অপ্রেম

তোমরা আজকে বেশ কিছু ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা বললে, যদিও এগুলোর কোনোটাই সরাসরি অভিজ্ঞতা না – “উমুকের কাছে থেকে শুনেছি”, “তমুক বলেছে”, এসবকে আসলে সত্যিকার ভৌতিক অভিজ্ঞতা বলা যায় না।

রাকিবের ঘটনাটা যদিও তার নিজস্ব, কিন্তু ওটাকে ভৌতিক অভিজ্ঞতা বলার চেয়ে মনে হয় রহস্য বলাই শ্রেয় হবে – কারণ রাকিব সরাসরি কিছু দেখেনি ওই রাতে, শুধু কিছু আওয়াজ শুনেছে।

কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমার ঘটনাটা তোমাদের সবার থেকে শুধু ব্যতিক্রমই না, এরকম কোন কিছু জীবনে তোমরা শোনোই নি। 

বলতে চাচ্ছিলাম জেরিনের আত্মার সাথে আমার যোগাযোগের ঘটনাটার কথা। আশা করি, এই ঘটনাটা আজ এই বৃষ্টির রাতে তোমাদের হতাশ করবে না। তাছাড়া তোমাদের ভাবিকে চা বানাতে বলেছি, আশা করছি সাথে কিছু পুরি বা সিঙ্গারাও সে ভেজে দেবে। মেয়েরা মায়ের জাত, তাদের কাছ থেকে এইটুক বাড়তি আপ্যায়ন তোমরা আশা করতেই পারো।

তাহলে শুরু করি, কি বলো? বলছিলাম জেরিনের কথা। এই জেরিন মেয়েটা ছিল ভুলে যাওয়ার মত সুদূর এক অতীতের দুর্দান্ত এক বান্ধবী আমার। সেই জেরিনেরই অতৃপ্ত আত্মার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল রমনার মোড়ে – এক অগভীর রাতে।

শীতের রাত। সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। রাস্তায় লোকজন কম। একটা রিক্সা নিয়েছি শেরাটন হোটেলের সামনে থেকে। যাবো শান্তিনগর। রিক্সাওয়ালা গায়ে একটা পুরানো জ্যাকেট আর মাথায় টুপি-মাফলার জড়িয়ে শীতের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে। আমি গা গরম করার আশায় স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও একটা বেনসন সিগারেট ধরিয়েছি। রিক্সা যখন রমনা পার্কের মূল গেটের সামনে দিয়ে যাচ্ছে, একটা মেয়েলি কণ্ঠ আমার নাম ধরে ডাকলো।

তাকিয়ে দেখি সাদা শাড়ি পড়া ছিপছিপে একটা মেয়ে হাত উঁচু করে এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। এই প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে মেয়েটার চুলগুলো খোলা, ব্লাউজ সম্ভবত লালচে ধরণের কোন রঙের – স্ট্রিটলাইটের হলদে আভার কারণে রংটা জমাট বেঁধে যাওয়া কালো রক্তের মতো লাগছিলো। গলার স্বরটা খুব চেনা চেনা লাগলো বলে রিকশাকে সাইড করতে বললাম।

এরপর যা হলো, তার জন্য অবশ্য আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম না। রিক্সাটা স্লো হতেই মেয়েটা উঠে বসলো আমার পাশে, তারপর বললো – “চলো”। আমিও নিজের অজান্তেই একপাশে সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিলাম। ততক্ষনে তাকে আমি চিনতে পেরেছি। এটা সেই জেরিন, যার সাথে পুরো তিন বছর সাত মাস আমি চুটিয়ে প্রেম করেছিলাম – যদিও শেষটা এর মিলনাত্মক হয় নি।

আমি শিউরে উঠলাম। আমার সারা গা বার বার কাটা দিয়ে উঠতে লাগলো, কেননা আমি নিশ্চিত ছিলাম এটা সত্যিকার জেরিন না। এটা জেরিন হতেই পারে না, কারণ ও তো দুই মাস হলো তার স্বামীর সাথে কানাডা উড়ে চলে গেছে, সে তো চিরতরে বিদায় হয়ে গেছে আমার জীবন থেকে।

রিক্সাওয়ালা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছিলো বলে তাকে যেতে বললাম। রিক্সা চলতে শুরু করতেই আমি ওর দিকে তাকিয়ে আতংকিত ঢোক গিলতে গিলতে বললাম – “জেরিন, তুমি এখানে? দেশে কবে এলে?”

