বেশ কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি, আয়নায় আমার ছবিটা যেন ঠিক সেভাবে আসছে না – কোথায় যেন একটা সমস্যা, যদিও সমস্যাটা ঠিক ধরতে পারছি না আমি।
এটা এমন একটা বিষয়, শব্দমালা সাজিয়ে-গুছিয়ে যেটা ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন ও জটিল। তবে আমার মূল সন্দেহটা হলো, আয়নায় আমার ছায়াটা আমাকে ঠিক অনুসরণ করছে না, একটু যেন দেরিতে সে রিএক্ট করছে, অথবা একটু আগে, কিন্তু ঠিক আমার সাথে সাথে করছে না। খুব অস্বস্তিকর অনুভূতি এটা, কিন্তু কাউকে আবার ঠিক বুঝিয়েও বলতে পারছি না।
কি বলবো তাদেরকে? বলবো, আয়নার ভেতর আমার প্রতিবিম্বগুলো আজকাল বেয়াদব হয়ে উঠেছে? বলবো, আমি বাঁ হাত তুললে সাথে সাথে বাধ্য কর্মচারীর মতো তারা তাদের ডান হাতগুলো তুলে ধরছে না, মোটকথা তারা আমাকে আজকাল মোটেই অনুসরণ করছে না?
ছায়ার বিষয়টাও একই রকম। ফুটপাত ধরে হেটে যাচ্ছি, আড়চোখে খেয়াল রাখছি দেয়ালের ওপর আমার কালো ছায়াটার দিকে। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে বারবার, ছায়াটা ঠিক আমার হাঁটার গতির সাথে তাল মেলাতে পারছে না – হয় কিছুটা পিছিয়ে পড়ছে, না হয় কিছুটা এগিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে শুরু করছি আমি।
মাহিনের ঘটনার সাথে কি এর কোন সম্পর্ক আছে? থাকতে পারে। মেয়েটার সাথে ওই দুর্ঘটনাটা যখন হলো, আর আমার এই সন্দেহটা যখন আমার মনে দানা বাঁধতে শুরু করলো – দুটা প্রায় এক সময়েরই কথা। হ্যাঁ, ঠিক, ডিসেম্বরের শেষ দিকেই প্রথম আমি আমার ছায়ার এই অস্বাভাবিক গতিবিধি প্রথম খেয়াল করতে শুরু করি।
গত বছর ডিসেম্বর মাসে আমরা পদ্মা ব্রিজ দেখতে যাচ্ছিলাম। ট্রলারের মতো ছোট একটা নৌযান নিয়ে আমরা দুপুরবেলা বের হবো, তারপর বিকেলের দিকে পদ্মা ব্রিজের নিচ দিয়ে সেতু অতিক্রম করে আবার ফিরে আসবো উজানে আধা ঘন্টার ভেতর। আরও আটটা পরিবারের সাথে বোটে উঠেছি আমি, শিউলি, আর মাহিন। মাহিনের বয়স তখন তিন।
সবকিছু পরিকল্পনা মাফিকই এগুচ্ছিলো। কিন্তু পদ্মা ব্রিজের অবয়বটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আমরা সবাই কেমন যেন তন্ময় হয়ে গেলাম, অন্যমনস্ক হয়ে কেউ তুলতে শুরু করলাম ছবি, কেউ সেলফি, আর উত্তেজনার মধ্যে কেউই খেয়াল করলাম না যে মাহিনটা রেলিঙের খুব কাছে চলে গেছে।
রেলিংটা উঁচুই ছিল, কিন্তু মাহিন – হয়তো নদীর পানির স্পর্শ পাওয়ার আশায় দুই রেলিঙের মাঝখান দিয়ে মাথা বের করে দিয়েছে। আমার তখন উচিত ছিল ছুটে গিয়ে ওকে ধরে ফেলা, কিন্তু আমার কি কপাল – ওই মুহূর্তেই আমাকে আবার আক্রমণ করে বসলো অদ্ভুত এক অসুস্থতা, আমি একেবারে পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলাম। আমার মনে হলো, সময় স্থির হয়ে গেছে, ফলে আমি আর কোনোদিন আমার জায়গা থেকে দৌড়ে গিয়ে মাহিনকে ধরতে পারবো না। আমার মনে হলো, সময় স্থির হয়ে গেছে, আর পুরো স্থিরচিত্রের মধ্যে মাহিনই একমাত্র প্রাণী যা স্বাধীনভাবে নড়া-চড়া করতে পারছে।
