মায়িন খান

পর্ব ১
নজরুল বেশী বয়সে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের সময় তার বয়স ছিল তেতাল্লিশ, রুমানার বয়স মাত্র পঁচিশ। সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে তার সুখী হবার কথা ছিল, রুমানাও খুব ভালো মেয়ে। কিন্তু কোন প্রাপ্তিই বোধহয় বিনিময় ছাড়া আসে না।
রুমানার খুব বড় একটা অসুখ আছে – সে রাতে ভীষণ ভয় পায়। অনেক মেয়েই রাতে ভয় পায়, কিন্তু রুমানার ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। এমনকি নজরুল নিজেও মাঝে মধ্যে দ্বিধায় পড়ে যান, এটা কি শুধুই তার ভয় নাকি সত্যি সত্যিই কোন ব্যাপার আছে এখানে। সত্যি কথা বলতে কি, এই মেয়েটার সাথে থাকতে শুরু করার পর তিনি নিজেও ভয় পাওয়া শুরু করেছেন – মাঝে মাঝে।
এই যেমন সেদিন নজরুল নিজে এক ভয়াবহ স্বপ্ন দেখে মাঝরাতে জেগে উঠলেন – খুব লম্বা ধরনের একটা লোক, গায়ে অসম্ভব শক্তি, তাকে বিছানা থেকে টেনে নামাচ্ছে, নজরুল প্রাণপনে চেষ্টা করছেন চাদর আকড়ে ধরতে কিন্তু পারছেন না। জেগে উঠে দেখেন তিনি ঘেমে নেয়ে গেছেন। কিন্তু সেটা আবার সকালে ভুলেই গিয়েছিলেন।
সকালে রুমানাকে গম্ভীর মুখে দেখে তিনি অভ্যাসবশত:ই জানতে চাইলেন, রাতে ঘুম ভালো হয়েছে কিনা – “কি, কাল রাতেও দু:স্বপ্ন দেখেছ?”
রুমানা মাথা নাড়াল।
“কি স্বপ্ন? ভৌতিক নাকি?” – মজা করে কথা বলে নজরুল বিষয়টা হালকা রাখার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু রুমানা যেটা বলল, তাতে নজরুল একেবারে চুপ হয়ে গেলেন – সে দেখেছে, একটা অস্বাভাবিক লম্বা ধরণের লোক, বিকৃত চেহারা, সে নজরুলকে বিছানা থেকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, নজরুল তার দিকে হাত বাড়াচ্ছে, কিন্তু রুমানা তাকে ছুঁতে পারছে না।
এরকম ঘটনা কিন্তু কয়েকবারই ঘটেছে। নজরুল জানেন, এটা কাকতালীয় ব্যাপার হতে পারে। এমনকি তিনি বা রুমানা যে একই ধরণের একটা লোককে বার বার স্বপ্নে দেখছেন, এটাও একটা কাকতালীয় ঘটনা হতেই পারে। হয়তো ওরা একই ধরণের কোন সিনেমা দেখেছিল – ভয়ের, দুজনের মনে সে সিনেমার ঘটনা একইভাবে দাগ কেটেছে, বা এরকম কিছু একটা।
অনেকেই তাকে বলেছে বাড়িটা ছেড়ে দিতে, কিন্তু তার মন একদম সায় দেয় না। এই বাড়িটা তিনি নিজে বানিয়েছেন, ঠিকাদারী ব্যবসাটা জমে ওঠার পর পর শখ করে বহু খরচ করেছেন এটার জন্য। কোন স্পষ্ট কারণ ছাড়া কিভাবে তিনি এ বাড়ি ছেড়ে দেন।
অনেকেই বলেছে, বাড়ির ছাদে রাতের বেলা একটা সাদা কাপড় পরা অল্পবয়সী মেয়েকে দেখেছে রেলিং-এর ওপর হাটতে – চুলখোলা, সাদা শাড়ীর আঁচল পায়ের নিচে গড়াচ্ছে। লোকজনের ধারণা, ওটা মৃত কোন মেয়ের অতৃপ্ত আত্মা। কিন্তু নজরুল নিজে তো কোনদিন এমন কিছু দেখেননি, তাহলে কিভাবে বিশ্বাস করেন ! সত্যি কথা বলতে কি – তিনি নিজে আজ পর্যন্ত এমন কিছু এ বাসায় দেখেননি, যা একেবারে কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু লোকের কথা তাতে থেমে থাকেনি।
এর সাথে যোগ হয়েছে রুমানার অসুস্থতা, মানুষ-জন এই বাসার অশুভ প্রভাবকেই যার মূল কারণ বলে বিশ্বাস করে। বিশেষ করে শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা তাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে – হুজুর দেখিয়ে বাড়ি বন্ধ করার জন্য, কিন্তু তিনি না বুঝে কোন কাজ করার লোক না।
এটা ঠিক, তিনি নিজেও মাঝে-মধ্যে ভয়াবহ সব স্বপ্ন দেখেন – যেমন সেদিন দেখলেন, আবার সেটা হুবহু মিলে গেলো রুমানার স্বপ্নের সাথে – কিন্তু এটা কি অসম্ভব যে, রুমানার কথা শুনতে শুনতে তিনি নিজেও মনের অজান্তে ভয় পাওয়া শুরু করেছেন, যার ফলশ্রুতি এসব স্বপ্ন! আর তাছাড়া স্বপ্ন তো স্বপ্নই, স্বপ্ন তো আর তার কোর ক্ষতি করতে পারছে না !
কিন্তু রুমানার ভয়ের মাত্রাটা দিন দিন বেড়েই চলেছে, সেই সাথে তার স্বাস্থ্যও খারাপ হচ্ছে। রুমানাকে নিয়ে নজরুলের দুশ্চিন্তা তাই রয়েই যায়।
কেউ কেউ তাকে বলেছে, সুন্দরী মেয়েদের এরকম সমস্যা হওয়া বিচিত্র না। গ্রামদেশে এগুলোকে বলে খারাপ বাতাস, যাদের আকর্ষণ থাকে অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়েদের প্রতি। এগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া নাকি সহজ না – ঝাড়-ফুঁক করতে হয়, খোলা মাঠে নিয়ে ঝাড়তে হয়, ইত্যাদি। কিন্তু নজরুলের মন কেন যেন এসব নাটকীয়তায় সায় দেয়নি।
তার শ্বাশুড়ী আনোয়ারা বেগম তো একদিন তাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলেছেনই – এগুলো যাদু-টোনার লক্ষণ, সে যেন একজন ভালো পীর-ফকির দেখায়। নজরুল মন দিয়ে শ্বাশুড়ীর কথা শুনেছেন, বলে এসেছেন যে তিনি অবশ্যই এরকম কারো কাছে যাবেন, কিন্তু পরে নানা কাজের চাপে ভুলে গেছেন। পরে আনোয়ারা নিজেই মেয়েকে নিয়ে স্থানীয় এক পীর সাহেবের কাছে গেছেন, এখনো প্রায়ই যান।
তাতে যে অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয় নি, এতে নজরুল মোটেও বিস্মিত নন। লেখাপড়া ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত হলেও নজরুল ছোটবেলা থেকেই বেশ যুক্তিবাদী। নিজে চেষ্টা করে ব্যবসাটা এতদূর এনেছেন, এটাও এ কারণে যে – তিনি নিজের বুদ্ধিতে কাজ করে অভ্যস্ত। নজরুলের নিজের ধারণা, এটা কোন জটিল মানসিক রোগের কেস। তিনি শুনেছেন এরকম ঘটনার কথা তার ডাক্তার বন্ধুদের কাছে।
কয়েকদিন আগে ঢাকায় তার এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে এ নিয়ে তিনি আলাপও করেছেন। তিনি এটার জন্য টাকা-পয়সা যা দরকার খরচ করবেন। সেই ডাক্তার ভদ্রলোক তার স্কুল জীবনের খুব ভালো বন্ধু, এলাকারই ছেলে – তাকে বলেছেন একটা উপায় বের করে দেবেন।
নজরুল বন্ধুর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছেন।
পর্ব ২
রাফিজ চমকে জেগে উঠল। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে।
অনেকদিন পর সে এধরণের স্বপ্ন দেখল, ওষুধের ডোজ অ্যাডজাস্টটা বোধহয় ঠিকমত হয়নি।
যাক, তারপরও তো সেই স্কুলের দিনগুলোর চেয়ে এ অনেক ভালো। কি ভয়াবহ সব দিনই না ছিল সেগুলো !
অবশ্য সেসব এখন দূর অতীতের কথা, ওসবের পর বহুদিন কেটে গেছে। রাফিজ সেই আমলে মানসিক ডাক্তার দেখিয়েছে, ইন্ডিয়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন তার বাবা। তারপর রাফিজ তার এপিসোডগুলোর সাথে মানিয়ে নেয়া শিখেছে, অনেক দূর লেখাপড়াও করেছে – পুরোনো ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাশ করেছে, কাকতালীয়ভাবে মনোবিজ্ঞানেই পড়েছে। সে অনেক কিছু জেনেছে, নিজের অতীতের সাথে মিলিয়ে দেখেছে। কিছু কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা খুব সহজেই করতে পেরেছে, যদিও আরো কিছু ঘটনা রয়ে গেছে নিতান্তই তার বুদ্ধির বাইরে।
রাফিজ ভালো করে চোখ খুলে তাকাল, পূবদিকের জানলা দিয়ে কড়া রোদ আসতে শুরু করেছে। সে উঠে বসল। কিন্তু বসেই টের পেল তার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে, ভীষণ ভারী হয়ে আছে মাথাটা। সে উঠে পড়ে টেবিলের ড্রয়ার হাতড়াতে লাগল প্যারাসিটামলের জন্য। ওষুধের একটা পাতা পাওয়াও গেল, কিন্তু সেটায় মাত্র একটা ট্যাবলেট আছে। রাফিজ এক গ্লাস পানির সাথে সেটাই খেয়ে নিল, তারপর বাতাসের জন্য সামনের জানালাটা খুলে দিল।
এ চিলেকোঠার বাসাটা রাফিজের খুব পছন্দের। অবশ্য বাসা না বলে একে রুম বলাই ভালো, বিদেশে এধরনের রুমগুলোকেই আরেকটু বড় করে বানিয়ে ওরা নাম দেয় স্টুডিও।
তিনতলা বাসার ওপরে এই অর্ধেক অসম্পূর্ণ ফ্ল্যাটটা আসলে বানানো হয়েছিল ছাদে একটা অতিরিক্ত ঘর হিসেবে ব্যবহারের জন্য, হয়তো বিশেষ কারো কথা চিন্তা করে। তবে মনে হয়, শেষ পর্যন্ত চিন্তাটা টেকেনি। বহুদিন এটা খালি পড়ে ছিল, পরে রাফিজ এসে ভাড়া নেয়।
দক্ষিণ দিকটায় খোলা একটু জায়গা আছে, রাফিজের কাছে উঠোনের মত মনে হয়। কয়েকটা টব আছে এখানে, কে এনেছিল কে জানে – এখন রাফিজ নিজেই এগুলোর যত্ন করে, পানি দেয়, ঝরা পাতা পরিষ্কার করে। প্রায় সারা বছর মৌসুমী বাতাসে ভরে থাকে জায়গাটা।
একটাই সমস্যা, দুপুরের গরম। মধ্যদিনের রোদ যখন সরাসরি ছাদে এসে পড়ে, চুল্লির মত গরম হয়ে যায় রুমটা। প্রথম প্রথম এ নিয়ে খুব ভুগেছে রাফিজ। পরে অবশ্য সে নিজ উদ্যোগে বেশ কিছু ছোট-বড় টব এনে বসিয়েছে ছাদে – একটু ছায়ার জন্য। তারপর থেকে এখন গরম একটু সহনীয় বলেই মনে হয়।
তবে গরমটা বছরের দুটো সময় মিলে মোট চার-পাঁচ সপ্তাহই তো ভোগায় – দু সপ্তাহ বৈশাখের শেষে, আর দু সপ্তাহ ভাদ্রমাসের মাঝামাঝি। অন্য সময় বৃষ্টি-বাদল মিলে তাপ খুব একটা বেশি হয় না। শীতের আগে আগে আর বসন্তের প্রথম দিকটা তো রাফিজের কাছে স্বর্গীয় বলেই মনে হয়, চমৎকার নীল আকাশ দেখে দেখে যেন সময় কেটে যায় ।
ও যে বাড়িটায় আছে, তার সামনের প্লটটা ফাঁকা পড়ে আছে, এর মালিক বিদেশে থাকে – সেটলড, কোনদিন আসবে বলে মনে হয় না। কেয়ারটেকার একজন থাকে একটা ঘর করে। সে আবার এটার ভেতর একটা ছোটখাট নার্সারী বানিয়েছে। বিকেলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নার্সারীর সবুজ দেখতে মন্দ লাগেনা – কাঠখোট্টা বাক্সবাড়ীগুলোর মাঝে এক চিলতে মুক্তি যেন ওটা। এছাড়া দুটো বড় আমগাছ আর সার বেধে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কিছু নারকেল গাছ আছে প্লটটায়।
বৃষ্টির ভেতর গাছগুলো দেখতে অসাধারণ লাগে রাফিজের। সে বৃষ্টিতে ভেজে প্রায়ই, একা একা – ওর তখন মনে হতে থাকে, বৃষ্টির সাথে তার অস্তিত্ব ধুয়ে ধুয়ে মিশে যাচ্ছে ছাদের ফ্লোরের সাথে। কোন কোন রাতে খুব বৃষ্টি হলে মিলার কথাও মনে পড়ে – মাঝে মাঝে। মেয়েগুলো সবই বোধহয় হিপোক্র্যাট।
এ ঘরটায় রাফিজ তিন বছরের বেশি সময় ধরে আছে। সময়টা চমৎকার কেটেছে তার। তার সিংগেল খাটের পাশে পূবদিকে যে জানালাটা, সেটা দিয়ে চমৎকার একচিলতে আকাশ দেখা যায়। রাফিজ অলস দুপুরগুলো বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখে দেখেই কাটিয়ে দিতে পারে। মাঝে মাঝে বিষন্নতা আর দুঃস্বপ্নের এপিসোডগুলো ছাড়া অবশ্য। সেগুলো অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের প্রসংগ।
মিলার চলে যাওয়ার সাথে অবশ্য এসব এপিসোডের কোন সম্পর্ক নেই। এই এপিসোডগুলো রাফিজের আজীবনেরই সংগী।
মিলা ছিল অসাধারণ একটি মেয়ে, স্বপ্নের মত সুন্দর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওদের মিল হল না। এটা সেই ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলোর একটা – যেখানে দুজন ভালো লোক একসাথে থাকতে পারে না শুধুমাত্র মতের অমিলের কারণে। রাফিজ চেয়েছিল একটি নিরিবিলি জীবন, নিজের মত, হয়তো কিছুটা সৃষ্টিশীল। মিলা চমৎকার একটি মেয়ে, কিন্তু সে ব্যতিক্রম হতে পারে নি – সে রাফিজকে পার্থিব যে প্রতিযোগিতার মধ্যে দেখতে চেয়েছিল, রাফিজ সম্ভবত কোনদিনই সে মাইলফলক ছুঁতে পারতো না। সে সৃষ্টিশীল হতে পারে, কিন্তু বাজার অর্থনীতির নিয়মগুলো মেনে প্রতিযোগিতা করার মত কোনদিনই বোধ হয় ছিল না।
সে যখন প্রথম এখানে এসে ওঠে, তখন পর্যন্তও মিলার সাথে তার যোগাযোগ ছিল। মিলা সুন্দরী এক আশ্বিনের বিকেলে এ বাসাটায় এসেছিলও। সেসব অবশ্য এখন দুর অতীত।
রাফিজ মাস দুয়েকের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছে। এখানে ওঠার পর এটাই প্রথম এতো লম্বা সময়ের জন্য তার বাসা ছেড়ে বাইরে যাওয়া। কিন্তু এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশনের মত। তাছাড়া এতদিন সে ছিল একজন এমফিলের ছাত্র, আর এখন সে বলতে গেলে একটা চাকরী শুরু করেছে। সে যদিও কোন কিছুতে বাঁধা থাকতে চায় না, কিন্তু বেঁচে থাকতে হলে কিছু না কিছু তো করতেই হবে।
যতদূর বোঝা গেছে, একটা পরিবারের সাথে এ কয়টা মাস থাকতে হবে। ওর জানামতে আজ পর্যন্ত কোন ডায়াগনোসিস হয়নি – সম্ভবত: কেসটা জটিল, এমনকি পরিবারের একাধিক সদস্য সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে। রাফিজ অনেক কেস স্টাডি পড়েছে, যেখানে পুরো পরিবার স্কিজোফ্রেনিয়ায় ভুগেছে। এগুলি অত্যন্ত জটিল কেস হয়ে থাকে সাধারণত।
কিন্তু মান্নান সাহেব রাফিজকেই কেন বেছে নিলেন, সেটাও একটা প্রশ্ন। এর একটা ব্যাখ্যা অবশ্য রাফিজ বের করেছে – সদ্য কাজ শুরু করেছে এমন লোক ছাড়া কেউই একটানা এতটা সময় ঢাকার বাইরে গিয়ে থাকতে রাজী হবে না। অন্যদিকে প্রোফেসর মান্নান রাফিজের সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, তার কাজের ধরণ সম্পর্কে জানেন।
রাফিজের অবশ্য কোন অসুবিধা নেই। সে বরং এরকম নিরিবিলি কাজই পছন্দ করে। আর কেসটা নিয়ে সে কিছুটা উত্তেজনাও বোধ করছে। সে কিছু বই-খাতা আর অল্প কিছু কাপড়-চোপড় বের করে হ্যান্ড ব্যাগটা গোছানোয় মন দিল।
পর্ব ৩
গেটট আলতো করে খোলা, আনোয়ারা আস্তে করে টোকা দিয়ে গেটটা আরেকটু ফাঁক করলেন। তখন ভেতরে মাঠটা দেখা গেল – একদল নারী-পুরুষ প্লাস্টিকের চেয়ারে লাইন ধরে বসে আছে। এদের অনেককেই আনোয়ারা আগে দেখেছেন, এরা নিয়মিত এখানে আসে।
আনোয়ারাও এখন বলতে গেলে নিয়মিতই এখানে আসেন। মেয়েকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। বিয়ের আগে যে এগুলো ছিল না, তা না। কিন্তু বিয়ের পর এসব সমস্যা যেন হু হু করে বেড়ে গেছে – এক সমস্যার সাথে যোগ হয়েছে আরেক সমস্যা। এসব থেকে বাঁচার জন্যই মেয়েকে অল্পবয়সে বিয়ে দিয়েছেন, তাড়াহুড়োর মধ্যে বিয়ে দিয়েছেন প্রায় দ্বিগুন বয়সের এক লোকের সাথে – কিন্তু আফসোস, কোন সমাধানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নজরুল অবশ্য লোক খারাপ না, এলাকায় সবাই তাকে সম্মান করে। কিন্তু লোকটা একটু গোয়ার ধরণের – ধর্ম-টর্মেরও তেমন একটা তোয়াক্কা করে না, নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করে।
আজকালকার মানুষ এগুলি বিশ্বাস না করতে পারে, কিন্তু এসব তো আর মিথ্যা নয়। আমাদের নবীজীকেও যাদু করা হয়েছিল, যাদু করেছিল এক ইহুদী মহিলা। এ ঘটনার কথা কে না জানে! পরে সূরা পরে দম দিয়ে দিয়ে যাদু থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন নবীজী। খোদা তায়ালার নবীকে যদি শত্রুরা যাদু করতে পারে, তাহলে তার এই এতটুকুন মেয়ে তো কোন ছাড় !
