১
ঘুমাতে যেতে ভয় লাগে আমার। কিন্তু আমার এই গল্পটা কেউ বিশ্বাস করবে কিনা, জানি না।
ভুতের গল্প মানুষ বিশ্বাস করে, কারণ অনেকেই বিশ্বাস করে যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের পাশাপাশি আছে একটা অতীন্দ্রিয় জগৎ – ফেরেশতা, শয়তান, জীন, আর আত্মা যে জগতের বাসিন্দা; পাপ-পুণ্যের বিচার হয় যে জগতে; ভাববাদী দার্শনিকেরা জীবনের অর্থ খুঁজে পান যে পৃথিবীতে। এদের কথা হলো, এই দুইটি জগৎ একে অন্যকে কোনোদিনই অতিক্রম করবে না, ফলে বিজ্ঞানীরা কোনোদিনই আত্মা জাতীয় জিনিসের অস্তিত্ব প্রমান করতে পারবে না। সব মিলিয়ে তারা জানে না, তাদের ঈশ্বরের কোন করুণাটিকে তারা অস্বীকার করবে।
সুতরাং এই গল্পটা বিশ্বাস করানো আমার জন্য সহজ হতো, যদি জীন-পরী জাতীয় কোন শরীয়তসম্মত ব্যাখ্যা আমি সবাইকে জানাতে পারতাম। কিন্তু সম্ভবত বিষয়টা এর চেয়েও গভীর, এমনকি এও হতে পারে যে এই ঘটনাটা প্রমান করে দৃশ্যমান আর অদৃশ্য জগতের বাইরে তৃতীয় একটা পৃথিবীর অস্তিত্ব, যেখান থেকে নির্ধারিত হয় এই দুই জগতের ভাগ্য, আর নির্ধারিত হয় মানুষের অস্তিত্বের থাকা কিংবা না থাকা।
যাহোক, মূল গল্পে আসি।
জুলাই গরমের মাস। ইটের বস্তি এই ঢাকা শহরে গ্রামাঞ্চল থেকে কোন টাটকা বাতাস ঢুকতে পারে না, আর ঢুকলেও তাদের অবস্থা হয় নদীভাঙা মানুষের মতো – অর্থাৎ এই নগরে বন্দী হয়ে বের হওয়ার পথ খুঁজতে থাকে গরম হাওয়া। সব মিলিয়ে অস্বস্তিকর দমবন্ধ একটা অবস্থা।
কিন্তু সোমবারের সেই রাতটা ছিল ব্যতিক্রম। বিকেল থেকে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের বাসার বারান্দা থেকে ছায়াঘেরা টানা যে গলিটা দেখা যায়, তার মাঝখানে হাটু পর্যন্ত পানি জমা হয়েছে। তার মানে মেইনরোডে পানি কোমর ছাড়িয়েছে নিশ্চয়ই। লাবনী আর আমি বারান্দা থেকে বৃষ্টি দেখছিলাম, আর নীরব থেকে যে যার মতো উপভোগ করার চেষ্টা করছিলাম ঝোড়ো হাওয়া আর তার সঙ্গে বাড়তি বোনাসের মতো আসা শীতলতাকে।
বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই। দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত লাগছিলো বলে হয়তো, অথবা অন্য কোন কারণে, সাড়ে এগারোটার দিকে লাবনী ঘরের ভেতর চলে গেলো। আমিও একসময় অনুসরণ করলাম তাকে। কিন্তু সুইচ টিপে ধরতেই বেডরুমের লাইটটা একরকম অবাধ্যতা দেখাতে শুরু করলো – একবার জ্বলে, আবার নিভে যায়, আরেকবার জ্বলে, আবার নিভে যায়।
মানুষের মস্তিষ্ক দীর্ঘ সময় ধরে বিভ্রান্তির অত্যাচার নিতে পারে না, আমার মাথাব্যথা শুরু হলো মিনিটখানেক যেতে না যেতেই। ফলে লাইট নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘন বর্ষণে নগরীর তাপমাত্রা কমে এসেছে। কাঁথা গায়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলো। সেই ঘুম ভাঙলো লাবনীর চিৎকারে। চোখ খুলে তাকাতেই দেখি তার মোবাইলের টর্চটা আমার দিকে তাক করা। কি হয়েছে, জানতে চাইলাম ভদ্রতার সাথে।