সে শুধু হাসলো, কিছু বললো না।

আমার তখন তাকে ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দিতেই হলো – ধরে নিলাম, সে বেড়াতে এসেছে বাংলাদেশে। এমনকি মনের গভীরে কোথাও এই আশাও উঁকি দিয়ে গেলো যে সে একবারে দেশে চলে এসেছে স্বামী-সংসার চিরতরে ছেড়ে দিয়ে।

জেরিন আমার হাত ধরলো, ঠিক যেমনভাবে প্রথমবার সে ধরেছিলো আমার হাত। তার স্পর্শ ছিল উষ্ণ, তার নিশ্বাস ছিল ভারী। আমার একবার মনে হলো, আমি স্বপ্ন দেখছি। নিজের হাতে চিমটি দিয়ে বুঝতে পারলাম, আমি জেগেই আছি। এটা যদি স্বপ্ন হতো, তাহলে এর নাম দিতে হতো দিবাস্বপ্ন – কিন্তু সেটাও বলার উপায় ছিল না, কেননা ততক্ষনে দিবস রূপান্তরিত হয়ে রীতিমতো রাত্রিতে পরিণত হয়েছে এই ঢাকা শহরে।

জেরিনের সাথে পরিচয় হয়েছিল, যখন আমি ঢাকা মেডিকেলে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। সেও পড়তো ঢাকা ভার্সিটিতে – বাংলা বিভাগে, দ্বিতীয় বর্ষে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরিতে তাকে যেদিন প্রথম দেখলাম, বান্ধবীদের ভিড়ে জেরিনকে একা লাগছিলো। আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সে কি ভেবে আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, মুভির রেকগুলো কোথায়। আমি যখন বললাম আমি এখানে কাজ করি না, সে লজ্জা পেয়ে গেলো। কিন্তু আমাদের মধ্যে আরো কথা বিনিময় হলো।

কাকতালীয়ভাবে রমনা পার্কের সামনে ঠিক এই জায়গা থেকেই প্রথমবার ও আমার সাথে রিক্সায় উঠেছিল। সে পার্কের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তীব্র রোদের ভেতর। কোন রিক্সা খুঁজে পাচ্ছিলো না। বুঝতে পারছিলাম, অনেকক্ষন অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে পড়েছে সে। রিক্সা থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবে সে। তারপর থেকে কতদিন একসাথে বাসায় ফিরেছি ! তার বাসা ছিল শান্তিনগরেই – কাকতালীয়ভাবে – আমার দুই গলি পরে। কার্ল য়ুঙ অবশ্য বলেছেন, পৃথিবীর কোনোকিছুই কাকতালীয়ভাবে ঘটে না।

পাশ করার সাথে সাথেই জেরিনের বিয়ের প্রস্তাব আসে কানাডা প্রবাসী এক ভদ্রলোকের পরিবার থেকে। লোকটা তার থেকে নয় বছরের বড়ো, কিন্তু সে টরন্টো শহরে সেটেল্ড – একাউন্টিংয়ে সিপিএ করে জীবনযুদ্ধে ইতোমধ্যে জয়ী হয়েছে। আর জেরিনেরও মনে হয় কানাডার মতো উন্নত বিশ্বে থিতু হওয়ার এই সুযোগ হেলায় হারানোর ইচ্ছে ছিল না। মেয়েটার যে বিদেশে যাওয়ার অন্ধ একটা ইচ্ছে ছিল, তার ছোটোখাটো একটা প্রমানও পেলাম আমি ওর কানাডা যাওয়ার ঠিক তিন দিন আগে।

সেদিনটা ছিল সোমবার। জেরিন ওদের বাসায় আমাকে ডেকে পাঠালো, বললো – জরুরি কাজ আছে। সপ্তাহান্তে যে পাড়ি জমাবে বিদেশে, তার সাথে আমার কি কাজ থাকতে পারে সেটা বুঝতে পারলাম না, কিন্তু হতাশা কৌতূহলের কাছে হার মানলো বলে কোনোমতে নীলশার্টটা গায়ে চড়িয়ে এক রাখাল বালক হাজিরা দিলো অধুনা এক রাজকন্যার অন্দরমহলে।   

দুপুর তখন শুনশান। অফিসে যারা যাওয়ার, তারা সবাই গেছে অফিসে। কলেজে-ভার্সিটিতে যারা যাওয়ার, তারাও সব চলে গেছে মহান এই নগরের ঘরগুলোকে ফাঁকা করে দিয়ে। একই পরিক্রমায় জেরিনদের বাসাটাতেও সে আর আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। কাজের মেয়েটাকে সে এমন একটা বাজারে পাঠিয়েছিল, যেটায় রিক্সা ছাড়া যাওয়া যায় না, আর ট্রাফিক জ্যামগুলো অতিক্রম করে যেখান থেকে ফিরতে সময় লাগে কম করে তিন ঘন্টা। 

