো তার বাসায়। রাকিব কয়েকজনের নাম বললো।
“কি কাজে তারা এসেছিলেন, সেটা বলা যাবে?” – প্রশ্নের একটা উদাহরণ।
“জি না, বলা যাবে না।”
“কেন বলা যাবে না, সেটা বলতে পারবেন?” – প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন।
“ব্যবসায়িক গোপনীয়তার শর্ত আছে।”
“কি ধরণের ব্যবসা?” – রীতিমতো জেরা।
“সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং। কাজের বাইরে প্রাইভেটলি মানুষকে সাহায্য করি আমি।”

ইন্সপেক্টর জামাল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আবার কি মনে করে বসে পড়লেন – “আসার আগে আমার সহকর্মীদের রিপোর্টগুলো দেখছিলাম। তাদের মনে হয়েছে, স্ত্রী নিহত হওয়ার পর অন্যান্য মানুষের তুলনায় আপনি অনেক স্বাভাবিক ছিলেন। আপনার ব্যবহার এমন ছিল, যেন কিছুই হয় নি।”
“স্ত্রী মারা গেলে ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত?”
“স্ত্রী মারা গেলে স্বামীরা সাধারণত বেশ বিচলিত থাকে। খুন হলে সেটা আরো বেশি বিচলিত হয়। বিশেষ করে যখন হত্যাকাণ্ডের সাথে তার সংশ্লিষ্টতার স্পষ্ট সম্ভাবনা থাকে।”

রাকিব কিছু বললো না।
“আপনি কি বুঝতে পারছেন, সন্দেহের তালিকায় আপনি বেশ ওপরের দিকেই আছেন?”

রাকিব মাথা নাড়লো, সে বুঝতে পারছে যে সে পুলিশের সন্দেহের তালিকায় আছে।
যাওয়ার আগে জামাল সাহেব তাকে মনে করিয়ে দিলেন যে সে জামিনে বাইরে আছে এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন এরিয়ার বাইরে তার যাওয়া নিষেধ।

জামাল সাহেব চলে যাওয়ার পর রাকিব চুপচাপ সোফার ওপর বসে রইলো। ঘরের ভেতর থেকে তখন কাপ-পিরিচের শব্দ আসছিলো। একটু পর লীনার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো রাকিব – “কে এসেছিলো, রাকিব?”

“কেউ না। কেউ না।” – নিজ মনেই বিড় বিড় করতে লাগলো রাকিব।

সারাদিন কোন কাজে মন বসছিলো না বলে সন্ধ্যার দিকে একটা রিক্সা নিয়ে রাকিব মগবাজারে প্রশান্তি ক্লিনিকে গেলো। ডাক্তার ইমতিয়াজ ফ্রি ছিল। মানসিক ডাক্তারের কাছে নাকি লোক আসা কমে গেছে।

“মানুষের বিশ্বাসের জোর বেড়ে গেছে। তারা এখন আধ্যাত্মিক লাইনে চিকিৎসা করে বেশ উপকার পাচ্ছে। আমার সম্ভবত মুরাকাবা জাতীয় কিছুতে সময় লাগানো উচিত ছিল।” – হতাশ কণ্ঠে বললো রাকিবের ছোটবেলার এই বন্ধু। রাকিব কুশল বিনিময়ের ধার না ধেড়ে ঝেড়ে কাশলো, বলে ফেললো তার মানসিক সমস্যার কথা।

“তুমি বলতে চাচ্ছো, তোমার মৃত স্ত্রীকে তুমি দেখতে পাও?” – বেশ অবাক হয়ে বললো ডাক্তার ইমতিয়াজ।
রাকিব হ্যা-সূচক মাথা নাড়লো – “আমি তাকে স্পর্শও করতে পারি।”
“আমি যদি বলি, এটা একটা হ্যালুসিনেশন, তাহলে তুমি কি বলবে?”