সে বললো, আমি নাকি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলাম। আমার নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছিলো, কিন্তু আমাকে সে দেখতে পাচ্ছিলো না।
“অন্ধকারে দেখবে কি করে? এই যে লাইট জালিয়েছো, সাথে সাথে দেখতে পাচ্ছো। এখন ঘুমাও, কাল লম্বা একটা দিন কাটাতে হবে। আফসার সাহেব নতুন প্রজেক্ট ধরিয়ে দিয়েছে।”
“না” – সে বাংলা ছায়াছবির নায়িকাদের মতো আর্তনাদ করে উঠলো – “লাইট অনেক্ষন ধরেই দিয়ে রেখেছি, বিছানায় তুমি ছিলে না।”
হড়বড় করে সে যা বললো, তার মর্মার্থ হলো – যতক্ষণ আমি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলাম, ততক্ষন আমি ছিলাম অদৃশ্য হয়ে, আর যেই আমার ঘুম ভাঙলো আমি আবার দৃশ্যমান হলাম।
বললাম – “তুমি বলতে চাচ্ছো, ঘুমালে আমাকে আর দেখা যায় না? আর জেগে গেলে আবার দেখা যায়?”
সে আতংকিত চোখে তাকিয়ে থেকে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
“তুমি বলতে চাচ্ছো, আমাকে দৃশ্যমান থাকতে হলে আমার চেতনাকে পাহারাদার বানাতে হবে?” সে আবার হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো – বুঝে কিংবা না বুঝে।
“শোনো” – তাকে আশ্বস্ত করে বললাম – “ঘুমিয়ে গেলে তো আমার অস্তিত্বের প্রয়োজন নেই, তাই না? আমার কাছে আমার অস্তিত্ব প্রয়োজন শুধু ততক্ষনই, যতক্ষণ আমি জেগে আছি। ঘুমের মধ্যে আমাকে দেখা গেলেই কি, আর না গেলেই কি। সুতরাং তুমি এ নিয়ে চিন্তা করো না, শান্তি মতো ঘুমাও।”
কিন্তু আমার কথা তাকে আশ্বস্ত করেছে বলে মনে হলো না। সে দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার ঘুম পুরো হয় নি তখনো, রাত মাত্র তিনটা বাজে – সুতরাং পাশ ফিরে আবার শুয়ে পড়লাম, অদৃশ্য হয়ে গেলাম আরো কয়েক ঘন্টার জন্য।
সকালে নিশ্চিন্ত মনে অফিসে গেলাম, সারাদিন কাজের ব্যস্ততা দিয়ে লাবনীর স্মৃতি ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেই গতরাতের কথা মনে পড়লো – মনে পড়লো যে ঘুমালে আমি অদৃশ্য হয়ে যাই।
বিষয়টা গুরুতর কিছু না, কিন্তু কেন যেন সেটা আমার মস্তিষ্কের ভেতর শুকনো বালুর মতো কচ কচ করতে লাগলো। কেন যেন মনে হতে লাগলো, এই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সমস্যাটা নিয়ে আমার চিন্তিত হওয়া উচিত। যদিও এই মুহূর্তে ওটা নিয়ে আমার ভেতর কোন উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে না, ভবিষ্যতে কখনো এটা আমার উদ্বেগের কারণ হতে পারে বলেই হয়তো এই নিয়ে আমার উদ্বিগ্ন হওয়া দরকার।
এসবের সাথে যোগ হলো লাবনীর আচার-আচরণ। কলিং বেলের উত্তরে দরজা খুলে দেয়ার পর থেকেই মেয়েটা কেমন যেন ভুতুড়ে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে । খাবার টেবিলে ভাতের মধ্যে ডাল নেয়ার সময় লক্ষ্য করলাম, সে চোখের কোনা দিয়ে আমাকে দেখছে, আর চোখে চোখ পড়লেই দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে। সব মিলিয়ে সে রাতে রাত যত গভীর হলো, আমার অস্বস্তি ততই বাড়তে লাগলো। একসময় আমার এমনও মনে হলো, আমার মধ্যে আসলেই কোন সমস্যা আছে।