ড্রইংরুমের পর্দাগুলো টানা ছিল বলে ঘরটা আবছা অন্ধকার লাগছিলো। আর সদ্য স্নান করে আসা জেরিনের ভেজা চুল থেকে পানি ঝরে ওর সাদা জামার কাঁধের কাছটা ভিজে যাচ্ছিলো। জেরিন বললো – উত্তর আমেরিকায় যাওয়ার এরকম সুযোগ, সেটাও এরকম একজন চমৎকার ভদ্রলোকের সাথে বিয়ে হয়ে, তার জীবনে সম্ভবত আর আসবে না।

“বিয়ে আর কি? দুইটা শরীরের মধ্যে সম্পর্ক তো? কিন্তু তুমি-আমি দুজনই জানি, আত্মার বন্ধনটাই আসল, ওটা চিরদিন টিকে থাকলেই হলো।” – নির্জন রাজপথে নায়িকার মত সে ঘোষণা করলো।

“শরীর কিছু না?” – আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠতে চাইলাম, কিন্তু একটা নির্দোষ প্রশ্ন ছাড়া আর কিছু বেরুলো না আমার কণ্ঠ থেকে । 

“শরীর আসলেও বড় কোন বিষয় না – হলেই কি, আর না হলেই কি! শরীর যে বড় বিষয় না, এটার প্রমান দেখতে চাও?”

আমি চুপ হয়ে গেলাম, বুঝতে চেষ্টা করলাম কথা-বার্তা ঠিক কোন দিকে গড়াচ্ছে। সে তখন সোফায় আমার একেবারে গা ঘেঁষে বসলো, আর ওর ধবধবে সাদা জামা থেকে বল সাবানের গন্ধ আসতে শুরু করলো।

আমার কানের কাছে মুখ এনে প্রায় শোনা যায় না এমনভাবে ফিস ফিস করে বলতে শুরু করলো সে – “শরীর যে বড় কিছু না, তুচ্ছ একটা জিনিস, সেটা দেখানোর জন্যই তো তোমাকে আজকে ডেকেছি। আমি জানি, আনিস, তুমি অন্তত একবারের জন্য আমাকে পুরোপুরি পেতে চেয়েছিলে। এতে দোষের কিছু নেই, এটা খুবই স্বাভাবিক একটা চাওয়া। মনে আছে, তুমি একবার তোমাদের শান্তিনগরের বাসায় একবার নিয়ে গেলে, যখন তোমার বাসার সব লোকজন সিলেট বেড়াতে গিয়েছিলো? আমি তখন তোমাকে অনুমতি দেই নি, কারণ ভেবেছি আমাদের তো সময় আছে। কিন্তু এখনকার বিষয়টা পুরোপুরি আলাদা।”

একটু থেমে কাঁপা কাঁপা গলায় সে বললো – “তুমি হয়তো ভাবছো, আমি পাগল হয়ে গেছি। আমি নিজেও জানি না, কি করতে যাচ্ছি। কিন্তু আমি কারো কাছে ঋণী থাকতে চাই না, এমনকি তোমার কাছেও না।” 

আমি হতভম্বের মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে তখন মোহময়ীর মতো উঠে দাঁড়ালো আমার তৃষ্ণার্ত দু’চোখের সামনে, তার সুডৌল কাঁধ থেকে খসে পড়লো সবুজ আঁচল। বাঁ-দিকের দরজাটার গোলাপি পর্দা সরিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে কুহকীনির মতো ইশারা করে সে আমাকে নির্দেশ দিলো তাকে অনুসরণ করতে। সবকিছু এত দ্রুত ঘটে যাচ্ছিলো যে আমি হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলাম খাপ-খোলা তলোয়ারের মতো ধারালো ওর শরীরের দিকে। প্রতি পদক্ষেপের সাথে সাথে ওর ওই নিপুন অস্ত্র আমার পুরো অস্তিত্বকে রক্তাক্ত করে চলেছিল।      

হয়তো আমি এরকম কোন প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, হয়তো আমি বুঝতে পারছিলাম না এটা সঠিক কোন বিনিময় হবে কিনা, অথবা হয়তো আমি আসলে চরম ভীতু টাইপের একটা প্রাণী – কিন্তু যখন পর্দার আড়াল থেকে ভেসে আসতে শুরু করলো ওর গুনগুন করার সুর, কেন যেন তখন আমি দৌড়ে বেরিয়ে এলাম ওই ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে। আমার মনে আছে, আমি দুপুর রোদে সেদিন ধানমন্ডি লেকের সামনে দিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম, পায়ে স্যান্ডেল, লোকজন অবাক হয়ে তাকাচ্ছিলো। লালমাটিয়ার মোড়ে একজন দয়ালু রিকশাচালক ভাই আমাকে ডেকে বলেছিলো, “মামা, কই যাইবেন?” 