ওই দুর্ঘটনার পর আমার সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধু আনোয়ার আশফাকের সাথে আমি বেশ কয়েকটা সেশন নিয়েছিলাম। তাকে খুলে বলেছিলাম যে সে বিকেলে আমার অপারগতার ভেতর আমার কোন দোষ ছিল না, বরং আমার শরীরকে ক্ষনিকের জন্য অকেজো করে দিয়েছিলো অদৃশ্য কোন তৃতীয় শক্তি। সে আমার কথা মন দিয়ে শুনেছে, তারপর খসখস করে প্রেস্ক্রিপশন প্যাডে কি যেন ওষুধের নাম লিখেছে।
“এইটাই কি তোমার জীবনে প্রথমবার এমন ঘটনা? মানে এই প্রথম তোমার শরীরের কন্ট্রোল নিয়ে নিলো তৃতীয় কোন পক্ষ?” – ঠান্ডা মাথার খুনির মতো ইস্পাত দৃঢ় কণ্ঠে ডক্টর আশফাক জিজ্ঞেস করলো আমাকে।
“না, আরো দুএকবার এরকম হয়েছে।” – আমি স্বীকার করলাম – “যখন কলেজে পড়ি, তখন একবার মরহুম শেখ ফজলুল করিমের আত্মা পুরো একরাতের জন্য আমার শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল।”
“লেখক শেখ ফজলুল করিম? তার আত্মা?”
“হ্যাঁ, ভাই। তখন রহস্যগল্প পড়ার নেশা ছিল আমার, যেকোনো ধরণের থ্রিলার বা ফিকশন গোগ্রাসে গিলতাম – বাংলাদেশী নাকি ভারতীয়, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী না ভৌতিক, কিছুই বাছ-বিচার করতাম না। এভাবে পড়তে পড়তে একসময় মনে হলো, একইরকম গল্প বারেবার ঘুরে-ফিরে আসছে, একই ধরণের আইডিয়া চর্বিত-চর্বনের কারণে ক্লিশে হয়ে আসছে কাহিনীগুলো। কিন্তু আমার মনে তখন প্রবল তৃষ্ণা নতুন ধরণের রহস্যগল্প পড়ার, যদিও আমার নাগালের মধ্যের বা সংগ্রহের কোন বইই সেই তৃষ্ণা মেটাতে পারছিলো না।
সেরকম এক তৃষ্ণার্ত রাতে এক কান্ড হলো, মনে হলো আমি অস্পষ্ট একটা কাহিনী দেখতে পাচ্ছি মনের চোখে। স্বপ্নের মতো একটা অনুভূতি ছিল ওটা, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো মনের স্ক্রিনে আমি একটা মুভি দেখতে পাচ্ছি, যদিও সেই প্রজেক্টরটা চালাচ্ছে এক অদৃশ্য শক্তি। আমার মন বলছিলো, এখন আমরা একমাত্র কাজ হচ্ছে মনের ভেতর সেই সিনেমাটা দেখে যাওয়া আর যথাসম্ভব সুন্দর শব্দমালা দিয়ে ওটার বর্ণনাটা কোথাও লিখে ফেলা।
একটার পর একটা দৃশ্য খুব দ্রুত গতিতে আসছিলো বলে হাতের কাছে যে কাগজ পেয়েছিলাম, সেটাতেই লিখে ফেললাম আমার প্রথম গল্প। পরদিন সকালে গল্পটা পড়ে স্পষ্টই বুঝতে পারলাম, এটা আমার লেখা না, কারণ এভাবে আমি চিন্তাই করি না। তার মানে ঘোরের ভেতর আমাকে দিয়ে কেউ লিখিয়ে নিয়েছে এই কাহিনী, যদিও আমি জানি না কে সেই লেখক। রহস্যপত্রিকার মিনহাজ ভাই যখন বললেন, আমার এই গল্পটা প্রয়াত শেখ ফজলুল করিমের লেখার মতো হয়েছে, তখনই শুধু বুঝতে পারলাম তার আত্মাই সে রাতে আমার ওপর ভর করে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে করিম সাহেবের অসমাপ্ত কোন গল্পের প্লট।
আমার ওই গল্পটা রহস্যপত্রিকার এপ্রিল সংখ্যাতে ছাপা হয়েছিল। কিন্তু আমি কাউকে বলিনি যে ওটা আসলে আমার লিখা না। বললে কি লাভ হতো, বলো?”