তাই তিনি কোন অবহেলা করেননি, ঘটনা জানার পর পরই মেয়েকে নিয়ে আসা শুরু করেছেন এই পীর সাহেবের কাছে। ভদ্রলোকের প্রচুর সুনাম করে সবাই, তার তদবিরে নাকি কাজ হয়। উনার বাবাও কামেল পীর ছিলেন, মৃত্যুর আগে খিলাফত দিয়ে যান পীরজাদাকে। ছেলে মৌলভী ছিলনা – ফ্যাশান করত, সিনেমা দেখতে যেত বন্ধুদের সাথে। তবে পীর সাহেবের মৃত্যুর পর উনি বদলে যান।
পীর সাহেবের মৃত্যু নিয়ে একটা জনশ্রুতি আছে – তিনি নাকি এক সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়েছিলেন, শরীর বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন, তখন তার প্রতিপক্ষ অশুভ শক্তি তাকে কব্জা করে ফেলে। তার মুরীদরা টের পাবার সাথে সাথে তাকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে আসে, কিন্তু তিনি সেই যে অসুস্থ হন আর সেরে উঠতে পারেননি। ঘটনার একমাসের মধ্যে তার মৃত্যু হয়।
পীরজাদা কবীর সাহেবের বয়স কম, কিন্তু তার জ্ঞানের গভীরতা আনোয়ারাকে মুগ্ধ করে। কেমন করে যেন ভদ্রলোক তার মনের কথাগুলো জেনে যান, তিনি কিছু বলার আগেই কি করতে হবে তা বলতে শুরু করেন। আর কথা-বার্তাও কি চমৎকার আর শালীন – সবসময় আনোয়ারাকে মা বলে সম্বোধন করেন, রুমানাকে বোন বলেন। পর্দা করে চলতে বলেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে বলেন, খোদার ওপর ভরসা করতে বলেন।
আনোয়ারার আরো ভালো লাগে ভদ্রলোকের বিনয়। এতো সম্মানিত লোক, কিন্তু কোন অহংকার নেই। সবসময় বলেন – আমি সামান্য লোক, সমাধানের গ্যারান্টি দিতে পারব না, সমাধানের মালিক তো ওই উপরে, কিন্তু আমার বোনের জন্য আমি খোদা তায়ালার কাছে খাস করে দোয়া করব।
তিনি এমনকি কোন ভিসিটও নেন না। তবে বড়লোক মুরীদদের বলে দেন তার পরিচিত গরীব মুরীদদের এটা-ওটা দিয়ে সাহায্য করতে। নিজে কিছুই নেন না। আনোয়ারা মাঝে মধ্যে আশ্চর্য হয়ে ভাবেন এই আলীশান মহল আর এই জাকজমকপূর্ণ জীবন পীরজাদা কিভাবে চালান। সম্ভবত সম্পত্তি থেকে প্রচুর আয় আছে ভদ্রলোকের। কিন্তু এসব নিয়ে বেশী ভাবতেও সংকোচ বোধ করেন – কিজানি, কোনভাবে যদি উনি টের পেয়ে যান !
রুমানাকে নিয়ে আনোয়ারা ভেতরে গিয়ে বসলেন। এই নিয়ে বহুবার এসেছেন তিনি এখানে। কিন্তু আশ্চর্য, আজ পর্যন্ত সাবলীল হতে পারেননি। প্রতিবার গেট দিয়ে ঢোকামাত্র কি একটা অদ্ভুত সংকোচ ধরণের অনুভূতি কাজ করতে থাকে তার ভেতর। অবশ্য এ নিয়ে তেমন চিন্তিত নন তিনি, একজন পীরের এটুক মর্তবা থাকতেই পারে।
রুমানা আস্তে করে বলল – “উনি না আগামী মাসে আসতে বলেছিলেন! কয়দিন যেতে না যেতেই যে আমরা চলে এলাম!”
আনোয়ারা মেয়ের দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন ভয়াবহ ছেলেমানুষী একটা কথা বলেছে মেয়েটা। শেষপর্যন্ত বললেন – “ডাক্তার তো ডেট দিবেই, কিন্তু ইমারজেন্সি হলে হাসপাতালে যেতে হবে না?”
“আমারতো তেমন সমস্যা হচ্ছিল না।” – মেয়েটা বলে।
“সমস্যা হচ্ছিল না মানে? রাতের পর রাত না ঘুমাতে না ঘুমাতে চেহারা কি হয়েছে, আয়নায় দেখেছিস! নাতি-পুতির কথা বাদই দিলাম, সে আশা তো আজকাল ছেড়েই দিয়েছি! জান নিয়ে টানাটানি – আর সে বলে, তার সমস্যা হচ্ছেনা!”
“ও তো বলে, এসব কিছু না।” – স্বামী নজরুলকে ইঙ্গিত করার জন্য রুমানা বললো।
আনোয়ারা আরো বিরক্ত হলেন – “ওই লোক তো আরেক সমস্যা, ও এসবের কি বুঝে!”
রুমানা চুপ হয়ে গেল।
“তাছাড়া পুরুষমানুষ এসব কতদিন সহ্য করবে, সেটাও একটা কথা। আমার তো সেটা নিয়েও চিন্তার শেষ নেই।”
“না মা, সে ওরকম না।” – রুমানা মিন মিন করে বলে।
আনোয়ারার বিরক্তি যেন আরো বেড়ে যায় – “সে ওরকম না মানে? সে কি মহাপুরুষ? পুরুষ মানুষকে চেনো না তো? ঘটনা ঘটলে তখন বুঝবে।”
রুমানা মাথা নিচু করে ফেলে, যেন খুব লজ্জা পেয়েছে। তার মনটাই খারাপ হয়ে যায়। এখানে একটা তথ্যের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে, ফলে মা নজরুলকে ভুল বুঝছে। কিন্তু সে ঘাটতিটা কিভাবে মেটানো যায়, সেটাও তার মাথায় এলো না।
ঠিক ঐ মুহূর্তেই ওদের ডাক এলো, পীরজাদা তাদের সালাম জানিয়েছেন। আনোয়ারা চটপট উঠে দাঁড়িয়ে
ঘোমটাটা একটু টেনে নিলেন। রুমানাও মায়ের দেখাদেখি উঠে দাঁড়াল।
পীরজাদা কবীর আহমেদ জালাল একটা তাকিয়ার ওপর বসে ছিলেন। আজ তিনি আপাদমস্তক কালো পোশাক পরেছেন, প্রায়ই পরেন। ভদ্রলোকের লম্বা-চওড়া গড়ন শরীরের, যেকোন পোশাকে রাজকীয় লাগে দেখতে।
আনোয়ারাকে দেখা মাত্র নিজে উঠে এসে পাশের মাদুরে বসালেন হাত ধরে। বেশ আন্তরিক ভংগীতেই বললেন – “কেমন আছেন আপনি, মা?”
আনোয়ারার ভেতরটা পর্যন্ত শীতল হয়ে গেল। ধরা গলায় বললেন – “আমি তো ভালোই আছি, চিন্তা তো আমার এই মেয়েটাকে নিয়ে।”
তার প্রসংগ আসামাত্র রুমানা আরেকটু জড়োসড়ো হয়ে বসল।
“আমার বোনের আবার কি সমস্যা? সমস্যার সমাধান তো হয়ে যাবার কথা।” – হেসে বললেন পীরজাদা।
“না, বলছিলাম কি, এখনো তো স্বপ্ন দেখে ভয় পায়, সারারাত জেগে থাকে, দেখেন না স্বাস্থ্যের কি অবস্থা!”
পীরজাদা স্মিত হাসলেন – “স্বপ্ন তো কিছু না, যারা ক্ষতি করতে চায় তারা ক্ষতি করতে পারছেনা, তাই এখন স্বপ্নে দেখা দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। ও কিছু না, এভাবে কোনকিছু করতে পারবে না।”
“সত্যি?” – আনোয়ারার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল পীরজাদার কথাগুলো।
“অবশ্যই। যে আমলগুলো দিয়েছিলাম, ওগুলো করছেন তো নিয়মিত?”
“হ্যাঁ, ওগুলোতো করছেই।”
“তাহলে চিন্তার কিছু নেই, মা। আমার বোনকে কেউ ক্ষতি করতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ। তবে আমি কোন গ্যারান্টি দিতে পারি না, আপনি জানেন। সব ক্ষমতার মালিক আল্লাহ তায়ালা। একমাত্র তিনি যদি কাউকে অনুমতি দেন, সে এটা পারবে।”
আনোয়ারা একটু দ্বিধা নিয়ে তাকান তার দিকে।
পীরজাদা কবীর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে চালান করে দেন, তারপর শুরু করেন তার বক্তব্য:
“কিছু মনে করবেন না মা, আপনার সাথে লুকোচুরি নেই। সবকিছু ছেড়েছি, এই একটা ছাড়তে পারলাম না। খোদার সামনে যদি লজ্জা না পাই, মানুষের সামনে লজ্জা করে কি লাভ?”
আনোয়ারা পীরজাদার এ অভ্যাসের কথা জানেন। তার আরেক মুরীদ একদিন আনোয়ারাকে বলেছিল, ভদ্রলোক নিজেকে সামান্য প্রমাণের জন্য এটা করেন।
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে কবীর সাহেব বলতে শুরু করলেন – “শোনেন মা, জীন পরী এসব তো মানেন? এসব তো আর মিথ্যা না। কোরান শরীফে সরাসরি এদের কথা এসেছে। সুতরাং এসব যে আছে, এটা নিশ্চিত। এখন প্রশ্ন হল – এরা থাকে কোথায়, কিভাবে সমস্যা করে বনী আদমকে। আমি আপনাকে বলি – এরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সবখানে, সবখানে না থাকলে ইনসানকে খারাপ কাজের অসঅসা দেয় কিভাবে? এরা চাইলে আপনার শিরায় শিরায় ঘুরে বেড়াতে পারে।
এখন আপনি বলবেন, তাহলে এর থেকে মুক্তির কি উপায়? আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি, মা, আপনি শুনে রাখেন। বোনজি, তুমিও ভালো করে শুনো – এর থেকে মুক্তির জন্য আলাদাভাবে আসলে কোন চেষ্টারই দরকার নেই। এরা হল ভাইরাসের মত, বাতাসে অবাধে ঘুরে বেড়ায়। ভাইরাসের ক্ষেত্রে কি হয় – শরীরের ভেতর যে রোগপ্রতিরোধক্ষমতা আছে, সেটাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাসের হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়ে দেয়। একইভাবে খোদা আমাদের যে মনের জোর দিয়েছেন, বেশির ভাগ জীন-পরীই পারে না সেই শক্তিকে হারিয়ে দিয়ে মনের ওপর প্রভাব ফেলতে। স্বাভাবিক একজন মানুষের মধ্যে সাধারণত এই শক্তিটা থাকে, ফলে জীনরা তাকে ভুল জিনিস দেখাতে পারেনা।
কিন্তু অন্যদিকে বলতে গেলে – দুর্বল শরীরকে যেমন সহজে জীবানু আক্রমণ করে, বার বার সে শরীর দেখা যায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে, একইভাবে দুর্বল মনকেও জীন-পরী সহজে ধরাশায়ী করে ফেলে। ধরাশায়ী করে তারপর তারা উল্টাপাল্টা জিনিস দেখায়। তবে সত্যি সত্যিই শারিরীকভাবে ক্ষতি করার ঘটনা কমই পাওয়া যায়। আর মেয়েরা সাধারণত মনের দিক দিয়ে দুর্বল হয়, মেয়েলি ছেলেরাও তাই। কিংবা যারা মনে করেন মানসিক প্রতিবন্ধী তাদেরকেও এরা সহজে ঘায়েল করে ফেলে। ফলে এসব শ্রেনীর মধ্যে জীনের আসর বেশি দেখা যায়।
তবে চিন্তার কিছু নেই। ভাইরাস আক্রমন করলে যেমন ডাক্তারের কাছে যান, ঐরকম আসর হলে আমার কাছে আসবেন। একজন হাক্কানী আলেম আদম সন্তানদের রূহের জন্য তো বলতে গেলে ডাক্তারের কাজই করেন, তাই না!”
কবীর সাহেব একটু থামলেন – তার হাতের সিগারেটটা ততক্ষণে শেষ হয়ে এসেছে।
“তবে স্বপ্নের ঘোর যাতে কমে, সেজন্য আমি কিছু তদবির দিচ্ছি। কিন্তু মনে রাখবেন, এসব চেষ্টা মাত্র। আল্লাহ যেদিন চাইবেন, সেদিনই সমস্যার সমাধান হবে।”
আনোয়ারা কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেন, কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারলেন না। অবশ্য এটাই কবীর সাহেবের চিকিৎসার ধরণ, কাজেই এখানে তার আর কিছু বলার নেই।
পীরজাদা হয়তো আনোয়ারার মনের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন, বললেন – “মা, আপনার দুশ্চিন্তা বোধহয় কাটেনি।”
আনোয়ারা দ্বিধা নিয়ে বললেন – “অনেকে যে তাহলে বলে, এরা হিংস্র পশুর মত, কোন কারণ ছাড়াই ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে !”
পীরজাদা স্মিত হাসলেন – “হিংস্র জিনিসও আছে এদের মধ্যে এটা সত্যি, কিন্তু সেগুলোতো মা খুব রেয়ার ঘটনা। বাঘ থাকে সুন্দরবনে, আপনি লোকালয়ে কখনো বাঘ দেখেছেন ! দেখেছেন কখনো ! তাহলে ?”
আনোয়ারা মেয়েকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। পীরজাদা তাদের সাথে এলেন দরজা পর্যন্ত, প্রতিবারই আসেন। আনোয়ারা একটু অস্বস্তিই বোধ করেন, কারণ আর কারো সাথে পীরজাদা দরজা পর্যন্ত আসেন না। অবশ্য তাঁর এক খাস মুরীদের কাছে আনোয়ারা শুনেছেন, পীরজাদা কবীর সাহেব তাঁকে আলাদারকম শ্রদ্ধা করেন, মায়ের মত দেখেন।
কিন্তু আনোয়ারা ভেতরে ভেতরে অধৈর্য হয়ে উঠছেন আজকাল – তার ভেতরে ধীরে ধীরে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠছে যে, এই পীরজাদার তদবির রুমানার তেমন কাজে আসছে না।
আনোয়ারা সতর্কভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন – উনার কাছে এসে যদি কাজ না হয়, দরকার হলে তিনি আরো ভালো কোন পীরের কাছে যাবেন।
৪.
পুরাতন রেলস্টেশনটার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থেকে রাফিজ বিচিত্র সব কল্পনায় বারবার হারিয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল। স্টেশনের পূবদিকের হলদেটে দেয়ালে শেষ দুপুরের কড়া রোদ ঝকমক করছে। একপাশে মরচেধরা কিছু রেলবগী বিষন্ন একাকী দাড়িয়ে আছে। প্রচন্ড রোদ দুপুরের শহরের ভেতর এক ধরণের নীরব বিভ্রম তৈরী করছিল।
দুপুর তিনটার মধ্যে সে নজরুলদের বাসার গেটে এসে উপস্থিত হল। একজন বয়স্ক লোক গেট খুলে দিল, তারপর তার ব্যাগ দুটো তুলে নিল। সম্ভবত লোকটা তার আসার অপেক্ষাতেই ছিল। লোকটা তাকে একটা বড় ঘরে নিয়ে বসাল। নজরুল বের হয়ে এলেন কিছুক্ষণ পর।
“সরি, আমি স্টেশনে যেতে পারিনি, একটা কাজ পরে গেল। আমি নজরুল।” – তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন। লোকটার শরীরটা ষণ্ডা-মার্কা, কিন্তু তার চেহারাটা নমনীয়, তার চোখে মায়ার একটা ছায়া আছে কোথায় যেন।
“আমার অসুবিধা হয়নি, আর হলে তো আপনার নাম্বার ছিলই।” – রাফিজ হাত মেলাল।
“তা অবশ্য ঠিক – নজরুল বললেন – আচ্ছা, কথা পরে হবে। এখন আপনার রুমটা দেখাই। আপাতত: ফ্রেশ হয়ে নেন।” – তিনি এগোলেন, পেছন পেছন রাফিজ।
রুম দেখে রাফিজের খুব পছন্দ হল। অন্ধকার ধরণের একটা রুম, বেশিরভাগ লোকই পছন্দ করবেনা – কিন্তু কাকতালীয়ভাবে এ ধরনের ঘরই রাফিজের পছন্দ, বেশি আলোয় তার চোখ জ্বালা করে। বাড়িটা আসলে দোতলা। নজরুল ছাদে কয়েকটা রুম বানিয়ে নিয়েছেন মেস হিসেবে ভাড়া দেবার জন্য। এগুলো এমনভাবে বানানো যে, ইচ্ছে করলে কয়েকজন ব্যাচেলর একসাথে থাকতে পারে, আবার ইচ্ছে করলে আলাদা আলাদাভাবেও থাকতে পারে। দক্ষিণদিকের খোলা বারান্দাটাও রাফিজের বেশ লাগল, এখান থেকে দূরে বড় খেলার মাঠটা দেখা যায়।
“এ দরজাটা কোন ঘরের?” – রাফিজ একপাশের একটা দরজা দেখাল – দুইটা বাথরুম নাকি।
নজরুল ছাদের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছিলেন, মনে হল রাফিজের কথাটা তিনি শুনতে পাননি।
“নজরুল সাহেব, এ দরজাটার কথা জিজ্ঞেস করছিলাম।”
নজরুল চমকে ফিরে তাকালেন, তারপর রাফিজের দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজাটার দিকে তাকালেন –
“ও এটা? ঐপাশে আরেকটা ঘর আছে, এই দুইটা ঘর ভাড়া দিয়েছিলাম।”
রাফিজ দরজাটার দিকে এগুলো। সে হয়তো খুলে দেখত, কিন্তু নজরুল তার হাত ধরে ফেললেন – ঐটা অন্য ঘর।
“ওহো, সরি।” – রাফিজ সরে এলো।
“অবশ্য ঐদিক থেকেও বন্ধ থাকার কথা।”
“তাহলে এপাশ থেকেও বন্ধ করে দিই।” – রাজিজ দরজার পেট বরাবর ছিটকিনিটা আটকে দিতে গিয়ে দেখলো, ওটাতে জং পড়ে গেছে – এজন্য আটকাতে গিয়ে বেজে যাচ্ছে।
নজরুল হাসলেন – “গত কয়েকমাস ধরে অবশ্য ঐদিকে কেউ নেই।”
“কয়টা রুম আছে এখানে?”
