কবরগুলো থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে লাশ

মা মারা যাওয়ার ঠিক পরের দিন ফ্লোরিডা সময় সকাল সোয়া দশটায় আমি আবিষ্কার করলাম, মা-র চেহারা আমি ভুলে গেছি। কিছুতেই তার চেহারা মনে করতে পারছি না। অল্প অল্প মনে আছে, ছোটখালার সাথে তার চেহারার একটা মিল ছিল – একইরকম কাটিং, ফলে খালার চেহারাতে পনের বছরের বেশি ভারিক্কি ভাব যোগ করলেই মা-র চেহারা পেয়ে যাওয়ার কথা। সাথে একটা প্লাস পাওয়ারের চশমা যোগ করতে হবে, সন্দেহ নেই। ওহ, আর মাথার চুলগুলো আধা-পাকা।

সবদিক থেকে বিবেচনা করলে মা-র চেহারা মনে পড়ে যাওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চোখ বন্ধ করে কল্পনার ভেতর এরকম আরো অনেক কসরত করেও মায়ের চেহারাটা ঠিকমতো মানে পুরোপুরি উদ্ধার করে উঠতে পারলাম না। কাছাকাছি একটা কিছু হলো, কিন্তু সব ক্যারিক্যাচারের পরও ভদ্রমহিলার চেহারাটা ঠিক হুবহু আমার স্মৃতির পটে ভেসে উঠলো না।

এসব নিয়ে যখন আমি খুব বিমর্ষ, তখনি হঠাৎ মনে পড়ে গেলো মা-র ফটোগুলোর কথা। তার বেশ অনেকগুলো সাদা-কালো ছবি ছিল আমার কাছে, পুরোনো এলবামে। সেইসব ছবি, আশির দশকে যেগুলো ফুজিকালারের ফিল্ম কিনে তোলা হয়েছিল, আর সময়ের সাথে যেগুলোর সাদা অংশ হলদেটে হয়ে যেত। এই ছবিগুলো থেকে মা-র যৌবনকালের চেহারাটা মনে পড়ার কথা, আর সেটাকে ধ্রুব সত্য ধরে নিলে তার শেষ বয়সের চেহারাটা মস্তিষ্কের অন্ধগলি থেকে উদ্ধার হওয়ার দারুন একটা সম্ভাবনা। কিন্তু লাবনী আর আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, ফটো এলবামগুলো থেকে ভদ্রমহিলার সমস্ত ছবি কেমন করে যেন মুছে গেছে।

ফেসবুকও ঘেটে দেখলাম। আশ্চর্য, এখানেও একই সমস্যা। কোন ছবিতে সে নেই। এই গতবছরও তো ছোটখালার সাথে মা-র একটা ছবি ছিল, সিয়ামের বিয়েতে। সেই ছবি ওপেন করে করে দেখি – সবাই আছে, শুধু মা নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, এই ছবিটাতে আমি মা-কে দেখেছি ছোটখালার ডানপাশের চেয়ারটাতে বসা ছিল মা। কিন্তু এখন এই চেয়ারটা শূন্য, যদিও সেখানে বসা থাকতে পারতো যে কেউ।  

হোয়াটস্যাপ মেসেজেও তার কোন ছবি পাওয়া গেলো না। গুগল ডক্স আর নিজের ল্যাপটপে খুঁজে দেখলাম তন্ন তন্ন করে। কোথাও মা-কে খুঁজে পেলাম না। যেন মানুষটা ছিলই না কোনদিন এই পৃথিবীতে।  

তার মানে, গত কয় বছরে মা-র চেহারা প্রায় ভুলেই গেছি আমি। যেভাবে কেয়ামতের ঠিক আগে দিয়ে মুমিনের অন্তর ভুলে যাবে খোদার কালাম, ঠিক সেভাবে ভুলে গেছি মা-র সরল হাসিমাখা মুখটা। নিয়মিত যোগাযোগ না করার ফল এগুলো। কিন্তু যে পরিমান ব্যস্ততা এই প্রবাসে, তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতামই বা কিভাবে? আমার জানা নেই।

