কালেমা হচ্ছে একজন ঈমানদারের জীবনের সবকিছু। ‘কালিমা তায়িবা’ বা বিশুদ্ধ কালেমা বলে – “খোদা ছাড়া আর কোন মাবুদ নাই।”
শুদ্ধ বাংলায় বললে – “ঈশ্বর ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই।”
মাওলানা শেখ রহমতুল্লাহ মাদানীর জীবনটাকে এই কালেমা সুউচ্চে তুলে ধরার সংগ্রাম বলেই বিবেচনা করা যায়।
মাওলানা রহমতুল্লাহ মাদানী সাহেব ছিলেন আমাদের যাত্রাবাড়ী এলাকার বটতলা মসজিদের পেশ ইমাম। বজ্রাহত হওয়ার পর তার মাথায় কিছু সমস্যা দেখা দেয়। এরশাদ সরকারের যে বছর পতন হয়, সেই একই বছরের ঘটনা ছিল সেটা।
বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে, বজ্রপাতের পর মানুষের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে খুব কম। কিন্তু এটা একটা ভ্রান্তবিশ্বাস, কারণ পরিসংখ্যান বলে বজ্রপাতে আক্রান্ত মানুষের নব্বই শতাংশই বেঁচে যায় – যদিও নানারকম শারীরিক সমস্যার শিকার হয়ে কাটাতে হয় তাদের বাকি জীবন। কেউ শ্রবণশক্তি হারায়, কেউ দৃষ্টি। বেশিরভাগেরই আগুনে পোড়ার চিকিৎসা করা লাগে। অনেকের শ্বাসকষ্ট হয়। রহমতুল্লাহ মাদানী সাহেবের ক্ষেত্রে হলো গায়েবি আওয়াজ শোনার প্রবণতা। শারীরিক প্রতিবন্ধিত্বের তুলনায় এটা তেমন কিছু না।
সুতরাং হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মাওলানা রহমতুল্লাহ যখন ঘোষণা করলেন, তিনি গায়েবি নির্দেশ পেয়েছেন মুলকে বাংলাস্থানে তাওহীদের বাণী প্রচারের জন্য তখন কেউ সেটা নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামালো না, যদিও রহমতুল্লাহ সাহেব তার অবস্থানে অটল থাকলেন।
বজ্রাহত হওয়ার পর পরই রহমতুল্লাহ সৌদি ফেরত শেখ জামিলুর রহমানের শরণাপন্ন হন। উদ্দেশ্য, শিরক থেকে মুক্ত থেকে কিভাবে জীবন-যাপন করতে হবে, সেটা জেনে নেয়া। তিনি শুনেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে তৌহিদের যে শিক্ষা দেয়া হয়, দুনিয়ার বুকে সেটা অনন্য ও বিরল।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সেই আসরে রহমতুল্লাহ মাদানী সাহেবের উদ্দেশ্য সফল হয়। ঈমান ও আকিদা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হয়ে তিনি তাওহীদ অর্থাৎ ইসলামিক একত্ববাদের প্রচারে মনোনিবেশ করেন। তিনি নিজে মদিনা যান নি, কিন্তু মদিনার শিক্ষা প্রচারের ব্রত নেয়ায় তার শেখ তাকে নামের শেষে মাদানী উপাধি সংযোগের এজাজত দিয়ে দেন। তাওহীদপন্থী শেখের দোয়ায়, মাদানী নামের বরকতে, এবং ইন্টারনেটের যুগের কল্যানে দ্রুতই তার কিছু ভক্তকুলও জোগাড় হয়ে যায়।
এসময় তিনি মনোযোগ দেন মাজারপূজা থেকে আলাভোলা মুসলমানদের ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। সিলেটভিত্তিক হজরত শাহজালালের দরগা আর চট্টগ্রাম ভিত্তিক বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার ছাড়া বাকি বিভিন্ন এলাকায় তার চেষ্টা-চরিত্রের অসীলায় বাঙালি অনেকেই মুক্তি পায় মাজার পূজা নামের অধর্ম থেকে। মাজারে গিয়ে লোকজন কবরের কাছে জিনিস মাঙ্গে। মৃত ব্যক্তির কাছে তারা বিপদমুক্তি প্রার্থনা করে। কিন্তু মৃত ব্যক্তি তো কিছু দিতে পারে না, সুতরাং তার কাছে জিনিস চাওয়া হলো শিরক – তাওহীদের খিলাফ।
