আমার স্ত্রী লিনা। বয়স মাত্র ঊনত্রিশ। তার একটা সমস্যা আছে। সে মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায়।
সমস্যাটা গভীর, যদিও সেটা গুরুতর কিছু না। যে সময় ঘটনাটা ঘটে, সেই কয়েক ঘন্টা কেউ তাকে দেখতে পায় না, যদিও কেউ কেউ তার কথা শুনতে পায়।
এ যেন সমান্তরাল কোন পৃথিবীতে কিছুক্ষনের জন্য কারো ঘুরে ফিরে আসা। আমি খুব একটা নিশ্চিত না, কারণ এইসব গভীর ধরণের বিজ্ঞানে আমার তেমন দক্ষতা নেই। হাই স্কুলে বিজ্ঞান পরীক্ষা ছিল আমার জন্য একটা আতঙ্ক। মেট্রিক পাশ করেছিলাম মানবিক বিভাগে পরীক্ষা দিয়ে।
লিনাকে ছোটবেলা থেকেই চিনতাম আমি। সে ছিল আমাদের শান্তিনগর এলাকারই মেয়ে। সে অবশ্য বিজ্ঞানে ভালো ছিল। যুক্তিভিত্তিক চিন্তা করতো। ধর্মকে কুসংস্কার বলে মাঝে মাঝে সন্দেহ হতো তার। ইন্টারমিডিয়েটে স্টার মার্কও পেয়েছিলো।
ছাত্রী হিসেবে সে সবসময়ই দারুন ছিল, কিন্তু বাবা তাকে নামাজ-রোজার কথা মনে করিয়ে দিলে বলতো – “বাবা, তোমরা জানো না, ধর্ম হলো মানুষের বানানো জিনিস।”
“স্রষ্টা বলে কেউ না থাকলে তোর অস্তিত্ব এলো কোত্থেকে?” – আব্দুর রহমান সাহেব সবিনয়ে জানতে চাইতেন।
“আমার অস্তিত্ব নিজে নিজেই আছে।”
মেয়ের উত্তর শুনে বাবা কিছু বলতেন না, শুধু ধৈর্য ধরে থাকতেন।
লিনার এই দৃশ্যমান থাকতে না পারার সমস্যাটা হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জানে না। এই মুষ্টিমেয় কয়েকজনের মধ্যে আমি একজন। তবে আমি কাউকে বলে বেড়াই না এই গোপন কথা। বলার প্রয়োজন নেই, তাছাড়া এতে কারো তেমন কিছু আসে যায় বলে মনে হয় না।
দুই বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে লিনা সবার বড় ছিল। ওর এই সমস্যাটা নাকি শুরু হয়েছিল বয়োসন্ধির সময় থেকে।
রিনা ছিল লিনার দুই বছরের ছোট। দেখতে হুবহু তার মতো ছিল তার এই ছোট বোনটা – শুধু রিনা ফর্সা, আর লিনা উজ্জ্বল শ্যামলা। রনজু মামা বেড়াতে এলে রিনাকে খুব ‘তুলু-তুলু’ করে, আর লিনাকে বড়বোন হিসেবে তার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। রিনাকে বাবা মেরুন রঙের ফ্রক কিনে দেয়, লিনাকে মা কিনে দেয় হালকা নীল রঙের সালোয়ার কারণ সেটাতেই তাকে মানাবে। মনজু খালা বাসায় এলেই রিনাকে “আমার মামনিটা কোথায়” বলে জড়িয়ে ধরে, আর লিনাকে জিজ্ঞেস করে “লেখা-পড়া কেমন চলছে”।
সেই সময়টাতেই এক সন্ধ্যায় লিনা লক্ষ্য করে, কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। সেদিন একটা বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। উপহার হিসেবে মৌচাক মার্কেট থেকে মা জাম রঙের একটা কাতান শাড়ি কিনে এনেছে। শাড়ির বাক্সে রাপিং পেপার জড়ানোর আগে রিনাকে মা ঘরে টেনে নিয়ে গেলেন, কৌতূহলবশত লিনাও সাথে গেলো। মা রিনাকে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, “বল তো, মা, শাড়িটা কেমন হয়েছে?”