আমি নিশ্চিত, সামনা-সামনি তাকে দেখলে ঠিকই চিনতে পারতাম – কিন্তু ছবি খুঁজে না পেলে তাকে সেই দেখাটা দেখবো কিভাবে, বিশেষ করে এখন যেহেতু সে মৃত? বাস্তব ছবি ছাড়া তো মনে হয় মা-র চেহারা কিছুতেই মনে করতে পারবো না আমি। মনের চোখে তার ছবি ভাসিয়ে তুলতে গেলে সব চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাবে, তবু তার নিখুঁত একটা ছবি চিন্তা করতে পারবো না। আর এভাবে চলতে চলতে একসময় কি স্মৃতি থেকে পুরোপুরিই মুছে যাবে না তার মুখ? একসময় কি বেমালুম ভুলে যাবো না আমরা তাকে?

আমার আগের ল্যাপটপটাতে তো তার কিছু ছবি ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটাতে আবার পানি পড়ে তার হার্ড ড্রাইভ গেছে। কবেই সেটা রিসাইকেলে দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু মা-র ছবি পাবো কোথায় আমি তাহলে? আর ছবি খুঁজে না পেলে বাকি জীবন তাকে মনে রাখবো কিভাবে আমি? আর এভাবে চলতে চলতে একসময় কি স্মৃতি থেকে পুরোপুরিই মুছে যাবে না তার মুখ? একসময় কি বেমালুম ভুলে যাবো না আমরা তাকে?

পান্নাকে ফোন করলাম তখন তখনি, সে বললো তারও একই অবস্থা। তনুকে কল দিলাম, সে আমার ওপর খেপে গেলো।বললো – হয় আমি তার সাথে ফাজলামো করছি, না হয় আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ছোট বোন হলে কি হবে, ভাবখানা এমন যে সে বাড়ির মূল অভিভাবক। অথচ পনের মিনিট যেতে না যেতেই সে ফোন করে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো – “ভাইয়া, এটা কিভাবে হলো?”

এভাবে সেই অদ্ভুতুড়ে সকালে আমাদের তিন ভাই-বোনকেই ছবির বিষয়ে একে একে হতাশ হতে হলো। জাহানারা বেগম বলে যে পৃথিবীতে কেউ কোনদিন ছিল, তার কোন তথ্য প্রমান আর থাকলো না দুনিয়ার কারো কাছে।

অবিজ্ঞানীদের মধ্যে ম্যান্ডেলা এফেক্ট বলে একটা ধারণা চালু আছে। প্যারানরমাল গবেষক ফিওনা ব্রুম দেখিয়েছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার জনমানুষের বড় একটা অংশ স্পষ্ট মনে করতে পারে যে ১৯৮০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যু হয়েছিল। পত্রিকায় সে মৃত্যু সংবাদ বড় করে ছাপানোও হয়েছিল। অথচ বাস্তবে ম্যান্ডেলা মারা যান ২০১৩ সালে। এরমধ্যে ১৯৯৪ সালে তিনি একবার দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন। তাহলে কিভাবে এতগুলো মানুষ আশি সালে তার মৃত্যুর সংবাদ দেখলো? এতগুলি লোক একসাথে কিভাবে ভুল স্মৃতি ধারণ করে বসে আছে? তারা কি তাহলে সমান্তরাল কোন পৃথিবী থেকে এসেছে, যেখানে ম্যান্ডেলার মৃত্যু ১৯৮০ সালেই হয়েছে জেলের ভেতর? নাকি ভিনগ্রহের কোন বুদ্ধিমান প্রাণী এসব লোকের মস্তিষ্কে রোপন করেছে ভ্রান্ত স্মৃতিগুলো? যা হোক, দুনিয়ার সব গুজবপ্রেমীদের মধ্যে এরকম বহু তর্কই এই ম্যান্ডেলা এফেক্ট নিয়ে জারি আছে আজো।

কিন্তু জাহানারা বেগম বলে যদি আসলে কেউ নাই থাকে, তার স্মৃতিগুলো যদি এলিয়েন, ফেরেশতা, বা এজাতীয় অন্য কোন চতুর্মাত্রিক জীবের বানানো কোন কৃত্রিম চিন্তা হয়ে থাকে – যে চিন্তা তারা কোনভাবে আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে – তাহলে আমার আসল মা কে? কে আমার সত্যিকার জন্মদাত্রী? ভেবে ভেবে চিন্তার কোন কুল-কিনারা পাই না আমি।

শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম, দেশে উড়ে যাবো। ঢাকার কোথাও না কোথাও, কারো না কারো কাছে, নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে মা-র ছবি। ছোটখালার কাছে তো ছবি না থেকে পারেই না। আর একবার সেই ছবি পেয়ে গেলে শত শত কপি করে ফেলবো, কপি করে সারা পৃথিবীতে – সমস্ত আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে – বিলিয়ে দেব সেই ছবি। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেব সেই ছবি স্ক্যান করে করে, যাতে আর কোনোদিন সেটা হারিয়ে যেতে না পারে। মা-র ছবি মানে মা-র স্মৃতি, এটাকে হালকা করে দেখার কোন সুযোগই নেই।

কিন্তু টিকেট জোগাড় করে ফ্লাইট মিলিয়ে ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে তিন দিন লেগে গেলো। এদিকে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতেই দেখি আকাশে কালো মেঘের ভীষণ ঘনঘটা। শান্তিনগরের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভারী করে বৃষ্টি শুরু হলো। সে বৃষ্টি এমন যে, এক রাতে হাটু পানি জমে গেলো বাসার সামনের গলিতে।

দোতলায় ঢুকেই পুরাতন বইয়ের আলমারিটা খুঁজে দেখলাম। নাহ, কোথাও কোন ছবি বা এলবাম নেই। ঢাকা আসার পর প্রথম একটা ধাক্কা খেলাম, যদিও পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিতে মন চাইলো না। কিন্তু সব ছবি তাহলে গেলো কোথায়!

মেঘের যন্ত্রনায় সেই সন্ধ্যায় আর কবর জিয়ারত করতে যেতে পারলাম না, কিন্তু যেতে হলো পরদিন মানে শুক্রবার সকালেই। জলিল ভাই কবরস্থানে গিয়ে দেখেছে মা-র কবরের একপাশের মাটি বসে গেছে। আমাকে বললো গিয়ে একটু দেখে আসতে।

সকালে ছোট খালা মিজান খালুকে নিয়ে এসেছিলো আমার সাথে দেখা করে স্বান্তনা আর দোয়া দিতে। তার বাসা বাসাবো, সকাল সকাল সে চলে এসেছে মৃতের ছেলেমেয়ের সাথে সময় কাটিয়ে উচ্চ হারের সুদে কিছু পারলৌকিক সওয়াব কামিয়ে নিতে। খালার সাথে দেখা হয়ে অবশ্য মায়ের চেহারা মনে পড়ে গেলো না, সে এত কঠোর এক হিজাব পরেছে যে তার মূল চেহারা নিয়েই আমি সন্দিগ্ধ হয়ে পড়লাম কিছুক্ষনের জন্য। শিমু খালা ইদানিং পর্দা শুরু করেছে। আমার মা পর্দা করতো না, তার চুল প্রায়ই খোলা থাকতো।

খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা-র কোন ছবি তার কাছে আছে কিনা। থাকলে আমি সেটা কপি করে নেব, আর এভাবে তার স্মৃতি সংরক্ষণ করতে পারবো অন্তত আমার কেয়ামত পর্যন্ত। খালা প্রথম হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করলো, একবার আড়চোখে খালুর দিকে তাকালো, তারপর জানালো – তারা ঘরে কোন ছবি রাখে না, কারণ ছবিওয়ালা ঘরে রহমতের ফেরেশতা ঢোকে না।

“কোন ডিজিটাল কপিও নেই?” – আমি জানতে চাইলাম। 

“আমরা ডিভাইসেও কোন ছবি রাখি না।”

“কোন ছবিই রাখা যাবে না?”