শেষে যখন আমার সব কথা ফুরালো, বন্ধু আনোয়ার স্নেহভরা কণ্ঠে বললো – “ভাই, ভাগ্যে যা আছে, তা আমাদের মেনে নিতেই হবে।” কিন্তু আমার মনে হলো আমার মাথায় হঠাৎ রক্ত চড়ে গেছে।
“আমি মানি না” – আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম – “ফাজলামি করো? এসব ভাগ্য-ফাগ্য আমি মানি না। নিশ্চয়ই কারো চেষ্টার ত্রুটি ছিল। হয় আমার চেষ্টার ত্রুটি – আমার অসুখটার কারণে আমি সময়মতো ছুটে যেতে পারি নি, না হলে শিউলির চেষ্টার ত্রুটি – নদীর মাঝখানে সে ঐটুক বাচ্চার হাত ছেড়ে দিয়েছিলো, নাহলে নৌকার কারিগরের ত্রুটি – সে রেলিং দেয়ার সময় বাচ্চাদের কথাটা চিন্তাই করেনি।”
আমার আচরণের বিপরীতে আনোয়ার কিন্তু মোটেও উত্তেজিত হলো না, তাকে মনে হলো মরা মানুষের মতোই অনুভূতিহীন। নিষ্প্রাণ চোখে আমার দিকে তাকালো সে – “তোমার জীবনের যে কোন পরিস্থিতি হলো তোমার ভাগ্য আর তোমার চেষ্টার গুণফলের সমান। ফলাফল শূন্য হওয়ার জন্য কপাল কিংবা কাজ যেকোন একটার শূন্য হওয়াই যথেষ্ট। এজন্য এসব ক্ষেত্রে নিজেকে দোষ দিয়ে কোন লাভ হয় না।”
তার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে আমার রাগ চক্রবৃদ্ধি হরে বাড়ছিল বলে খারাপ কিছু হওয়ার আগেই দ্রুত ওর চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম আমি, সোজা এসে নামলাম বেইলি রোডে খোলা আকাশের নিচে। বাইরে তখন টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
সে সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে আধা-ভেজা হয়ে ঘরে ঢুকতেই শুনতে পেলাম অদ্ভুত একটা শব্দ। আশ্চর্য! মাহিনের ঘর থেকেই শব্দটা আসছে – থেকে থেকে একটা শব্দটা আসছে।
ধুপ। ধুপ। ধুপ। ধুপ। ধুপ।
অজান্তেই আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। ওই ঘর থেকে তো কোন শব্দ আসার কথা না। ওই ঘরের ভেতর তো শুধু অসীম একটা শূন্যতা থাকার কথা।
ধুপ। ধুপ। ধুপ। ধুপ। ধুপ।
বিড়ালের মতো নিঃশব্দে পা ফেলে এগিয়ে গেলাম মেয়েটার ঘরের দিকে। নীল-কালো পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিলাম ওর ঘরের ভেতর। নাহ, সবকিছু তো ঠিকই আছে। ঘর ফাঁকা, ঠিক যেভাবে রেখে আমরা ঘুমাতে গিয়েছি। ওর বিছানাটা বিষন্নতার চাদর জড়িয়ে তেমনি শূন্য আছে, যেমনটা আছে গত তিন মাস ধরে। ওর পড়ার টেবিল আর খেলনা রাখার বাক্স ঠিক তেমনি ভাবে গোছানো আছে, যেভাবে করে প্রতিদিন সকালে শিউলি সেগুলো সাজিয়ে রাখে। তাহলে শব্দ আসছে কোথা থেকে?