“দুইটা বড় রুম আছে, আপনার এটা আর পাশেরটা। আরেকটা বেশ ছোট, তবে অনেক সময় অনেকে এরকম রুম খোঁজে। আচ্ছা, আপনি আপাতত ফ্রেশ হন, তারপর নিচে দেখা হবে, দুপুরে খাওয়ার সময়। আপনি কিন্তু আমাদের সাথেই খাওয়া-দাওয়া করবেন।”
“আমি কিন্তু বাইরে খাওয়া-দাওয়ার প্ল্যান নিয়েই এসেছি।” – রাফিজ বলে।
নজরুল হাসলেন – “এখানে বাইরে খেয়ে আরাম পাবেন না, ছোট শহর তো। আর সময়-অসময় আপনি বাইরে যাবেন খেতে, কি দরকার এসব ঝামেলার। প্লীজ এটাকে নিজের বাসা মনে করবেন।”
রাফিজ অল্প হাসল, নজরুল বয়স্ক লোকটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
রাফিজ দরজা বন্ধ করে ব্যাগ নিয়ে বসল। ঘরে একটা সিংগেল খাট, একটা পুরনো সোফা আর একটা কাঠের আলমারী আছে। জানলার পাশে পুরনো টেবিল আর চেয়ার। পাশে ছোট একটা বাথরুম। রাফিজ ব্যাগ থেকে বই-খাতাগুলো বের করতে শুরু করল।
কাপড়গুলো আলমারীতে তুলে রেখেই সে তার নোটবইটা নিয়ে বসল। এখানে আসতে আসতে সে কেসটা নিয়ে কিছু চিন্তা-ভাবনা করেছে, সেগুলি লিখে ফেলা দরকার।
মান্নান সাহেবের সাবেক সহকর্মী সে ভদ্রলোক যেসব তথ্য দিয়েছিল, তাতে মোটামুটি বোঝা যায় – আসল সমস্যা ভদ্রমহিলাকে নিয়ে, মহিলা কিছু দেখেন এবং ভয় পান। ক্ল্যাসিক স্কিজোফ্রেনিয়ার কেস হবার সম্ভাবনাই বেশি, কিন্তু রোগের পুরো ইতিহাস ভালো করে জানতে হবে।
তবে নজরুল সাহেবকেও ভালো করে জানতে হবে – এ ভদ্রলোকের ব্যাপারটা পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। তিনি নিজে কখনো ভয় পেয়েছেন কিনা, সেটা জানতে হবে। কোন সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেয়া যাবে না। তবে প্রথমে সবগুলো সম্ভাবনাগুলোকে লিখে ফেলতে হবে, তারপর তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে একটা একটা করে সম্ভাবনাকে বাতিল করতে হবে। সবশেষে যে সম্ভাবনাটা টিকে থাকবে, সেটাই হবে তার ডায়াগনোসিস – নির্ণীত রোগ।
কিন্তু সে বুঝতে পারছে না, এটার জন্য দেড়-দুই মাস সময় কেন লাগবে। তার নিজের ধারণা, এখানে এমন কোন তথ্য আছে – যা এরা ঠিকভাবে জানায়নি, বা এমন কোন ঘটনা যার গুরুত্ব এরা ধরতে পারছেনা।
তবে এখন তার প্রথম কাজ হল এ বাসার সবার সাথে অন্তত: একবার করে কথা বলা। সম্ভব হলে আশে-পাশের লোকজন বা পাড়া-প্রতিবেশীর সাথেও কথা বলতে হবে। এমন কিছু জানা যেতে পারে, যা পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে তার ধারণা বদলেও দিতে পারে। রাফিজ এসব ব্যাপারে যতটুক সম্ভব খোলামন নিয়েই জানার চেষ্টা করবে।
৫.
ঘর থেকে বের হতে হতে রাফিজের সন্ধ্যা হয়ে গেল। নিচে নেমে সে দেখে, নজরুল সাহেব লনে বসে আছেন। সে সেদিকে এগিয়ে গেল।
সে লনটার চারিদিকে দেখছিল। সত্যি কথা বলতে কি, কিছুটা অযত্ন লনটাকে একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। জায়গায় জায়গায় উঁচু হয়ে থাকা ঘাসের মধ্যে একটা বুনো ধরনের সৌন্দর্যের আভাস মিলছিল। সবুজের মধ্যে প্লাস্টিকের সাদা চেয়ারগুলো আর ছোট টেবিলটাকে বেশ আয়েশী আয়োজন বলে মনে হচ্ছিল।
“প্রতিদিনই এরকম বসেন নাকি?” – রাফিজ নজরুল সাহেবকে জিজ্ঞেস করল।
“না,” – নজরুল হাসলেন – “শুধু ছুটির দিনে, তাও আবহাওয়া ভালো থাকলে।”
“চমৎকার – চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রাফিজ মন্তব্য করল।”
“হ্যাঁ, মফস্বলের লাইফ একেবারে মন্দ না – কি বলেন?”
“হুম,” – রাফিজ মাথা নাড়ল – “তা সন্ধ্যার পর এখানে বসেন না?” – রাফিজ লনটার ব্যাপারে তার রোমান্টিকতা থেকে তখনো বের হতে পারেনি।
নজরুল হেসে উঠলেন – “কেন নয়? প্রায়ই বসা হয়। আর আপনি – সত্যি কথা বলতে – আমার ঘরের লোকের মতই। বরকতের সাথে আমার পরিচয় কিন্তু সেই বগুড়া থেকে। একদম ছোটবেলার বন্ধু, আপনার সাথে পরিচয় কিভাবে?”
“না, ঠিক সরাসরি পরিচিত না। আমি ডাক্তার মান্নানের সাথে একটা ক্লিনিকে কাজ করি, মাদকাসক্তি ক্লিনিক। ডক্টর বরকত উনার পরিচিত।”
“ও, আচ্ছা আচ্ছা। আপনার সম্পর্কে সে বলেছে। ভালো ভালো।” – নজরুল মাথা নাড়লেন।
“আমি যত দ্রুত সম্ভব কাজ শুরু করে দিতে চাই।” – রাফিজ বলল।
নজরুল তার দিকে তাকালেন – “নিশ্চয়ই, শহরে থাকেন, মফস্বল আপনাদের ভালো লাগার কথা না।”
“না, সেজন্য না, আমি আসলে ব্যাপারটা নিয়ে একটু কৌতূহলী হয়ে আছি।”
“অবশ্যই, অবশ্যই, আপনার যেরকম সুবিধা।” – নজরুল বলেন।
রাফিজ বেতের চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে – “আমি ডাক্তার বরকতের কাছে ঘটনাটা শুনেছি, উনি আমাকে বেশ বিস্তারিতই বলেছেন। আচ্ছা, ব্যাপারটার শুরু কবে থেকে?”
নজরুল একটু নড়ে-চড়ে বসলেন। একটু সময় নিয়ে কি যেন ভাবলেন।
“অবশ্য অন্য সময় বললেও চলবে, আজ তো এলাম মাত্র।” – রাফিজ তাড়াতাড়ি বলে।
“না, আমার কোন অসুবিধা নেই। আমিও চাই, যত দ্রুত সম্ভব এটার সমাধান হয়।”
নজরুল শান্ত ভংগীতে বলা শুরু করলেন।
“একদম প্রথম থেকেই শুরু করি। আমাদের বিয়ে হয় প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল। বিয়ের আগে রুমানাকে আমি চিনতাম না। ফ্যামিলির মাধ্যমে বিয়ে। ওর বয়স তখন বাইশ কি তেইশ, মেয়েদের বিয়ের বয়স হিসেবে ঠিকই আছে। কিন্তু আমার সে তুলনায় বয়স একটু বেশিই ছিল। ব্যবসাটা গুছিয়ে আনতে আনতে একটু সময় লেগে গিয়েছিল আর কি। যাহোক, পুরুষ মানুষের নিজের পায়ে শক্ত করে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করা ঠিকও নয়, এতে অনেক সমস্যা হয়।
এ বাড়িটা অবশ্য বিয়ের পরে কমপ্লিট করা। আগে আমরা একতলাটায় থাকতাম, সেখানে একটা টিনশেড ছিল। জায়গাটা আমার পৈত্রিক সম্পত্তি। বাবা মারা যান আমি যখন স্কুলে পড়ি, সেই থেকে মা আর আমি সংসারে একা। থাকার ঘরটা না থাকলে বিপদেই পড়তাম। মা অবশ্য পাকা বাড়িটা দেখে যেতে পারেননি। উনি আমার বিয়েও দেখে যেতে পারেননি।
যাহোক, বিয়ের পর – তখন আমার ব্যবসার অবস্থা ভালো – বাড়িটা একটানে পাকা করে ফেলি। দোতলা পর্যন্ত পুরোটা করি, আর তিনতলায় ঐ দুই তিনটা রুম। প্রথমে গেস্টরুম চিন্তা করেই করেছিলাম রুমগুলো, পরে সিংগেল রুম হিসেবে ভাড়াও দিয়েছি কিছুদিন। পুরুষদের কথা চিন্তা করেই করা, একটা মেয়েও ছিল কয়দিন।”
“আপনার ওয়াইফের কথা কিছু বলুন।” – রাফিজ বলে।
নজরুল হাসলেন – “সরি, আমি শুধু ঘরবাড়ির কথাই বলছি, আসলে ব্যবসায়ী মানুষ তো, ওগুলো ছাড়া কথা স্টার্ট করতে পারি না। তবে রুমানার সমস্যার সাথে এ বাড়ির প্রসংগটা একদম অপ্রাসংগিক নাও হতে পারে।”
“মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, বাড়ি হবার পরই সমস্যাগুলো শুরু হয়?”
“ঠিক তা না, তবে বাড়ি করার পর সমস্যার ধরনগুলো একটু অন্যরকম হতে থাকে।”
“ইন্টারেস্টিং।” – রাফিজ হেলান দিয়ে বসল।
“রুমানা ছোটবেলা থেকেই নাকি ভয় পেত। বিয়ের পর পর আমি যখন ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ্য করি, তখন আমার শ্বাশুড়ী এটা আমাকে বলেছিলেন। আমি অবশ্য তেমন একটা পাত্তা দেই নি। মেয়েরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভয় পেতেই পারে, এসব নিয়ে মাথা ঘামালে চলে ! ভয় পাবে, আবার ঠিকও হয়ে যাবে। অন্তত: প্রথম প্রথম আমার ধারণা সেরকমই ছিল।
প্রথম প্রথম বলছি এজন্য যে, পরে আমার ধারণা কিছুটা বদলে গিয়েছিল। আসলে তার ভয় পাবার ব্যাপারটা একটু যেন অন্যরকমের ছিল। একদম ছোটবেলায় আমরা যেরকম ভূতের ভয় পেতাম, রাত্রে একা টয়লেটে যেতে চাইতাম না – এ ভয় তার থেকে কিছুটা আলাদা।
উদাহরণ দেই। যেমন, রুমানা অনেকসময়ই একা একা ছাদে যেত। সন্ধ্যার পরও সে বহুদিন ছাদে গেছে কাপড় আনতে, একদম স্বাভাবিক – কোন ভয় নেই। সেই মেয়েই একদিন দুপুরবেলা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রায় অজ্ঞান হওয়ার মত অবস্থা, আমি তো ফোন পেয়ে বাসায় এসে দেখি হুলুস্থূল অবস্থা – মুখে ফেনা ভাংগছে, মাথায় পানি দেয়া হচ্ছে। কি ব্যাপার? সে নাকি পেছনের ঘরের জানলায় কার ছায়া দেখেছে।
আমার শ্বাশুড়ীও চলে এসেছিলেন। আমি বললাম – চোর-টোর হতে পারে, এতে এতো অস্থির হবার কি আছে? কিন্তু আমার শ্বাশুড়ী মাথা নাড়লেন এমনভাবে যেন তিনি জানেন কে এসেছিল।
রাত্রে রুমানাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি দেখেছে। সে কেঁদে ফেলল, বলল – ঐ জিনিস তাকে খুঁজে বের করে ফেলেছে, এখন নাকি আর রক্ষা নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোন জিনিস। সে যা বলল, সংক্ষেপে সেটার মানে হল – দশ-বারো বছর বয়স থেকে অদৃশ্য একটা কিছু তাকে ফলো করে। যেখানে সে যায়, সেটাও সেখানে যায়। এমনকি স্কুলের রাস্তায়ও সে ওটার গন্ধ পেয়েছে। কিরকম গন্ধ, জিজ্ঞেস করেছিলাম। অনেকটা নাকি গাঁজা পোড়ানোর মত গন্ধ। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর সে নাকি একলা থাকতে চাইতোনা, এমনকি বাথরুমেও মাকে নিয়ে যেত।
সেটা কি উনার কোন ক্ষতি করেছে কখনো? – রাফিজ জিজ্ঞেস করে।
ঠিক সেভাবে নয়, তবে ইনডাইরেক্টলি তো অবশ্যই। সে প্রতিদিনই স্বপ্নে একটা বিশেষ জন্তু ধরণের লোককে দেখত, এখনো মাঝে-মধ্যে দেখে। স্বপ্ন দেখে ভয় পাওয়া ছিল তার নিত্যদিনকার ব্যাপার, ফলে এটা তাকে শারিরীক আর মানসিক দুইভাবেই ক্ষতি করছিল। তবে আমার শ্বাশুড়ী কোন এক হুজুরের কাছে গিয়ে দোয়া-তাবিজ আনতেন, এটাতে নাকি কিছু উপকার হয়েছিল।”
“একটা প্রশ্ন করি, এটা গুরুত্বপূর্ণ।” – রাফিজ তাকে বাধা দিয়ে বলে – “আপনি কি এসবে বিশ্বাস করেন?”
নজরুল হাসলেন, তারপর একটু গম্ভীর হয়েই বললেন – “আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কি কিছু যায় আসে?”
“অতীতে হয়তো যায় আসেনি, কিন্তু বর্তমানে অবশ্যই যায় আসে। আপনার অবস্থান যদি যুক্তিসংগত হয়, তাহলে তা আপনার ওয়াইফকে শক্তি দেবে।”
“জীন-ভূত হয়তো থাকলেও থাকতে পারে, আমরা এই দুনিয়া সম্পর্কে কতটুকুই বা জানি। কিন্তু আমার কথা হল, এতো জায়গা থাকতে জীন-ভূত ওর পিছনে লাগবে কেন? বাঘ-ভাল্লুক থাকে জংগলে, এরা লোকালয়ে আসে না। তাহলে জীন-ভূত কেন মানুষের ঘাড়ের ওপর এসে থাকবে, তাই না?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে উনি উল্টো প্রশ্ন করলেন রাফিজকে – “কেন? আপনি মনে হয় বিশ্বাস করেন না?”
রাফিজ হাসল – “আমি যা নিজে দেখি বা শুনি তাই শুধু বিশ্বাস করি। তবে…”
“তবে কি?”
“তবে আমি এও মনে করি, ব্যাখ্যা নেই মানেই এই না যে – ঐ জিনিসটাও নেই।”
“জীন-ভূত তো সেরকমই জিনিস, তাই না !”
“হ্যাঁ, সেরকমই জিনিস। কিন্তু তার আগে তো আমার নিশ্চিত হতে হবে যে – ঘটনাটা জীন-ভূতই ঘটাচ্ছে।”
নজরুল চুপ হয়ে গেলেন।
“আর হুজুরের দোয়ার ব্যাপারটা?” – রাফিজ আবার শুরু করল – “আপনার কি মনে হয় এতে উপকার হয়েছিল কিংবা হচ্ছে?”
“ঠিক বলতে পারব না – নজরুলকে একটু অনিশ্চিতই মনে হল – সে তো এখনো স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখে প্রচন্ড ভয় পায়। তবে তারা বলে, তাবিজের ফলেই সে শারিরীক ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে গেছে। নাহলে নাকি তাকে এরা তুলেই নিয়ে যেত।”
“উনি কি বাসার একমাত্র মেয়ে?”
“হ্যাঁ।”
“বাবা বেঁচে আছেন?”
“উনি ব্যবসা করেন, এসব ব্যাপারে তার মাথাব্যথা খুব কম।”
“আপনি বলেছিলেন এই বাড়িটার সাথে কিছুটা সম্পর্ক আছে উনার সমস্যার, সেটা কিরকম?” – রাফিজ জানতে চায়।
নজরুল হেসে উঠলেন – “সম্পর্কটা হল, এ বাড়িতে আসার আগে ও ভয় পেত, আর আজকাল ভয় দেখাচ্ছে।”
“সেটা আবার কিরকম?”
“আগে ভয় পেত, বিয়ের আগে বা পরে, সেটা আমার মনে হয় অনেক মেয়েই পায়। সত্যি কথা বলতে কি, এসব খারাপ নজরের কথা গ্রামদেশে আমরাও কমবেশি শুনেছি। সে অর্থে এইসব স্বপ্ন বা ভয়ভীতি নিয়ে আমি নিজে খুব একটা চিন্তিত ছিলাম না। কিন্তু গত কয় বছর থেকে বিশেষ করে আমার বাসায় যেটা ঘটছে, সেটা রীতিমত ভয়াবহ। এরকম আমি কখনো শুনিনি, কিংবা নিজে দেখব এমন চিন্তাও করিনি। আজকাল আমি নিজেই তো ভয়ে ভয়ে থাকি।
একটা ঘটনা বলি, তাহলে বুঝবেন। একবার আমি বাসায় ফিরেছি রাত করে, সেদিন আমার শহরে একটা জায়গায় ছাদ ঢালাইয়ের কাজ ছিল। সন্ধ্যার পর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি, আমি অনেক ঝামেলা করে ফ্রেশ ঢালাইয়ের জায়গাগুলো ঢেকে-ঢুকে এসেছি। ঘরে ঢোকার আগেই গোসলখানায় গিয়েছি, একবারে ফ্রেশ হয়ে তারপর ঘরে এসেছি। ঘরে ঢুকেই মনে হল হাস্নাহেনা ফুলের গন্ধ। আমাদের উঠানে একটা হাস্নাহেনা গাছ ছিল, কিন্তু সেটা কেটে ফেলেছি সাপের ভয়ে বহুদিন হয় – হাস্নাহেনা গাছে নাকি সাপ আসে, এরকম একটা কথা শুনেছিলাম।
যাহোক, ঘরে ঢুকে দেখি – রুমানা খাটের ওপর বসে আছে, পরনে একটা সাদা শাড়ী। আমি মনে করার চেষ্টা করলাম তার কোন সাদা শাড়ী ছিল কি না। মনে করতে পারলাম না। যাহোক, হতে পারে আমার মনে নেই। আমি পাশের সোফাটায় গিয়ে বসলাম, ও আমার দিকে পেছনে ফিরে ছিল।
আমি প্রতিদিনের মতই জিজ্ঞেস করলাম, কেমন কেটেছে তার সারাদিন। তখনই ঘটল ঘটনাটা – আমি ঘরে ঢোকার পর প্রথমবারের জন্য সে মুখ তুলে তাকাল, আর আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম – এটা কে বসে আছে আমার খাটে? আমি কে-কে বলে চীৎকার করে উঠলাম। আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। লম্বাটে একটা মুখ, পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।”
রাফিজ চুপচাপ শুনছিল। এ পর্যায়ে বলল – “কে ছিল ওটা?”