“যাবে না কেন?” – খালা চশমা নামিয়ে বললো – “প্রাণীর চোখ কেটে দিয়ে সেই ছবি রাখা যাবে। তাহলে আর গুনাহ হবে না।”

জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, মা-র চোখ কেটে রাখা বা চোখের ওপর কালি মারা কোন হালাল ছবি তার কাছে আছে কিনা। কিন্তু সেই তদন্ত শুরুর আগেই জলিল ভাই এসে জানালো মা-র কবর ভাঙার সংবাদ। বললো, দ্রুত এটা মেরামত না করলে কবর আরো ভেঙে যেতে পারে। 

কথাটা শোনার সাথে সাথে কেন যেন আমার ভেতর আমার অস্তিত্ব পুরোটা একসাথে লাফিয়ে উঠলো। মনে হলো, হয়তো এটা আমার জন্য অনন্য একটা সুযোগ, বোধ হয় এটা স্বর্গীয় কোন হস্তক্ষেপ যেন আমি মা-র চেহারা একবার হলেও আবার দেখতে পারি। কবর যদি মেরামত করতে হয়, নিশ্চয়ই একবার ওর ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখার সুযোগ আমার হবে। হবেই হবে। আর তিনদিনে লাশ নিশ্চয়ই পচে যায় না। যদি যথেষ্ট সুযোগ পাই, মোবাইলের ক্যামেরায় একটা ছবিও তুলে নিতে পারবো। আর সে ছবি ছড়িয়ে দিতে পারবো ডিভাইস থেকে ডিভাইসে।

আমি কয়েক হাজার টাকা পকেটে ভরে নিয়ে একটা রিকসা করে রওনা দিলাম শাহজাহানপুরের দিকে। রিক্সা এগিয়ে চললো পানিবন্দী মহানগরীর বুক চিরে। কবরস্থানে নেমে দেখি, গেটের বাইরে বসে আছে একটা ল্যাংড়া ফকির আর ন্যাংটা গ্যাদা পোলাপান কোলে নিয়ে কতগুলি মহিলা। আমাকে দেখে অন্তত তিনজন হাত বাড়ালো। আমি সতর্কভাবে এড়িয়ে গেলাম তাদের। খেয়ে-দেয়ে আর কোন কাজ নেই আমার, অকম্মার এই ঢেকীগুলোকে টাকা দিয়ে অযথা মাথায় তুলি আর কি। দেশের বারোটা তো বেজেছে এইসব লোকজনের জন্যই। প্রত্যেকটাকে ধরে ধরে আশ্রয়কেন্দ্র বা এ জাতীয় কিছুতে ঢোকানো উচিত।

গোরস্থানের গেটে ঢুকতেই চোখে পড়লো ওজুখানা আর একটা বসার ঘর। সেখানে বসে আছে সাদা পাঞ্জাবি পরা কয়েকজন। তাদেরকে গিয়ে বললাম আমার সমস্যার কথা। ওদের মধ্যে সবচেয়ে শুকনা-পাতলা যে লোকটা, সে কিছুটা অনিচ্ছা নিয়ে উঠে এলো, গেটের পাশ থেকে একটা কোদাল আলতো করে তুলে নিলো হাতে, তারপর আমার পেছন পেছন আসতে আসতে বললো চাটাই ঠিক করতে হলে পাঁচশো টাকা লাগবে।

কোদাল দিয়ে মাটি সরানো শুরু হতেই – কেন কে জানে – ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় আমি টগবগ করতে শুরু করলাম।

“মাটি সরালে কি আমি মা-কে দেখতে পাবো?” – সোৎসাহে বললাম কাঁচা-পাকা দাড়িওয়ালা ক্ষীণকায় লোকটাকে।

“দেখবেন, স্যার।” – সে বললো। ওর নিচের চোয়ালটা অল্প খুলে রাখা ড্রয়ারের মতো সামনের দিকে একটু ঝুলে পড়েছে।

“চেহারা দেখা যাবে?”

“যাইতে পারে, কেবল তিন দিন হইসে।” – মাথা না উঠিয়ে গোরখোদক উত্তর দিল। তাকে দেখে মনে হলো, দুনিয়ার কোন বিষয়েই তার আর কোন আগ্রহ অবশিষ্ট নেই।

“তিন দিনে কবর ভেঙে পড়লো?”

“যেই ঢল নামছে কাইলকা!”

