শেষ পর্যন্ত ভদ্রমহিলার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি আজ।
অনেক চিন্তার পর ঠিক করেছি, জীবনের যে কয়টা দিন বাকি আছে, সে কয়টা দিন বাঁচার মতো বাঁচবো। অর্থাৎ তার সাথে থাকবো যাকে আমি ভালোবাসি। তীব্র তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার সাথে বসবাস আর না।
উনিও আমাকে টেক্সট করেছেন যে মিলউডস টাউন সেন্টারে তিনি অপেক্ষা করবেন আমার জন্য ঠিক বিকেল পাঁচটার সময়। তাই অফিস থেকে একটু আগেই বের হয়েছি, যেন তিনি ওখানে যাবার অন্তত মিনিট পাঁচেক আগেই আমি ওখানে পৌঁছে অপেক্ষা করতে পারি।
সেই ক্লাস এইটে থাকতে যে মেয়েটার প্রেমে পড়েছিলাম ঢাকার শান্তিনগরে, তাকে আবার দেখতে পাবো – সেও কিনা হাজার মাইল দূরে কানাডার এই এডমন্টন শহরে। ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। আমাকে নিশ্চিত করতে হবে, আমার জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে সে যেন হেমন্তের শীতল বাতাসে ঠান্ডা লাগিয়ে না বসে।
না, আমার স্ত্রী জানে না যে আমি স্কুল থেকে এই মেয়েটিকে ভালোবাসি। মাঝখানে ও কোথাও হারিয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু আমি কখনো আশা ছাড়ি নি। আর আজ তো প্রমান হলো, আমার আশা করার ভেতর কোন ভুল ছিল না।
এই সিদ্ধান্তটা অনেক কঠিন ছিল, শিকার করতেই হয়। শত হলেও দীর্ঘ দেড় যুগের সংসার। ছেলেটা গ্রেড ফাইভে যায়, মেয়েটা থ্রি। পরিচিত পরিবারগুলো আমাদের যে অসুখী বলবে, তাও না। কিন্তু সম্পর্কে শীতলতা আসে, যেভাবে পুরোনো গাড়ির বডিতে জং ধরে। সুতরাং পুরোনো প্রেমের কাছে ফিরে যাওয়া পুরোপুরি অযৌক্তিক বলা যায় না। আমি শুধু আশা করছি, টাউন সেন্টারে পৌঁছে আমি সেই মেয়েটিকে দেখতে পাবো, যাকে বছর বিশেক আগে হারিয়েছি ঢাকা মহানগরীর অচেনা গলিতে।
আমি শুধু আশা করছি, তিনি আমাকে হতাশ করবেন না। তিনিও আমার মতোই পুরোনো আমাকে খুঁজে পেতে চাইবেন, এই চল্লিশোর্ধ আমার মধ্যে।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে টোয়েন্টি থ্রি এভিনিউ থেকে বাঁয়ে মোড় নিয়ে ফেলেছি, মনেই নেই। নানা ভাবনার কারণে ইস্ট ইউরোপিয়ান এক মহিলার গায়ে গাড়ি উঠিয়ে দিচ্ছিলাম প্রায় – অসাবধানতাবশত, অন্যমনস্কতার কারণে। সে মহিলা দুই হাত তুলে হতাশা প্রকাশ করলো, আর সম্ভবত পোলিশ ভাষায় আমাকে একটা গালি দিলো।
যদিও আমার মনকে এসব কিছুই আজ স্পর্শ করতে পারবে না, কারণ আজ আমি এমন একটা কাজ করতে যাচ্ছি যা নির্ধারণ করবে আমার বাকি জীবনের সুখী কিংবা অসুখী হওয়া।
বাসস্ট্যান্ডের সামনের মোড়টা ঘুরতেই দেখতে পেলাম, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। এতদিন পর দেখা, অথচ দূর থেকেই চেনা গেলো তাকে। মনের টান? হতে পারে। সবুজ একটা জ্যাকেট পড়েছেন তিনি, জিনসের প্যান্ট। শপিং ব্যাগ হাতে শপার্স ড্রাগ মার্টের সামনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। মনের অজান্তেই এস্কেলেটরে পায়ের চাপ বেড়ে গেলো, নিজের হৃৎস্পন্দনের শব্দ নিজেই যেন শুনতে পাচ্ছিলাম।
দ্রুত কাছে গিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতেই তিনি চিনতে পারলেন আমাকে। নিজেই দরজা খুলে এসে বসলেন, ঠিক আমার পাশের সিটে। চিন্তা করা যায়?
কিন্তু কোথাও কোন একটা গন্ডগোল হয়েছে মনে হলো হঠাৎ, কেননা সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে তিনি তাড়স্বরে চিৎকার করে উঠলেন – “অফিস থেকে মিলউডসে আসতে দুই ঘন্টা লাগে তোমার? ছেলে-মেয়েগুলি যে বাসায় ফিরে নেটফ্লিক্স দেখতে বসে যাবে, সে খেয়াল আছে? তোমার কি মাথায় কোন কিছু খেলে না আজকাল?”
মুহূর্তের মধ্যে বুঝে উঠলাম, আমার দিবাস্বপ্নটা ভঙ্গ হয়েছে। ভদ্রমহিলা বিনীতভাবে আমাকে নামিয়ে এনেছেন কাদা-মাটির বাস্তব এক পৃথিবীতে।
আত্মার খুব গভীর থেকে বেরিয়ে এলো ভীষণ কৃতজ্ঞতা – “ধন্যবাদ, প্রিয় ভদ্রমহিলা”।