“ওটা রুমানাই ছিল। আমি চীৎকার করামাত্র সে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে পড়ল। আমি তাকে ধাক্কা দিতেই সে উঠে বসল – দেখলাম, রুমানাই উঠে বসেছে। আমি তাহলে প্রথমে কার চেহারা দেখলাম? আমি জিজ্ঞেস করলাম – সে খাটের মাঝখানে বসে কি করছিল। সে বলল, সে ঘুমিয়ে ছিল, আমার চীৎকারে সে ঘুম ভেংগে জেগে উঠেছে।”
“আর কখনো কি এরকম হয়েছে?”
“বেশ কয়েকবার, তবে একেকবার একেকভাবে। কিন্তু হয়তো এগুলি আমার মনের ভুল।” – নজরুলের শেষ কথাটায় যেন কিছুটা হতাশা মিশে ছিল।
“তবে সেই রাতে রুমানা আমাকে বলেছিল, সে নাকি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছিল। পরে বুঝলাম – সে যখন বসে ছিল, তখন সে ঘুমের ঘোরে কোন স্বপ্ন দেখছিল।”
“স্লিপওয়াকিং।” – রাফিজ বিড় বিড় করে নিজমনেই বলল।
“কি স্বপ্ন ছিল ওটা?”
“সেটা শুনে তো আমি আরো আশ্চর্য হয়েছি। সে স্বপ্নে দেখছিল, একটা মেয়ের সাথে সে গল্প করছে। মেয়েটা তার বাসায় বেড়াতে এসেছে, তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়। মেয়েটার চেহারা আর মুখের গড়ন নাকি ছিল লম্বাটে ধরনের, দৃষ্টি প্রখর ধরণের।”
“অন্য যে কয়বার এধরণের ঘটনা ঘটেছে, আপনি কি একই চেহারা দেখেছেন?”
নজরুল মাথা নাড়লেন, তার ধারণা – তিনি হুবহু একই চেহারা দেখেছেন।
“চেহারাটার সাথে কি আপনার পরিচিত কারো মিল ছিল?”
নজরুল কিছু বললেন না।
“পরিচিত বা স্বল্প পরিচিত?”
“আমার মনে পড়ছে না।” – অন্যদিকে তাকিয়ে আস্তে করে মন্তব্য করার মতো করে বললেন নজরুল।
“এরকম আর কি ঘটেছে?”
“তেমন কিছু না। অনেক সময় পাশের ঘর থেকে ওর কথা শুনি, মনে হয় দুইজন কথা বলছে।”
“দুইজন?”
“হ্যাঁ, একটা ওর নিজের কণ্ঠ। অন্যটা খসখসে ভারী ধরণের একটা কণ্ঠ, ফিসফিস করে কথা বলে। জানতে চাইলে রুমানা অদ্ভুত করে হাসে। পরে জিজ্ঞেস করলে কিছু মনে করে বলতে পারে না। আর তাছাড়া…”
নজরুল একটু থামলেন, যেন ভাবছেন কি বলবেন। রাফিজ তার দিকে তাকিয়ে রইল।
“তাছাড়া ওর চেহারায় একটা মৃত মেয়ের ছাপ পড়ে তখন।” – নজরুল তার কথা শেষ করলেন।
“মৃত মেয়ে?”
“হ্যাঁ, আমার এক আত্মীয়া আত্মহত্যা করেছিল। রুনার মধ্যে সেই মেয়েটির চেহারা ফুটে ওঠে, যখন সে পাগলামি করে। আর আসলে …”
রাফিজ নড়েচড়ে বসে।
“আসলে আমি এই চেহারাটাই ওর মধ্যে দেখি প্রতিবার, সেই লম্বাটে ধরণের মুখ, বড় বড় চোখ।”
রাফিজের মনে হল – নজরুল যেন গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“আমি জানি, এটা খুব অদ্ভুত লাগে শুনতে, কিন্তু আমার মনে হয় ডাক্তার হিসেবে আপনাকে আমরা প্রাসংগিক-অপ্রাসংগিক সবই বলতে পারি, তাই না?” – তিনি বললেন।
“নিশ্চয়ই। রোগীর হিস্ট্রি থেকে প্রাসংগিক বিষয়গুলো আলাদা করে নেয়া একজন চিকিৎসকের কাজের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ।” – রাফিজ বলল।
“আমি প্রথমে এটা লক্ষ্য করলেও খুব একটা পাত্তা দেইনি, ভেবেছি হয়তো এটা আমার মনের ভুল হতে পারে। এমনকি এটা আমি কারো সাথে আলাপও করিনি। কিন্তু পরে যখন বাসার কাজের লোকগুলোও একই রকম কথা বলা শুরু করল, তখন বুঝতে পারলাম – রুমানার এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করার মতই কিছু একটা।”
“আপনার কাজের লোকেরা কি আপনার সেই আত্মীয়াকে ভালো করে চিনত?”
“হ্যাঁ, চিনবে না কেন? ও তো নিয়মিতই এ বাসায় আসত।”
রাফিজ ভ্রু কুঞ্চিত করে শুনছিল।
“ওরা বলে, ওর মধ্যে মৃত আত্মা ভর করে। আমি অবশ্য এখনো ব্যাপারটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিনি, শত হলেও মৃত তো মৃতই, তাই না !” – নজরুল সাহেব একটু বিব্রত হাসি হাসলেন – “কিন্তু সাথে সাথে এটাও সত্যি যে, আমি বুঝতে পারছি না এটা কিভাবে সম্ভব?
“কোনটা?”
“সেই যে, তার চেহারায় আমার সেই আত্মীয়ার ছাপ আসছে। আমি নিশ্চিত যে এরকম কিছু হচ্ছে, কিন্তু এর ব্যাখ্যা কি হতে পারে ! আপনাদের মেডিক্যাল সায়েন্স কি বলে, এই বয়সে কি মানুষের চেহারায় খুব বড় ধরণের পরিবর্তন হতে পারে?”
“বড় ধরণের পরিবর্তন হয় না, তবে অনেক সময় এরকম হতে পারে যে – দুজনের চেহারায় মিল আছে কিন্তু কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না, তারপর একটা ঘটনা ঘটল, যেমন ধরা যাক একজন মারা গেল, তখন সবাই সেই মিলটা লক্ষ্য করতে শুরু করল।”
নজরুল কিছু বললেন না, অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেন।
“যাহোক, আশা করি এসব নিয়ে আপনি খুব একটা চিন্তিত নন।” – রাফিজ হঠাৎ বলে।
“শোনেন,” – নজরুল এবার সোজা হয়ে বসলেন – “রুনা আমার ওয়াইফ, ওর সুস্থতার জন্য যা যা করা দরকার তা আমি করব। যদি হুজুর ডাকতে হয় ডাকব, যদি ওষুধে কাজ হয় ওষুধ খাওয়াবো। আপনি যদি খুঁজে বের করতে পারেন এর কোন সায়েন্টিফিক কারণ, আমি আপনার পরামর্শই নেব। বরকতের আপনার সম্পর্কে খুবই উঁচু ধারণা। আমারও বিশ্বাস, আপনি একটা কিছু বের করতে পারবেন। এসব আর ভালো লাগে না।”
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। মফস্বল শহর বলেই হয়তো, সাড়ে আটটাতেই রাত অনেক মনে হচ্ছিল। রাফিজও তখন নিজের রুমে চলে এলো।
৬.
রুমে ফিরেই রাফিজ তার নোটবইটা নিয়ে বসল। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো এখনই লিখে ফেলা দরকার।
এখানে স্পষ্ট দুই ধরণের ঘটনা রয়েছে – কিন্তু একটা একটা করে সমস্যা ধরেই চিন্তাকে এগিয়ে নিতে হবে। রাফিজ সেভাবেই তার বিশ্লেষণটা লেখার পরিকল্পণা করল।
প্রথম সমস্যাটি হচ্ছে মেয়েটির নিজের ভয় পাওয়া – যদিও যতটুক বোঝা গেছে, এই প্রথম সমস্যাটি নিয়ে নজরুল সাহেব নিজে খুব একটা চিন্তিত নন।
এই প্রথম ধরণের সমস্যা অর্থাৎ মেয়েটির ভয় পাওয়ার শুরু তার দশ কি বারো বছর বয়সে। এক্ষেত্রে মেয়েটির বাবার প্রসংগ খুব কম এসেছে, অন্যদিকে মেয়েটির মা প্রতিটি ব্যাপারেই খুব তৎপর বলে মনে হচ্ছে। সাধারণত সেসব পরিবারে এটা ঘটে, যেখানে মা থাকে খুব বেশি রকম তৎপর। মা বেশি তৎপর হলে ছেলেমেয়েরা অলস হতে পারে – অলস এবং কল্পণাপ্রবণ। এটা একটা বাস্তব সম্ভাবণা।
এরকম একটি মেয়ে যখন বারো বছর বয়সে পড়ল, তখন সে কিছু শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করল। এই শারীরিক পরিবর্তনগুলোর সাথে মানিয়ে নেবার মত যথেষ্ট শিক্ষা সে পরিবার অর্থাৎ মা থেকে পেয়েছিল কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এখানে রাফিজ নজরুল সাহেবের শ্বাশুড়ী কথাটি তীর চিহ্ণ দিয়ে লিখে রাখল। ভদ্রমহিলার সাথে আলাপের সময় এ ব্যাপারটা সামনে নিয়ে আসতে হবে।
এই শারীরিক পরিবর্তনগুলো সাথে করে নিয়ে আসে একইসাথে শারীরিক আকাংক্ষ্যা এবং মানসিক আশংকা। ফলশ্রুতিতে আসতে পারে চরম মানসিক দ্বন্দ্ব। শারীরিক চাহিদার সাথে প্রচন্ড লজ্জা যোগ হলে ফলাফল হিসেবে ঘটতে পারে মানসিক সমস্যা, এমনকি সেই দ্বন্দ্বকে আড়াল করার জন্য মন সাজাতে পারে জীন-ভূতের নাটকও। এরকম ঘটনা নিয়ে ক্ল্যাসিক কেস আছে। সুতরাং এই সমস্যাটি তুলনামূলকভাবে একটি সাধারণ সমস্যাই, এমনকি এটা বিয়ের পর পর মিটে যাবারও কথা।
তাহলে এখন প্রথম সমস্যাটার ব্যাপারে কয়েকটা বিষয়ে জোর দিতে হবে – এক, বিয়ের পর আসলেও মেয়েটার সমস্যা উলেখযোগ্যভাবে কমেছিল কিনা। দুই, নজরুল-রুনা দম্পতির সম্পর্ক স্বাভাবিক কিনা। যদি স্বাভাবিক হয়ে থাকে, তাহলে আসলে এ সমস্যাটা বর্তমানে আর থাকারই কথা না। এদিকে যদি দেখা যায় যে, তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক আছে কিন্তু তারপরও সমস্যাটা ঘুরে-ফিরে আসছে – তাহলে ধরে নিতে হবে, এখানে অন্য কোন কিছু প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। তবে এখন পর্যন্ত এই হাইপোথিসিস ধরেই এগোনো যাবে বলে মনে হচেছ।
এপর্যন্ত নোট নিয়ে রাফিজ বিছানায় চিৎ হয়ে শুলো। মাথায় সূক্ষ্ম একটা ব্যথা হচ্ছে, চিন্তাগুলো কেমন যেন এলো-মেলো হয়ে যাচ্ছে। রাফিজ ঐ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা আপাতত: বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিল। আর ঠিক তখনই ঝুপ করে কারেন্ট চলে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভ্যাপসা গরমে হাসফাস করতে শুরু করল রাফিজ। বছরের এই সময়টা এমনিতেই গরম, তার মধ্যে অদ্ভুত এই মফস্বল শহরটায় কারেন্ট থাকেনা দিনের অর্ধেক সময়। সে পাখাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করল গরমের সাথে। তারপর একসময় যখন মনে হল নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন উত্তরদিকের জানালাটা খুলে দিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
জেলা শহর হলেও এটা খুব একটা ব্যস্ত জায়গা না, এই ডিশ এন্টেনার যুগেও নয়টার সময়ই রাত গভীর হয়ে যায়। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জানলা খোলার সাথে সাথে একরাশ ঘন অন্ধকারই বরং ঢুকে পড়ল ঘরটায়। আর ঠিক তখনই কে যেন প্রায় শোনা যায় না এমনভাবে দরজার কড়া নাড়ল।
রাফিজ অন্ধকারে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল – মোমবাতি শেষ হয়ে গেছে। ম্যাচের জন্য পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে সে একবার হোচট খেয়ে দরজার দিকে এগুলো।
“কে?” – প্রথমে কোন উত্তর এলো না। রাফিজ বুঝে পেল না, এই রাতে কে তার ঘরে আসতে পারে।
“কে?”
এবার একটা পায়ের শব্দ পাওয়া গেল ওপাশে। খুব নিচু স্বরে একটা মেয়ে কণ্ঠ বলল – “আমি।”
রাফিজ চিনতে পারলনা, কিন্তু দরজা খুলে দিল।
“আমি নীপা, আমি আপনার পাশের ঘরে থাকি। ভেতরে আসব?” – খুব ক্ষীণস্বরে বলল মেয়েটা।
রাফিজ একটু অবাক হল, পুরো বাড়ি অন্ধকার – কিন্তু সে দ্রুতই নিজেকে সামলে নিল।
“আচ্ছা, আমি তো কোন লাইট খুঁজে পাচ্ছি না” – সে বলল।
“আমি একটু ভেতরে বসব শুধু।”
“ও, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।” – রাফিজ তাড়াতাড়ি বলল। সে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ঢোকার জায়গা করে দিল – “প্লিজ আসুন। ডানদিকে একটা সোফা আছে।”
“আমি জানি, আগে দেখেছি।” – মেয়েটি ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে গেছে। রাফিজ চমৎকার একটা ফুলের গন্ধ পেতে শুরু করল।
সে একটু ইতস্তত করে তারপর দরজাটা লাগিয়ে দিল।
“আপনি বসুন, আমি কোন একটা লাইট জাতীয় কিছু খুঁজে আনি।” – রাফিজ ব্যস্ত কণ্ঠে বলল।
“আপনি ব্যস্ত হবেন না, লাইট না হলেও আমার অসুবিধা নেই।” – মেয়েটা মনে হল বসার জায়গাটা খুঁজে পেয়েছে – “আমি জাস্ট একটু বসব, কারেন্ট আসলে চলে যাব, আশা করি আপনার কোন অসুবিধা করছি না।”
“না, সেরকম কিছু না, আপনি বসুন।” – রাফিজ বলল।
“আমি আসলে অন্ধকারে ঘরের চাবিটা খুঁজে পাচ্ছি না, কিন্তু আপনি কবে থেকে এখানে?”
রাফিজ অস্বস্তিকর অন্ধকারে পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে বলল – “প্রায় এক সপ্তাহ। কিন্তু নজরুল সাহেব বলছিলেন, কয়েক মাস হয় ওপাশের ঘরটায় কেউ থাকে না।”
“আমি চলে গিয়েছিলাম, জিনিসপত্র ছিল। হঠাৎ করেই আবার ফিরতে হল।”
এর মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে রাফিজ গতকালকের একটা আধা ব্যবহার করা মোমবাতি খুজে পেয়ে একটা দেশলাই কাঠি ধরিয়ে ফেলেছে। সে মোমটা নিয়ে সোফার সামনের ছোট টেবিলটায় রাখতে রাখতে মেয়েটার দিকে তাকাল, আর তাকিয়েই চমকে উঠল।
মেয়েটা একটি জড়ি দেয়া সাদা শাড়ী পড়েছে। মোমবাতির আলো সরাসরি তার মুখের ওপর পড়ছিলো, আর তাকে দেখাচ্ছিল প্রতিমার মত। বিশেষ করে শাড়ী পরাতে তাকে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে। আটোসাটো পোশাকের ভেতর থেকে ফুটে ওঠা ওর চমৎকার শরীরটা বার বার রাফিজের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করতে লাগল।
“আসলে অন্ধকারে একা একা ভয়ও পাচ্ছিলাম কিছুটা।” – নীপার কথায় রাফিজ সম্বিৎ ফিরে পেল। সে কি বলবে বুঝে না পেয়ে অল্প হাসল।
আকাশে তখন গুড় গুড় করে মেঘ ডেকে উঠল।
রাফিজের হাতে সময় ছিল। সে বলল – “আপনি কতদিন চেনেন নজরুল সাহেবের ফ্যামিলিকে?”
নীপা হাসল। রাফিজের মনে হল হাসিটা অর্থপূর্ণ। সে চোখ ছোট করে বলল – “অনেকদিন মনে হচ্ছে!”
নীপা আবার হাসল – “নজরুল ভাই আমার মামাতো ভাই। যখন হাই স্কুলে চাকরীটা হল, উনি বললেন উনাদের সাথেই থাকতে।”
“নজরুল সাহেব আপনার মামাতো ভাই,” – রাফিজ আবার হেলান দিয়ে বসল – “ভালোই হল, আপনার কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যাবে।”
“কিরকম তথ্য?”