“হয়েছে, খারাপ না।” – বলে রিনা গুন গুন করতে করতে ওর ঘরে চলে গেলো।
লিনার খারাপ লাগলো। মা এত আগ্রহ করে জানতে চেয়েছে শাড়িটার বিষয়ে, আর ও কিনা তেমন আগ্রহ না দেখিয়ে চলে গেলো? লিনা এগিয়ে গিয়ে বললো – “মা, শাড়িটা খুব সুন্দর হয়েছে।”
কিন্তু কামরুন্নেসা জামান তাকে কিছু বললেন না।
“মা, শাড়িটা আসলেই খুব সুন্দর হয়েছে।” – লিনা আবার বললো, কিন্তু এবারো মা কিছু বললেন না। তখনি প্রথম লিনার সন্দেহ হয়, সে হয়তো অদৃশ্য হয়ে গেছে। সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হয়, যখন সেজে-গুজে বাথরুম থেকে বেরিয়ে লিনা দেখে বাসায় কেউ নেই। টেবিলের ওপর একটা কাগজ রাখা, মা-র হাতের লেখা – “বাসায় ফিরলে খেয়ে নিস। ফ্রিজে দুধ আছে।”
মানে কি? সবাই তাকে রেখে চলে গেলো? এ হতেই পারে না। নিশ্চয়ই মা তাকে দেখতে পায় নি, ভেবেছে সে এখনো পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে বসে আছে আর সুচরিতার সাথে গল্প করছে।
এরকম যখন বেশ কয়েকবার হলো, সুচরিতাকে বিষয়টা জানালো লিনা। সুচরিতা ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল। সে পরামর্শ দিলো – “তুই খোদার কাছে সাহায্য চাইতে থাক, খোদা যদি বলে ‘হও’ সাথে সাথে তোর সমস্যা ঠিক ‘হয়ে’ যাবে।”
“খোদা কোথায়? তাকে তো দেখা যায় না। আমি কিভাবে অদৃশ্য কারো কাছে সাহায্য চাইবো?”
“তাহলে দুনিয়াবী লাইনে চেষ্টা চালিয়ে যা। ভালো করে লেখাপড়া কর। বড়োদের বলতে শুনেছি, লেখাপড়া জানা লোকেদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলি হয় না।”
সেই থেকে লিনা অনেক লেখা-পড়া করলো। নাইনে ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে ক্লাসে ফার্স্টও হলো। তার কাছ থেকে নোট জোগাড় করার জন্য মেয়েদের মায়েরা ভিড় করলো, কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো এই মেয়েগুলো তাকে রেখেই সিনেমা দেখতে হলে চলে গেলো – প্রতি রিক্সায় তিনজন করে উঠেছিল, শেষ রিক্সায় চারজন উঠতে হয়, কিন্তু আলিফা একটু মোটা বলে চারজনের জায়গা হলো না। লিনা “এই, এই, দাড়া” বলতে বলতে রিক্সা টান দিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলো।
এইভাবে চলতে চলতে লিনা একসময় বিষয়টা মেনে নিলো। মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটা তেমন কোন সমস্যা তো করছে না তার জীবনে। বরং এই বিষয়টা একসময় সে উপভোগ করতে শুরু করলো। হয়তো কোন জন্মদিনের প্রোগ্রামে গেলো, কেউ তাকে লক্ষ্য করছে না – সে এক কোনায় বসে অন্যদের দেখা শুরু করলো, আর তখন গল্পেরা পাখা মেলা শুরু করলো তার মাথায়।
সেই সময় লিনা দেখতে শুরু করলো এমন সব জিনিস, যা সাধারণত অন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। যেমন – রিনা আর সরফরাজের মধ্যে যে একটা কিছু চলছিল, সেটা রিনার বাড়ি থেকে পালানোর বছর তিনেক আগেই লিনা টের পেয়েছিলো।