“ও।”

প্রথম যখন খবরটা শুনেছিলাম, ফ্লোরিডাতে তখন রাত বাজে মাত্র এগারোটা। ফ্রাইডে নাইট বলে একটা মুভি দেখতে বসেছি, সাইন্স ফিকশন মুভি। সিনেমার মাত্র মিনিট বিশেক বাকি, তখনি নিশি ছুটে এলো আমার রিডিং রুমে, তারপর চিৎকার শুরু করলো তারস্বরে – “আরিফ, শুনেছ, তোমার আম্মা আর নেই।” আমি কি বলবো, বুঝে পেলাম না। ওর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে শেষে বোকার মতো বললাম – “ও আচ্ছা।” সে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ল্যাপটপ আবার চালু করলাম, মুভির আর মাত্র একুশ মিনিট বাকি আছে। আর তাছাড়া এই বারো হাজার মাইল দূরে বসে আমি তো আর আমার সদ্যমৃত মা-কে তেমন কোন সাহায্য করতে পারছি না।

সিনেমার এন্ডিংটা অবশ্য বেশ বিরক্তিকর লাগলো। মনে হলো, এই দেড়টা ঘন্টা সময় পুরোই নষ্ট করলাম। শেষরাতে আম্মার চেহারাটা দেখালো ফেসবুকে, মনে হলো শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। মনে মনে ভাবলাম – যাক, এই দুনিয়ার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে একজন তো অন্তত মুক্তি পেলো।

কবরের যে পাশটা ভেঙে গেছে, আনসার আলী সে পাশ থেকে এখন মাটি সরাচ্ছে। প্রথমে জায়গাটা সমান করতে হবে, তারপর দেখতে হবে মাচার কি অবস্থা। সম্ভবত আড়াআড়ি কিছু কাটা বাঁশ দিয়ে নিতে হবে। সে বললো, তার স্টকে আছে সেগুলা। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

“ভাই, আপনি তো অনেক মৃত্যু দেখেছেন, তাই না?”

লোকটার কাজ থামিয়ে একবার আমার দিকে তাকালো।

“নিশ্চয়ই দেখেছেন। প্রতিদিনই তো দেখেন। মৃত্যুটা কিরকম বলে আপনার মনে হয়? অনেক কষ্ট?”

“মৃত্যু হইলো গিয়া কঠিন ঘুম। আর কিছুই না।”

“চিরতরের ঘুমে সব শেষ?” 

“সব শেষ।”

“কিন্তু ধর্মে যে বলে কবরে আজাব হয়, কেয়ামতের দিন আমরা আবার জেগে উঠবো, এসব?”

সে হাসলো, কেন কে জানে, তারপর আবার তার কাজে মন দিলো। সে এখন চাটাই মেরামত শুরু করেছে।

স্কুলে পড়ার সময় মা-কে ছাড়া থাকতেই পারতাম না। মেট্রিকের পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো, ফুর্তির শেষ নেই। পরদিন সকালেই মামুনদের সাথে ঘোড়াশাল সার কারখানাতে বেড়াতে গেলাম তার বড়চাচার বাসায়। সারাদিন বল খেললাম, পুকুরে ডুবাডুবি করলাম, কিন্তু সন্ধ্যা হতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মা-র কথা মনে পড়লো, মামুনের ইঞ্জিনিয়ার চাচার সরকারি বাড়ির গেস্টরুম কবরের মতো চেপে আসতে লাগলো আমার অস্তিত্বের ওপর। বুকের বাঁ-দিকের পাঁজর ভেঙে ডান দিকে ঢুকে যাবার আগেই ছুটে বের হয়ে এলাম ওই বাসা থেকে। রাত নয়টার শেষ বাসে ঘোড়াশাল থেকে ঢাকা ফিরলাম। রাত পৌনে বারোটায় ঘরে ঢুকলাম, মায়ের চেহারা দেখার পরই শুধু মনটা শান্ত হলো।

আমেরিকা যাওয়ার পর অবশ্য বিষয়টা বদলে গিয়েছিলো। প্রথম প্রথম মা-র জন্য ভীষণ খারাপ লাগতো। তারপর যখন থেকে নিজে রান্না করতে শিখলাম, নিজের বিছানা নিজে ঠিক করতে জানলাম, মা-র চেহারা ভুলে যেতে শুরু করলাম। আর এখন তো দেখা যাচ্ছে তার চেহারার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই আমার ব্রেনের স্টোররুমে, তার মমতাময়ী মুখের জায়গায় অদ্ভুত এক সাদা কাগজের শূন্যতা শুধু।