মাজার-পূজা নিয়ে আংশিক সফলতার সাথে তার অনলাইন অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তখন তিনি মনোযোগ দেন পীর পূজার দিকে। বাংলাদেশ নামের এই ব-দ্বীপ এলাকাতে লোকজনের মন দুর্বল, তারা মনে করে পীর একটি বিশেষ প্রজাতির প্রাণী যাদের সাথে খোদার সরাসরি যোগাযোগ আছে। তারা আরো মনে করে, পীর পুলসিরাত পার করিয়ে দিবেন। এই যে তারা পীরকে খোদার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম ভাবলো, এটাও তো একধরণের শিরক – খোদার সাথে শরিক করা। সুতরাং এটার বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করতে হবে।
কিন্তু এইবার রহমতুল্লাহ সাহেব খুব একটা এগুতে পারলেন না। মুন্সিগঞ্জের মতো যেসব এলাকায় পীর সাহেবরা দীর্ঘদিন ব্যবসা করে আসছেন, সে জায়গাগুলিতে তিনি ঢুকতেই পারলেন না। তার বয়ানের আগেই মঞ্চ ভাঙচুর হলো, তার মাইক্রোবাসকে ধাওয়া করে এলাকা থেকে বের করে দেয়া হলো, আরো কত কি। মধ্যপ্রাচ্য পন্থীরা তাকে সাদর আমন্ত্রণ জানালেও ভারতীয় উপমহাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে দীক্ষিত পীরবাদী ও সুফিপন্থীরা তাকে ‘ঠ্যাডা মাওলানা’ ও ‘ঠ্যাডা শেখ’ বলে ব্যঙ্গ করতে পিছ-পা হলো না। একত্মবাদের পথে তার সফর শুরু হওয়ার পর প্রথমবার রহমতুল্লাহ হতাশ হলেন। রাতের পর রাত তিনি তাহাজ্জুদের সেজদায় পড়ে থেকে ঐশী সাহায্য চাইলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
কিন্তু রাত জেগে দীর্ঘ ইবাদতের কারণেই সম্ভবত মাওলানা রহমতুল্লাহ এক দিকে বিশেষ আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করলেন, এক শেষরাতে হঠাৎ করে তার ইলহামের দরজা খুলে গেল। আধ্যাত্মিক জগতে যাত্রার এই পর্যায়ে এসে তিনি শির্কের আরো গভীর কিছু স্তর লক্ষ্য করতে শুরু করেন।
প্রথমেই তিনি খেয়াল করলেন, এলাকার মফিজুল ইসলামের মধ্যে শিরকের বেশ দীর্ঘ একটা ছায়া আছে। মফিজ সাহেব যাত্রাবাড়ীর বড় ব্যবসায়ী, তার পাঁচটা ইটের ভাটা আছে, আরও আছে বড়বাজারে একুশটা দোকান। রহমতুল্লাহর দৃঢ় ইয়াকিন ছিল, টাকা দিয়ে সবকিছু আদায় করা যায় বলে এই ব্যক্তি আসলেও বিশ্বাস করে। টাকার পেছনে যে খোদা শক্তি দেন, এই লোক তা ভুলে গেছে।
কিন্তু শেখ রহমতুল্লাহ এই মফিজুল সাহেবকে কিছু বলার সাহস পান না। ইনি মসজিদের সবচেয়ে বড়ো ডোনার, তার এক কথায় রহমতুল্লাহর চাকরি বাদ হয়ে যেতে পারে, তখন তার এতদিনের কষ্ট সব বৃথা যাবে, ধর্মের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে, তদুপরি স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে পথে বসতে হবে। সব দিক বিবেচনার পর এক জুম্মার জামায়াতে রহমতুল্লাহর বয়ানের বিষয় হলো কারুনের কাহিনী, কিভাবে মাটি তার সমস্ত সম্পদ এক লোকমায় গিলে ফেলেছিলো আর সে নিঃস্ব-রিক্ত অবস্থায় জমিনে তলিয়ে গিয়েছিলো তার দৌলতের সাথে একত্র হয়ে। বয়ান দেয়ার সময় নিজের অজান্তেই বার বার তার চোখ চলে যাচ্ছিলো মফিজুল সাহেবের দিকে, ইচ্ছা স্বত্ত্বেও এটা তিনি ঠেকাতে পারছিলেন না।