লিনা আসলে বুঝতে শুরু করেছিল – যা দেখা যায় তা যেমন সত্য, যা দেখা যায় না কিন্তু ধারণা করা যায় তাও তেমনি সত্য কিংবা তার চেয়ে বেশি সত্য হতে পারে। সুতরাং সে তার ধারণাগুলো নিয়ে লিখতে শুরু করলো – প্রথমে ডাইরিতে, তারপর ছদ্মনামে অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলোতে। এমনকি একসময় মানুষ তার লেখাগুলো পড়তেও শুরু করলো।
লেখালেখির শুরুর পর লিনার অদৃশ্য হয়ে যাবার সমস্যাটা কমে এসেছিলো। সেই বছর মাত্র একবার কি দু’বার সেই অসুখে আক্রান্ত হলো সে। লিনা তাই তার লেখালেখি বাড়িয়ে দিলো। এক প্রকাশকের সাথে ছোট-খাটো চুক্তিও হয়ে গেলো। কিন্তু বইমেলাতে তার প্রথম উপন্যাসিকা বের হবার পর সে আবিষ্কার করলো, স্টলগুলোতে পাঠকের চেয়ে লেখক সংখ্যায় কিছুটা বেশি।
স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে ওটা রক্ষা করা যেমন কঠিন, ঠিক সেরকম বই বের করার চেয়ে তা বিক্রি করা বেশি কঠিন মনে হলো তার কাছে। পুরো বইমেলায় তার বই বিক্রি হলো মাত্র তেত্রিশ কপি, লেখকের কেনা দশ কপি সহ। সেবছর ফেব্রুয়ারী শেষ হয়ে মার্চ শুরু হতে না হতেই লিনার সমস্যাগুলো আবার ফিরতে শুরু করলো তার কাছে। মার্চের শেষ সপ্তাহে সে উধাও হয়ে রইলো পুরো চার দিন তিন রাত।
তার সেই আপাতসঙ্কটের দিনগুলোর মধ্যেই এক সন্ধ্যায় রাকিবের বাসায় লিনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। জন্মদিনের অনুষ্ঠান আমার ভালো লাগে না, তরুণেরা যখন ঝলমলে শার্ট পরে আর তরুণীরা যখন প্রসাধনকে তাদের আব্রু বানায় তখন কেন যেন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয় আমার। অসহায় মনে হয়, কারণ কিছুতেই তাদের মতো হতে পারি না আমি, আবার তাদের ছেড়ে থাকতেও পারি না। কি একটা অবস্থা !
সাতজন তরুণ আর আটজন তরুণী যখন ব্যাকগ্রাউন্ডে হিন্দি সিনেমার আশ্চর্য গানগুলোর একটা ছেড়ে লাল-নীল রঙের ক্রিমের ভেতর বাড়াবাড়িরকম সতর্কতার সাথে প্লাস্টিকের ছুরি চালাচ্ছে, তখন আমি খোলা কোন বারান্দা খুঁজছিলাম আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো বলে। তখনি দেখলাম একটা মেয়ে একা বসে আছে ড্রইংরুমের কোনার কালো সোফাটাতে, আর কেক কাটার দৃশ্য দেখে মিটিমিটি হাসছে। কৌতূহল হলো বলে আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। বললাম – “আপনি যাচ্ছেন না কেন?”
আমার কথা শুনে তার হাসি বন্ধ হয়ে গেলো মুহূর্তের মধ্যে। বেশ কিছুক্ষন হতভম্ব চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো যেন জ্যান্ত কোন ভুত দেখেছে, তারপর চোখ বড় করে বললো – “আপনি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন?”
আমি তার প্রশ্ন বুঝতে না পেরে বললাম – “দেখতে পাবো না কেন? আপনি কি জীন না ফেরেশতা যে আপনাকে দেখতে পাবো না?”