সেদিন এভাবে কতক্ষন দৌড়েছিলাম, আমার মনে নেই। তবে আমার সেই দৌড় শেষ হয়েছিল একবার বাংলামোটরের কাছে এসে। তিন-চার মাইল তো হবেই, কি বলো? 

যে কোন বাঙালি যুবক পরে এ ধরণের দুর্ঘটনা নিয়ে আফসোস করতো, আমিও করেছিলাম। বাসায় ফেরার পর আমারও টনক নড়েছিলো, ভাবছিলাম – এটা কি আমি ঠিক করলাম! সেই বিকেলে সাহস করে জেরিনকে আবার ফোনও দিয়েছিলাম, কিন্তু কানাডা যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে আর আমার ফোন ধরে নি। বেহেশতে যাওয়ার সুযোগ বার বার আসে না।  বিদেশ যাওয়ার পর তার সাথে আবার সীমিত যোগাযোগ চালু হয়েছিল – অন্তর্জালে।

বাই দ্য ওয়ে, এটা স্পর্শকাতর ঘটনা তো। তোমাদের ভাবিকে এটা বলার দরকার নেই, মানে না বললেই ভালো। ভুল বুঝতে পারে। মেয়েরা আবার সহজেই ভুল বোঝে তো, সেজন্য বলছি, আর কোন কারণে না।

যা হোক, মূল ঘটনায় ফিরে আসি। সে অদ্ভুত রাতে জেরিনের সাথে বাস্তবসম্মত কিন্তু ভৌতিক সেই সাক্ষাৎকারের পর বাসায় ঢুকতে ঢুকতে আমার রাত বারোটা বেজে গেলো। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই বিছানার পাশ থেকে মোবাইলটা টেনে নিয়ে স্কাইপে কল করলাম জেরিনকে। সে ধরলো সাথে সাথে। 

“ফোন করেছো কেন? তুমি জানো না, আমাদের এখানে এখন রাত?”

“তুমি কি, বাই এনি চান্স, দেশে এসেছো?” – আমি দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললাম।   

“আমি দেশে আসবো কোন দুঃখে? কানাডিয়ান পাসপোর্ট না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে বের হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। আর কিছু বলবে?”

সে ফোন রেখে দিলো। কিংবা আমিই কেটে দিলাম। কিছু যায় আসে না, যদিও ঠিক সেই রাতেই আবার তার সাথে আমার দেখা হলো – সেই একই জায়গায়, এবার রাত নয়টায় – যেন সে জানতো, ঠিক ওই সময়টাতেই আমার রিক্সা পার্কের গেটটা অতিক্রম করবে।   

সে রাতেও জেরিনের মতো সেই অবয়বটাকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত শীতল একটা ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিল, কেননা আমি বুঝতে পারছিলাম – এটা সম্ভবত জেরিন না, বরং জেরিনের অতৃপ্ত আত্মা। কিন্তু সে রাতেও তাকে ঠিকই আমি রিক্সায় তুলে নিলাম, তারপর ঠিক একইভাবে খুনসুটি করতে করতে শান্তিনগর ফিরলাম সে আর আমি।

রাতে বাসায় ফিরেই আবার ইন্টারনেটে কল করলাম জেরিনকে। প্রথমবার সে ধরলো না। আমি নিশ্চিত, এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা – আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, সে অনলাইনে আছে।

দ্বিতীয়বারে সে ধরলো, কণ্ঠে তার কেমন যেন একটা ঝাঁঝ – “বার বার ফোন করো কেন? তোমার সমস্যা কি?”

“তোমাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি, কতদিনের জন্য ঢাকা এসেছো। বাই দ্য ওয়ে, তোমার হাসবেন্ড লোকটা কি সাথে এসেছে?”

“কি বলছো আবোল-তাবোল? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”

আমি লাইন কেটে দিলাম, নিশ্চিত হলাম – মূল জেরিনের সাথে না, বরং জেরিনের আত্মার সাথেই আমার দেখা হচ্ছে প্রতিদিন।

এর পর থেকে প্রায়ই এরকম হতে লাগলো। সপ্তাহে অন্তত দুই থেকে তিনদিন জেরিনের আত্মার সাথে আমার দেখা হয়। ওই একই জায়গা থেকে ওকে আমি রিক্সায় তুলে নেই, কোনোদিন ওর পরনে থাকে শাড়ি, কোনদিন জিনসের সাথে ফতুয়া। আমরা হাতে হাত রেখে গল্প করতে করতে বাসায় ফিরি, তারপর ও ওর পথে চলে যায় আর আমি আমার পথে। প্রতিবারই রিক্সাওয়ালা টাকা নেয়ার সময় আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করে, কিন্তু আমার তাতে কিছু যায় আসে না। বাস্তব হোক আর আত্মা হোক, জেরিনের সঙ্গ পাওয়া দিয়ে আমার কথা – সেটা তো নিয়মিত পাচ্ছি আমি, আর কে না জানে সামাজিক জীব হিসেবে যেকোন ধরণের সঙ্গই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য।