আনসার আলী এখন আবার কবরের মাঝখান থেকে মাটি সরাচ্ছে। তিন-ফুট-বাই-তিন-ফুট একটা চাটাই রেডি আছে। কবর মেরামতের আগে, কিন্তু পুরাতন ভেঙে পড়া চাটাইটা সরানোর পর, ঐটা বসাতে হবে। তখনি সম্ভবত মা-কে কিছুটা দেখতে পাবো আমি। আর তখনই প্রমান হবে, মা বলে আসলেও কেউ ছিল কিনা এই শহরে।

মায়ের একটা আজব অভ্যাস ছিল। সে আনারস খেতে পারতো না। আমাদের কেটে দিতো, কিন্তু জীবনে কোনোদিন মুখে দিতো না। আনারসে নাকি তার এলার্জি, খুব ছোটবেলায় আনারস খেয়ে মা নাকি মরতে বসেছিল, তিন-দিন চার-রাত হাসপাতালে সেলাইন আর মৃত্যুর মাঝখানে অবস্থান করে তাকে লড়াই করতে হয়েছিল অস্তিত্বশীল থাকার জন্য।

কুমিল্লা শহরের সেই জেলা হাসপাতালে সেদিন সেই কিশোরী মেয়েটির মৃত্যু হলে আজ আমি কিভাবে এখানে এই স্থান-কালে দাঁড়িয়ে থাকতাম, ভেবে কিছুটা হলেও আতংকিত বোধ করলাম। একটা সামান্য আনারস কি তখন হয়ে দাঁড়াতো না আমার সম্ভাব্য অস্তিত্বের বিপক্ষে মূল হুমকি? নাকি আমার জন্ম ঠিকই হয়ে যেত, অন্য কোন মায়ের গর্ভে, অন্য কোন বাস্তবতায়?

“বুঝলেন ভাই, আমার মা খুব ভালো মানুষ ছিল। অনেক দান-সদকা করতো। আমি হয়েছি তার ঠিক উল্টা। আমার মন অনেক শক্ত।”

আনসার আলী একমনে কাজ করে চলেছে। 

মা আমাকে গল্প শুনাতো। যে রাতে আমার ঘুম আসতো না, সেই রাতগুলোতে। স্কুলে পড়ার সময়। অদ্ভুত সব গল্প।  তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে এক যুবক দৌড়ে যাচ্ছে, সে তার প্রেমিকার কাছে যাবে। হঠাৎ এক মাথার খুলিতে হোঁচট খেয়ে সে উল্টে পড়লো মাটিতে। এদিকে যুবকের লাথি লেগে জেগে উঠলো বহু বছর আগে লাশ হয়ে যাওয়া সেই নরকঙ্কাল। যুবককে ডেকে সে বললো – একদিন এই পথ দিয়ে আমিও ছুটে গিয়েছিলাম।

আমি যখন কবরের ভেতর মা-র চেহারা দেখতে পাবো, তখন কি তার কাটা দাগটাও দেখতে পাবো? নাকি সেটা মাটিতে ঢেকে গেছে এই তিন দিনে? মায়ের কপালে একটা দাগ আছে। ছোটবেলা জাম গাছ থেকে পড়ে হয়েছিল। এত সুন্দর চেহারা মায়ের, ওই একটাই খুঁত। এই খুঁত না থাকলে মা সিনেমায় নায়িকা হতে পারতো। ববিতা, শাবানা ফেল করতো।

আচ্ছা, কবর খুঁড়ে যদি শেষপর্যন্ত দেখা যায় মা-র চেহারার সাথে আমার চেহারার অসম্ভব মিল আছে, তখন কি হবে? তখন কি কবর দেখে আমার মনে হবে, আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আর কবরে যে শুয়ে আছে সে মা না, বরং সে হলো আমি নিজে? আর সাথে সাথে আমি টের পেতে শুরু করবো বিভিন্ন আজাব?