আমার কথা শুনে সে হেসে উঠলো, আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমি তার প্রেমে পড়ে গেলাম।
পর মুহূর্তেই অবশ্য লিনার হাসি থেমে গেলো। চোখ সরু করে বললো – “প্রায় সময়ই আমি অদৃশ্য থাকি তো। ভেবেছিলাম আজও সেই অবস্থা। মনে হচ্ছে, ব্লাড প্রেশার আজ ঠিক আছে। আমি দেখেছি, যেদিন আমার প্রেশার লো থাকে না, সেদিন আমাকে দেখতে কারো তেমন একটা সমস্যা হয় না।”
আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম – তাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, শুধু তাই না, তাকে দেখতে খুব স্নিগ্ধ আর সুন্দর লাগছে। উত্তরে সে মলিন হাসি হাসলো।
সেই থেকেই লিনার সাথে আছি আমি। বলতে গেলে ছায়ার মতো থাকি তার সাথে। আমার সাথে দেখা হওয়ার পর লিনার সমস্যাটাও বেশ কমে এসেছিলো। সত্যি কথা বলতে কি, বিয়ের পর প্রথম তিন বছর একবারের জন্যও সে অদৃশ্য হয় নি।
বিয়ের পর একদিন লিনাকে বললাম – “তোমার এসবি ভুল ধারণা, মনের ব্যারাম। দেখো, আমার চোখে তুমি কোনোদিনই কিন্তু অদৃশ্য হও নি।”
“প্রথম প্রথম সব সম্পর্কই ভালো থাকে”- সে মলিন হেসে উত্তর দিলো – “তারপর সেটা ফ্যাকাশে হতে শুরু করে পুরোনো জামার মতো। মা মারা যাওয়ার পর ভেবেছিলাম, তাকে হারানোর দুঃখ কোনোদিন ভুলতে পারবো না, কিন্তু দেখো বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাকে ভুলে বসে আছি। শুধু তাই না, সুখেই আছি। চিন্তা করো, মা কবরে শুয়ে আছে, আর আমি দিব্যি মাটির ওপর মজা করে বেড়াচ্ছি। এজন্যই হয়তো মায়ের লাশ কবর থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছে।”
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই বললো – “বাবা নিজে দেখেছে। গত জুলাইয়ে তোমার মনে নেই তিন সপ্তাহ প্রচন্ড গরম পড়লো, তারপর সারারাত বৃষ্টি হয়ে ঢাকা শহর হাটু পানিতে ডুবে গেলো? ওই সময় শাহজাহানপুর কবরস্থানেও পানি উঠেছিল। পানি নামার পর দেখা গেলো, মা-র কবর আর আশে-পাশের কবরগুলো ডেবে গেছে। কবর মেরামত করতে গিয়ে ওরা দেখে ভেতরে লাশ নেই।”
“লাশ চুরি? আমি শুনেছি, মেডিকেলের স্টুডেন্টদের সাপ্লাই দেয়ার জন্য কিছু অপরাধী চক্র লাশ চুরি করে, পরে সেগুলি এসিডে গলিয়ে স্কেলেটন বের করে বিক্রি করে। একেকটার দাম পনর থেকে বিশ হাজার টাকা হয়। ডাক্তারির মতো মহৎ পেশা শেখার জন্য অবশ্য এই মূল্য তেমন কিছু না।” – আমি বললাম।
“মনে হয় না সেরকম কিছু।” – সে গম্ভীর কণ্ঠে বললো – “বেওয়ারিশ লাশ চুরি হয়। কবর থেকে লাশ চুরি হয় না। তাছাড়া শাহজাহানপুর কবরস্থানে চব্বিশ ঘন্টা পাহারাদার থাকে।”
“আমি শুনেছি, পরিবেশ অনুকূলে থাকলে তিন মাসের মধ্যেই লাশ মাটিতে মিশে যেতে পারে।” – বিজ্ঞানভিত্তিক একটা মতামত প্রকাশের চেষ্টা করলাম আমি এবার।
“না, সেরকম কিছু না। সেরকম কিছু হলে কাফনটা অন্তত থাকতো। কবর ছিল একেবারে শূন্য, যেন সেখানে কেউই কোনোদিন ছিলই না। ঠিক এভাবেই কিন্ত আমার মাথা থেকেও তার স্মৃতি মুছে গেছে, যেন মেহেরুন্নেসা বেগম বলে কাউকে কোনদিন চিনতামই না আমি।”
“এ ব্যাপারে কোন বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা কি তোমার জানা আছে?” – কৌতূহলবশত জানতে চাইলাম আমি।
“হয়তো আমার মতো মায়েরও একই রোগ ছিল। হয়তো তার রোগটা জীবদ্দশায় প্রকাশ পায় নি। অসম্ভব না। হতেও পারে, এই রোগ এতটাই অস্বাভাবিক যে কাউকে কাউকে এটা আক্রমণ করে শুধু মারা যাওয়ার পরই। আর মা সেই ব্যতিক্রমী অভাগা মানুষদেরই একজন ছিল।”
বইমেলাতে প্রগতিশীল একটা স্টলে বসতো বলে আমি তাকে “মহিলা নাস্তিক” নামে ডেকে মস্করা করতাম। সে কিছু মনে করতো না অবশ্য, তার মনটা ছিল এমনই উদার। তবে মানুষের ভেতর সম্ভবত একটা কোন উপাস্য খুঁজে বেড়ানোর অন্তর্গত কোন প্রবণতা আছে, আর সেজন্য যেসব লোক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না তারা অন্য কোন অদ্ভুত জিনিসে বিশ্বাস করে সেই শূন্যতাটা পূরণের চেষ্টা করে। প্রায়ই দেখতাম আয়নার সামনে বসে থাকতো মেয়েটা আর নিজের প্রতিবিম্বটার সাথে কথা বলতো। সেইসব কথাও আবার অস্তিত্ববাদী ধরণের।
যেমন একদিন বেডরুমে ঢুকতে গিয়ে শুনি সে আয়নাতে তার ছায়াকে বলছে – “আমি হলাম আসল, আর তুমি হলে নকল। তোমার অস্তিত্ব পুরোটাই আমার ওপর নির্ভরশীল, বুঝলে মেয়ে?”