এই জুম্মাতে মাওলানা রহমতুল্লাহকে বয়ান ছোট করতে হলো, বিনা নোটিশে মসজিদের মাইক হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে। লাইট আছে, ফ্যান আছে, শুধু মাইকেই কোন আওয়াজ নেই। দুনিয়াতে কিছু কিছু রহস্যের কোন কিনারা হয় না, রহস্য রহস্যই থেকে যায় – জুম্মার ইমামতির প্রস্তুতি নিতে নিতে মনে মনে ভাবলেন তিনি।
সে দুপুরে নামাজের পর মসজিদসংলগ্ন ঘরে ফিরে মাওলানার মন খুব খারাপ থাকলো। যে শিরকের বিরুদ্ধে তার আজীবনের সংগ্রাম, নিজের মসজিদের লোকেদের মধ্যেই সেই শির্কের চরম সব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এমাম হিসেবে যে এলাকার জিম্মাদার তিনি, সে এলাকাবাসীকেই তিনি শিরকের বিষয়ে সচেতন করতে পারছেন না। এসব ভেবে ভেবে তার দিন-রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে চললো।
যাহোক, সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই আবার রহমতুল্লাহ সাহেব তাহাজ্জুদের পর পর স্বপ্নে নতুন ইলহাম পেয়ে জানতে পারেন, তার মসজিদের কমিটির চেয়ারম্যান জামিল সাহেব এমপি ক্ষমতার পূজা করেন। জামিল মনে করেন, ক্ষমতা থাকলে সব কিছু সম্ভব। কিন্তু রহমতুল্লাহ জামিল সাহেবকেও ভয় পান, তার সাথে সবসময় সাত-আটজনের একটা গুন্ডা বাহিনী থাকে, ফলে তাকে কখনো একা পাওয়া সম্ভব না, তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছানোও সম্ভব না।
কিন্তু ওলামারা হলেন আম্বিয়াদের উত্তরাধিকারী, নবীরা যেভাবে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও শাসকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তাওহীদ প্রচার করেছেন, তাকেও তো তা করতে হবে সেটাতে যত বড় ঝুঁকিই থাকুক। সুতরাং রহমতুল্লাহ মাদানী পরবর্তী জুম্মাতে হাদিস-কোরান থেকে উদ্ধৃত করে বললেন – “আমরা যে বলি, জনগণই ক্ষমতার উৎস, এটা ভাই বড় ভুল। ক্ষমতার একমাত্র উৎস হইলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। আজকে তিনি একজনকে ক্ষমতায় বসান, তো কালকে তাকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দেন। নমরুদ মনে করছিলো সে চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে, তাকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য খোদার কাছে একটা ল্যাংড়া মশাই ছিল সেনাবাহিনী হিসেবে যথেষ্ট।”