কবরের মাটি ততক্ষনে সরিয়ে ফেলা গেছে। আমি একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম। একবার যদি অন্তত চেহারাটা দেখতে পারি, তাহলে সাথে সাথে স্মৃতিতে গেঁথে ফেলবো সেই মায়াবী চেহারা, ফলে কোন ফটোগ্রাফ ছাড়াই তাকে আমি মনে করতে পারবো – আমার বাকি জীবন তার স্নেহের আঁচল আমাকে ঘিরে থাকবে, সে রবে সরবে – হৃদয়ে মম।

কিন্তু অনেক্ষন উঁকি-ঝুঁকি দিয়েও সর্বগ্রাসী এক অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম না, যেন সাড়ে তিন হাত ওই গর্তের মধ্যে লুকিয়ে আছে ভীষণ ভয়াবহ এক কৃষ্ণগহ্বর, যা অস্তিত্ব আর স্মৃতি দুটোকেই একসাথে গিলে খেয়ে ফেলে মুহূর্তের ভেতর।

“কিছুই তো দেখা যায় না। আপনি না বললেন, আমি মা-কে দেখতে পাবো?” – যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে লোকটাকে বললাম আমি।

সে কিছু বললো না, তার কপালে ভাঁজ দেখে আমি ভরসা হারাতে শুরু করলাম।

“কিছুই তো দেখি না। লাশ কি চুরি হয়ে গেলো নাকি?”

তার নির্বিকার মুখমণ্ডলে প্রথমবারের মতো আবেগের চিহ্ন দেখতে পেয়ে আমার মনে তখন অজানা আশংকা বাসা বাঁধতে শুরু করেছে।

“কি হয়েছে, আনসার ভাই?”

“লাশ নাই।” – সে কোদাল ফেলে উঠে দাঁড়ালো।

আমি কি বলবো প্রথমে বুঝে পেলাম না। আতঙ্ক আর আশংকাগুলো মনের এক পাশে সরিয়ে রেখে শেষে বললাম – “কি বলছেন এগুলো?”

পুরো বিষয়টা ততক্ষনে আমার কাছে একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হতে শুরু করেছে। নাকি জীবনটাই একটা চলমান দুঃস্বপ্ন?

“হয়, এইরকম মাঝে মইধ্যে হয়।” – সে শান্তস্বরে বললো।

“ও।” – জাদুকরের ভণিতার সামনে অসহায় এক সম্মোহিত স্বেচ্ছাসেবীর মতো বললাম আমি।

সে তখন আবার চাটাইয়ের ওপর মাটি চাপা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমার মাথা তখন কাজ করছিলো না। কোনোমতে দু’পায়ে শক্তি সঞ্চার করে উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু দাঁড়িয়ে পড়ে যে দৃশ্য দেখলাম, তাতে আমার আবার মাথা ঘোরাতে লাগলো। দেখলাম, ডানে-বাঁয়ে সামনে-পেছনে যে কবরগুলো দেখা যাচ্ছে তাদের অনেকগুলোই ভেঙে পড়েছে। দুর্বল পায়ে গেটের দিকে ফিরতে ফিরতে আমার মনে হলো আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবো, কেননা ভেঙে পড়া কবরগুলোর অধিকাংশই আমার মায়ের কবরের মতো ফাঁকা, অন্ধকার, লাশহীন।

বুঝতে অসুবিধা হলো না, এই কবরস্থান থেকে একে একে চুরি হয়ে যাচ্ছে সবগুলো লাশ। আনসার আলীর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে ফিরে তাকালাম, সে অপরাধবোধে ভোগা মানসিক রোগীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। দৃষ্টি তার নিজের মাটিমাখা পায়ের পাতার দিকে – যেন নিভৃতে বলতে চাইলো, নিয়মিত এইসব লাশ চুরির জন্য সে কোনোভাবেই দায়ী নয়, যদিও এর পেছনের ঘটনা সে জানে।

মাতালের মতো টলতে টলতে বেরিয়ে এলাম গোরস্থান থেকে। আমার চারদিকে কি হচ্ছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একসময় আমার মনে হলো, যেন মাথার মধ্যে সব কেমন ওলোট-পালোট হয়ে যেতে শুরু করেছে। আমি এমন সব জিনিস দেখতে শুরু করলাম, যা আগে কখনো দেখি নি। এমন সব জিনিস শুনতে শুরু করলাম, যা আগে কখনো শুনি নি। জাহানারা বেগম বলে পৃথিবীতে যে কখনোই কেউ ছিল না, এই সন্দেহ ততক্ষনে দানা বাঁধতে শুরু করেছে আমার নিজের মনে।

