প্রতিপৃথিবী

Series 1 Episode 2

প্রতিটা দিন আসে ঠিক একইভাবে। যায়ও একইভাবে। যেন প্রতিটা দিনই রবিবার, কিংবা সোমবার, বা অন্য কোন বার। যেন কিছুতেই কিছু যায় আসে না।

দশটা বেজে গেছে। চোখ খুলে রাকিব একবার সবুজ সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকালো, তারপর আবার জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু এবার আর ঘুম আসতে চাইলো না কিছুতেই। তাহলে কি সারারাত ঘুমিয়ে ক্লান্ত সে?

হ্যা, ঘুমেও ক্লান্তি আসে। ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ সেটা জানে না। জানা সম্ভবও না। সত্য তো এই যে ঘুমের ক্লান্তি হলো সবচেয়ে ভয়াবহ ক্লান্তি। জীবন একেবারে থেমে যায় এখানে এসে, যেভাবে কৃষ্ণগহ্বরে এসে থেমে যায় মহাজগতের সব আলো।

মৃত্যুর আগে রাকিবের বাবারও এরকম হয়েছিল। আফজাল সাহেবের সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে হতো না, কেননা তিনি জানতেন না কেন ঘুম থেকে জেগে উঠবেন বা জেগে উঠে সারাদিনে তার কাজ কি হবে। অবসর নিলে অনেকেরই এরকম হয়, কিন্তু তার বেলা সমস্যাটা বাড়াবাড়ি রকম হয়ে গেল। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অবসরে গেলেন, তিন মাসের মধ্যে মৃত্যু।

রাকিব প্রতিদিনই চেষ্টা করে নতুন কিছু করতে। যেমন, গত বুধবার গেলো রমনার শিশুপার্কে ছেলেবেলার স্মৃতিচারণের চেষ্টা করতে, সন্ধ্যার পর টিএসসিতেও গেল, কিন্তু তার সেই বুধবার অন্য বুধবারগুলোর চেয়ে তেমন একটা ব্যতিক্রম মনে হলো না।

রাকিব প্রতিদিনই এরকম কিছু না কিছু করার চেষ্টা করে। এমনকি স্যামুয়েল ব্যাকেটের মতো রাকিব প্রতিদিন গডো সাহেবের জন্যও অপেক্ষা করে, কিন্তু ত্রাণকর্তা হয়ে গডো সাহেবরা কখনোই আসে না। যীশু কিংবা ঈমাম মেহেদিও আসে না। রাকিবের সোমবারগুলোতেও তাই ব্যতিক্রম কিছু ঘটে না, শনিবারগুলোও শনিবারই রয়ে যায়। ফলে প্রায় প্রতিদিনই তার কাজে যেতে দেরি হয়। আজও হলো। কাওরানবাজার প্লাজার দোতলায় বিনির্মান লিমিটেডের চার রুমের অফিসে সে যখন ঢুকলো, তখন এগারোটা বেজে গেছে।

কাজে দেরি করে আসলেও মাহমুদ ভাই রাকিবকে কিছু বলেন না। শত হলেও রাকিব তার বিমূর্ত সফটওয়্যার লিমিটেডের প্রধান প্রোগ্রামার, তার কোম্পানির মেরুদন্ড। মেধাবী এই ছেলেটাকে নিয়ে বছর পাঁচেক আগে তিনি প্রতিষ্ঠানটা দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু এই ছেলে ব্যবসার কিছুই বোঝে না, তাই টাকা-পয়সার পুরো ব্যাপারটা তাকেই দেখতে হয়। তবে প্রোগ্রামার হিসেবে রাকিবের জুড়ি নেই। মূলত তার মেধা আর পরিশ্রমের ওপর ভর করেই এই প্রতিষ্ঠানটা পাঁচ বছরে কোটি টাকার ক্লাবে ঢুকে গেছে, প্রতিষ্ঠানের আকার দুইজন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাতাশ জনে।

কিন্তু সমস্যা হলো, ছেলেটা হঠাৎ হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। জানতে চাইলে বলে, সে জীবনের কোন উদ্দেশ্য খুঁজে পাচ্ছে না, এর অর্থ হলো দৃশ্যমান জগতের কোথাও কোন একটা সমস্যা আছে। রাকিব নাকি সেই সমস্যার মূল বের করার চেষ্টা করছে।