অবশ্য এ কথা বলার দুই মিনিট যেতে না যেতেই মসজিদ কমিটির আয়মান সাহেব তাকে ঘড়ি দেখিয়ে সময়ের কথা মনে করিয়ে দিলেন – জুম্মার খুৎবা মানে এই না যে, মানুষকে আসর পর্যন্ত মসজিদে বসে থাকতে হবে। ফলে সেদিন রহমতুল্লাহকে তড়িঘড়ি করে খুৎবা শেষ করতে হলো। জুম্মার নামাজও পড়ালেন ছোট সূরা দিয়ে, যেন নষ্ট হওয়া সময়টা কিছুটা পূরণ করা যায় – যদিও মাওলানার শেষ রক্ষার জন্য এটা যথেষ্ট হলো না।
আসরের নামাজ তিনি নির্বিঘ্নেই পড়ালেন। স্বাভাবিকের তুলনায় আসরের জামায়াতে দুই সারি বেশি লোক দেখেও তার সরল মনে কোন সন্দেহ উঁকি দিয়ে গেলো না। কিন্তু জামাত শেষে তসবিহ-তাহলীল করার জন্য যখন তিনি মুসল্লিদের দিকে ঘুরে বসেছেন, তখন তার দিকে অগ্রসর হলো নয়ন সাগর। এই ছেলে মুন্সিগঞ্জ সরকারি কলেজের উঠতি ছাত্রনেতা, সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। ইমামের অনুমতি না নিয়ে সে মাইকটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, তারপর বললো ‘এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে’ তার কিছু কথা বলার আছে।
নয়ন যে অভিযোগটা করলো সেটা ছিল ভয়াবহ – এলাকাবাসী তার কাছে অভিযোগ নিয়ে এসেছে যে রহমতুল্লাহ ভেতরে ভেতরে রাজাকার চিন্তাধারার ধারক-বাহক, আর এ কারণেই আজকের জুম্মার বয়ানে সে এমপি সাহেবকে নমরুদের সাথে তুলনা করেছে। মুসল্লিদের তৃতীয় ও চতুর্থ সারি থেকে একসাথে পনর-বিশজন চিৎকার করে উঠলো। নিয়মিত মুসল্লিরা আগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞাপন বিরতিহীন নাটক দেখতে শুরু করল।
সূর্যের চেয়ে বালি বেশি গরম থাকে, সুতরাং মসজিদ কমিটির সেই আয়মান সাহেব তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন – “আমার আগেই সন্দেহ হইছিলো, এই শালা বিরোধী দলের চর।” রহমতুল্লাহর ধারণা হলো, পূর্বনির্ধারিত নিয়তির মতো সওয়াল-জাওয়াবের আগেই তার মিজানের পাল্লায় ওজন নেয়া হয়ে গেছে। তিনি কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু তাকে চ্যাংদোলা করে দ্রুত মসজিদ থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো।
শেষ পর্যন্ত রফা হলো যে, মসজিদের গেটের ঠিক বাইরে রহমতুল্লাহ দশবার কানে ধরে উঠ-বস করবে আর স্বীকার যাবে যে সে আর কোনোদিন মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অবৈধ শ্লোগান দিয়ে মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট করবে না। তবে খুব দ্রুতই ঘটনা আয়ত্ত্বের বাইরে চলে গেলো। মাওলানাকে রাস্তায় নামানোর সাথে সাথে সরকার দলের সমর্থক লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠলো, ফলে তারা দাবি করতে শুরু করলো – খালি কানে ধরে উঠ-বস করলেই হবে না, সেটা করতে হবে কাপড়-চোপড় খুলে। রহমতুল্লাহ বাধা দিতেই বিষয়টা মারামারিতে পরিণত হলো, তার ওপর স্যান্ডেল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো তিনজন। তার সবুজ পাঞ্জাবি ছিড়ে ফেললো একজন, আর টেনে-হিচড়ে তার পাজামা খুলে ফেললো আরেকজন। সাদা আন্ডারওয়ার পরা মসজিদের ইমামের শাস্তি দেখতে ততক্ষনে জড়ো হয়ে গেছে শুভেচ্ছা কোচিং-এর কোমলমতি ছাত্ররা।