ঘরে ঢোকার সময় আমি হাসছিলাম, ও সেটা খেয়াল করে দেখলো। জানতে চাইলাম, কে আসল আর কে নকল।
“আমি আসল, আর আমার ছায়া নকল।” – বললো সে।
“কিভাবে বুঝলে, তুমি আসল?” – হেসে বললাম।
কিন্তু সে মোটেও কথাটা তামাশা হিসেবে নিলো না, বললো – “আমি আসল, কারণ আমার ওপর আমার ছায়াটার অস্তিত্ব নির্ভরশীল, উল্টোটা না। আমি যদি আয়নার সামনে থেকে সরে যাই, তাহলে আমার ছবিটা মুহূর্তের ভেতর নাই হয়ে যাবে। তার মানে সে নকল।”
“ঠিক আছে। ঠিক আছে। তুমিই আছো, তোমার ছায়ার কোন অস্তিত্ব নেই। এখন খেতে চলো, ক্ষুধা লেগেছে।” – অস্থির হয়ে বললাম আমি।
“আমি কিন্তু তা বলিনি, ফুয়াদ।” – সে যেন ওই ঘোর থেকে বেরই হতে পারছিলো না – “আমি কিন্তু একবারও বলিনি ওর কোন অস্তিত্বই নেই। আমার যেমন অস্তিত্ব আছে, আমার ছায়ারও তেমনি অস্তিত্ব আছে। দু’টা অস্তিত্বই কিন্তু সত্য – আমার অস্তিত্ব যেমন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমান করা যায়, আমার ছায়ার অস্তিত্বকেও তেমনি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমান করা যায়। যদিও ওরটা খুবই ভিন্ন ধরণের একটা অস্তিত্ব – আমি স্বাধীন অস্তিত্ব, আর সে নির্ভরশীল অস্তিত্ব।।”
আমি ওর সামনে বসলাম, একদম মুখোমুখি, তারপর বললাম – “এমন যদি হয়, লিনা, তুমি, আমি, আমরা সবাই মহা কোন অস্তিত্বের ছায়া এই পৃথিবীর আয়নাতে? সেক্ষেত্রে কিন্তু তোমার-আমার অস্তিত্ব সেই মহান অস্তিত্বের তুলনায় নগন্য। আমাদের অস্তিত্ব তাঁর ওপর নির্ভরশীল অস্তিত্ব। ভেবে দেখো, লিনা, ভেবে দেখো। সে যখন তোমার ওপর থেকে তার করুণার দৃষ্টি সরিয়ে নেবে, তখন তোমার অস্তিত্ব কিন্তু মুহূর্তের ভেতর নাই হয়ে যাবে। তুমি উধাও হয়ে যাবে, তুমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে – তুমি নাই হয়ে যাবে, তুমি ফানা হয়ে যাবে। হতেও তো পারে, তাই না?”
সে অবশ্য আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করলো, যেন এবার আমিই অদৃশ্য এই ঘরে। নিজের মনে সে বলে চললো – “এসবই বাজে কথা, ফালতু তত্ত্ব যার কোন প্রমান নেই।”
“তাহলে কিসের প্রমান আছে বলে মনে হয় তোমার?”