ধুপ। ধুপ। ধুপ। ধুপ। ধুপ।
ঐতো আবার শব্দ হলো, মেঝেতে বল ফেলার শব্দ। এ আওয়াজ আমার ভুল হতে পারে না। মাহিন যখন ঘরে একা থাকতো, ঠিক এরকম শব্দ করে ও বল খেলতো। শিউলি বলতো – “আমার মেয়েটা কেমন করে একটা টম বয় হলো, খোদাই জানে?”
আমি চলে আসছিলাম নিজের ঘরে। কিন্তু আরেকবার হলো শব্দটা, এবার যেন আরেকটু জোরে – যেন শেষবারের মতো একবার আমাকে ডাকছে, “দেখে যা, দেখে যা”। আমি ছুটে গিয়ে একটানে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম। এদিক-ওদিক তাকালাম, খাটের নিচে উঁকি দিলাম। কোথাও কেউ নেই। যখন ভাবতে শুরু করেছি, আমার মস্তিষ্কে হয়তো ভ্রম হচ্ছে, তখনি চোখ পড়লো স্টিলের আলমারির বড় আয়নাটায়।
রীতিমতো চমকে উঠতে হলো আমাকে। ওই তো আয়নায় দেখা যাচ্ছে, মেয়েটা খেলছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মেয়েটা খেলছে। একটা বল ছুড়ে দিচ্ছে দেয়ালে, সেটা দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসতেই আবার ছুড়ছে ওটা সে। খুব বিরক্তিকর একটা খেলা হওয়ার কথা এটা, কিন্তু ছ’ বছরের একটা মেয়ের কাছে একঘেয়েমির সংজ্ঞা ভিন্ন রকম হলেও হতে পারে।
আয়নার এপাশে কিছু না থাকলেও, ওপাশে মেয়েটা তার জীবন চালিয়ে যাচ্ছে। ওই তো আয়নার ভেতর আমি নিজেকেও দেখতে পাচ্ছি – উনচল্লিশ বছর বয়সী একটা লোক মেয়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তার খেলা দেখছে।
আমি নিজের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করলাম, নিজেকে থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার ভেবে নিয়ে পুরো পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। তখন আমার মনে হলো, এটা একজন পিতার অতৃপ্ত আত্মার মতিভ্রম হতে পারে। যদিও একটা জিনিস কিছুতেই মিলাতে পারছিলাম না, আর একটা প্রশ্নের কোন সদুত্তরই পাচ্ছিলাম না। আয়নার ওপাশের লোকটা তাহলে কে? আয়নার ওপাশের মারুফ আর এপাশের আমি কি একই ব্যক্তি? আর ওই মারুফ যদি আরেকজন হয়, তাহলে কে বেশি বাস্তব – আমি, নাকি ও? আর ও যদি আমার ছায়া হয়ে থাকে, তাহলে এ পাশে আমার মেয়ে নেই কেন?