“উনার এক আত্মীয়া আত্মহত্যা করেছিল শুনলাম, তার ব্যাপারে কিছু জিনিস জানা দরকার ছিল। আশা করি, আপনি চেনেন।”
নীপাকে একটু গম্ভীর মনে হল। তবে সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
“অবশ্য আজই সেটা নিয়ে কথা না বললেও চলবে।”
মেয়েটা মাথা নীচু করে বসে ছিল।
“আপনি কতদিন ধরে এ বাসায় আছেন?” – রাফিজ কথোপকথন চালিয়ে যাবার চেষ্টা করল।
“সে অনেক দিন।” – মেয়েটি বলল।
“তাহলে তো মনে হয় এ বাড়ি হবার পর থেকেই।”
“তা বলা যায়,” – মেয়েটা অন্যমনস্কভাবে বলল। তারপর হঠাৎই কি ভেবে বলে – “অবশ্য অন্য বাসা নিতে পারতাম, কিন্তু এখানে ভাইয়ের বাসায় একটু নিরাপদ মনে হয় আরকি, ও তো বাইরে বাইরেই থাকে।”
“আপনি কি বিবাহিতা?”
“জি।”
“আপনার স্বামী কোথায় কাজ করেন?”
“একটা এনজিওতে আছে। এই জেলাতেই কাজ, কিন্তু একটু দূরের দিকের গ্রামগুলোতেই কাজ বেশি।
রাফিজ মাথা নাড়ল। মেয়েটি আবার চুপ হয়ে গেল।
“আপনি বাইরে থেকে এসেছেন, একটু পানি দেই।” – হঠাৎ কি মনে করে রাফিজ বলল।
মেয়েটা মাথা নাড়ল। রাফিজ একটু লজ্জিত হল, এতক্ষণ পানির ব্যাপারটা তার মনে আসেনি বলে। সে ঘরের পাশের কোণাটায় চলে এল পানির বোতল আর গ্লাস আনতে। আর ঠিক তখনই কারেন্ট চলে এল। রাফিজ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলল।
পানি নিয়ে ফিরে এসে রাফিজ দেখে, ঘরে কেউ নেই। সম্ভবত: মেয়েটা তার ঘরের চাবি খুঁজে পেয়েছে। রাফিজ আবার তার নোটবইটা নিয়ে বসল।
৭.
সকালে নাস্তা সেরেই রাফিজ নজরুলের সাথে দেখা করল। সে আজ নজরুলের স্ত্রীর সাথে কথা বলতে চায়। নজরুল কি একটা কাজে বেরিয়ে যাচ্ছেন, বয়স্ক লোকটাকে বললেন রুমানার সাথে সে যেন রাফিজের দেখা করিয়ে দেয়। রাফিজ জিজ্ঞেস করে জানল, তার নাম জয়ন্ত।
“কতদিন কাজ করেন এখানে?”
লোকটা হাসল – “সাহেব যখন ছোট ছিল, তখন থেকেই তো আছি আমি উনাদের বাড়িতে।”
রুমানার সাথে দেখা হতে আরো সময় লাগবে মনে হচ্ছে। রাফিজ চিন্তা করল, এই ফাঁকে এর সাথে কিছু কথাবার্তা সেরে নেয়া যায়।
“নজরুল সাহেব কেমন লোক? খুব রাগী নাকি?”
“কি যে কন?” – সে প্রতিবাদ করে ওঠে রীতিমত – “উনার মত মানুষই হয় না, কত ভুল-ভাল করি আমরা, কোনদিন বকে না, খালি ডেকে বলে – সাবধানে কাজ করবা। ব্যস, এইটুকুই।”
“কি ডাকেন নজরুল সাহেবকে আপনি?”
“মামা, ছোটবেলা থেকেই মামা ডাকি।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে তো আপনি এ বাড়ির অনেককিছ্ইু জানেন বোঝেন।”
“জি, তা তো অবশ্যই, তা তো অবশ্যই।” – সে মাথা নাড়তে থাকে।
“আপনার মামীকে কেমন মনে হয়?”
“উনিও ভালো, খুবই ভালো মানুষ, উনার মাও ভালো লোক। যতবার বাসায় আসে, সবার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে।”
“প্রতিবার আপনার জন্যও আনে?”
সে চুপ হয়ে গেল।
“আপনার মামীর সাথে আপনার কথাবার্তা কেমন হয়?”
“উনি চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে তো, আমরা তারে তেমন ঘাটাই না।”
“ঘাটান না কেন? ভয় পান?”
জয়ন্ত চোখ ছোট করে তাকাল। কিছু বলল না।
“উনার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছেন কখনো আপনি?”
“না, আমি কিছু দেখি নাই।”
“তাহলে তো ভয়ের কিছু নেই, তাই না?”
“তবে তিনি নিজে ভয় পান, সেটা শুনছি।”
“কার কাছে শুনেছেন?”
“আমরা বাসায় থাকি, এগুলা টের পাই। এগুলা বলে দিতে হয় না।”
“কি দেখে ভয় পান?”
“শুনছি তিনি ঘুমের মধ্যে ভয় পান।”
“সে তো অনেকেই পায়। ছোট বাচ্চা, যারা একটু ভীতু ধরণের, তারা তো প্রায়ই ভয়ের স্বপ্ন দেখে।”
“না, উনার ঘটনা আলাদা।”
“কিরকম আলাদা?”
“উনারে কেউ ভয় দেখায়।”
“কে ভয় দেখায়?”
জয়ন্ত চুপ করে রইল।
“আপনি জানেন, কে ভয় দেখায়?”
“আমি কেমন করে জানব – কে ভয় দেখায়? তবে এইসব বোঝা যায়।”
“ভয় পাওয়া ছাড়া আর কোন সমস্যা তো নেই?” – রাফিজ তার অনুসন্ধানের বৃত্ত ছোট করে আনতে চেষ্টা করে, শুধু ভয় পাওয়ার ব্যাপার হলে বিষয়টা খুব সাধারণ মানসিক সমস্যা হতে পারে যার সমাধান সহজই হবার কথা।
জয়ন্ত চুপ করে ছিল।
“আর কোন সমস্যা তো দেখেননি, তাই না?” – রাফিজ আবার জিজ্ঞেস করে।
“মামা আমারে বলে দিছে, যেন আপনারে সব কিছু বলি – আমরা যা জানি। মামীর ভালো হোক, এটা আমরা সকলেই চাই।”
“আপনি নিশ্চিন্তে আমাকে বলতে পারেন, আমি একজন ডাক্তার।”
“উনি তো মাঝে-মধ্যে পাগলামি করে।”
“তাই? সে কি ধরণের।”
“উনার চেহারাই বদলে যায়, উনি অন্য মানুষ হয়ে যান।”
ক্ল্যাসিক পসেশন কেস – বিড়বিড় করে বলল রাফিজ।
“উনি তখন উঁচু গলায় কথা বলেন, হাসেন।”
“মানুষ তো সবসময় মন খারাপ করে থাকে না, কখনো কখনো সে মন খারাপ করে, কখনো কখনো মন ভালো থাকে।”
“না, ডাক্তার ভাই, এটা মন ভালোর ঘটনা না। এটা আলাদা। এইটা একদমই আলাদা।”
“তাই?” – রাফিজ অপেক্ষা করে, সময় দেয় জয়ন্তকে।
“উনি যেমন চুপচাপ, সেটার থেকে এই ভাব-সাব একদম আলাদা। উনি তখন একেবারে অন্য মানুষ। উনি নিজেই বলতে পারেন না, তখন উনি কি করবেন বা কি বলবেন।”
“এরকম সময়ে উনার নিজের নাম মনে থাকে?”
“কি জানি? ঐসময় তো মামীর উপর অন্য জিনিস ভর করে। নিজের নাম মনে থাকে বলে মনে হয় না।”
“ইন্টারেস্টিং!”
“জী। উনার আম্মা তো উনাকে একজন হুজুরের কাছেও নিয়ে গেছেন। হুজুর বলছেন, এটা জীন-পরীর আসর।”
“আসর?”
“জি, আমাদের এলাকায় এটারে দেবী ভর করা বলে।”
“দেবী না দানবী? দেবী তো ভালো জিনিসই হবার কথা।”
জয়ন্ত চুপ হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর সে রাফিজের চোখে চোখ রেখে বলে – “আপনে এটা থেকে উনার মুক্তির চেষ্টা করেন।”
রাফিজ সোজা হয়ে বসে – “অবশ্যই, এটা আমাকে করতেই হবে।”
দোতলা থেকে তখন একটা হৈ চৈ-এর শব্দ আসে। জয়ন্ত তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। রাফিজ ওর চোখে তাকায়।
“মনে হয়, কিছু হয়েছে।” – জয়ন্ত এগিয়ে যায়। রাফিজ তার পেছন পেছন এগোতে থাকে।
সিড়ি বেয়ে উঠলেই দোতলায় একটা টানা বারান্দা দেখা যায়, পুরো বারান্দা গ্রীল দেয়া। মাঝখানের রুম থেকে একটি উত্তেজিত নারীকণ্ঠ শুনতে পেল রাফিজ। এটাই সম্ভবত নজরুলের বেডরুম।
রাফিজ প্রথমে হাসির শব্দ শুনল, তারপর জোরে জোরে কথা। জয়ন্ত ততক্ষণে ঘরের দরজায় গিয়ে উঁকি দিয়েছে।
রাফিজ কিছুটা দূরে অপেক্ষা করছিল, জয়ন্তের ইংগিত পেয়ে এগিয়ে গেল।
ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা মেয়ে উত্তেজিত হয়ে কি যেন বলছে, একজন মহিলা তাকে থামানোর চেষ্টা করছে। মহিলার চোখে-মুখে স্পষ্ট আতংক। একে রাফিজ আগে দেখেছে, মহিলা সম্ভবত স্থানীয় কেউ – নজরুলদের ঘরের কাজে সাহায্য করে, রান্না-বান্নাও করে বোধ হয়।
রুমানাকে দেখে রাফিজ একটু অপ্রস্তুতই হয়েছিল – কমবয়সী একটা মেয়ে, খুব বেশি পচিশ-ছাব্বিশ হবে, বা তার চেয়েও কম হতে পারে। অস্বাভাবিক সুন্দর, যেন মোম দিয়ে বানানো এর চেহারা। রাফিজের মনে হল, এতো সুন্দর কোন নারী সে জীবনে কখনো দেখেনি।
মেয়েটাকে দেখে আরেকটা ব্যাপার তার মনে হলো – ওর পাশের ঘরে যে মেয়েটা থাকে, যার সাথে কাল পরিচয় হল, নীপা নাম – এর সাথে মহিলার চেহারায় কোথায় যেন একটা মিল আছে, বেশ ভালো মিল। এটা নোট করে রাখতে হবে।
রুমানা চীৎকার করছিল – “ঐ বদমাশটাকে আমি যদি খুন না করেছি, একদিন না একদিন আমি তাকে মারব। কোথায় গেছে সে? ব্যবসা না ছাই? পরকীয়া চালানোর জন্য ওর কয়টা ব্যবসা দরকার! হারামজাদার বারোটা বাজাবো আজকে আমি।”
তখন হঠাৎ রাফিজের দিকে চোখ পড়ল তার, একদম চুপ হয়ে গেল সে। বাঁকা চোখে লক্ষ্য করতে থাকল সে রাফিজকে।
রাফিজ স্যান্ডেল বাইরে রেখে খালি পায়ে ঘরে ঢুকল – “আমি রাফিজ, কাল আপনাদের এখানে এসেছি, বেড়াতে। কয়টা দিন বেড়াব, আশা করি অসুবিধা হবে না।”
রুমানা হাত দিয়ে ইশারা করল পরিচারিকাটিকে চলে যেতে। মেয়েটা অনিশ্চিত দৃষ্টিতে জয়ন্তর দিকে তাকাল। তবে জয়ন্ত মাথা নাড়াতেই সে আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
“আপনিও।” – রুমানা এবার জয়ন্তর দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট নির্দেশের সুরে বলল।
“জী, মামী।” – জয়ন্তও বেরিয়ে গেল। রাফিজ আন্দাজ করল – এরা দূরে কোথাও যাবে না, সম্ভবত সিড়ির মুখেই বা বারান্দার আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকবে।
“বসুন।” – ইশারায় সামনের চেয়ারটা দেখাল – “কি নাম বললেন আপনার?”
সে নিজে বিছানার একপাশে পা তুলে বসল।
“রাফিজ ইমতিয়াজ।”
“আপনি কিভাবে পরিচিত ওর?” – স্পষ্ট কর্তৃত্বের সুর।
“নজরুল সাহেবের এক ডাক্তার বন্ধু আছেন ঢাকায়, ডাক্তার বরকত। আমি তার পরিচিত।”
“আপনি বেড়াতে এসেছেন এখানে?”
“ঠিক বেড়াতে না। এটা সত্যি, আমার একটা ব্রেক দরকার ছিল। কিন্তু আমি স্পষ্ট কথা বলা পছন্দ করি, এখানে আমি এসেছি চিকিৎসার স্বার্থে।”
“কিসের চিকিৎসা? কার চিকিৎসা? কিসের ডাক্তার আপনি?”
“আমি একজন সায়কায়াট্রিস্ট, বাংলায় বললে মনোচিকিৎসক।”
“ওহ,” – রুমানা হেসে উঠল – “পাগলের ডাক্তার। শেষপর্যন্ত হারামিটা ভেবেছে, আমাকে এভাবে শায়েস্তা করবে!”
“দু:খিত, আমি আপনার কথা বুঝতে পারিনি।”
“আপনি কার চিকিৎসা করবেন এখানে? আমার?”
রাফিজ অল্প হাসল – “আমি এখানে এসেছি একজন পারিবারিক চিকিৎসক হিসেবে। কার চিকিৎসা করতে হবে, এখনো ঠিক করিনি।”
রুমানা চুপ হয়ে গেল। রাফিজ লক্ষ্য করল, মেয়েটির দৃষ্টি অস্বাভাবিকরকম প্রখর।
“শুনে খুব খুশী হলাম,” – একটু পর সে বলল – “কে বলতে পারে, চিকিৎসা হয়তো আপনার বন্ধুরই বেশি দরকার।”
“আমি যখন চিকিৎসক, তখন কেউ আলাদা করে আমার বন্ধু নয়।”
“কিন্তু আপনার কথাবার্তা আমার ভালো লেগেছে, আমিই আপনার বন্ধু হতে চাই।” – সে উঠে এসে হাত বাড়িয়ে দিল, হ্যান্ডশেকের মত করে।
রাফিজ এর জন্য প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু সেও উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। নরম একটা হাত, কিন্তু অসম্ভব উত্তপ্ত। প্রচন্ড জ্বরেই সাধারণত এরকম গা গরম থাকতে পারে, রাফিজ রীতিমত চমকে উঠল।
“আপনার সাথে সময় নিয়ে আলাপ করব একদিন, আজ মাথাটা খুব ধরেছে।” – সে বলল।
রাফিজ বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে আসছিল, হঠাৎ পেছন থেকে শুনল রুনা বলছে – “আপনি কি এখনো ছোটবেলার মত ভয় পান?”
রাফিজ ঘুরে তাকাল, মেয়েটা মিটিমিটি হাসছে – দুষ্টুমি করে বাচ্চা মেয়েরা যেভাবে হাসে অনেকটা সেভাবে।
রাফিজ কিছু বললনা, শুধু হাসল। তারপর বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
তার ধারণা ঠিক, এরা দুজন দরজার বাইরেই অপেক্ষা করছিল। ও বেরিয়ে আসার সাথে সাথে পরিচারিকা মহিলাটি ঘরের ভেতর গিয়ে ঢুকল আবার।
রাফিজ তার ঘরের দিকে রওনা হল। তখন সে লক্ষ্য করল, জয়ন্ত পেছন পেছন আসছে।
“মামীর কথাবার্তায় আপনি মনে কিছু নিবেন না। উনি এখন ঠিক অবস্থায় নেই।”
রাফিজ হাসল – “আমি সেটা জানি, আমি কিছু মনে করি নি।”
এমনিতে উনি খুব ভালো মানুষ।
রাফিজ মাথা নাড়ল – “হ্যাঁ, উনার বোধহয় জ্বর আছে। সম্ভব হলে একজন ডাক্তার দেখান। টেম্পারেচার খুব বেশি বলে মনে হলো, এটা থেকে ব্রেন হ্যামারেজ পর্যন্ত হতে পারে।”
জয়ন্ত তাকিয়ে ছিল তার দিকে।
“প্লীজ, শিগগীর একজন ডাক্তার দেখান। টেম্পারেচার খুব বেশি হলে বরফের পানিতে গোসল করাতে হতে পারে। যা করার জলদি করুন।”
জয়ন্ত মনে হয় এতক্ষণে তার কথা বুঝতে পারল।
“সম্ভব হলে নজরুল সাহেবকে ফোন করে জানান।” – বলে রাফিজ এগোতে লাগল।
জয়ন্ত চলে গেল। রাফিজ চিন্তিত মুখে ঘরে ঢুকল, তার ছেলেবেলার কথা এই মেয়েটা জানল কি করে? সে কি থট রিড করতে পারে? এর কিছু স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষা আছে, কিন্তু সেসব পরীক্ষা সবসময় কাজ নাও করতে পারে।
রাফিজের নিজেরও গা ম্যাজ ম্যাজ করছিল, ভাইরাল ফিভারে যেরকম হয়। সে বিছানায় পিঠ লাগিয়ে শুয়ে আরাম পেল, এমনকি একসময় তার মনে হল সে এ বিছানা থেকে আর কোনদিন উঠতে পারবেনা – হঠাৎ এতোটা দুর্বল লাগছিল।
সে একইসাথে ঘটনাগুলো নিয়েও ভাবছিল – চিন্তাগুলো এখনই নোটে লিখে ফেলা দরকার। কিন্তু একদম উঠতে ইচ্ছে করছেনা, চারিদিক কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে।
রাফিজ একসময় এ অবস্থাতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
৮.