রাকিবের এই ব্যাপারগুলো মাহমুদ একেবারেই জানেন না। তিনি আর যেটা জানেন না, সেটা হলো যা রাকিব কাজের বাইরের সময়গুলোতে করে থাকে। তেমনি এক সন্ধ্যায় মাহমুদ সাহেব অফিস থেকে বের হওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বিনির্মাণ লিমিটেডের কাওরানবাজার অফিসে দরজা ঠেলে ঢুকলো বিশ-পঁচিশ বছরের একটা মেয়ে।

মেয়েটা যখন কাঁচের দরজা ঠেলে রাকিবের রুমে ঢুকলো, তার দিকে রাকিব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো – এজন্য না যে মেয়েটা ডানা কাটা হুরপরীর মতো সুন্দর, বরং এজন্য যে ওর সৌন্দর্যটা কিছুটা অবাস্তব ধরণের। এই সৌন্দর্য্যের মধ্যে কোথায় যেন একটা অস্বাভাবিকত্ব আছে, যেমন অস্বাভাবিকত্ব আছে মৃত স্ত্রীর সাথে তার নিয়মিত দেখা হওয়ার মধ্যে।

এই বয়সী মেয়েরা সাধারণত সালোয়ার-কামিজ পরে, অথবা জিন্স-টিশার্ট। এই মেয়ে পড়েছে লাল পাড় দেয়া সাদা শাড়ি, তার ফর্সা ত্বক আর শাড়ির আঁচলের মধ্যে সীমান্তের দেয়াল হয়ে আছে শুধু ওই লাল পাড়। তার চেহারার হুর-সম ঔজ্জ্বল্য আলোকিত করে দিয়েছে কারওয়ানবাজারের এই মলিন অফিস কক্ষটাকে, হাই হিল তার আর্য উচ্চতাকে তুলে দিয়েছে সমস্ত কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে। রাকিব তাকে বসতে বলে জানতে চাইলো তার আগমনের কারণ।
“আমার নাম নাদিয়া, আপনাকে আমাদের খুবই প্রয়োজন।” – মেয়েটার কণ্ঠ অস্বাভাবিকরকম যান্ত্রিক।
“আপনাদের? আপনারা কারা? ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে সার্ভিস টিকেট নিয়েছেন?”
“ব্যক্তিগতভাবে আপনার সাহায্য দরকার আমাদের।”

রাকিব এবার বুঝতে পারলো ঘটনাটা। কোন পার্টি তাকে ‘রেকমেন্ড’ করেছে কাজের জন্য। কে জানে, কি বেআইনি আবদার নিয়ে এসেছে এই মহিলা! রাকিব আগেও দেখেছে, কাজের অফার দিয়ে যারা সুন্দরী মহিলাদের পাঠায়, সে পার্টিগুলো সাধারণত তিন নাম্বারি হয়, অর্থাৎ দুই নাম্বার থেকেও খারাপ। নিশ্চিতভাবেই কোন হ্যাকিং বা স্প্যামের প্রজেক্ট। হ্যাকিং-এ তার আপত্তি নেই – উইকিলিকসের জুলিয়ান এসাঞ্জের ভীষণ ভক্ত রাকিব, কিন্তু চুরি কিংবা লোকঠকানোর প্রকল্প হলে সে অভদ্রভাবেই এই মহিলাকে না বলে দেবে।
“ব্যক্তিগত প্রজেক্টগুলা আমি অফিসে ডিল করি না।” – সে বললো।

“আমরা জানি, আপনি অফিসে এসব নিয়ে কথা বলেন না। কিন্তু সময় খুবই কম।” – একঘেয়ে কণ্ঠে বলে চললো নাদিয়া। কিন্তু রাকিব উঠে দাঁড়ালো – “আপনি একটা সময় দেন, বাইরে কোথাও মিট করবো।”

নাদিয়ার মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো – “আমরা কিন্তু জানি, আপনি কেন আপনার স্ত্রীকে খুন করেছেন।” – শীতল কণ্ঠে বললো সে।
রাকিবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো – “আমি কাউকে খুন করি নি।” – চিবিয়ে চিবিয়ে বললো সে।