আসলে আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না যে আয়নার ওপাশে পিতা আর কন্যা একসাথে বেঁচে আছে, আর এপাশে নিঃসঙ্গ এক পিতা অসহায় হয়ে ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি তখন। আমার বিপরীতে ওপাশে দাঁড়িয়ে আরেক মারুফ – ব্যতিক্রম শুধু মাহিন, ওপাশে ও আছে আর এপাশে মাহিন নামের কেউ বেঁচে নেই।
তখন আমার ভেতর অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে শুরু করলো। আমার মনে হলো, আজ আমি একটা সরল অংকের উত্তর বের করতে যাচ্ছি – প্রশ্নটা যতই জটিল দেখাক, উত্তরটা হবে আশ্চর্যরকম সহজ। আমার মন বলছে, উত্তরটা হবে হয় শূন্য না হয় এক, মাঝামাঝি কোনকিছুই হবে না সেটা।
এদিকে এসব ভাবতে ভাবতে এমন একটা কাজ করে বসলাম, যা এ পর্যন্ত আমি করিনি – আর সেটা হলো আয়নাটাতে আমার ছায়ার চোখে চোখ রেখে তাকানো। কেন করলাম এটা – আমি জানি না, কিন্তু সেটা করার সাথে সাথে আমার মনে হলো – হঠাৎ করেই অন্তহীন এক শূন্যতার মাঝে পড়ে যেতে শুরু করেছি আমি। মনে হলো, আত্মহত্যা করার জন্য এগারো তলা বিল্ডিঙের ছাদের রেলিং থেকে লাফ দিয়েছি নিচে, কিন্তু অনন্তকাল ধরে পড়ছি তো পড়ছিই, দুঃস্বপ্নের সেই পড়তে থাকা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না, কিছুতেই ছুঁতে পারছিনা রাস্তার স্ল্যাবের ওপর পড়ে মাথা ফেটে চৌচির হয়ে মরে যাওয়ার পরিণতিটাকে।
ওই মুহূর্তে আমি আসলে কোন কিছুই অনুভব করতে পারছিলাম না। আমার স্বাদ, গণ্ধ, দৃষ্টি সব হঠাৎ করেই অকেজো হয়ে গিয়েছিলো। কিংবা হতে পারে, আমি আসলে মারা যেতে শুরু করেছিলাম হঠাৎ করে। হবে কিছু একটা।
কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝলাম, ব্যাপারটা আসলে আমার ঐসব দুশ্চিন্তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর এজন্য যে, আমি আসলে সেই সময় অন্তত কয়েক মিনিটের জন্য আয়নার সামনে পুরোপুরি আটকে গিয়েছিলাম। আমার আতঙ্ক চূড়ান্ত রূপ নিলো, যখন দেখলাম আমি তাই করছি যা আয়নার ভেতর আমার ছায়াটা করছে। ও যখন ডান হাত তুলছে, তখন আমিও ডান হাত তুলছি। ও যখন বাঁয়ে সরে যাচ্ছে, আমিও তখন কিঞ্চিৎ বাঁয়ে সরে যাচ্ছি। মোটকথা, ওকে আমি অনুসরণ করে চলেছি প্রতি মুহূর্তে, যদিও ওরই বরং উচিত ছিল আমাকে অনুসরণ করা।
আমার মনে হচ্ছিলো, আমি যেন এক পুতুল নাচের মোচওয়ালা গৃহকর্তা পুতুল, যাকে অদৃশ্য কোন সুতো দিয়ে নাচিয়ে চলেছে অন্য কেউ অন্য কোনখান থেকে। সমস্যা হলো, সেই অন্য অস্তিত্বটা আমার নিজেরই ছায়া, আয়নার ভেতর অবৈধ বসতি গড়া আমার নিজেরই প্রতিবিম্ব।
মনে পড়লো আমার বন্ধু আনোয়ারের একটা কথা – অনেকদিন আগের একটা কথা, যখন আমরা ঢাকা কলেজের মাঠে বিকেলবেলা আড্ডা দিতাম।ওর সব কথা আমি মন দিয়ে শুনি, আর মনে রাখি। আনোয়ার বলেছিলো – মানুষ হিসেবে আমাদের বেছে নেয়ার কোন সুযোগ নেই, কারণ আমাদের ভাগ্য লেখা হয়ে গেছে।