সূর্যাস্তের আগেই রহমতুল্লাহ মাদানী সাহেবের আন্ডারওয়ার পরে কান ধরে উঠবসের দৃশ্য ইন্টারনেটে ভাইরাল হলো। নাজমা তার স্বামীর ভাইরাল ভিডিও দেখে নীরবে আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। তার তিন বছরের বাচ্চা ছেলে রাস্তায় হাসি-তামাশার শিকার হলো। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি এই ঘটনার মধ্যে ‘ভুল পথে সঠিক বিচারের’ ইঙ্গিত খুঁজে পেল। অন্যদিকে মাওলানার ভক্তকুল কি-বোর্ডে ঝড় তুলে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক ভার্চুয়াল জিহাদ ঘোষণা করলো।
বিকেল নাগাদ রহমতুল্লাহ এলাকা ছেড়ে পালালেন, লজ্জায় নাকি ভয়ে সেটা বোঝা গেলো না। যাত্রাবাড়ী মসজিদের মাগরিবের নামাজ তাই পড়াতে হলো মুয়াজ্জিন একরামুল হক সাহেবকে। একরামুল বহুদিন এলাকায় আছেন, কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় ভালো করে জানেন। রহমতুল্লাহ সেদিন আসলে এক বস্ত্রে যাত্রাবাড়ী থেকে চলে এসেছিলেন কুমিল্লায় তার নিজের বাড়িতে। কয়েকদিন উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরির পর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পাড়ি জমান ইন্ডিয়াতে।
দীর্ঘ সফরের পর উত্তর প্রদেশে তিনি দেখা করেন মাওলানা নিজামুদ্দিন সাহেবের সাথে। নিজামুদ্দিন নিশাপুরি সেসময়ের সুফিসম্রাট। পঞ্চাশ বছরের বেশি হয় তিনি ইজাজত পেয়েছেন। রহমতুল্লাহর সব কথা শুনে তিনি তাকে আশ্বস্ত করে বললেন – রহমতুল্লাহ ঠিক লাইনেই আছে, তবে সাধনার দ্বারা তাকে আরেকটু আগে বাড়তে হবে। কিভাবে আগে বাড়তে হবে জানতে চাইলে তিনি উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন। রহমতুল্লাহ জানতেন, কঠিন প্রশ্ন তিনবার করা সুন্নত। ফলে একই জিনিস তিনি তিনবার জানতে চাইলেন।
নিজামুদ্দিন নিশাপুরি পিতৃস্নেহে কাছে ডেকে বসালেন রহমতুল্লাহ মাদানীকে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে বহু বছর তার সাথে কেউ নরম গলায় কথা বলে নি, ফলে নিজের অজান্তেই রহমতুল্লাহর চোখে জল চলে এলো, এমনকি ভেতর থেকে ডুকরে ওঠা কান্না থামানোর জন্য তাকে বেশ তকলিফ করতে হলো।
হুজুর বললেন – “তোমার মঞ্জিল কি? তুমি তোমার এই ক্ষুদ্র জীবনে শেষ পর্যন্ত কি চাও?”
কথা-বার্তা চালাচালি হচ্ছিলো হিন্দিতে – “হুজুর, এই দুনিয়াতে আমার কাজ হইলো আমার কওমের মধ্যে কালিমা তায়িবাকে কায়েম করা। হুজুর, এই কাজে আমি ফেল করছি।”
নিশাপুরি সাহেব আবার হাসলেন – “তোমার কওমের মধ্যে কালিমা তায়িবা কায়েম করার আগে কি তুমি দেখছো, তোমার মধ্যে কালিমা আছে কিনা?” রহমতুল্লাহ চমকে উঠলেন। তার মধ্যে কালিমা থাকবে না তো কার মধ্যে কালিমা আছে!
“তুমি আর তোমার খোদার মধ্যে আছে কয়েক খানা ধোঁকা। ধোঁকাগুলি থেকে বাঁচতে পারলেই তুমি পাইতে পারো খোদাকে। রহমতুল্লাহ, বাবা আমার, তুমি কি তৈয়ার খোদাকে পাওয়ার জন্য?”