রাফিজ ঘুম ভেংগে দেখল সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে। কেন যেন সাথে সাথেই একটা গাঢ় বিষন্নতা তাকে ঘিরে ধরল। কিন্তু রাফিজ তখনো বুঝতে পারেনি, এটা আসলে ভয়াবহ একটা এপিসোডের মাত্র শুরু।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ভয়াবহ শূণ্যতা গ্রাস করল তাকে। রাফিজ জানেনা এ শূণ্যতার উৎস, সে শুধু জানে এ শূণ্যতা সীমাহীন। এটা গাঢ় অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা এক ব্ল্যাকহোলের মত যা মুহূর্তের ভেতর গ্রাস করে আশেপাশের সবকিছুকে।
রাফিজ জানে এই সেই জিনিস, যা তাকে সারা পৃথিবীর আর সব মানুষ থেকে করেছে আলাদা – আলাদা এবং একাকী। নিজের রাজ্যে সে রাজা, কিন্তু একজন রাজা সবসময়ই নি:সংগ। নি:সংগতার বিরুদ্ধে লড়াই সে বন্ধ করেছে বহু আগেই, আজ শুধু একটা আরামদায়ক বোধহীনতা নিয়ে বেঁচে গেছে।
তার বন্ধুরা সবাই নিজ নিজ পরিবার নিয়ে সুন্দর জীবন-যাপন করছে – হয় সংসারী হয়েছে, না হয় সংসারী হবার চেষ্টা করছে। আর রাফিজ নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে একটা চিলেকোঠায় প্রায় লুকিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। কিসের থেকে এই পালিয়ে থাকা, রাফিজ নিজেও জানে না। শুধু এটুক সে বোঝে, এর থেকে তার আর কোনদিন মুক্তি নেই, এটা নিয়তির মতই অমোঘ।
নিজের চারদিকে দেয়াল গড়ে তুলেছিল একটি শিশু, বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। তারপর একদিন সে আবিষ্কার করল নিজের তৈরী করা দেয়ালের আড়ালে সে নিজেই বন্দী হয়ে গেছে।
নিজেকে মাঝে মাঝে তার মনে হয় ভবিষ্যতের দিকে পিঠ দিয়ে বসে থাকা অদ্ভুত এক জীব। মৃত্যু তাকে একইসাথে প্রলুব্ধ আর আতংকিত করে।
খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করা লোকের মত কতদিন সে ডুবে গেছে চরম একাকীত্বে কিংবা ভয়াবহ বিষন্ন সব সংগীতে – কিন্তু শেষ পর্যন্ত দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতায় ফিরে আসার জন্য তাকে প্রতিবারই নিতে হয়েছে ওষুধের আশ্রয়। একজন মনোচিকিৎসক হিসেবে রাফিজ নিজেও জানে, এটা একধরণের পংগুত্ব – কিন্তু এই মানসিক পংগুত্বকে মেনে নেয়া ছাড়া সে আর কোন পথ দেখতে পায়নি।
হয়তো এসব কারণেই মিলার সাথেও সে টিকতে পারেনি। মিলা তার ওপর অধিকার ফলাতে চেষ্টা করলেই ওর সাথে ঝগড়া লেগে যেত রাফিজের। আসলে এ ধরণের মানুষের বোধহয় একা থাকাই ভালো।
আর মাঝে-মধ্যেই উঁকি দিয়ে যাওয়া সেইসব ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলো তো আছেই – সেইসব ভয়, আতংক, অশরীরী, কালো ছায়া !
রাফিজ নিজের একটা ডায়াগনসিসও করেছে – তার ধারণা তার নিজের চাইল্ডহুড স্কিজোফ্রেনিয়া ছিল, এবং খুব তীব্রভাবেই ছিল – সেইসব ভয়াবহ দৃশ্য, যা চিন্তা করলে এখনো গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে, যেগুলো এখনো মাঝে-মধ্যেই দু:স্বপ্ন হয়ে তাড়া করে ফেরে তাকে।
দূরে কোথাও বেসুরো কণ্ঠে কেউ আজান দিচ্ছে – পুরোপুরি সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
রাফিজ লাইট না জ্বালিয়েই বসে রইল সন্ধ্যার অন্ধকারের মধ্যে। জানলা দিয়ে ওপাশের রাস্তাটার একাংশ দেখা যাচ্ছিল – একটু পর পরই রিক্সা চলে যাচ্ছে এদিকটা দিয়ে, কোন কোন রিক্সায় হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়েছে এখনই।
ছোটবেলায় এরকম একটা শহরেই থেকেছে ও, ওদের বাসাটা ছিল একতলা সরকারী কোয়ার্টার। বাসার সামনে পেছনে ছিল আম-কাঠাল-নারকেল-বড়ই গাছের সারি। বোশেখ মাসের কোন কোন বিকেলে হঠাৎ করে যখন চারদিক অন্ধকার করে ঝড় শুরু হতো, কি মজাটাই না লাগত! জানলা দিয়ে উকি-ঝুঁকি দিতে দিতে মন আনচান করতে থাকত বাইরে যাবার জন্য, কিন্তু মায়ের জন্য কোনদিনই সেটা সম্ভব হত না, সবসময় ছেলের ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্ক থাকত মা – হয়তো একমাত্র ছেলে বলেই। আর ওদের উঠোনটা ছিল ভীষণ স্যাঁতস্যাঁতে, তার মা প্রায়ই চীৎকার করত – “রাফি, তুই পড়ে যাবি।” তার মা তাকে আদর করে রাফি ডাকত।
রাফি কোনদিন সেই উঠোনে আছাড় খেয়ে ব্যথা পায়নি, কিন্তু কোন একটা বিচিত্র কারণে সে বাসাটা থেকেই তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলো শুরু হয়। প্রথম একদিন রান্নাঘরে, তারপর বাথরুমে। শেষে তো এমন হল যে, রাফি বাথরুমে যেত দরজা খোলা রেখে। কত পীর-ফকির দেখিয়েছে মা, কত দোয়া-তাবিজ – কোন কিছুতে কোন লাভ হয়নি। শেষপর্যন্ত যা লাভ হয়েছিল, সেটা ওষুধে।
রাফিজের বাবা ছিলেন খুব শক্ত ধরণের মানুষ, পৃথিবীর কোনকিছু তাকে বিচলিত করতে পারত না। আর ভদ্রলোক ছিলেন যুক্তিবাদী, কোন রকম সংস্কারকে প্রশ্নাতীত মেনে নেন নি কোনদিন। তিনিই খোঁজ-খবর করে করে জেলা হাসপাতালের এক ডাক্তারের কথা জানতে পারেন, তারপর ছেলেকে নিয়ে যান তার কাছে। ওষুধগুলোতে বেশ ঘুম ঘুম লাগত, কিন্তু রাফিজের সমস্যাগুলো বেশ কমে গিয়েছিল তারপরই।
এরপরতো তার বাবার বদলী হয়, ওরা ঢাকায় চলে যায় বাসা নিয়ে। এরপরও রাফিজ নানারকম সমস্যায় পড়েছে – বিষন্নতা, অবসেশন, নিউরোসিস – কিন্তু সেসবের কোনটাই শৈশবের সেগুলোর মত এরকম ভয়াবহ ছিল না।
রাফিজ দীর্ঘশ্বাস ফেলল – বিচিত্র এক জীবন তার। চরম স্বাধীনভাবে থাকে সে, কাউকে তোয়াক্কা করতে হয়না। সে জানে, এটা চূড়ান্ত অসামাজিক একটা বাঁচার ধরণ – সে তবুও এটাই বেছে নিয়েছে, কারণ যে কোন কারণেই হোক সমাজ এবং এর লোকজনকে তার একদমই সহ্য হয় না। তার ধারণা, বেশির ভাগ লোকই উদ্দেশ্যহীন জীবন-যাপন করছে – সুতরাং দৈনন্দিন জীবনের মেকি আনুষ্ঠানিকতা তাকে অস্থির অসুস্থ করে তোলে।
কিন্তু কাজ না করলে জীবন আরো অসহ্য হয়ে উঠবে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে খুজতে খুজতেই হয়তো একদিন বের হয়ে আসবে তার জীবনের লক্ষ্য।
তীব্র বিরক্তি স্বত্তেও রাফিজ তার নোটখাতা আর একটা কেস স্টাডির বই নিয়ে বসল। প্রচন্ড মাথাব্যথা স্বত্তেও লিখতে শুরু করল এ বাসার দ্বিতীয় ধরণের ঘটনাগুলো নিয়ে – রুমানার মধ্যে দ্বৈত ব্যক্তিত্বর মত কিছু সমস্যা দেখা যাচ্ছে, সে ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় আরেকটা মেয়ের মত আচরণ করছে। দেখা দরকার, সে বিশেষ কারো মত আচরণ করছে কিনা – এমন কেউ যে তার পূর্বপরিচিত। আলাদাভাবে লক্ষ্য করার মত আরেকটা বিষয় হল – মেয়েটার চেহারার ভেতর সবাই মিলে মৃত একটা মেয়ের চেহারা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে।
দ্বিতীয় ধরণের এই ঘটনাগুলোতে কিন্তু নজরুল নিজেও আক্রান্ত হচ্ছেন, এবং যে কোন কারণেই হোক তিনি সেটা নিয়ে চিন্তিত বলেই মনে হয়। আজকাল নজরুল সাহেব তার স্ত্রীকে দেখে ভয় পাচ্ছেন। তবে এটা সবসময় ঘটছে না, ঘটছে বিশেষ কিছু সময়ে। এই বিশেষ সময়গুলোর বর্ণনার সাথে পসেশন ধরণের কেসগুলোর মিল আছে, যাকে এরা বলছে আসর – এটা নোট করে রাখার মত একটা ব্যাপার। এই সময় মেয়েটি দুইটা কণ্ঠেও কথা বলেছে, যা দ্বৈত ব্যক্তিত্ব ইংগিত করে। এখানে খুঁজে দেখতে হবে, কি সেই দ্বন্দ্ব যা মেয়েটার ব্যক্তিত্বকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটা ভাগে ভাগ করে দিচ্ছে।
এদিকে মেয়েটার ভেতর সবাই মিলে মৃত একটি মেয়েকে দেখার চেষ্টা করছে কেন, সেটাও একটা রহস্য। সম্ভবত এই আইডিয়াটা এদের যেকোন একজনের মাথা থেকে এসেছে – নজরুল সাহেব নিজেই হতে পারেন সেই একজন, পরে কোনভাবে অন্যদের সে ব্যাপারটায় যুক্ত করেছে নিজের অজান্তেই। যাই হোক না কেন, এটা বের করা দরকার কেন একজন এধরণের চিন্তা করতে যাবে! তাছাড়া এধরণের চিন্তার প্রভাব পরোক্ষভাবে রোগীর ওপর পড়ছে না, তাও বলা যায় না।
যে মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে, তার সাথে নজরুল সাহেবের সম্পর্ক কি ধরণের ছিল – এটা বের করাও খুব জরুরী। মনে হচ্ছে, ভদ্রলোক নিজের স্ত্রীর মধ্যে সেই আত্মীয়া মেয়েটার ছায়া খুজতে চাচ্ছেন। এটা কি একটা সম্ভাবণা যে, রুমানা যখন পাগলামি করছে তখন ভদ্রলোকের এক ধরণের আফসোস তীব্র হচ্ছে – ফলে তৈরি হচ্ছে ইচ্ছাপূরণের এক ধরণের প্রক্রিয়া?
রাফিজ রুমানার দ্বিতীয় সমস্যাটার সাথে প্রথমটার সম্পর্কও আন্দাজ করতে পারছে না। এটা না হয় বোঝা গেল যে, বয়:সন্ধির কোন সমস্যার কারণে রুমানা ভয় পেত। কিন্তু মেয়েটা কেন দ্বিতীয় একটা ভূমিকায় মাঝে মাঝেই অভিনয় করবে?
এগুলো ভাবতে ভাবতেই একসময় রাফিজের মাথাব্যথা আরো তীব্র আকার ধারণ করল – সে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে থেকে বড় করে নি:শ্বাস নিতে লাগল।
৯.
নজরুলের ফিরতে রাত হল, বেশ রাত। এলাকার এক্সিকিউটিভ ইনজিনিয়ারের অফিসে এতক্ষণ বসে ছিল সে। না থেকে উপায় নেই, এছাড়া ব্যবসা করা যাবে না। কিছু কাগজও নিয়ে এসেছে সে। রাতে বসে বসে রেট বসাতে হবে। ইনজিনিয়ার ভদ্রলোক মোটামুটি একটা আন্দাজ দিয়েছেন, ঠিকমত হিসাব-নিকাশ করে দাম দিতে পারলে কাজটা পাওয়া যাবার কথা।
ফিরেই নজরুল রুনার কথা জিজ্ঞেস করলেন জয়ন্তকে। সে জানাল, রুমানা খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়েছে।
“আজকে আবার মামীর জ্বর মত আসছিল।” – সে যোগ করল।
“জানি।”
“ডাক্তার ভাইয়ের সাথে কথা বলছে।”
“ভালো। আমি কিছু কাজ নিয়ে এসেছি, আমার টেবিলে বসব, রাত পর্যন্ত কাজ করব। আমাকে এক কাপ চা দিও।”
“জি, মামা।” – জয়ন্ত বেরিয়ে গেল।
নজরুল চট করে গোসল সেরেই খাবার টেবিলে এসে বসলেন। তার অভ্যাস জয়ন্তর জানা, টেবিলে খাবার রাখাই ছিল। নজরুল চারটা কোনমতে মুখে দিয়ে প্লেটেই হাত ধুয়ে নিলেন। তারপর লুংগিতে হাত মুছতে মুছতে তার কাজ-কর্মের টেবিলটায় এসে বসলেন। এখানে তার দরকারী সব কাগজ-পত্র আছে। ড্রয়ারে আলাদাভাবে সাজানো আছে প্যাড আর কোম্পানীর সিল। তার অনুমতি ছাড়া এই টেবিল কেউ গুছানোরও সাহস পায় না।
নজরুল টেবিলে বসেই একসিকিউটিভ ইনজিনিয়ারের অফিস থেকে আনা কাগজগুলো বের করলেন ব্যাগ থেকে। তারপর একসময় কাজে ডুবে গেলেন। জয়ন্ত এক ফাঁকে চা দিয়ে গেল, সে কিছু একটা বলেছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েও ছিল। নজরুল শোনেনওনি, উত্তরও দেননি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে চলে গেছে।
রাত আড়াইটার দিকে নজরুল কাজ কিছুটা গুছিয়ে আনতে পারলেন। এখন শুধু দরকারী কাগজগুলো সাজানো আর জায়গামতো সই করা। নজরুল চেয়ারে হেলান দিয়ে বড় করে একটা হাই তুললেন। আর তখনই একটা শব্দ হল দরজায়।
নজরুল মাথা তুলে তাকালেন, দরজায় রুমানা দাঁড়িয়ে আছে। নজরুল একটু অবাক হলেন, রুমানা সাধারণত এরকম পোশাক পরে না। সে গ্রামের মেয়েদের মত করে শাড়ী পরেছে, ব্লাউজ ছাড়া, শাড়ী প্রায় হাটু পর্যন্ত ওঠানো। সে হাসছিল।
“কি রুমানা, তুমি এতো রাতে? ঘুম আসছে না?”
রুমানা কিছু বললনা, সে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসতে লাগল নজরুলের দিকে – যেন ছোট মানুষের কোন খেলা।
নজরুল বেশ অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলেন। সত্যি কথা বলতে কি, এই মেয়েটার সাথে বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেননি। আর আজকাল তো রীতিমত ভয় পান তিনি একে।
তিনি হাতের কাগজগুলো গুছাতে গুছাতে কথা বলবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। রুমানা এর মধ্যে টেবিলটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
“কি, খারাপ স্বপ্ন দেখেছ আবার?” – নজরুল কথা চালিয়ে যাবার জন্য বললেন।
রুমানা হাসতে লাগল। তখন নজরুল লক্ষ্য করলেন, সে সম্ভবত পান খেয়েছে। রুমানাকে পান খেতে দেখেননি কখনো, অবশ্য এমন হতে পারে – সে দাওয়াত-টাওয়াত হলে পান খায়, তিনিই ভালো করে লক্ষ্য করেননি। আরেকটা জিনিস মনে হল নজরুলের – মেয়েটা ঘেমে নেয়ে গেছে। তার সারা শরীর ভিজে আছে। সে তার মাথাটা আরেকটু সামনে এগিয়ে দিয়ে হাসতে লাগল – নি:শব্দে।
নজরুলের অস্বস্তি বেশ বেড়ে গেল, তিনি বললেন – “রুমানা, এরকম ড্রেস তোমাকে মানায় না, আমার একদম ভালো লাগছেনা।”
সে হাসতেই লাগল, একই রকম নি:শব্দে।
“বলছি তো, আমার ভালো লাগছে না এসব।” – নজরুল বেশ অধৈর্য হয়েই বললেন।
রুমানা এবার টেবিল ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার হাসি আরো প্রশস্ত হল। নজরুল না দেখার ভান করতে লাগলেন।
রুমানা চলে গেল, যেভাবে এসেছিল সেরকমই নি:শব্দে। নজরুল যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি কাজে মন দিলেন আবার। প্রায় এক ঘন্টা কাজ করার পর কাজ পুরোপুরি শেষ হল তার। সবকিছু গুছিয়ে যখন তিনি ঘরে এসে ঢুকলেন, তখন রাত বাজে সাড়ে তিনটা।
রুমানা ঘুমাচ্ছে, একটা হালকা চাদর তার গায়ে। নজরুল পাশে এসে শুয়ে পড়লেন।
কি মনে হতেই চাদর একটু সরিয়ে দিয়ে দেখলেন – আশ্চর্য, রুমানা সাদা একটা গাউন পরে আছে।
নজরুল বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সে কি এরমধ্যে পোশাক বদলে শুয়ে পড়ল? শাড়ী পরে নিচে যাওয়া কি রুনার শুধুই একটা খেয়াল ছিল !
নজরুল রুমানাকে আস্তে করে ডাকলেন। রুমানার ঘুম এমনিতেই পাতলা, দুবার ডাকতেই উঠে বসল। উঠেই বলল – “তুমি কখন এসেছ?”
নজরুলের ভ্রু কুঞ্চিত হল, বললেন – “এইতো, কিছুক্ষণ আগে। তুমিতো একটু আগে গিয়ে দেখেও এসেছ?”
“কোথায়?” – রুমানাকে বিস্মিত মনে হল।
“তুমি একটু আগে নিচে যাওনি? আমার কাজের রুমে?”
“তোমার কাজের রুমে আমি কখনো যাই? তুমি কি যে বল না?” – বলে রুমানা পাশ ফিরল।
“তুমি কি রাতে পান খেয়ে ঘুমিয়েছো?”
“পান? কিসব আবোল-তাবোল বলছ? আমি আবার কবে পান খাই?”
“পান খাওনি তুমি?”
“উল্টো-পাল্টা কথা বোলোনা তো প্লীজ। ঘুমাও। পানের কথা শুনলেও আমার বমি আসে।”
নজরুল রুনার মুখের দিকে তাকালেন, আসলেও সে পান খেয়েছে বলে মনে হল না, রুমানার মুখ পানের রসে লাল হয়ে নেই একেবারেই। অথচ একটু আগে যখন তাকে দেখলেন, তার ঠোঁট পুরোই রাঙা ছিল পান-জরদার রঙে। তাহলে নজরুল একটু আগে নিচে কি দেখলেন?
নজরুল লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন, কিন্তু নানা চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। আজকাল কি হচ্ছে বাড়িতে এসব? তার মনে হচ্ছিল, এ জীবনে আর কোনদিন তার ঘুম আসবে না।
নজরুল শুয়ে থেকে শুধু শুধুই ঘামতে লাগলেন।
১০.