সারাদিনে অনেক ধকল গেছে শরীরটার ওপর, সেই ভোর রাতে উঠেছি, তারপর আবার গতরাতে ওর চিল্লাচিল্লিতে ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছিল। ক্লান্ত লাগছিলো বলে ঘুমাতে গেলাম এগারোটা বাজার আগেই, তারপর কখন যে তলিয়ে গেলাম অন্ধকারের গভীরে জানিও না।
ভোর তিনটার দিকে ঘুম ভেঙে গেলো। বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠবো, দেখি পাশে লাবনী নেই। বাথরুম সেরে বেরিয়ে দেখি, তখনো সে নেই। ড্রইংরুমে উঁকি দিয়ে দেখি, সে একটা শাল গায়ে জড়িয়ে বসে আছে, আর একটু পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছে, আর বার বার তাকাচ্ছে বেডরুমের দিকে। আমার চেহারা দেখে মনে হলো তার আতঙ্ক আরো বেড়ে গেলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে। সে কোন উত্তর দিলো না, আর সাথে সাথে আমার মনে পড়ে গেলো – ঘুমালে আমার অস্তিত্ব শূন্য হয়ে যায়, আর একারণেই লাবনীর এই আতঙ্ক। তাকে খুব একটা দোষ দিতে পারলাম না, কোন মেয়েই বা পারবে অস্তিত্বহীন একজন মানুষের পাশে নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে ঘুমাতে!
বিছানায় ফিরে আবার ঘুমাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঘুম ততক্ষনে চোখ দুটো থেকে ফেরারি হয়ে গেছে। আর এই সুযোগে বরাবরের মতোই আমার মাথায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীর সমস্ত উত্তরহীন প্রশ্ন। জন্মের সময় আমি কোথা থেকে এসে উদয় হলাম এই দুনিয়ায়? কোথায় যাবো আমি আমার পূর্বনির্ধারিত মৃত্যুর পর? এই “আমি” বলে কোন জিনিস কি আসলেও আছে, নাকি পুরোটাই একটা দৃষ্টির ভ্রম – যেমনটা বিজ্ঞানীরা দাবি করে থাকেন? সবচেয়ে বড় কথা, আমি যদি ঘুমের মধ্যে নাই হয়েও যাই, তাহলে অসুবিধাটা আসলে কোথায়?
অসুবিধা যে কোথাও একটা আছে, সেটা লাবনীর চোখে আতঙ্ক দেখেই আমি অবশ্য টের পেয়ে গেছি। আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক হয়তো বিষয়টা চিন্তা করতে পারছে না, কিন্তু অস্তিত্ব নাই হয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই সমস্যার একটা বিষয়। শত হলেও, মানুষের একটা আত্মসম্মানবোধ আছে, “আশরাফুল মাখলুকাত” হিসেবে তার একটা আলাদা মর্যাদা আছে। সৃষ্টির সেরা প্রজাতির যদি অস্তিত্বের নিশ্চয়তা না থাকে, সেটা একটা চিন্তার বিষয়তো বটেই।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি – মানে অস্তিত্বহীন হয়ে গেছি – মনে নেই। স্বপ্নে দেখলাম, আমার জীবনে লাবনী বলে কেউ নেই, তাই আমার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে, এদিকে যে মেয়েটাকে সবার পছন্দ হলো সে একজন অদৃশ্যমানবী, তবুও তার জন্য মা গাউসিয়ার দোকানে গিয়ে একটা লাল জামদানি পছন্দ করলো।