এভাবে চলেছিল টানা প্রায় তিনমাস। ততদিনে জেরিনের আত্মার প্রতি ভীতি আর অস্বস্তি আমার বেশ কমে এসেছে। সত্যি বলতে কি, ওই দিনগুলোতে আত্মা জেরিনের সাথে যতক্ষণ থাকতাম, মনে হতো ফিরে গেছি পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ শ্রেণীর কৈশোরের সেই দিনগুলোতে। হাই স্কুলের শুরুর দিকের সেই বছরগুলোতেও – সেই মাসগুলোতেও – আমাদের অপরিপক্ক মনে প্রেম ছিল, কিন্তু সেই প্রেম ছিল সমস্ত কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত। তোমরা যারা ইংরেজি সাহিত্যের ভক্ত আর বিদেশী লেখকদের দু’একটা অনুবাদ বই পড়ে বড় বড় কথা বলতে পছন্দ করো, তাদের ভাষায় হয়তো এটা প্লেটোনিক প্রেম। কিন্তু আমার মতে, এটাই এক আত্মার সাথে আরেকটা আত্মার প্রেম। সত্যি কথা বলতে কি, কিশোর আর কিশোরীর প্রেম আমার দৃষ্টিতে একমাত্র প্রেম যাকে মহান ও পবিত্র বলা যায়, কারণ এটা প্রেমের সেই পর্যায় যখন দুটি আত্মার মিলনের মধ্যে শরীর এসে কাবাবের হাড় হয়ে দাঁড়ায় না। এইটা ভালোবাসাবাসির সেই ধাপ, যেই ধাপে ফ্রয়েডীয় বিছানা চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে মনের মধ্যে উঁকি-ঝুঁকি দেয় না।

জেরিনের আত্মার সাথে যতক্ষণ থাকতাম, ততক্ষন আমার মনে স্বর্গীয় একটা অনুভূতি হতো। সেই ফিলিংস তোমাদের আমি বলে বোঝাতে পারবো না, এত অদ্ভুত সুন্দর ছিল সেই প্রহরগুলো। জেরিনের আত্মা প্রায়ই বলতো – “পৃথিবী সৃষ্টির আগে খোদা যখন সব আত্মাকে আদম আলাইহিসসালামের মেরুদন্ড থেকে সৃষ্টি করলেন, তখন মনে হয় তোমার আত্মা আর আমার আত্মা আরাফার মাঠে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। তোমার-আমার মিলের এটা ছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা হয় না।”

একদিন হঠাৎ করে সে বললো – “তোমার মনে আছে আমার দেহটা যেদিন কানাডা চলে গেল তার দিন তিনেক আগে তোমার একটা সুযোগ ছিল ওইটাকে নষ্ট করার? তুমি সুযোগ পেয়েও সেটা করো নি। তোমার সেই সততার পুরস্কারই কিন্তু এই আমি, মানে স্বয়ং আমার আত্মা। যতদিন তুমি এরকম শরীরের ঊর্ধ্বে চিন্তাভাবনা করতে পারবে, ততদিনই আমি তোমার হয়ে থাকবো।“

বুঝতে পারলাম, তারাভরা এই আকাশগুলোর নিচে কেউ জেরিনদের পেয়ে হারায়, আর কেউ হারানোর মাধ্যমে জেরিনদেরকে খুঁজে পায়।   

তবে তার আত্মার প্রতি আমার আত্মার আকর্ষণের আরেকটা কারণ মনে হয় এই বুড়ো বয়সে এসে আমি কিছুটা হলেও ধরতে পেরেছি। কি সেই কারণ? কারণটা মূলত আধ্যাত্মিক। যদিও জানি, তোমরা আধুনিক ছেলে-পেলে এসব তেমন একটা পাত্তা দাও না, তবু পরিস্থিতিটা পুরোপুরি বোঝানোর জন্য বলি।