গেটের বাইরে ছয়-সাতজন মহিলা এখনো বসা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক যে, সে একটা ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে বসেছে, হয়তো তার নাতনি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলাম – চমকে উঠলাম, কারণ তার দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ে গেছে মা-র চেহারা – এমনভাবে মনে পড়ে গেছে যে, সারাজীবনে আর কখনো কোন ছবি দেখে সেই মুখ আমাকে মনে করতে চেষ্টা করতে হবে না।

কিন্তু মায়ের চেহারার সাথে এই ফকির মহিলার এতটা মিল হলো কোথা থেকে? চিন্তা করতে গিয়ে মাথার ঠিক মাঝখানে প্রচন্ড একটা ব্যথা শুরু হলো, কিন্তু ভাবনাটা মাথা থেকে বেরও করে দিতে পারছিলাম না।  

প্রথম ওহী নাজিলের পর আতংকিত নবীজি যেমন ছুটে চলে এসেছিলেন জিব্রাইল ফেরেশতার কাছ থেকে, মুহূর্তের ভেতর তেমনি অজানা এক ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম আমি – কোনোমতে মায়ের মতো দেখতে তার হাতে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে প্রায় দৌড়ে পালালাম।

আমার মাথায় ততক্ষনে সাদা-কালো ফটোর মতো এমন সব স্মৃতি উঠে আসতে শুরু করেছে, যেগুলো আগে কোনোদিন আমি জানি নি, যাদের আমি জীবনে কখনো দেখিনি। মনে হলো, আমি যেন আজ আর সেই আমি নেই, আমার মধ্যে যেন ভর করেছে কবরের খাঁচা থেকে পলাতক কোন প্রেতাত্মা আর আমি তার সামান্য প্রতিনিধি হয়ে এই দুনিয়াটাকে দেখে চলেছি।

বাসায় ফিরে ঘরে ঢুকতেই দেখি ড্রইংরুমে ছোট খালা তখনো বসে আছে। মহিলার অসম্ভব ধৈর্য। আমাকে দেখেই বললো, “তুই কপালে ব্যথা পেলি কিভাবে? এটাতো আগে খেয়াল করি নি।” আমি ছুটে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। দেখি, কপাল বরাবর কাটা একটা দাগ, ঠিক যেরকম মায়ের ছিল।

এরপর বেশ কয়েকদিন চলে গেছে। ঢাকায় থাকা অবস্থায়ই আমি নিজের ভেতর বিশেষ কতগুলো পরিবর্তন টের পেতে শুরু করেছি। মিষ্টি আর সমুচা নিয়ে দেখা করতে এসে রাকিব তো সেদিন বলেই বসলো – “তোর চেহারা দিন দিন তোর মায়ের মতো হয়ে যাচ্ছে। তোর ওপর তোর মায়ের আত্মা ভর করেছে মনে হয়।”

আরেকদিন বুয়া আনারস কেটে দিলো। দেখে মনে হলো, এটা খেলে আমার মুখ কাটা কাটা হয়ে যাবে। এই আনারস খেলে তিন-দিন চার-রাত হাসপাতালের আইসিউএ-তে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে এই দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিতে হবে আমাকে। আতঙ্কে মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা হলো আমার – অথচ ছোট থাকতে আনারস ছিল আমার প্রিয় ফলগুলোর একটা, বিশেষ করে চট্টগ্রামের মিনি সাইজ আনারসগুলো।

আমি একসময় বুঝতে পারলাম, আমার ভেতর আর আমি বলে কেউ নেই। আমি বুঝতে পারলাম, আমি কেউ না, একই ডিএনএ-র ধারক ও বাহক হয়ে আমিই আসলে আমার মা, আমার মা-ই আমি।

শেষ কথা হলো, কবর থেকে লাশ চুরি হয় না। আর কেই বা সাধ করে নিজের কাঁধে তুলে নেবে ভুলে যাওয়া মৃতদেহের ভার! লাশেরা কখনোই চুরি বা ডাকাতির শিকার হয় না, তারা শুধু ফিরে আসে পৃথিবীতে ফটোগ্রাফ, সন্তান, না হয় ঘাসফড়িং হয়ে – মনে হলো আমার।

[ জনরা: জাদু বাস্তবতা / লেখক: মায়িন খান / উৎসর্গ: হাসান অরিন্দম, শ্রদ্ধাস্পদেষু ]

Leave a comment