এসব মিলিয়ে সকালে আমার ঘুম ভাঙলো প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে। অফিসে যেতে পারলাম না। ফোন দিতেই ফ্রন্ট ডেস্কের রুক্সি মেয়েটা আফসার সাহেবের ফোনে লাইন লাগিয়ে দিলো, ফলে প্রায় মিনিট তিনেক সময়ানুবর্তিতা নিয়ে বিনামূল্যের বক্তৃতা শুনতে হলো আমাকে। মুখ কালো করে ফোন রাখতেই লাবনীর নির্ঘুম চোখে চোখ পড়লো, সে চোখ সরিয়ে নিলেও তার চেহারায় দেখলাম স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠা তীব্র আতঙ্ক – আমার অস্তিত্বহীন ঘুম বিষয়ক আতঙ্ক।
২
মাস তিনেকের মধ্যে লাবনীর সংকট চরমে উঠলো। রাতে সে দুই-তিন ঘন্টার বেশি ঘুমাতে পারে না। যতটা সময় ঘুমায়, সেটার মধ্যেও বার বার আঁতকে জেগে ওঠে। অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ওর সামনেই ডাক্তার মনজুর আলমকে ক্রমাগত অনুরোধ করে গেলাম ঘুমের ওষুধ দেয়ার জন্য। লাবনী সাক্ষী, আমি সেদিন ডাক্তার মনজুরের পায়ে পড়া বাদ রেখেছি। আমাদের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে হোক, কিংবা সব বর্ণনা শুনেই হোক, ভদ্রলোক লাবনীকে কড়া ঘুমের ওষুধ দিলেন। এর ফলও মিললো প্রায় সাথে সাথে। সে রাতে ওষুধ খাওয়ার ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে লাবনী বললো, সে ঘুমাতে যেতে চায়। আমি খুশি মনে তাকে বেডরুম পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ড্রইংরুমে ফিরে এলাম। কিন্তু তখনও জানতাম না, কি বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
এগারোটার দিকে আমার নিজের চোখেও ঘুম চলে এলো। ঢুলু ঢুলু চোখে ঢুকলাম আমাদের আধো-অন্ধকার ওই শোয়ার ঘরে। তীব্র অনিশ্চয়তার মধ্যে মেহগনি কাঠের পুরোনো খাট আর বোর্ডের তৈরী আধুনিক ওয়ার্ডরোবের মাঝখানের পথটা আন্দাজ করে করে পৌঁছে গেলাম বিছানার অন্য প্রান্তে। আর তখনি লক্ষ্য করলাম বিষয়টা।
লাবনী নেই। নেই মানে নেই। বিছানা হাতড়ে দেখলাম। বিছানা শূন্য। প্রথমে ভাবলাম, এটা হয়তো আমার মনের ভুল। আসলে হয়তো সে পাশের রুমে গেছে, কিছুক্ষনের মধ্যেই ফিরে আসবে ওর অতিপরিচিত এই ঘরে।
কিন্তু তখন আবার অটবির কালো ড্রেসিং টেবিলটার আয়নায় চোখ পড়লো আমার, আর ভীষণভাবে চমকে উঠতে হলো আমাকে। বাইরের স্ট্রিটলাইটে যে হলুদ আলোর ছোট একটা অংশ ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সীমানা ডিঙিয়ে এসে ঢুকে পড়ছে ঘরে, তাতে অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা, যেখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিলো লাবনী বিছানাতেই আছে। সে স্বাভাবিকভাবেই শুয়ে আছে, ঘুমিয়ে আছে আর দশটা অপরিচিত নারীর মতোই।
আমি চট করে আমার পাশে তাকালাম। লাবনী নেই এখানে, যেমনটা আয়নায় দেখে মনে হচ্ছে। পাগলের মতো বিছানা হাতড়ালাম। লাবনী কোথাও নেই। কিন্তু এখনো ওকে দেখা যাচ্ছে, ওকে দেখা যাচ্ছে আয়নার ভেতর। যেন আয়নার ভেতরে আরেকটা পৃথিবী আছে, সেই পৃথিবীটাই সত্য, আর আমাদের এই পৃথিবীটা একটা বিভ্রম। যেন আয়নার ভেতরের লাবনী যখন জেগে উঠবে, তখন ওর এপাশের স্বত্তাটা আবার প্রাণ ফিরে পাবে, আর তখনই কেবল তাকে আবার দেখতে পাবো আমি।