আমার ধারণা, পুরুষ আর নারীর শারীরিক গঠনে যেমন পার্থক্য আছে, ঠিক তেমনি পার্থক্য আছে তাদের আত্মার গঠনেও। বুঝতেই পারছো, আমার কথা কোন দিকে এগুচ্ছে। বলতে চাচ্ছিলাম, পুরুষদের আত্মা আসলে আসলে তাদের শরীরের মতোই কঠোর, আর নারীর আত্মা তাদের শরীরের মতোই কোমল। কঠোর শরীরগুলো যেমন কোমল শরীরের সংস্পর্শে বস্তুগত অর্থে শান্ত হয়, তেমনি কঠোর মনগুলো কোমল মনের সান্নিধ্যে আত্মিকভাবে শান্তি পায়। জগদ্বিখ্যাত প্লেটোনিক প্রেমগুলোরও এইটাই সঠিক রহস্য।  

তো ওর সাথে আমার অকৃত্রিম ভালোবাসা যখন তুঙ্গে, তখন এক সুন্দর সকালে ফজরের পর পর আমার মনে হলো এই সম্পর্কটাকে একটা স্থায়ী রূপ দেয়া দরকার। যেই ভাবা, সেই কাজ – সেই বিকেলেই বেইলি রোডের চটপটির দোকানগুলোর সামনে জেরিনের আত্মাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিলাম। আমি জানতাম, তার এতে কোন আপত্তি থাকার কথা না। সে আপত্তি করলোও না, উত্তরে মৃদু হাসলো, তারপর বললো – “কিন্তু তুমি কি পারবে এই সম্পর্কের ভার বহন করতে?”

“ভার?”

“তুমি হয়তো এতদিনে বুঝে ফেলেছো, আত্মা আর শরীর হলো পূর্ব আর পশ্চিমের মতো, তুমি শরীরের যত কাছে এগিয়ে যাবে, আত্মা থেকে ততই দূরে সরে যাবে।”
“এতদিন পর বুঝলাম, কেন তোমার শরীর কানাডাতে, আর তোমার আত্মা বাংলাদেশে।” – তামাশা করে বললাম। 

আমাদের বিয়ের এই সিদ্ধান্তের পথে বাধা ছিল একটাই, ধর্মীয় নিয়মাবলী। আমরা নিশ্চিত ছিলাম না, শরীরের সাথে আত্মার বিয়ে শরীয়ত সম্মত কিনা। এদিকে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের মনে আঘাত করে হারাম ধরণের কোন বিয়েও আমরা করতে চাইছিলাম না। সব মিলিয়ে সমাধানের আশায় একজন বিজ্ঞ আলেমের শরণাপন্ন হলাম। কাটাবন মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা জুবায়ের সিদ্দিকী ইদানিং ইউটিউবে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ফতোয়া দিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন, সারা দেশে তার ফ্যান-ফলোয়ার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। মসজিদে আসরের নামাজের পর যখন তাকে একদিন একা পেয়ে গেলাম, উনাকে একপাশে ডেকে নিয়ে আমার সমস্যার কথা তাজিমের সাথে বর্ণনা করলাম। সব শুনে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর বললেন – “জিনের সাথে বিয়ের কথা শুনেছি, আত্মার সাথে বিয়ের কথা কখনো কোন কিতাবে পাই নি। তবে জিনের জন্য যে নিয়ম, আত্মার জন্যও একই নিয়ম হওয়ার কথা। আর বেশির ভাগ উলামাই মত দিয়েছেন যে মানুষ ও জিনের বিয়ে অবৈধ।”

“কারণ কি, হুজুর?”

“কারণ তো স্পষ্ট, জনাব। মানুষ জাহেরী প্রাণী, আর জীন গায়েবি দুনিয়ার জিনিস।”

“বেশির ভাগ উলামা মত দিয়েছেন যে মানুষ ও জিনের বিয়ে অবৈধ?”

“জি, বেশির ভাগ হাক্কানি উলামার এটাই মত।“

“সব উলামা তো এটা বলেন নি, তাই না?” – নাছোড়বান্দা আমি বলি। 

“শোনেন, ইখতিলাফ সবসময়ই থাকবে। অনেকে তো এইটাও বলে, রানী বিলকিস ছিল জীনকন্যা। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে তো নবী সোলাইমান পরীর সাথে বিয়ে বসেছিলেন।”

শেষপর্যন্ত ওই ইখতিলাফের ওপর ভরসা করেই বাসায় বিয়ের কথাটা পাড়লাম। বাবা কিংবা মা তেমন একটা উৎসাহ দেখালো না, কারণ তারা জানতো আত্মার সাথে বিয়ের ফলে কোন নাতি-নাতনির মুখ দেখার কোন সম্ভাবনা তাদের নেই। আর উত্তরপুরুষের নিশ্চয়তা না থাকলে তাদের বংশের বাতি শিখা অনির্বানের মতো কিভাবে প্রজ্জ্বলিত থাকবে, সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত ছিলেন না। তবু আমি জোর করায় তারা মৃদু আপত্তি নিয়ে বিয়েতে রাজি হলেন। হয়তো তারা মনে মনে আশা করছিলেন, দিনের পর দিন শরীরের সাথে মিলনের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকতে থাকতে, মনের সাথে মনের মিলনে ক্লান্ত-হতাশ হতে হতে, একসময় আমি জেরিনের আত্মাকে পরিত্যাগ করবো, বলা যায় না বিষয়টা বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়াতে পারে। তাছাড়া একটা নারী আত্মার সাথে ডিভোর্সে তারা কোন আর্থিক ঝুঁকি দেখেন নি, আত্মারা ‘নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে’ মামলা করেছে এরকম কথা আজ পর্যন্ত কোথাও শোনা যায় নি।