“প্রমান আছে আমার। এই আমার। এই যে আমাকে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়। আমার তো মনে হয়, আমিই মূল অস্তিত্ব, আর আমার মনের ভেতর থেকেই পৃথিবীর শুরু।”
খুব গোলমেলে লাগলো ওর কথাগুলো। সন্দেহ হলো, তার মাথা খারাপ হতে শুরু করেছে। কে জানে, নিজের অদৃশ্য হওয়ার সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে ঘামাতে তার মাথাটাই গেছে কিনা।
“তুমি তো মনে হয় নিজেকেই নিজের ঈশ্বর বানিয়ে নিয়েছো।” – বললাম।
“ঈশ্বর বলে যদি কেউ থেকেই থাকে তাহলে উনি তার জায়গায়, আর আমি আমার জায়গায়।” – সে গ্রীবা উঁচু করে উত্তর দিলো।
ওর কথাগুলোতে অস্বস্তি হচ্ছিলো বলে আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম – “আমার তো মনে হয়, তুমিই বরং ঈশ্বরের দেখা সুন্দর একটা স্বপ্ন।”
আমার সেই কথা শুনে তার হাসি আর থামেই না।
বিয়ের পর গত বছরই প্রথম বারের মতো ও আমার চোখ থেকে ও উধাও হয়ে গিয়েছিলো, যদিও ওর কণ্ঠস্বর আমি শুনতে পাচ্ছিলাম পুরোটা সময় জুড়েই।
সেই রাতে বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। বারান্দায় পানি জমে পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিলো। ঘরে ঢুকে দেখি, লিনা আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে আর তার মুখ থমথমে। আমি জানতে চাইলাম, কি হয়েছে।
“আমার নাকটা কেমন বোঁচা, দেখেছো? একটু খাড়া খাড়া হলেই আমাকে সুন্দর লাগতো, তাই না?”
আমি কি বলবো, বুঝে পেলাম না। মেয়েদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, তার অনুশীলন খুব একটা করা হয় নি জীবনে। সে তো আমার কাছে সুন্দরীই, তবু তার মন ভালো করার জন্য বললাম – “তোমার চেহারার সাথে কিন্তু তোমার নাক বেশ যায়।”
কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, তার মন আরো খারাপ হয়ে গেলো।
শেষ রাতে ঘুম ভেঙে দেখি, সে পাশে নেই। নাম ধরে কয়েকবার ডাকলাম, উত্তরে সে বললো “কি হয়েছে, আরিফ”। বিছানায় আমার পাশ থেকেই তার কণ্ঠ কথা বলছে, কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না। বুঝতে পারলাম, তার রোগটা আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। আর এজন্যই আমার ঠিক পাশেই, আমার হাতের নাগালের একেবারে ভেতরে থাকার পরও তাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না। ল্যাম্পের হলুদ আলো কিন্তু সারা ঘর জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
এই কয় বছরে আমরা কোন সন্তান নেয়ার চেষ্টা করি নি, স্বাভাবিকভাবেই – কি অবস্থা হবে, যদি এমন একটা শিশুর জন্ম হয় যার অস্তিত্ব আছে কিন্তু আকৃতি নেই ! আমরা আসলে অদৃশ্য হবার রোগটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে চাই নি – কে বলতে পারে হয়তো বিষয়টা জেনেটিক, আর তার ফলে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়তে পারে একই ধরণের অবয়বহীনতার রোগ।
বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় এসে তার সমস্যাটা চরম আকার ধারণ করলো। অবস্থা এমন হলো যে আমি তাকে সপ্তাহান্তে রবিবার ছাড়া আর কোনোদিন দেখতেই পেতাম না। রাত এগারোটায় অফিস থেকে ফিরে দেখতাম, শূন্য আমার বাসা। কিন্তু বুঝতে পারতাম, সে আছে কোথাও – শুধু অদৃশ্য হয়ে আছে বলে তাকে দেখতে পাচ্ছি না আমি।