সকালে ঘুম ভাংগতে ভাংগতে ওর সাড়ে এগারোটার মত বাজল। জানলা দিয়ে দুপুরের রোদ এসে তার মুখের ওপর পড়ছিল। আশে-পাশে কোথাও একটা কাক তাড়স্বরে চীৎকার করছিল অবিরাম। রাফিজের মনে হল, আজ গরমটা একটু বেশিই।
শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছিল, ফলে কালকের এপিসোডের কথা মনে হতেই পুরো ব্যাপারটা কেমন যেন ছেলেমানুষি বলে মনে হতে লাগল ওর। অবশ্য কাল রিলাক্সিনের একটা মোটামুটি ভালোরকম ডোজই নিয়েছিল সে – একদম সময়মত। রাফিজের এমনকি সুখী মানুষের মত বেশ ক্ষুধা ক্ষুধাও লাগতে শুরু করল।
আজ ভালো কিছু খেতে হবে, যা মনে চায় তাই। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে কখনো কখনো ছেড়ে দিতে হয়, না হলে সৃজনশীল হওয়া যায় না। আর তার যে পেশা, তাতে কখনো কখনো সৃজনশীলতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে – দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে হবে, চিকিৎসাবিদ্যায় যাকে বলে ডায়াগনোসিস – রোগ নির্ণয়। অথচ তিন আর একেও চার হয়, আর সেটাও আরেকটা সম্ভাব্য ডায়াগনোসিস !
রেস্টুরেন্টে লোকজন তেমন ছিল না, হয়তো গরমের কারণে। সে কোনার দিকে একটা নিরিবিলি টেবিল নিয়ে বসল। একটা কমবয়সী ছেলে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু না বলে সে ভাবলেশহীন তাকিয়ে ছিল মাটির দিকে।
রাফিজের খারাপই লাগল – কতই বা বয়স হবে এর, অথচ এখনই কাজ করে নিজেরটা আদায় করার সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছে। আচ্ছা, কি হত যদি এরও স্কিজোফ্রেনিয়া থাকত ! সম্ভবত: পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াতে হত রাস্তায় রাস্তায়। কেই বা যত্ন করবে এদের ! আচ্ছা, কেমন হয় – যদি ছোটখাট একটা উদ্যোগ নেয়া যায় এদের বয়সী মানসিকভাবে অসুস্থ বাচ্চাগুলোর জন্য !
“তুই ভাত খেয়েছিস?” – রাফিজ জিজ্ঞাসা করল।
সে ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে রইল মানুষটির দিকে, হয়তো বুঝতে চেষ্টা করল – লোকটা কেন এসব জিজ্ঞেস করছে।
“ভাত খেয়েছিস?” – রাফিজ আবার বলে।
সে মাথা নাড়ল, এতে বোঝা গেল না সেটার অর্থ কি হ্যাঁ নাকি না।
“কি খাওয়া আছে আজকে তোদের এখানে?”
“বিরানী আছে, থিছুরি আছে!” – বলে সে আবার মাটির দিকে কি যেন লক্ষ্য করতে লাগল, যেন উত্তর জানার কোন তাড়া নেই।
“খিচুরীই দিস আমাকে।”
ছেলেটা চলে গেল। বসে থাকতে থাকতে রাফিজের চোখে পড়ল, একটা লোক বার বার তার দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। লোকটাকে চেনা চেনা মনে হল তার।
রাফিজ যখন খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখনো লোকটা বার বার তার দিকে তাকাচ্ছিল – সেটা রাফিজ বুঝতে পারছিল। রাফিজও মাঝে-মাঝেই লোকটার দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল। লোকটার চাপ দাড়ি আছে, মাথায় অল্প টাক, গায়ের রং শ্যামলা – কিন্তু কোথায় দেখেছে সে একে?
রাফিজ লক্ষ্য করল, লোকটা বেশ সময় নিয়ে যত্ন করে খাচ্ছে, আর এর মাঝেই তার দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছে। তাকানোর সময় রাফিজের সাথে তার চোখাচোখিও হচ্ছে, কিন্তু আশ্চর্য সে কখনো চোখ নামিয়ে নিচ্ছেনা।
রাফিজের খাওয়া চলে এল এরমধ্যে, সে আস্তে আস্তে খাওয়া শুরু করল। কিন্তু নিজেও লোকটাকে লক্ষ্য করতে লাগল।
লোকটা একসময় তার খাওয়া শেষ করে প্লেটেই তার হাতটা ধুয়ে নিল, তারপর প্লেটের সেই পানিটুকু তৃপ্তি নিয়ে খেল। বাচ্চা ছেলেটা ছোট ছোট টুকরো করে কেটে রাখা পুরনো খবরের কাগজের একটা তার হাতে দিল, সে সেটা দিয়ে ঘষে ঘষে হাত মুছতে লাগল।
এসবই রাফিজ বসে বসে লক্ষ্য করছিল, ঠিক তখনই একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল – লোকটা সোজা এগিয়ে এসে রাফিজের উল্টোদিকের চেয়ারে বসে পড়ল, তারপর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল – “তুমি রাফিজ না !”
রাফিজ কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিল, কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। কিন্তু তার দৃষ্টিই বলে দিচ্ছিল সে লোকটাকে চিনতে পারেনি।
“তুমি আমাকে চিনতে পার নাই, না?” – লোকটা হেসে মাথা নাড়ল।
রাফিজ তখনো মনে করার চেষ্টা করছে।
“আরে আমি মকবুল, ধানমন্ডিতে তোমাদের সামনের বাসায় থাকতাম। তোমাদের বাসায় কত গিয়েছি! তোমার বাবা ভালো আছে?”
রাফিজের এতক্ষণে মনে পড়ল লোকটাকে। একসময় খুব ভালোই পরিচয় ছিল এর সাথে তার। অবশ্য শেষের দিকে লোকটাকে আর পাড়ায় দেখেনি রাফিজ, শুনেছিল – এক পীরের মুরীদ হয়ে ঘর ছেড়েছে।
রাফিজ মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করল, ঠিক কি কারণে সে লোকটাকে প্রথমে চিনতে পারেনি। স্মৃতি কেন তার সাথে প্রতারণা করছে! এটা কি ওষুধের পরোক্ষ প্রভাব – সাইড ইফেক্ট ! নাকি সে অন্য মানুষকে তেমন গুরুত্বই দেয় না – চরম আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে সে !
“তা তুমি এখানে কি কর?”
“একটা কাজে এসেছি মাস খানেকের জন্য।”
“কি কাজ? চাকরী-বাকরী?”
“হ্যাঁ, সে জাতীয়ই।”
“ভালো, তা তুমি কি জানি করতে?”
“তখন ডাক্তারী পড়তাম, এখন মানসিক রোগের চিকিৎসা করি।”
“বল কি? এখানে কি ডাক্তারী করতেই এসেছো।”
“স্টাডি ধরণের একটা কাজ, তবে মেডিক্যাল স্টাডি।”
“ও, বুঝেছি। গবেষণা। ভালো, ভালো।”
“তা আপনি কি এখানেই থাকেন?”
“ও হ্যাঁ, এইটা তো আমাদের নিজস্ব এলাকাই – জমি-জিরাত আছে, সেগুলা দেখি। ব্যবসা করি, খামার আছে। তা এখানে কোথায় উঠেছো?”
রাফিজ বলল নজরুলদের বাসার কথা।
“ও, ওই বাসায় উঠছ তুমি? বল কি?”
“কেন? চেনেন নাকি?”
“আরে চিনবনা, সবাই চিনে। ওই বাসায় তো সমস্যা আছে।”
“সমস্যা মানে?”
“খারাপ বাতাস আরকি? তুমি টের পাও নাই?”
“কি টের পাব? – রাফিজ নড়েচড়ে বসল।”
“শেষরাত্রে ছাদে একটা মেয়েলোক হাটে, মেয়েটা কার্নিশের উপর একবার এপাশ থেকে ওপাশে যায়, আবার ফিরে আসে। অনেকেই দেখেছে।”
“আমি অবশ্য তেমন কিছু দেখিনি।”
মকবুল মাথা নাড়ল – “সবসময় দেখা যায় না, সবাই দেখেও না। তোমরা তো অবশ্য পড়ালেখা করেছ, এসবে বিশ্বাস করবে না।”
সে চায়ের অর্ডার দিয়েছিল, বোঝা গেল – দুই কাপ চা চলে এসেছে।
খেয়ে দেখ, বিখ্যাত চা। ভালো লাগবে।
এসময়ে চায়ের আইডিয়া খারাপ না – রাফিজ কাপে একটা চুমুক দিল।
“কি? কেমন মনে হয়?”
“কড়া মিষ্টি।” – সে বলল।
“কনডেন্স মিল্ক দেয়, পরে আবার চিনিও দেয়, এই জন্য মিষ্টি লাগে। আমি তো ডেইলি খাই।”
রাফিজ দেখল, লোকটা খুব আগ্রহ নিয়ে এবং আয়োজন করে চা খাচ্ছে।
“নজরুল সাহেবের পরিবার এখন কেমন আছে? উনি তো শুনেছিলাম পাগল হয়ে গিয়েছিল। আচ্ছা, তুমি কি উনার চিকিৎসার জন্যই আসছো?”
“আমি একটা গবেষণার কাজে এসেছি।”
“ও হ্যাঁ, গবেষণা,” – সে বুঝেছে এমনভাবে মাথা নাড়ল, তারপর বলল – “কিন্তু এবাসায় এসেই তো মেয়েটা পাগল হয়ে গেল।”
“তাই?”
“তুমি জানো না? তার পরিবার তো আমাদের এলাকারই মেয়ে। বিয়ের পরই মেয়েটা পাগল হয়ে যায়।”
“কিভাবে পাগল হল?”
“আরে, এই বাড়িতে তো জীনের আসর আছে। তাকেও আসর করেছিল।”
রাফিজ মাথা নাড়ল – “নজরুল সাহেব লোক কেমন?”
“সে তো বড় কন্ট্রাকটার। যে সরকারই আসুক না কেন, সে কাজ পাবে – এমন ধুরন্ধর লোক।”
রাফিজ হাসছিল – “কিন্তু আমার তো তাকে তেমন একটা ধুরন্ধর মনে হয়নি।”
“না, এমনিতে তো ছেলে ভালো। আর আজকাল চালাক-চতুর না হলে ব্যবসা করা যায় নাকি? তার বাবা এখানকার নামকরা উকিল ছিল – সেটা জানোতো?”
রাফিজ মাথা নাড়ল – সে জানতো না।
মকবুলের সাথে আরো অনেকক্ষণ সে কথা বলল। নজরুলের প্রসংগ ছাড়াও আগেকার ঘটনা নিয়ে আলাপ চলল কিছুক্ষণ – এরমধ্যে ছেলেটা এসে আরো দুই কাপ চা দিয়ে গেছে। মনে হল, যতক্ষণ এখানে থাকবে এভাবে চা আসতেই থাকবে।
রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরতে ফিরতে রাফিজের আড়াইটা বেজে গেল। বাইরের প্রচন্ড গরম থেকে ঘরে ঢুকে রাফিজের একটু শান্তি লাগল এজন্য যে অন্তত: রোদের হাত থেকে তো বাঁচা গেল। ঘরে ঢুকে সে দরজা লাগিয়ে দিল।
চশমাটা খুলে টেবিলে রাখতেই রাফিজের মনে হল, বাথরুমে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। কল কি সে ভুলে খুলে রেখে বের হয়েছিল? কিন্তু বাথরুমের কাছে গিয়ে মনে হল, গুনগুন করে গানের শব্দ। চুড়ির শব্দও হল বোধ হয়।
রাফিজ নিজের চিন্তা-ভাবনায় নিজেই অবাক হল। সে বাথরুমের দরজায় নক করল, এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল বাইরে।
ভেতরের শব্দটা তখন থেমে গেল। রাফিজ তখন আবার দরজায় নক করল। এবার দরজাটা অল্প একটু ফাঁক হল। ভেতর থেকে উঁকি দিল একটি নারীমুখ, চুল-মুখ ভেজা। রাফিজ চিনতে পারল, এই মেয়েটি সেদিন সন্ধ্যায় এখানে এসেছিল, তারপর না বলে চলে গিয়েছিল।
দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। রাফিজ বিছানায় গিয়ে পা তুলে বসল, সে বুঝতে পারছিলনা মেয়েটি ঘরে কিভাবে ঢুকল – তাকে যে তালাটা দেয়া হয়েছে, সম্ভবত: এর ডুপ্লিক্যাট চাবি আছে। কিন্তু সে তো তালা খুলেই ঘরে ঢুকল। নাকি তালা খুলেনি? রাফিজ দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেল, তার ঠিক মনে পড়ছে না – সে তালা খুলেই ঘরে ঢুকেছিল কিনা।
নাকি এই দুই ঘরের মধ্যের দরজাটা সে এপাশ থেকে ভুলে খোলা রেখেছিল ! এই ব্যাখ্যাটা তার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হল।
মেয়েটি বাথরুম থেকে বের হয়ে এসেছে, মাথার ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে বাঁধা। রাফিজ লক্ষ্য করল – তার ঘাড় বেয়ে পানি পড়ছে, জামাটাও জায়গায় জায়গায় ভিজে আছে। তাড়াহুড়ো করে গা মুছলে এরকম হয়।
“সরি, আমি বুঝতে পারিনি, আপনি চলে আসবেন। আমার ঘরে পানি নেই।”
“অসুবিধা নেই।” – রাফিজ বলল অন্যদিকে তাকিয়ে, ওর বিব্রতভাব তখনো কাটেনি।
“আপনি আসার আগে এ ঘরটা খালি ছিল, তখন মাঝখানের দরজাটা খুলে প্রায়ই চলে আসতাম – আমার ওদিকে পানি না থাকলে এই বাথরুমটা ব্যবহার করতাম। আজও দেখি খোলাই আছে, তখন চলে আসলাম।”
“আপনি দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, প্লীজ বসুন।”
“না, চলে যাই। আপনি তো বাইরে থেকে এসেছেন।”
“আমি অবশ্য মনে মনে ভাবছিলাম আপনার সাথে কথা বলব। সেটা অবশ্য পরেও হতে পারে।”
“পরে হবে কেন? আপনি এখনই বলতে পারেন।” – সে সামনের চেয়ারটায় বসল।
রাফিজ দেখল – মেয়েটা সোফাটায় হেলান দিয়ে বসেছে, তার কোন তাড়াহুড়ো আছে বলে মনে হল না। তাই রাফিজ কিছু কিছু বিষয়ে আলাপ সেরে নেয়ারই সিদ্ধান্ত নিল। এই মেয়েটার জন্য তিনটা প্রশ্ন সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, সে এই তিনটা ব্যাপারেই আলাপ করবে। এক – রুমানার ভয় পাওয়া, দুই – তার ওপর তথাকথিত আসর হওয়ার বিষয়টা, এবং তিন – রুমানার অসুস্থতার সময়টা তার ভেতর ওরা কার চেহারা দেখতে পায়।
রাফিজ তার নিজের মত করে প্রশ্ন শুরু করল – “আপনি জানেন কিনা জানিনা, আমি একজন চিকিৎসক, নজরুল সাহেবের স্ত্রীর একটা সমস্যার কথা জেনে এসেছি। সে ব্যাপারেই কথা বলতে চাচ্ছিলাম, অবশ্য আপনার যদি এই মুহূর্তে সেরকম সময় থাকে।”
“আপনি বলুন, অসুবিধা নেই।”
“নজরুল সাহেবের স্ত্রী ভয় পান। এ ব্যাপারে আপনি কতটুক জানেন?”
“ভাবী ছোটবেলা থেকেই ভয় পান। আমি শুনেছি, এটা তার পুরনো সমস্যা।”
“বিয়ের পর কি এটা বেড়েছে? মানে আপনি এ ব্যাপারে কি কিছু জানেন?”
“আগেও নাকি ভয় পেত, বিয়ের পরে তো পায়ই। সবাই বলে, কেউ তাকে ভয় দেখায়।”
“কে তাকে ভয় দেখাবে?”
মেয়েটা চুপ করে বসে ছিল। রাফিজ অপেক্ষা করছিল।
“আপনি কি জীন-পরী বিশ্বাস করেন?” – মেয়েটা হঠাৎই জিজ্ঞেস করে।
“হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
“সবাই কিন্তু মনে করে, ভাবীকে ঐ ধরণের কিছুই ডিস্টার্ব করছে।”
“প্রথমেই এধরণের সিদ্ধান্তে চলে আসা বোধ হয় ঠিক না।”
“আপনি সম্ভবত এসব বিশ্বাস করেন না, তাই না?”
“আমার বিশ্বাস করতে আপত্তি নেই, কিন্তু তার আগে আমরা বাস্তব সম্ভাবণাগুলোকে যাচাই করে দেখছি না কেন?”
“এটাওতো বাস্তব হতে পারে, তাই না? আমি নিজেও কিন্তু স্কুলে বিজ্ঞান পড়াই। আচ্ছা, এমন কি হতে পারেনা, মানুষের আত্মার নিয়ন্ত্রণ কিছু জিনিসের ওপর, যাকে আমরা শরীর বলি। ওরকম, ওদের আত্মার নিয়ন্ত্রণ কিছু শক্তির অর্থাৎ ফোর্সফিল্ডের ওপর। মানে ওদের শরীর শক্তির তৈরি, এমন কি হতে পারে না?”
“ইন্টারেস্টিং তত্ত্ব, কিন্তু তারপরও খুব দ্রুত কোন সিদ্ধান্তে চলে যাওয়া বোধ হয় ঠিক হবে না।”
সে আবার চুপ হয়ে গেল।
“আচ্ছা, উনার ছোটবেলা সম্পর্কে কার কার কাছ থেকে সলিড তথ্য পাওয়া যেতে পারে? আমি উনার মায়ের সাথে কথা বলব, যদিও ভদ্রমহিলার কাছ থেকে বায়াস্ড তথ্য পাবার সম্ভাবণা আছে।”
“সেটা কেমন?” – মেয়ে জানতে চাইলো।
“ছেলেমেয়ের সমস্যা অনেকসময়ই বাবা-মায়ের সমস্যার এক্সটেনশান হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে উনার দেয়া তথ্যটাই ভুল তথ্য হতে পারে।”
“আমি আরেকজনের কথা বলতে পারি, যে ভাবীর ছোটবেলা সম্পর্কে জানে।”
“প্লীজ, বলুন।”
“উনি নুসরাত আপা, ভাবীর খালাতো বোন।”
“কোথায় থাকেন উনি?”
“এখানেই থাকেন। উনারও বিয়ে হয়েছে এখানেই, প্রেমের বিয়ে। হাজব্যান্ড সরকারী কলেজে পড়ায়।”
“আপনি ঠিকানা জানেন?”
