অনন্ত-অক্ষয় একজন হারিস চৌধুরী

হারিস চৌধুরী নিজেকে নিজে গুলি করলেন, মস্তিষ্ক বরাবর।

জীবনে তো অনেক পেয়েছেন। তার জন্ম দরিদ্র পরিবারে, বাবা কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন, দিন এনে দিন খেতেন। হারিসের স্কুলে পড়া নিয়ে আশংকা ছিল। কিন্তু তিনি কেমন কেমন করে স্কুলে গেছেন, এমনকি জগন্নাথ ভার্সিটি থেকে বিএ পাশও দিয়েছেন। তার বাকি ভাই-বোনেরা কেউ স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারে নি। সেলসম্যানের চাকরি দিয়ে জীবন শুরু করলেও পরে পানির পাম্পের ব্যবসা করেছেন, হাতে টাকা এসেছে, আত্মীয়-স্বজনকে যখন চেয়েছেন করুণা করতে পেরেছেন।

মেয়েদের বিষয়ে তার বিপুল আগ্রহ ছিল। স্কুলে পড়ার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে সালেহা আর মল্লিকাকে দেখতেন, যদিও কোন মেয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস কোনোদিন তার ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বাজিমাত করেছেন। সালেহার ছোট বোন মালিহাকে বিয়ে করেছেন, সে সালেহার চেয়েও বেশি সুন্দর। অর্থাৎ শেষ বলে ছক্কা মেরে হারিস ম্যাচ জিতে নিয়েছেন। তাদের ছেলে অনিক ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, তাদের গালি-গালাজগুলোও কি সুন্দর ইংরেজিতে। সেও কয়দিন পর চলে যাবে বিদেশ – আর চিন্তা কি।

ছোটবেলা থেকে ঘোরাঘুরির শখ ছিল। ক্লাস সিক্সে থাকতে মাহবুবরা কক্সবাজার বেড়াতে গেলো, ফিরে এসে কত গল্প করলো। হারিস এগুলো শুনতেন, আর অন্যমনস্কতার কারণে রাস্তায় হোঁচট খেতে খেতে বাসায় ফিরতেন। পরে তো তিনি কক্সবাজারে মোটেল কিনে নিয়েছেন। সারা দেশে এমন কোন জায়গা নেই, যেখানে তার ভ্রমণ হয় নি।

এই পঞ্চাশ বছর বয়সে তার জীবনের সব পাওয়া হয়ে গেছে। যেসব বিষয় নিয়ে অভিজ্ঞতা পাওয়ার ইচ্ছা ছিল, সব জানা হয়ে গেছে। সুতরাং এখন একটা সিদ্ধান্তে আসার দরকার ছিল। ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকতেই তারকারা যেমন অবসর নিয়ে নেয়, তারও অবসর নেয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। লোকে বলে, প্রতিটি মানুষের দুইটা পরিণতির একটাকে বেছে নিতে হয় – অল্পবয়সে মৃত্যু, না হয় বার্ধক্যের কারাগারে বন্দি হয়ে অসুস্থ এক দীর্ঘ জীবন। প্রথমটাই হারিস বেছে নিয়েছিলেন, সাহসের সাথে। বিশেষ করে যখন তার চতুর্থ স্টেজে গলার ক্যান্সার ধরা পড়লো, তখন বছরের পর বছর ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকার বিষয়ে তার কোন আগ্রহই ছিল না। সুতরাং নিজেকে যন্ত্রনা থেকে বাঁচাতে তার ওই কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না।

সুতরাং – অনেক ভাবনা-চিন্তার পর – হারিস চৌধুরী নিজেকে নিজে গুলি করলেন, মস্তিষ্ক বরাবর।