কিন্তু অবস্থা একসময় এত খারাপ হলো যে, আমি তাকে মাসের পর মাস দেখতে পেতাম না। শুধু শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর বাসায় ফিরে যখন একটু তন্দ্রা মতো আসতো, তখন তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেতাম। সংসারের টুকটাক কথাবার্তা, বাজারের লিস্ট, ইলেক্ট্রিসিটি বিল, এগুলো নিয়ে আলাপ সেরে ফেলতাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
কিন্তু তারপর এক সোমবার বিকেলে হঠাৎ করেই অবস্থার উন্নতি হলো। আমি অফিস থেকে ফিরে দেখলাম, সে দিব্যি ড্রইংরুমে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ছে। পরনে কালো পাড় লাগানো সাদা একটা শাড়ি। মাথায় সফেদ ওড়না। আমি স্বস্তির নিঃশাস ফেললাম, কিন্তু নামাজ শেষ হতে না হতেই সে আবার অদৃশ্য হয়ে গেলো।
আমি তার কথা শুনতে পাচ্ছিলাম, যেমন সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো প্রতি সোমবারের মতো আজ আমি বাজারে যাই নি কেন। আমার অবশ্য ওর প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না – কেন যেন।
যে মেয়ে দৃশ্যমান না বলে স্রষ্টা জাতীয় কিছুর ওপর ভরসা রাখতে পারে নি কোনোদিন, তাকে অকস্মাৎ-মৌলভী হতে দেখে যার-পর-নাই বিস্মিত হলাম আমি। আলো-আঁধারি হাতড়ে অদৃশ্যমানবীকে জিজ্ঞেস করতে সে বললো, তার ভীষণ অসুস্থ – সম্ভবত মৃত্যুপথযাত্রী – বাবা তাকে ফোন করেছিল। বাবা তাকে শেষবারের মতো অনুরোধ করেছে বিশ্বাসের তরিকা চেষ্টা করে দেখতে, তাই সে বাবার শেষ অনুরোধটা রাখার চেষ্টা করছে মাত্র।
এশার আজানের পর দেখলাম, সাদা শাড়ির কালো আঁচলকে ঘোমটা বানিয়ে সে দিব্যি নামাজ পড়ছে। সবুজ জায়নামাজ উঠিয়ে যখন ভাঁজ করছে আর মুখে কি যেন দোয়া পড়ছে, তখন পর্যন্ত সে দৃশ্যমান থাকলো। কিন্তু তসবিহ জপা শেষ হতেই সে যথারীতি অদৃশ্য হয়ে গেলো আবার।
সেই থেকে লক্ষ্য করলাম, তাকে শুধু তখনই দেখতে পাওয়া যায় যখন সে নামাজ পড়ে, দোয়া-কালাম করে, ইত্যাদি। এছাড়া তাকে আমি দেখতে পাইনা। আমি নিজেকে এই ভেবে স্বান্তনা দিতে চেষ্টা করলাম, অন্ততপক্ষে এবাদত-বন্দেগীর সময় তো তাকে দেখতে পাওয়া যায়, অর্থাৎ দিনে অন্তত পাঁচ ওয়াক্ত। এটাই বা কম কি? আগের অবস্থার তুলনায়, মানে যখন মাসের পর মাস সে অদৃশ্যমানবী হয়ে থাকতো, সেই তুলনায় তো এটা ভালো উন্নতি।
এভাবে মাসের পর মাস চলতে লাগলো। লিনার এই রোগমুক্তিতে আমার খুশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কেন যেন আমি সেটা হতে পারলাম না, বরং ভেতরে ভেতরে কি যেন একটা কিছু জুতার ভেতর ঢুকে আটকে পড়া নুড়িপাথরের মতো আমাকে খোঁচাতে লাগলো ক্রমাগত।
স্বীকার করতেই হয়, আমি আসলে ভেতরে ভেতরে ঈর্শ্বায় জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছিলাম, যদিও জানতাম না কাকে আমি ঈর্ষা করছি। আসলে আমি ভুলতে পারছিলাম না যে, সে তখনই শুধু দৃশ্যমান থাকে যখন কেউ তাকে মনোযোগ দেয়। ওর সাথে সেই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ার পর পর তার সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, কারণ তখন আমি তাকে অবিচ্ছিন্নভাবে মনোযোগ দিয়েছি – প্রথম প্রেমের প্রভাবে বলতে গেলে চোখে চোখে রেখেছি। বিয়ের পর যতদিন তাকে সময় দিয়েছি, সে ভালো ছিল।