রহমতুল্লাহ মাদানীর দু’চোখ বেয়ে জল নেমে এলো – তার আর জীবনে হারানোর কি আছে? বিবি আর বাচ্চাকে নিয়ে নিজের দেশ ছেড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন ভিন এক দেশে। দেশে তার না আছে সম্পদ, না আছে সম্মান।
“কি? তৈরী তো? ভেবে-চিনতে বলবা।”
“তৈরী, হুজুর।”
“তা হইলে ঘরে যাও। দোআ করে দিসি। ঘরে গেলে দেখবে, তোমার একটা ধোঁকা দূর হইসে।”
নিশাপুরি হুজুরের দরবার থেকে যখন বের হয়ে আসছেন, তখন কেন যেন রহমতুল্লাহ মাদানীর মন বেশ হালকা। তার মনে জীবন সম্পর্কে নতুন আশা জেগে উঠেছে। হুজুরের মুরিদানের সাথে তার কথা হয়েছে। তারা তাকে ছোট-খাটো একটা কাজ জোগাড় করে দেবে – এই শহরে এক বিবি আর এক বাচ্চাকে নিয়ে থাকা তার জন্য তেমন একটা সমস্যা হবে না। সাথে থাকবে নিশাপুরি হুজুরের সোহবত। জীবনে আর কি চাই তার!
শহরের পশ্চিম পাড়ার যে বস্তিতে মাদানী এক ঘর ভাড়া নিয়েছেন, তার দরজায় পৌঁছে তিনি ‘নাজমা’, ‘নাজমা’ বলে কয়েকবার ডাকলেন। কোন উত্তর এলো না দেখে আবার ডাকলেন। এবারো উত্তর এলো না দেখে তিনি দরজায় টোকা দিতে গিয়ে দেখেন দরজা খোলা। ভেতরে উঁকি দিয়ে কাউকে দেখা গেলো না। মনটা হালকা দমে গেলো রহমতুল্লাহ সাহেবের। সেই মনের ভাব দুশ্চিন্তায় রূপ নিলো, যখন এবার আজানের পরও নাজমা কিংবা বকরের কোন চিহ্নমাত্র কোথাও দেখা গেলো না।
রাত এগারোটার দিকে তিনি পাশের দরজায় কড়া নাড়লেন। এই ঘরের মুসলমান ‘বেহেন’টার সাথে এই এক সপ্তাহের ভেতর নাজমার ভালো খাতির হয়ে গেছে। সে হয়তো বলতে পারবে নাজমা আর বকর কোথায় গেছে। বেশ কিছুক্ষন কড়া নাড়ার পর উনি দরজা খুললেন, সম্ভবত পর্দা করছিলেন। নাজমার কথা জিজ্ঞেস করতেই উনি কেমন চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন, বললেন – “নাজমা? নাজমাটা আবার কে?”
“কেন আমার বৌ নাজমা? সে তো, বোন, আপনার সাথে প্রতিদিন গপসপ করে!”
মহিলা আরো অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো – “আপনার বৌ? কই, আপনি তো একলা একলাই থাকেন। আপনার সাথে তো কেউ কোনদিন থাকে নাই।”
রহমতুল্লাহ পাগলের মতো ছুটে গেলেন ফোনের দোকানে। দশ রুপিয়া খরচ করে কুমিল্লায় ফোন করলেন তার ছোট মামাকে। ছোট মামা শফিক তার একমাত্র জীবিত আত্মীয়, যার সাথে এখনো রহমতুল্লাহ মাদানীর যোগাযোগ আছে। মামা ফোন ধরতেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন মাদানী – “মামা, নাজমা আর বকরকে খুঁজে পাইতেসি না। ওরা হারায়ে গেসে।”
ওপাশে কিছুক্ষন নীরবতার পর মামার গলা শোনা গেল – “নাজমা? বকর?”