হেসে উঠলো নাদিয়া। ওর হাসিটা কিন্তু উচ্ছল, ওর কণ্ঠস্বরের মতো রোবোটিক না।
“বসুন, প্লিজ।” – সে চেয়ারে হেলান দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসতে বসতে বললো – “এই চুক্তিতে আপনার লাভ হয়তো আমাদের চেয়েও। আমরা হয়তো আপনাকে বলতে পারবো, এই পৃথিবীতে মোট কয়জন লীনা আছে।”
রাকিব ধপাস করে বসে পড়লো তার চেয়ারে। সম্ভবত কোন ব্লাকমেলার গ্রূপের পাল্লায় পড়েছে সে। আগে একবার এরকম হয়েছিল। রাকিবের হ্যাক করা একটা তথ্যসূত্র ব্যবহার করে সেবার চট্টগ্রামভিত্তিক একটা গ্রূপ তাকে বাধ্য করেছিল তিন কোটি টাকার একটা অনলাইন জালিয়াতিতে সাহায্য করতে। ওই কাজের জন্য রাকিব আজ পর্যন্ত পুলিশের ভয়ে থাকে। কিন্তু তারা কি করে জানলো দ্বিতীয় লীনার কথা, ও আর ওর ঘরের ফেরেশতারা ছাড়া আর কেউ তো জানে না এসব কথা।

“শুনুন রাকিব সাহেব, ভীষণ বিপদে আছেন আপনি। আমরাও বিপদে আছি। দুই পক্ষের শত্রু মনে হচ্ছে একই গ্রূপ। আমরা যদি একসাথে কাজ করি, সম্ভাবনা প্রবল যে আমরা দুজনই এবারের জন্য ঝামেলা এড়িয়ে যেতে পারবো।”

“আমি আমার স্ত্রীকে খুন করিনি, ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন।” – একগুঁয়ের মতো বললো রাকিব। – “আমি জানি না, কে তাকে খুন করেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, ও নেই। সারা ঘরে তান্ডবের চিহ্ন। দেয়ালে রক্তের ছাপ। আমার নিজের হাতেও কালশিটে দাগ। প্রচন্ড ব্যথা সারা গায়ে। আইস ব্যাগ বের করার জন্য যখন ডিপ ফ্রিজের ডালাটা খুললাম, তখনই দেখলাম লীনা ওখানে বসে আছে। যেন ছোট্ট একটা মেয়ে লুকোচুরি খেলার জন্য ফ্রিজটা বেছে নিয়েছে, এমন সুন্দরভাবে ডেডবডিটা বসিয়েছে ওরা। কারা ওকে মেরেছে, আমি জানি না, কারণ আমি ওই রাতের কথা কিছুই মনে করতে পারছিনা – সম্ভবত এমনেশিয়া হয়েছে মাথায় ব্যথা পেয়ে। আমি নিজে ক্লিনিকে গিয়েছিলাম প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য।”
“আপনি জানেন না, কে ওকে মেরেছে। তার মানে তো এটা যে কেউ হতে পারে? আমি হতে পারি, সে হতে পারে, আপনিও হতে পারেন। কেউই তো সন্দেহের ঊর্ধ্বে না, তাই না?”

রাকিব চুপ করে রইলো। তার মনে যে এই সম্ভাবনাটা আসে নি, তা না? কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব? যে মেয়ের সাথে সে সাত বছর ধরে প্রেম করেছে, যার সাথে পাঁচ বছরের বেশি সংসার করেছে, তার চেয়ে বড় কথা যাকে ছাড়া বেঁচে থাকা অর্থহীন, তাকে সে কেন খুন করতে চাইবে?
“আপনার গ্রূপ কি চায়? আমাকে কি করতে হবে?” – দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো সে।

নাদিয়া একটা কার্ড এগিয়ে দিলো, গাঢ় কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে সোনালী অক্ষরে লেখা একটা নাম “সাদিক চৌধুরী সুফী”, নিচে একটা ফোন নাম্বার লেখা।
“এই লোকটা আপনার সাথে যোগাযোগ করবে। উনি যা বলবে, আপনি তাই করবেন। তাহলে আশা করা যায় আমরা আপনাকে বের করে নিয়ে আসতে পারবো।”
“কোথা থেকে বের করে নিয়ে আসবেন?”

“সময় মতো সবই জানতে পারবেন, রাকিব সাহেব।” – মেয়েটা উঠে দাঁড়ালো, আবার আলোকিত হলো পুরাতন বিল্ডিঙের পুরো দোতলাটা।

নাদিয়া চলে যাবার পর রাকিব আবার ফিরে এলো বাস্তবে, যেন এতক্ষন একটা ঘরের মধ্যে ছিল।
ওর তখন মনে পড়লো, মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি কিভাবে সে জানলো দ্বিতীয় লীনার কথা। রাকিব গভীর চিন্তায় ডুবে গেল পুরো সন্ধ্যাটা জুড়ে।

(to be continued)

Leave a comment