আমার মাথা ঠিকমতো কাজ করছিলো না। ফলে একবার আয়নার অবাস্তব কিন্তু সত্য লাবনীর দিকে, আরেকবার বাস্তব কিন্তু শূন্য বিছানার দিকে তাকাচ্ছিলাম, আর আয়াতুল কুর্সির প্রথম লাইনটা মনে করার চেষ্টা করছিলাম, যদিও বারবার গন্ডগোল লাগিয়ে ফেলছিলাম অন্য কোন একটা সূরার সাথে।
কতক্ষন এভাবে ছিলাম জানি না, হঠাৎ ভীষণ আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। খুব কাছেই কোথাও বাজ পড়েছে। কানফাটা শব্দের জন্য অপেক্ষা করছি, তখন লাবনীর কণ্ঠ শুনতে পেলাম – এই তো সে আমার পাশে। উঠে বসে সে আমার চোখে তাকাতেই কানে তালা লাগলো।
সে অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, যেন ভিনগ্রহের কোন জীব দেখেছে। চোখের কোনা দিয়ে একবার ড্রেসিং টেবিল আরেকবার পাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম, সে অস্তিত্বশীল আছে আয়নার ভেতর আর বাইরে দুই জায়গাতেই।
৩
সে রাতের পর আমার সাথে এরকম আর কখনোই হয় নি। তবুও কেন যেন আমাকে এখনো সেই রাতটা তাড়া করে ফেরে। আর তাড়া করে ফেরে বলেই রাতে আমার ঘুম আসতে চায় না। ঘুম আসতে চায় না, শুধু ভয় হয়। ভয় হয়, করোনাভাইরাসের মতো যদি আবার ফিরে আসে আমার ওই অসুখ আর ঘুমের ভেতর আমি আবার অস্তিত্বহীন হয়ে যাই, ঠিক যেভাবে মৃত্যু মানুষকে অস্তিত্বহীন করে! ভয় হয়, যদি ঘুম থেকে আর জেগে উঠতে না পারি !
একই সিনেমা বার বার দেখার মতো প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটে। রাত এগারোটা বাজলে আমার মনে হয়, মাত্র সন্ধ্যা হলো, এখনো অনেক কাজ বাকি। সাড়ে এগারোটার দিকে আমি আমার যাবতীয় কাজকর্ম শুরু করি – গতমাসের বিলের হিসাব মেলানো, বাড়িভাড়ার রশিদ গোছানো, ফেলে রাখা বাকি কাজ অফিসের, ইত্যাদি। ইউটিউব আর ফেসবুক তো আছেই।
এই করতে করতে রাত আড়াইটা বেজে যায় কখন, জানি না। এরপর একরকম অপরাধবোধ আর অনুশোচনা থেকেই বিছানায় যাওয়া – তারপর অন্ধকার বেডরুমে হাতড়ে দেখা ঘুমন্ত লাবনীর অস্তিত্ব আছে কিনা, এরপর আরো আধা-ঘন্টার মতো আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা ঘুমের জন্য – সেই ঘুম, যা হয়তো আমার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে প্রতিদিন অন্তত একবার করে।
মজার ব্যাপার হলো, ধর্ম বা বিজ্ঞান কোনোটাই আমার সমস্যার সমাধান করতে পারে নি। আমার নাস্তিক বন্ধু রোমেলকে বলেছিলাম ঘুম নিয়ে আমার এসব আতঙ্কের কথা, কিভাবে ঘুমের ভেতর আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়, এসব। তাকে খুব একটা বিস্মিত মনে হলো না। “অস্তিত্ব থাকলেই না সেটা বিলীন হবে?” – সে নির্জীব কণ্ঠে বললো – “এই যে আমরা খামোখাই শুধু ‘আমি’, ‘আমি’ বলি, ‘ফার্স্ট পার্সন এক্সপেরিয়েন্স’-এর কথা বলি, বিজ্ঞান প্রমান করেছে যে এগুলি সবই ডিলুশন।”
“আমার কোন অস্তিত্ব নেই? আমিত্বের ধারণা ডিলুশন?”