“মামা, আমার পরিবার, নাজমা। আমার ছেলে বকর।”
“রহমতুল্লাহ, তুই কি পাগল হয়ে গেলি? তুই কবে বিয়ে করলি”
“কি বল, মামা? তুমিই তো নাজমার সম্বন্ধ আনলা। বকর হইলো পরে সোনার চেন দিলা।”
“ব্যাটা। তোর কি হইসে, বল তো! আমার তো চিন্তা হইতেসে। বাবা, তুই ভালোয় ভালোয় দেশে চইলা আয়, মামা-ভাইগ্না এক সাথে থাকবো।”
রহমতুল্লাহ মাদানীর চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। সে ফোন রেখে শেখ নিশাপুরির দরবারের দিকে দৌড়াতে শুরু করলো। নিজামুদ্দিন সাহেব তখন তাহাজ্জুদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তার হন্ত-দন্ত ভাবে দেখে বললেন – “একটা ধোঁকা দূর হইসে।”
রহমতুল্লাহ মাদানী থমকে দাঁড়ালেন। ও, এটাই ছিল তার সেই বাঁধা? এজন্যই ওরা বলে, খোদাকে পাওয়ার পথে একটা বাঁধা সম্পদ, আরেকটা বাঁধা পরিবার?
পরিবারের – কিংবা পরিবার নামক বিভ্রমের – শোক ভুলতে মাদানীর প্রায় তিন সপ্তাহ সময় লাগলো। একটা আস্ত পরিবারের স্মৃতি আছে তার মনে, অথচ বাস্তব হলো যে এরা কোনোদিন তার জীবনে ছিলই না। তাহলে কোনটা তার জীবন? এইটা, যেখানে তার পরিবার অনুপস্থিত? নাকি ঐটা, যেখানে তার পরিবার উপস্থিত ছিল? অবাস্তব একটা স্মৃতির জন্য কিভাবেই বা তিনি শোক করবেন?
নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারার সাথে সাথে মাদানী আবার ফিরলেন নিশাপুরি হুজুরের আস্তানায়। যে যাত্রা তিনি শুরু করেছেন, তার শেষ তাকে দেখতেই হবে। হুজুর তাকে আবার আদর করে ডেকে পাশে বসালেন, তারপর সস্নেহে বললেন – “ব্যাটা, তোমার আর একটামাত্র মঞ্জিল পার হওয়ার আছে।“
“হুজুর, আরেকটা মঞ্জিল?”
“জ্বি, ব্যাটা। তবে এই মঞ্জিলটাই সবচেয়ে কঠিন।“
সেদিন আর কোন উত্তর না পেয়ে রহমতুল্লাহ ফিরে এলেন দেওবন্দ মসজিদের কাছে তার অস্থায়ী ডেরায়। ঠিক এক সপ্তাহ পর আবার গেলেন তিনি মাওলানা নিজামুদ্দিনের দরবারে। চোখ বন্ধ করে ধ্যান করছিলেন নিজামুদ্দিন। রহমতুল্লাহ যে ঘরে ঢুকেছে তার জানার কথা না, তবু তিনি তার নাম ধরে ডেকে জানতে চাইলেন – খোদার অবস্থান কোথায়।
উত্তরটা রহমতুল্লাহর জানা ছিল। সৌদিতে থাকতে বহুবার তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আকাশের দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন – “খোদা আসমানে, পবিত্র গ্রন্থগুলিতে তাই বলা আছে।“
উত্তর শুনে নিজামুদ্দিন সাহেবের চেহারা মুবারক লাল হয়ে উঠলো। রহমতুল্লাহ বুঝে নিলেন, তার উত্তর সঠিক হয়নি। তিনি সশ্রদ্ধ নম্রতায় জানতে চাইলেন সঠিক উত্তরটা কি হবে। হিন্দিতে বললেন শায়খ তখন – “রহমতুল্লাহ সাহেব, তুমি কি নিজেকে খোদার সমান মনে কর যে তুমি থাকবে নিচে আর উনি থাকবেন উপরে?”
রহমতুল্লাহ লজ্জিত হলেন। তাইতো, খোদার জন্য দিক ঠিক করা মানে তো খোদার স্থানগত অবস্থানের সাথে নিজেকে তুলনা করা। কথাটা তো ঠিক যে এটা একটা সূক্ষ্মতম শিরক হয়ে যাচ্ছে।
ভীষণ লজ্জা নিয়ে রহমতুল্লাহ তার মেসে ফিরে এলেন। দুপুরে কিছুই খেতে পারলেন না। ছি ছি ছি, সারাজীবন ঈমানের যে অসুখ নিয়ে তিনি সংগ্রাম করলেন তিনি নিজেই কিনা পরোক্ষভাবে সেই অসুখে আক্রান্ত! লজ্জা! লজ্জা!