সবকিছু পরিকল্পনামাফিক ঠিকমতোই চলছিল, কিন্তু জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি যে সপ্তাহে খুব গরম পড়লো, একটা ঘটনা ঘটলো।

সোমবার বিকেল বেলা পশ্চিম দিক কালো করে কালবোশেখী শুরু হলো বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার ঠিক আগে দিয়ে। ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে গেলো আমার। ফলে যখন ঝর ঝর করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো, নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না, আসমানী বালাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য বেপরোয়া হয়ে ছাদে উঠে এলাম। আর তখনি দেখলাম মেয়েটাকে।

জেরিনরা যে বাসাটায় থাকতো, তার ছাদটা আমাদের সিঁড়িকোঠা থেকে স্পষ্ট দেখা যেত। আর ছাদে উঠলে পর ওটার দিকে আমি প্রায়ই আমি তাকিয়ে থাকতাম, নস্টালজিয়া খুঁজে পাওয়ার আশায়, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর ভাবনা থেকে। ঠিক সেই ছাদেরই দরোজা খুলে একটা মেয়ে সন্তর্পনে পা রাখলো বৃষ্টিতে। না, এটা জেরিন না, জেরিনের আত্মাও না, শুধুই অন্য আরেকটা মেয়ে। বিশ-বাইশ হবে তার বয়স, নীল জামা আর কালো স্কার্ট পরা পূর্ণ একজন তরুণী। ছাদে উঠেই সে তার তামাটে মুখ তুলে তাকালো আকাশের দিকে।

তখন আবার বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগে আমার গায়ে। একটু সরে বসি, তবুও আমার শার্টের কলারটা পানিতে ভিজে যায়, আর সেই মুহূর্তে আমার মনে হতে শুরু করে যে আমি আসলে একটা স্বপ্ন দেখছি। অলস আরামদায়ক এই ঘুমটা যেন ভেংগে না যায়, মনে মনে সেটার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণাও করে ফেললাম কয়েকবার।

বৃষ্টি তার পোশাককে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আঁটোসাঁটো করে ফেলছিলো বলে মেয়েটার শরীরের বাকগুলো আমার মনের চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছিলো। আরামদায়ক এক আলস্যে সে যখন চোখ বুঁজে ফেললো, তারপর একসময় ঘুরে ঘুরে এলোমেলো নাচতে শুরু করলো, ভিজে জবজবে হয়ে থাকা তার কালো স্কার্ট তখন একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে জলের বিন্দু ছড়াতে থাকলো। সে মুহূর্তে তরুণীর শরীর থেকে অসংখ্য আলোকবিন্দু ছুটে আসতে থাকে সিড়িঘরের বিস্মিত চোখদুটোর দিকে। নতুন শহরের অনাবিষ্কৃত নির্জন পথে চলার অনুভূতি নিয়ে নির্বাক আমি বসে থাকি অদ্ভুত এক অন্ধকারে। বৃষ্টি আরো একটা ঝাপটা দিয়ে যায় পুরনো সিড়িকোঠায়।

তরুণী যখন এক পর্যায়ে হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দিলো, আর পৃথিবীর সমস্ত বৃষ্টি ওই সুকোমল হাত দু’টোকে স্পর্শ করার জন্য ছুটে চললো, তখন হঠাৎ আমার কাঁধে কেউ হাত রাখলো। চমকে ফিরে দেখি, জেরিনের আত্মা আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে একবার আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার তাকাচ্ছে ওই তরুণীর দিকে।

ক্ষনিকের মোহে গন্ধম ফল খেয়ে ফেলে বাবা আদম বহু বছর আগে যেভাবে লজ্জিত হয়েছিলেন, আমিও সেরকম লজ্জিত হলাম। বুঝতে পারলাম, জেরিনের আত্মা আমাকে সম্মানের যে বেহেশতে বসিয়েছিলো, সেখান থেকে মর্ত্যের অপমানের ভেতর পতন আমার জন্য অনিবার্য হয়ে গেছে। অবশ্য আদম আলাইহিসসালামের স্বর্গ থেকে পতনও পূর্ব-নির্ধারিতই ছিল, একই প্রাকৃতিক নিয়মে আমাকেও সম্ভবত একদিন না একদিন জেরিনের আত্মাকে হারাতেই হতো, সুতরাং আফসোস করে খুব একটা লাভ নেই বলেই মনে হলো।