রাকিব কিছু বললো না। কিন্তু সে জানে, এটা হ্যালুসিনেশন না। সে জানে, কারণ দ্বিতীয় এই লীনাকে এবারই প্রথম সে দেখে নি। লীনা যখন বেঁচে ছিল, তখনও প্রায়ই সে একে দেখতে পেতো। দুপুরে হয়তো লীনা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে, রাকিব ড্রইংরুমে গিয়ে দেখে দ্বিতীয় এক লীনা টিভিতে মিকিমাউসের কার্টুন দেখছে।

একবার লীনার সাথে সে রাতের খাবার খেলো, বেডরুমে গিয়ে দেখে আরেকটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে ওই ঘরে, তাকে দেখে বললো – “লাইট জ্বালালে কেন? উফফ, চোখটা মাত্র লেগেছিল?” রান্নাঘর থেকে তখনও কিন্তু থালা-বাটি গোছানোর শব্দ আসছে।

লীনাও জানতো সমস্যাটা। রাকিবকে সে লালবাগের পীর সাহেবের কাছে নিয়ে গেলো। হুজুর রাকিবের কপালে দোআ পরা পানি ছিটিয়ে দিয়ে বললেন, ওই ঘরে জিন্নির আসর আছে – এই জিন্নিই স্ত্রী সেজে রাকিবের সাথে “দুষ্টামি” করে। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে রাকিবকে একটা মোটা তাবিজ দিলেন তিনি, তবে বললেন বাথরুমে যাওয়ার সময় যেন তাবিজ খুলে যাওয়া হয়।
“বাথরুমে যদি জিন্নি দেখি?” – রাকিব জানতে চেয়েছিলো।
“জীবনে কিছু রিস্ক থেকেই যায়।” – অবিচল কণ্ঠে বলেছিলেন পীরজাদা।

রাকিবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আজমল ফিজিক্সের প্রফেসর। তার বাসায় এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় ভুতের গল্পের আসরে সে ঘোষণা করলো, ভুত আসলে প্যারালেল ইউনিভার্সের দৃশ্য যা আমরা মাঝে মধ্যে দুর্ঘটনাবশত দেখে ফেলি।
“এইসব দুর্ঘটনা কেন হয়?” – রাকিব জানতে চেয়েছিলো।
“হয়তো এসব দৃশ্য দেখিয়ে প্রকৃতি আমাদের খোঁচা দেয়, বোঝাতে চেষ্টা করে মানুষ কতটা বুদ্ধু, কতটা অনগ্রসর।” – আজমল মত প্রকাশ করেছিল।

যাহোক, সব শুনে আজ ইমতিয়াজ তাকে ঘুমের ওষুধ দিলো, সাথে কিছু সদুপদেশ। রাকিব চুপচাপ প্রেস্ক্রিপশনটা নিলো, তারপর চেম্বার থেকে বের হওয়ার পথে সেটা যত্ন করে ফেলে দিলো – প্রথম যে ডাস্টবিনটা দেখলো সেটাতে।

বাস্তবতার নিরিখে বিচার করলে লীনা তো মারাই গেছে। রাকিব যাকে কবর দিয়ে এসেছে, সে যে লীনা এ বিষয়ে সন্দেহের তো কোন অবকাশ নেই। এমনকি লীনার মৃত্যুর জন্য রাকিবের মাথার ওপর পুলিশের তদন্তও ঝুলছে।

কিন্তু সে এটাও জানে, সে দ্বিতীয় এক লীনার সাথে জীবন কাটাচ্ছে। সেই লীনাও রক্ত-মাংসের এক মানুষ। কিভাবে সেটা রাকিব জানে না, কিন্তু সে জানে এটাই সত্য। আর তার কাছে এর অর্থ একটাই, আর সেটা হলো দৃশ্যমান এই জগৎটাতেই কোন একটা সমস্যা আছে। কোন একটা সমস্যা আছে। সমস্যা আছেই আছে।

রাকিব সেই সমস্যাটা খুঁজে বের করবে। তার জীবনের কোন লক্ষ্য যদি না থাকে, তাহলে এটাই হোক তার জীবনের লক্ষ্য।

পৃথিবীর সমস্যাগুলোর মূল খুঁজে বের করার লক্ষ্যে রাকিব কোনোমতে বেরিয়ে এলো সিদ্ধেশ্বরীর রোদতপ্ত রাস্তায়। তারপর উদ্দেশ্যহীন পথে হাটতে হাটতে একসময় ভুলে গেলো, কেন সে বের হয়েছিল পথে।

(to be continued)

Leave a comment