হারিস নিশ্চিত ছিলেন, গুলিটা তার কপালের পাশ বরাবর মাথায় ঢুকে যাওয়ার সাথে সাথে সব অন্ধকার হয়ে যাবে। রিমোট কন্ট্রোল টিপে টিভি বন্ধ করলে যেমন স্ক্রিন কালো হয়ে যায়, সেভাবে হারিসও অস্তিত্বহীন হয়ে যাবেন মুহূর্তের ভেতর। কাঠমিস্ত্রি বাবাকে সারাজীবন হারিস কষ্ট করতে দেখেছেন, তিনি সেই একই ফাঁদে পা দেবেন না। জীবন থেকে সুখগুলো তার নেয়া হয়ে গেছে, এখন যখন দুঃখ আর বেদনা এসেছে তাদের পাওনা বুঝে নিতে তখন তিনি তাদের ফাঁকি দিয়ে চলে যাবেন। যেভাবে তিনি তার পাওনাদারদের ফাঁকি দেন, আইনি নোটিশ দিয়ে ব্যাংকগুলোকে পর্যন্ত ঝুলিয়ে দেন, ঠিক সেভাবে যন্ত্রনাগুলিকেও তিনি বুড়ো আঙ্গুল দেখাবেন। যন্ত্রনা হয় মানুষের মস্তিষ্কে, গুলি করে সেটা উড়িয়ে দিলে যন্ত্রনা আর আসবে কোথা থেকে!

এইসব ভেবেই অস্বাভাবিকরকম বুদ্ধিমান হারিস চৌধুরী নিজেকে নিজে গুলি করলেন, মস্তিষ্ক বরাবর।

কিন্তু একটা ছোট সমস্যা হলো। গুলিটা কপালের পাশে চামড়া পর্যন্ত আসতে কিছুটা সময় নিলো। যেটা এক সেকেন্ড কিংবা আধা সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে যাওয়ার কথা, সেটা ঘটতে তিন এমনকি হয়তো চার সেকেন্ড সময় লাগলো। আজব তো!

হারিস বসার ঘরের সোফায় বসে নিজের মাথায় গুলিটা চালিয়েছিলেন। ট্রিগার টেপার আগে তার চোখের সামনের বড় গোল সাদা দেয়ালঘড়িতে সেকেন্ডের কালো কাঁটাটা তখন রীতিমতো ছুটে চলছিল। কিন্তু তার জার্মান পিস্তলের নল থেকে গুলিটা বের হওয়া মাত্র কাঁটাটা ধীর হতে শুরু করলো। গুলিটা তার চামড়ায় স্পর্শ করে যখন কপালটা একটু উত্তপ্ত লাগছে, তখন সেকেন্ডের ওই কাঁটাটা চুয়ান্ন থেকে পঞ্চান্ন সেকেন্ডে যেতে প্রায় এক মিনিট সময় নিলো বলে তার মনে হলে। হচ্ছেটা কি এসব!

গুলিটা তার করোটি চুরমার করার জন্য যখন মাথার হাড় পর্যন্ত পৌঁছেছে, ততক্ষনে হারিসের মনে হলো অনন্তকাল কেটে গেছে। তার মনে হলো, যেন পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন কেয়ামতের ময়দানে শুধু বিচার শুরুরই অপেক্ষায়।

ঠিক ওই মুহূর্তটাতে একটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে গেলো হারিস চৌধুরীর মাথায় – হঠাৎ করেই, অতর্কিতভাবে। এমন কি হতে পারে, মৃত্যু মানে সময়ের থমকে যাওয়া? আতঙ্কে তিনি শিউরে উঠলেন – যদি তাই হয়, তাহলে তো গুলি যখন তার মস্তিষ্কে পৌঁছবে, তখন সময় স্থির দাঁড়িয়ে যাবে, আর মস্তিষ্ক ছিড়ে যাওয়ার ওই যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে তাকে অনন্তকাল। হায়, হায়, এ কি কাজ করেছেন তিনি !

এটাই তাহলে আত্মা, যা মৃত্যুর পরও যন্ত্রনা ভোগ করে, মৃত্যুর সময় যা আটকে যায় চেতনার এক কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর উল্লম্ব এক অনন্ত পতনে। কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে বলে অনন্ত আরেকজন মানুষ হারিস চৌধুরীর মনে হলো।

মাথার ভেতর দোজখের আগুনের মতো চরম সেই যন্ত্রনা শুরুর এক হাজার বছর আগে থেকে হারিস প্রার্থনা করতে শুরু করলেন – খোদা যেন কেয়ামতকে তাড়াতাড়ি করে দেন।

Leave a comment