“অবশ্যই ডিলুশন। আচ্ছা তুমি কি তোমার দুই বছর বয়সের স্মৃতি মনে করতে পারো? পারো না। কেন পারো না? কারণ, তখন পর্যন্ত তোমার ডিলুশনটা পুরো তৈরী হয় নি। হতে পারে, সমস্যাটা আসলে তৈরী করেছে তোমার মা-বাবা। জন্মের পর থেকে তোমাকে এত অসংখ্যবার তারা আনিস নামে ডেকেছে যে তোমার মনে একটা ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছে যে তুমিই সেই আনিস। আসলে আনিস বলে কেউ নেই। পুরোটাই মনোবৈকল্য।”
শেষ আশা ছিল ধর্ম ও বিশ্বাস। শুনেছি, ধর্ম মানুষের অস্তিত্বের বিষয়ে উত্তম গ্যারান্টি দেয়। সুতরাং আমার সমস্যার কথা গিয়ে বললাম আমাদের মসজিদের মহিউদ্দিন ভাইয়ের কাছে। তিনি তাকালেন আমার চোখে, যেন মোরাকাবা থেকে এইমাত্র জেগে উঠেছেন, অদৃশ্যের জগৎ থেকে ইলহাম নিয়ে হাজির হয়েছেন আমার ভুলে যাওয়ার মতো সামান্য অস্তিত্বের সামনে। অপার্থিব কণ্ঠে বললেন – “তোমার বন্ধু, কি যেন তার নাম, সে ঠিক কথাই বলেছে। তোমার আসলে কোন অস্তিত্ব নেই। একমাত্র স্রষ্টাই বাস্তব, আর সৃষ্টি মাত্রই অবাস্তব। তোমার একটা অস্তিত্ব আছে, কিন্তু সেটা অবাস্তব ধরণের অস্তিত্ব।”
“আমার অস্তিত্বের কোন মূল্য নেই? পুরোটাই বিরাট বড় একটা শূন্য?”
“শূন্যও একটা সংখ্যা, তারও মূল্য আছে। শূন্য ছাড়া কি অশূন্যকে প্রকাশ করা যায়, বলো?”
সেই থেকেই বেঁচে আছি মরে থাকার মতো করে, বেঁচে আছি নিজের অস্তিত্ব নিয়ে দ্বিধা আর দ্বন্দ্ব নিয়ে। আমি কি আছি, নাকি আমি নেই? দেকার্ত কি বলে? গাজালী কি বলে? সার্ত্রে কি বলে? সব এমন এলোমেলো লাগে কেন?
কেউ যেন ভুল না বোঝে, আমার ভয় শুধু আমাকে নিয়ে না – আমার ভয় আমার জীবন সঙ্গিনী, অর্ধাঙ্গিনী, লাবনীকে ঘিরেও – কোনোদিন হয়তো সে ঘুম থেকে উঠে দেখবে, পাশে আমি নেই – নিদ্রা জিনিসটা কোনোভাবে আমার অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়েছে, সুফী সাধনা কিংবা মোরাকাবা ছাড়াই আমি ‘ফানা’ হয়ে গেছি, যদিও আমার অস্তিত্বের লক্ষণ হিসেবে সে আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে, আর বিছানার পাশের কালো অটবির স্বচ্ছ আয়নায় ঘুমন্ত আমাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এভাবেই যদি চলতো, তাহলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু ইদানিং এই আতঙ্কের সাথে যোগ হয়েছে আরেকটা চরম আতঙ্ক। মৃত্যু বিষয়ক আতংক। মৃত্যুর পর আমার অস্তিত্বের কি হবে, সেই সংক্রান্ত আতংক। ঘুমের মধ্যে যদি আমার মৃত্যু হয় – মানে আমার জীবনের শেষ মুহূর্তটা, শেষ হয়ে যাওয়ার শেষ দৃশ্যটা যদি কোন কারণে না দেখতে পারি – তাহলে কি মৃত্যুর পর আমার অস্তিত্ব নাই হয়ে যাবে? আমি নিশ্চিত না, একেবারেই নিশ্চিত না। আর নিশ্চিত না বলেই, ঘুমাতে যেতে আজকাল আমার ভয় হয়, ভীষণ ভয় হয়।