এক মাস মাওলানা নিজামুদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ালেন রহমতুল্লাহ, কিন্তু শেষপর্যন্ত তার লজ্জা তার কৌতূহলের কাছে হার মানলো বলে তিনি আবার গেলেন উনার দরবারে।
এবার তার দিকে না তাকিয়ে শায়খ জিজ্ঞেস করলেন, হিন্দিতে – “রহমতুল্লাহ সাহেব, তুমি যে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করছো, তোমার উদ্দেশ্য কি দোজখ থেকে বাঁচা, নাকি বেহেশত লাভ করা।”
“বেহেশত লাভ করা, হজরত,” – প্রায় শোনা যায় না এমনভাবে বললেন রহমতুল্লাহ – “খোদার কাছে আশা করার নিয়ম আছে শুনেছি।”
শায়খ মৃদু হাসলেন, যদিও রহমতুল্লাহর মনে হলো ওই হাসি ছিল ভয়াবহ তাচ্ছিল্যের। সে তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে রইলো, উনার পরবর্তী অমরবানীর উচ্চারণ পর্যন্ত – “রহমতুল্লাহ সাহেব, তুমি তাহলে সারাজীবন দৌড়ালে নিজের লাভের জন্য? খোদার জন্য কি করলে তুমি? তুমি কি নিজেকে ভালোবেসেছো, না খোদাকে? বলো দেখি।”
শায়খের কথা শেষ হওয়ার আগেই দৌড়ে দরবার থেকে বের হয়ে এলেন রহমতুল্লাহ। খোলা রাস্তায় এসে তাকবীর দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন। ব্যস্ত পথচারীরা তাকে ইসলামিক সন্ত্রাসী ভেবে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে রইলো।
তিনি কেন খোদার প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন? এই ধারণা মনে জায়গা হওয়ার আগে তো তার ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভালো। অস্বস্তি বাড়তে বাড়তে বিকেলের দিকে বুকে হঠাৎ চাপ অনুভব করতে শুরু করলেন তিনি, কিন্তু সেটার কষ্ট ভুলে গেলেন যখন তার নিজের পায়ের দিকে চোখ গেলো।
রহমতুল্লাহ আতঙ্ক নিয়ে দেখলেন, তার পায়ের নখগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে। কিভাবে জিনিসটা ঘটছে, সেটা তার ধারণার বাইরে। কিন্তু দেখতে দেখতে একসময় পায়ের আঙ্গুলগুলো অদৃশ্য হয়ে গেলো। তিনি অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলেন, যখন দেখলেন তার পায়ের পাতা থেকে শুরু করে হাটু পর্যন্ত একসময় নাই হয়ে যাচ্ছে।
এটাই কি মৃত্যু? এটাই কি ফানা? এতকিছু ভাবার সময় নেই, কারণ এই অস্বাভাবিক শূন্যতা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গ্রাস করে ফেলেছে তার দুই পা সহ তলপেট। রহমতুল্লাহ জানেন না, তিনি ঠিক কিভাবে এখনো চিন্তা করছেন, কিন্তু কোমরের নিচ থেকে কোন কিছু এখন আর অনুভব করছেন না তিনি, যেন কোনোদিনই কিছু ছিল না ওখানে।
কৃষ্ণগহ্বরের মতো অন্ধকার সেই শূন্যতা তার বুকের কাছে আসার আগেই, নিজের অস্তিত্ব শূন্যে বিলীন হবার আগেই, দ্রুততার সাথে তিনি উচ্চারণ করলেন সেই শুদ্ধতম কালেমা, যা খোঁজার জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছেন তিনি – “খোদা ছাড়া আর কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই।”
শুদ্ধ বাংলায় বললে – ঈশ্বর ছাড়া বাকি সব কিছুই বিমূর্ত।