আমি কি বলবো, বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের প্রতিদিনের আলাপের প্লেটোনিক বিষয়গুলোর কোনোটাই আমার মনে আসছিলো না, ফলে আমি বার বার হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম। সে তখন একবার আমার মাথায় হাত রাখলো, যেভাবে মায়েরা হাত রাখে সন্তানের মাথায় ঠিক সেভাবে, তারপর আস্তে করে সিঁড়ি বেয়ে হেটে নেমে চলে গেলো।

জেরিনের আত্মার সাথে সেটাই আমার শেষ দেখা। যে কারণেই হোক, সে বিকেলের পর থেকে ওর আত্মা আমার অস্তিত্বের কাছাকাছি এসে আর কোনোদিন ধরা দেয়নি। কাজ থেকে ফেরার পথে রমনা পার্কের বড় গেটটার সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু শুধুই দাঁড়িয়ে থেকেছি, বহুদিন এমন হয়েছে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমেই হোক আর দুর্ভাগ্যক্রমেই হোক, জেরিনের আত্মা কিংবা ভূত কোনটারই দেখা পাই নি আর।

আমি আর কি বলবো! শরীর মাত্রই স্ত্রীলোকের সহজ শিকার। হারুত আর মারুত মধ্যপ্রাচ্য-কেন্দ্রিক মহান ফেরেশতা হওয়া স্বত্ত্বেও সুন্দরী যুবতী জোহরার ফাঁদে পড়েছিল, আর আমি তো সামান্য এক বাংলাদেশী বাঙালি। আমার এইটুকু পদস্খলন হতেই পারে।

আমার অবশ্য খুব বেশি আফসোস নেই। আরেকটা তরুণী যখন স্পষ্টতই জেরিনের ছাদটাকে সেদিন দখল করে নিতে পেরেছিলো, তাহলে সামনের কোন একদিন অন্য কোন নারীর ভুতও যে এই মেয়েটার বারান্দাটাকে দখল করে নিতে পারবে না, তার নিশ্চয়তা কি? আসলে তো দেখা যাচ্ছে, এই পৃথিবীর কিছুই নিশ্চিত না, কোনকিছুই অমোঘ না, আর শেষ পর্যন্ত কোন সম্পর্কই মলিনতার ঊর্ধ্বে না।

স্বীকার করি, সামনের ছাদের বিকেলে ঘুরতে বের হওয়া এই তরুণী কিংবা তরুণীর শরীরকে – সে যেটাই হোক না কেন – ইদানিং আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে, কিন্তু এই ভালোলাগাটাই তো আবার অর্থহীন করে তুলছে জেরিনের প্রতি আমার অতীতের সব ভালোলাগাগুলোকে। দু’জনের প্রতি দুর্বলতা উভয়ের অপ্রয়োজনীয়তাকেই মূলত: স্পষ্ট করে তুলছে ইদানিং আমার কাছে।

আমার গল্প এখানেই শেষ। তোমাদের ভালো লাগুক আর না লাগুক, এর বেশি কিছু এই গল্পে নেই। তোমাদের মনোতুষ্টির জন্য তো আর আমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প দীর্ঘায়িত করতে পারি না, তাই না?

এখন এই কাহিনী শুনে তোমাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, জীবিত মানুষের আবার আত্মা হয় কিনা। আমি বলবো – আত্মা তো আত্মাই, তার আবার জীবিত কি, আর মৃত কি!

আবার তর্কের খাতিরে তোমরা হয়তো বলে বসতে পারো – মৃত মানুষের আত্মার সাথে ভৌতিক সাক্ষাৎকারের কথা বিশেষ করে প্ল্যানচেট জাতীয় গল্প আমরা অনেক শুনেছি, কিন্তু জীবিত মানুষের বিষয়ে তো এরকম কখনো শুনি নি। 

আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, তোমাদের এই প্রশ্নের সঠিক কোন উত্তর আমারও আসলে জানা নেই। তাছাড়া আমি বিজ্ঞান কিংবা ধর্ম কোনোটাতেই তেমন ভালো ছিলাম না, যে তোমাদের এসব আধ্যাত্মিক প্রশ্নের সব উত্তর জানবো। তোমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ইন্টারমিডিয়েটে আমার পাঠ্য বিষয় ছিল হিসাবশাস্ত্র, মানে একাউন্টিং।

Leave a comment