তার মানে কি এই না যে, এর অর্থ কি এই না যে, সে ইদানিং অন্য কাউকে পেয়ে গেছে, আর এতেই তার অসুখ আবার ঠিক হতে শুরু করেছে? এটা কি আমার বিশ্বাস করা উচিত হবে যে সে শুধু তার বাবার একটা কথাতেই ঠিক হয়ে গেছে? নাকি আর কেউ আছে তার এই অতর্কিত হেদায়েতের পেছনে? কিন্তু কে সেই লোক? সে নিশ্চয়ই মৌলভী ধরণের – আমি ধারণা করি – যে কারণে লিনার মতো মেয়ে নামাজ-কালাম শুরু করে দিয়েছে।
একদিন দুপুরে তাকে বললাম – “আমি আর এসব নিতে পারছি না, লিনা। আমি জানি, আমি তোমাকে সময় দিতে পারি না। তোমার যদি কাউকে ভালো লাগে, বলতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না।”
সে হেসে বললো – “আমি এমন একজনকে পেয়ে গেছি, যে সবসময় আমাকে দেখে রাখছে। আমার শরীরের আয়নায় যতক্ষণ তার ছায়া পড়বে, ততক্ষন আমার কোন ভয় নেই, আমার হারিয়ে যাওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই।”
সে নিশ্চয়ই আমার কথা বলছে না। আমার সাথে বিয়ের পরও তো তার সমস্যাটা ফিরে এসেছিলো, তাই না? তাহলে সে কি আরেকজন কাউকে পেয়েছে, আর তাই আমাকে আর তার প্রয়োজন নেই? মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমি, ফলে ভেতরে ভেতর জ্বলে-পুড়ে মরছিলাম।।
তার এই উত্তর আমার সংশয় দূর করার বদলে আমাকে আরো দ্বন্দ্বে ফেলে দিলো। ভেতরে ভেতরে ভীষণ কুঁকড়ে গেলাম আমি। যে মেয়েটাকে শুধু “কবুল” বলার কারণে পেয়ে গেছি বলে ভেবেছিলাম, যাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে যাবার কারণে অবহেলা করেছিলাম, হারিয়ে ফেলার ভয় চোখের পলকে তাকেই আবার আমার কাছে মহামূল্যবান করে তুললো। আশংকা, সন্দেহ, ঘৃণা, টান আমাকে প্রায় অর্ধোন্মাদ করে তুললো মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে।
এরপর থেকে দিনের পর দিন এই রহস্যটা নিয়ে চিন্তা করেছি আমি। কেন সে অদৃশ্য হয়ে যেতে শুরু করেছিল, কেনইবা আবার তার সেই রোগ হঠাৎ ভালো হতে শুরু করলো – এসব নিয়ে চিন্তা। কিন্তু ভেবে ভেবে কোন কুল-কিনারা করতে পারি নি।
হতে পারে, বিশ্বাসের সাথে অস্তিত্বের একটা সম্পর্ক আছে কোথাও না কোথাও। কিন্তু আমি ঠিক নিশ্চিত না। বলে রাখা ভালো, বিজ্ঞান ছাড়াও ধর্মে দুর্বল ছিলাম আমি। আমাদের ব্যাচের প্রায় সবাই ইসলামিয়াতে লেটার মার্ক পেলো, আমিই শুধু পেয়েছিলাম ঊনসত্তর।
এগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে বহু রাত আমার নির্ঘুম কেটেছে, বহু দিন কেটেছে দুপুরের কড়া রোদে মিন্টু রোড ধরে হেটে হেটে হয়রান হয়ে। অস্তিত্ব সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে ভেবে ভেবে আমি হয় অস্থির না হয় অসুস্থ হয়েছি, মাসের পর মাস কাটিয়েছি আবার লিনাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে সিঁটিয়ে থেকে। অনিয়মিত হওয়ার কারণে বায়িং হাউসের চাকরিটাও চলে গেছে একদিন। ততদিনে ধার-দেনার কারণে বন্ধু আর আত্মীয়রাও আমাকে এড়িয়ে চলা শুরু করেছে।
তারপর শেষে একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছি, রোদ জড়ানো এক শীতের সকালে কেমন করে যেন হঠাৎই মেনে নিতে পেরেছি ব্যাপারটা। অদৃশ্যের কোন জগৎ থেকে যেন ইলহাম জারি হয়েছে আমার ওপর, তাই আমার বোধোদয় হয়েছে যে – আমার তো দরকার লিনার অস্তিত্বশীল থাকা, তো সেই অস্তিত্ব যদি বিশ্বাসের হাত ধরে আসে তাতে আমার আর সমস্যা কি!
বিশ্বাসের অন্ধকারে তো ঝাঁপ দিতে হয় চোখ দু’টো বন্ধ করেই, তাই না? এই ইহজগতে মানবজাতি যদি সবকিছুর প্রমান পেয়েই যায়, তাহলে বিশ্বাসের আর কি কোন মূল্য থাকে?

Darun lekha
LikeLike