হঠাৎ করেই আমি বুঝতে পারলাম – মাহিনের পরিণতি ঠেকানোর কোন সুযোগই আমার কিংবা শিউলির সামনে ছিল না, কেননা নিয়তির কলম তুলে নেয়া হয়েছে অনেক আগেই। আমাদের সামনে কোন সুযোগ ছিল না, কেননা এমনকি আমাদের ভুল সিদ্ধান্তগুলোও পূর্বনির্ধারিত আর অনিবার্য।
আগে জানতাম, ডিএনএ নিয়ন্ত্রণ করে আমার দেহ, আর পাঠ্যপুস্তক নিয়ন্ত্রণ করে আমার মন। আজ এই আয়নার দিকে তাকিয়ে জানলাম, আমার আত্মাকে আসলে নিয়ন্ত্রণ করে আমারই ছায়া – যা বাস করে অদেখা অতীন্দ্রিয় এক পৃথিবীতে। অথচ এর উল্টোটাই হওয়ার কথা ছিল – আমারই নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল আমার ছায়া এবং আমার ভাগ্যকে।
বিস্ময় আমার আতঙ্কে রূপ নিলো, যখন দেখলাম আয়নার ওপাশে আমার সেই সন্দেহজনক ছায়াটা ধীরে ধীরে নিচু হতে শুরু করেছে, আর ওর হাত এগিয়ে যেতে শুরু করেছে ওপাশের ওই মাহিনের দিকে। আমার আতঙ্ক চরমে উঠলো, কারণ ততক্ষনে আমি নিজেও নিচু হতে শুরু করেছি, এমনকি আমার প্রতিবিম্বের অন্ধ অনুসরণ করে আমিও হাত বাড়াতে শুরু করেছি, হাত বাড়াতে শুরু করেছি এক শূন্যতার দিকে – কারণ আয়নার এই পাশে তো কোন মাহিন নেই, আছে শুধু ভীষণ অতল এক শূন্যতা।
আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম, কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আমি কাকে ছুঁতে যাচ্ছি। মাহিনকে? মাহিনের আত্মাকে? নাকি ওর স্মৃতিকে? নাকি আমার নিজেরই নষ্টালজিয়াগুলোকে? কিন্তু ততক্ষনে আমার পুরো জীবনটাই নিজের কাছে অচেনা লাগতে শুরু করেছে। আর এর মধ্যেই দেখতে পেলাম, আমার প্রতিবিম্বের হাত একসময় ছুঁয়ে ফেলেছে আয়নার সেই মাহিনের হাত।
আমি আর নিতে পারলাম না। আমার মাথা ঘুরে উঠলো। সাথে সাথে চিৎকার করে জ্ঞান হারালাম আমি।
পরদিন যখন সবাই চলে গেছে, আর এক কাপ চা নিয়ে দেবী মূর্তির মতো আমার সামনে বসে আছে শিউলি, তখন ওকে খুলে বললাম সব কথা। শিউলি মন দিয়ে সব শুনলো। ওর চোখে-মুখে স্বস্তির একটা হাসি খেলে গেলো। সে অস্ফুটস্বরে বলল – “আমি সব জানি।”
“তুমি ঘটনাটা বিশ্বাস কর?” – অবাক হয়ে বললাম আমি।
“আমি ঘটনাটা বিশ্বাস করি না, আমি ঘটনাটা জানি। কারণ আমিও ওকে দেখি।”
অথচ এতদিন কিছুই বলে নি সে আমাকে, পুরো ব্যাপারটা গোপন রেখেছিলো। তবুও আমার মনে হলো, কেউ যেন আমার আস্ত জীবনটা ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকে এক মুহূর্তের ভেতর – ডুবতে থাকা একজন মানুষ যেন খুঁজে পেয়েছে আঁকড়ে ধরার মতো কিছু খড়কুটা।
দুইজন মানুষ তো একই ভুল দেখতে পারে না। একাধিক ব্যক্তি যখন একই দৃশ্য দেখতে পায়, তখন সেই দৃশ্যটা সত্য হতে বাধ্য। সত্য হতে বাধ্য সেই অন্য পৃথিবীটাও, যেখানে চলমান আছে মাহিনের অস্তিত্বের চাকা। কিন্তু এসব কিছুর পরও আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আলমারিটা বিক্রি করে দেব। কোন মানে হয় না এসবের, কোন মানে হয় না বার বার নিজেকে এই অসম অসমান্তরাল সত্যের মুখোমুখি করার। নিজের ওপর যে আপনার কোন নিয়ন্ত্রণই নেই, আপনাকে যে বরং নিয়ন্ত্রণ করে বহুমাত্রিক অন্য কোন পৃথিবীর অদ্ভুত আরেক আপনি – এটা মেনে নিতে কি আপনার ভালো লাগতো? বলেন, ভালো লাগতো?