“হ্যাঁ।”
রাফিজ পাশ থেকে তার নোটবইটা খুলে একটা পাতা ছিড়ে এগিয়ে দিল নীপার দিকে, সাথে কলমটা – এখানে লিখে দেবেন প্লীজ।
আমার তো ঠিকানা মুখস্ত নেই, তবে আপনাকে লিখে দিয়ে যাব।
“দেখুন,” – রাফিজ বলল – “আসলে আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পছন্দ করি। আমি যদি ঠিকানাটা নজরুল সাহেবের শ্বাশুড়ীর কাছ থেকে নিই, তাহলে উনি সাথে সাথে যোগাযোগ করবেন আপনার সেই নুসরাত আপার সাথে। তখন আবার সেই মহিলার তথ্যগুলোও বায়াস্ড হয়ে যাবে।”
“আমি বুঝতে পেরেছি।” – নীপা মাথা নাড়ল।
রাফিজ তার পরবর্তী প্রশ্নটা করল – “এবার নজরুল সাহেবের প্রসংগ। উনিও দেখি আজকাল ভয় পাচ্ছেন, বিশেষ করে নিজের স্ত্রীর কিছু কিছু আচরণে। এ ব্যাপারটা সম্পর্কে কি আপনি কিছু জানেন?”
মেয়েটা প্রশ্নটা ভালো করে শুনল, তারপর মিটিমিটি হাসতে শুরু করল।
“আপনি হাসছেন যে?”
“না, অন্য একটা কথা ভাবছিলাম,” – তাড়াতাড়ি বলল সে – “হ্যাঁ, কি যেন বলছিলেন?”
“বলছিলাম, নজরুল সাহেব নিজেও আজকাল ভয় পাচ্ছেন।”
এ সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানিনা – মেয়েটা বলল। সে মাথা নিচু করে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু রাফিজের কেন যেন মনে হল, সেই মিটিমিটি হাসিটা এখনো তার মুখে অল্প অল্প লেগে আছে।
“এবার অন্য ধরণের একটা প্রসংগ,” – রাফিজ তার সাক্ষাৎকার পর্ব চালিয়ে যায় – “যদিও মূল সমস্যার সাথে এটার কোন সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। ওরা আপনার ভাবীর মধ্যে মৃত একটা মেয়ের চেহারা খুঁজে পাচ্ছে। আপনারও কি সেরকম কিছু মনে হয়েছে কখনো?”
মেয়েটা কিছুক্ষণ রাফিজের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর হেসে ফেলল।
রাফিজও অল্প হাসল – “আমি জানি, এটা হাস্যকর। এজন্য এটা আপনাকে বলেও নিয়েছি যে ব্যাপারটা গুরুত্বহীনও হতে পারে। কিন্তু আমি বোঝার চেষ্টা করছি, যে কেউই হোক না কেন, সে কেন আপনার ভাবীর ভেতর আরেকটি মেয়ের ছায়া খোঁজার চেষ্টা করবে। আমি আসলে বুঝতে চাচ্ছি, এর পেছনে ফ্যামিলির অন্য কারো কোন মানসিক কমপ্লেক্স কাজ করছে কিনা। সেটা যদি বাই চান্স হয়ে থাকে, তাহলে সেই অন্য মানুষটার সেই বিশেষ কমপ্লেক্সটা রুমানার সমস্যার পেছনে পরোক্ষ অবদান রাখতে পারে।”
“আপনি খুবই বুদ্ধিমান।” – মেয়েটি হেসে বলল।
“আপনি কিন্তু এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেননি। আমি আসলে যেটা জানতে চাচ্ছিলাম সেটা হল, আপনি এ ধরণের কিছু লক্ষ্য করেছেন কিনা, বিশেষ করে যখন উনার ওপর তথাকথিত আসর হয়?”
মেয়েটি তখনো অল্প অল্প হাসছিল, বলল – “আমি ওদের ওখানে তেমন একটা যাই না।”
রাফিজের হঠাৎ মনে হল, মেয়েটা কিছু বলতে চাচ্ছে, কিন্তু কোন কারণে একটু ইতস্তত করছে। শেষে একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলল – “আপনার সাথে খোলাখুলি বলা যায় হয়তো, আপনি কি ভাবীকে লক্ষ্য করেছেন?”
রাফিজ একটু কপাল কুচকালো – “হ্যাঁ, একটু চুপচাপ। কিন্তু কেন বলুন তো?”
“হয়তো আপনার মনেও প্রশ্নটা এসেছে। আচ্ছা, কথাটা আপনাকে এভাবে বলি – আমি কিন্তু উনাদের সাথেই থাকতে পারতাম, কিন্তু তারপরও আলাদা থাকাই ভালো মনে করলাম, এখানে আমি তো বলতে গেলে একাই থাকি। আসলে বেশি কাছাকাছি থাকলে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে।”
“আমি বুঝতে পেরেছি।” – রাফিজ বলল।
“আমি একটু দূরে থাকি এটা ভেবে, হয়তো ভাবী ওখানে বেশি যাওয়া পছন্দ করবে না।”
“আমি বুঝতে পারছি।” – রাফিজ তাড়াতাড়ি বলল, তারপর যোগ করল – “আমি অবশ্য ঐ অবস্থায় তাকে একবার দেখেছি।”
“তাই?” – মেয়েটা তখনো মিটিমিটি হাসছিল, রাফিজের কাছে এ ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিকই মনে হল।
“মজার ব্যাপার হল, উনার সাথে আপনার চেহারার বেশ মিল। আজকে আপনার সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হবার পর আরো বেশি করে মনে হচ্ছে কথাটা। বাই এনি চান্স, আপনারা অর্থাৎ নজরুল সাহেবরা কি কোনভাবে আপনার রুমানা ভাবীদের আত্মীয়?”
মেয়েটির হাসি বিস্তৃত হল – “আমরা সবাই মা হাওয়া থেকে হয়েছি, সে অর্থে তো অবশ্যই একজন অন্যজনের আত্মীয়।”
রাফিজ অল্প হাসল, কিন্তু কি একটা অস্বস্তি তার মনের ভেতর কাজ করতে থাকল। বার বার মনে হতে থাকল, কি যেন জিজ্ঞেস করা হয়নি – খুব জরুরী কিছু, যা এই মেয়েটার কাছ থেকে জানা দরকার ছিল, কিন্তু এখন মনে পড়ছেনা। কি যেন বিষয়টা, কি যেন?
মেয়েটা মাথা থেকে তোয়ালে খুলে ফেলল, ভেজা চুল ছড়িয়ে পড়ল তার পিঠে। সে তখনো ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রেখেছে একটা রহস্যময়ী হাসি।
“আপনার তিনটা প্রশ্ন শেষ হয়েছে?” – মেয়েটি উঠে দাঁড়াল।
রাফিজ চমকে উঠল – ওর যে তিনটাই প্রশ্ন ছিল, তা তো কখনো মেয়েটাকে বলেছে বলে মনে পড়ছে না।
“আমি তাহলে উঠি।” – সে উঠে দাঁড়াল।
রাফিজও নি:শব্দে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটা তাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল, যাবার সময় মাঝখানের দরজাটা ব্যবহার করল। ওর চলে যাবার সময় রাফিজ একটা ফুলের গন্ধ পেল, কোন হালকা পারফিউম হবে হয়তো।
এ সাক্ষাৎকারটা রাফিজের জন্য খুবই তথ্যবহুল হয়েছে, কিন্তু সাথে সাথে ওর মনে কিছু নতুন প্রশ্নও জেগে উঠেছে। রাফিজের খুবই ক্লান্ত লাগছিল, সে বিছানায় পিঠ লাগিয়ে চলন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রশ্নগুলো মনে মনে সাজিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। কিন্তু ক্লান্তির কারণেই হয়তো একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
১১.
রাফিজ নজরুলদের ড্রইংরুমে বসেছিল। সে আসলে জয়ন্তর জন্য অপেক্ষা করছিল, জয়ন্ত বলেছে আনোয়ারা বেগমের বাসার ঠিকানাটা রাফিজকে লিখে দেবে। বসে বসে আজকের পেপারটা দেখছিল সে। তখন ঘরে এসে ঢুকল রুমানা। সে হেসে সম্ভাষণ জানাল রাফিজকে – “কেমন আছেন? সেদিন জ্বরের ঘোরে আপনাকে কি না কি বলেছি, কিছু মনে করবেননা ভাই।”
“আমার নিজেরও ভয়াবহ জ্বরের অভিজ্ঞতা আছে, সেরকম হলে কি অবস্থা হয় খুব ভালো করে জানি।” – রাফিজ হাসল।
“আপনি সম্ভবত আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন।” – রুমানা বলে। সালোয়ার-কামিজে তাকে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তরুনী বলে মনে হচ্ছিল, কিন্তু একটা গাম্ভীর্য ছিল ওর কথার মধ্যে। আর আশ্চর্য, তার চেহারাটা সেদিনের থেকে বেশ আলাদাই মনে হচ্ছে, আজ দিনের আলোতে তার চেহারাটা আর ওই নিপা মেয়েটার মতো লাগছে না মোটেই।
“হ্যাঁ,” – রাফিজ বলল – “কিন্তু আপনার কি জ্বর সেরেছে? সেদিন কিন্তু আপনার বেশ টেম্পারেচার ছিল।”
“গত দুইদিন তো আমার আর জ্বর আসেনি।”
কথা বলতে বলতেই চা চলে এল – সম্ভবত: এই কথোপকথনটা রুমানার পূর্বপরিকল্পিত।
“আমরা তো তাহলে এখনও কথা বলতে পারি।” – রাফিজ বলল।
“হ্যাঁ, মনে হয় এটা খারাপ হবে না।”
রাফিজ শুরু করল – “আপনি হয়তো জানেন, মূলত আপনার সমস্যাটার জন্যই আমি এখানে এসেছি।”
“কি জানতে চান বলুন।”
“আপনার সমস্যা সম্পর্কেই বলুন। সেটাই হোক স্টার্টিং পয়েন্ট।”
রুমানা জানালার বাইরে তাকাল, যেন কিছু চিন্তা করে নিচ্ছে – “আমার সমস্যাটা অনেক পুরনো, তবে তার ধরণ পাল্টেছে সময় সময়। আগে সমস্যাটা ছিল ভয় নিয়ে – ছোটবেলায় খুব ভয় পেতাম।”
“সরি, একটু জিজ্ঞেস করে নিই। ছোটবেলায় সবাই কম-বেশি ভয় পায়। আপনার বিষয়টা সেগুলো থেকে কিভাবে আলাদা ছিল?”
“আলাদা ছিল এই ভাবে যে, আমি একই জিনিস প্রতিবার দেখতাম।”
“স্বপ্নে?”
“স্বপ্নে তো দেখতামই – একই ভয়ের স্বপ্ন বারবার দেখতাম – কিন্তু মাঝে-মধ্যে সত্যি সত্যিও দেখতাম।”
“বাস্তবেও দেখেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“বাস্তবের ঘটনা দু-একটা বলুন।”
রুমানা একটু সময় নিল, যেন ভেবে নিচ্ছে – “বেশ কয়েকবারই এরকম হয়েছে। যেমন, এক দুপুরে রান্নাঘরে গেছি আচার আনতে। আমাদের একটা কাজের বুয়া ছিল, রহিমার মা। রান্নাঘরে ঢুকেই মনে হল, রহিমার মা দাঁড়িয়ে আছে – ও আমার দিকে পেছনে ফিরে ছিল। আমি ডেকে বললাম, সে যেন আমাকে আচারের বয়মটা দেয়। সে হাত বাড়িয়ে আচারের বয়মটা নিয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল, দেখি কি … এই যে দেখেন আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে … দেখি, ওর মুখের জায়গাটা … চিন্তা করতেই কেমন লাগে … মুখটা হলুদ আর তাতে কোন চোখ-মুখ নেই … উফ, কি ভয়ংকর !”
“আপনি তখন কি করলেন?”
“আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।”
“রহিমার মা কি এখনো আপনাদের সেই বাসায় কাজ করে?”
“না, সে তো কবেই চলে গেছে ! কিন্তু কেন?”
“এ ধরণের ঘটনাগুরো নিয়ে তার সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হত।”
“সে তো বলে, সে রান্নাঘরে এসে দেখে আমি নিচে পড়ে আছি।”
“বলতে চাচ্ছেন, সে ঐ সময় রান্নাঘরেই ছিলই না? আপনি নিশ্চিত?”
“না, সে ছিল না? খুব জোর দিয়ে বলেছে সে।”
রাফিজের ভ্রু কুঞ্চিত হল – সে কি যেন ভাবছিল।
“আর স্বপ্নে একটা লম্বা লোককে দেখতাম – অনেক লম্বা, ছাদ পর্যন্ত লম্বা। মুখটা বিশ্রী, মাথা শরীরের তুলনায় বড়। প্রতিদিন একই লোককে স্বপ্নে দেখতাম।”
“কি দেখতেন?”
রুমানা চুপ হয়ে গেল, ওর দৃষ্টি ছিল অন্যদিকে। রাফিজ অপেক্ষা করছিল উত্তরের জন্য।
“সে আমাকে ধরতে চাইত, আমি দৌড়ে পালাচ্ছি, একসময় সে আমাকে ধরে ফেলল।” – অনেকটা এরকম।
“প্রতিদিন একই ঘটনা?”
রুমানা আবার চুপ হয়ে গেল, কিছুটা সময় নিয়ে তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে বলল – “না।”
স্বপ্নে অনেক কিছু ঘটে যা পুরোপুরি শ্লীল না, সুতরাং রাফিজ এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না বলে ঠিক করল। সে কি যেন একটু ভেবে নিয়ে তারপর বলল – “এই কুৎসিত ধরণের লোকটার স্বপ্ন আপনি কবে থেকে দেখা শুরু করেন?”
রুমানা যেন বাস্তবে ফিরে এল – “কবে থেকে? এই ধরেন, আমি যখন নাইন কি টেনে পড়ি। হ্যাঁ, নাইন-টেনই হবে … মেট্রিকের আগের ঘটনা এগুলো।”
“কতদিন দেখেছেন এই লোকটার স্বপ্ন?”
মেয়েটা রাফিজের দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন কি বলবে বুঝে পাচ্ছে না। শেষে বলল – “এখনো দেখি।”
“বিয়ের আগে বেশি দেখতেন, নাকি বিয়ের পর বেশি?”
“আগে বেশি দেখতাম।”
রাফিজ চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো – সে গভীরভাবে কি যেন ভাবছে।
“কিন্তু বিয়ের পর অন্য ধরণের স্বপ্নও যোগ হয়েছে।”
কি ধরণের স্বপ্ন? ভয়ের?” – রাফিজ চোখ খুলল।
“ভয়ের তো অবশ্যই।”
“কিরকম?”
“কালো কুকুর দেখি, দেখি – ওরা আমার বাসার চারদিকে ঘোরাঘুরি করছে। দরজা বা জানলা খোলা পেলেই ঘরে ঢুকে পড়বে।”
“ঘরে ঢুকে পড়লে কি হবে? মানে কি হবে বলে আপনি মনে করেন?”
“একবার ঢুকে পড়লে ওরা আমাকে কামড়ে ছিড়ে ফেলবে। আমি এখন পর্যন্ত এমন কিছু দেখিনি, কিন্তু আমি কেমন করে যেন জানি – এটা হবে।”
রাফিজ তার নোটখাতায় আকিবুকি করছিল, এখন পর্যন্ত একটা শব্দও সে লিখেনি ওটাতে।
আমি জানি, ওটা যেদিন দেখব – “সেদিন আমি হয় হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যাব, নাহলে সেদিন থেকে আমি পাগল হয়ে যাব।”
রাফিজ নোটবই থেকে মুখ তুলে তাকাল – “সেটা হতে যাবে কেন? আমরা সবাই আপনার আশে-পাশে আছি।”
রুমানার মুখটা খুব করূণ লাগছিল – ভরসা হারানো দৃষ্টি তার দু’চোখে।
“আপনার ছোটবেলায় আপনাকে খুব কাছে থেকে দেখেছে, এমন কারো সাথে কথা বলা যায়?” – নোটখাতায় কি একটা লিখে সে রুমানাকে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, আপনি মায়ের সাথে কথা বলতে পারেন।”
“আর কেউ?”
“আর কেউ? … না, আর কাউকে তো মনে পড়ছেনা। বাবা তো সবসময় ব্যবসার কাজে বাইরে বাইরে থাকত।”
“আপনার ভাই বা বোন, কাছাকাছি বয়স এরকম…”
“আমার ভাই-বোন নেই, আমি বাবা-মার একমাত্র সন্তান।”
রাফিজ আরেকটা কি যেন লিখল নোটে। তারপর বলল – “আর যে সময়টা আপনার জ্বরের মত হয়, আপনার কি কিছুই মনে থাকেনা?”
“না, কিছুই মনে থাকে না।”
রাফিজ আবার নোট করে। লিখতে লিখতেই বলে – “আপনাদের মানে নজরুল সাহেবদের একজন আত্মীয়া বোধহয় আত্মহত্যা করেছিল। সে ঘটনা সম্পর্কে আপনি কতটুক জানেন?”
রুমানা কিছু বলল না ।
“আমি জানি, এটা স্পর্শকাতর একটা বিষয় – এরকম ঘটনা সম্পর্কে আলাপ করতে কারো ভালো লাগেনা। কিন্তু এটার ব্যাপারে আমার জানতে হবে।”
সে তবুও কিছু বলল না।
“আপনি কি তার আত্মহত্যার কারণ জানেন?”
রুমানা দুপাশে মাথা নাড়ল – সে জানে না।
“তাকে কি আপনি কাছে থেকে দেখেছেন?”
সে এবার হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
“তাকে কি আপনি পছন্দ করতেন, নাকি অপছন্দ করতেন?”
“অপছন্দ করতাম না।”
উত্তরটা শোনার সময় রাফিজ রুমানার বলার ধরণটা লক্ষ্য করল।
“তার সাথে কি আপনার ঘন ঘন দেখা হত? সপ্তাহে একবার? মাসে একবার? বছরে …”
“মাসে একবার।” – রুমানা বলল। রাফিজ এটা নোট করে নিল। এছাড়াও সে আরো কি যেন লিখছিল।
“আচ্ছা, অনেক লেখাপড়া করলে মানুষ কি নাস্তিক হয়ে যায়?” – হঠাৎ মেয়েটা জিজ্ঞেস করে।
রাফিজ হেসে ফেলল – “তা হবে কেন?”
“এই যে যতজন ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি, জীন-ভূতের কথা বলার সাথে সাথে তারা আমাকে পাগল মনে করে। আর আপনি তো পাগলেরই ডাক্তার।”
“আমি একজন সায়কায়াট্রিস্ট, একজন স্বাভাবিক মানুষেরও মানসিক সমস্যা হতে পারে।” – রাফিজ হেসে বলল – “আজকের এই জটিলতায় ভরা পৃথিবীতে মানসিক সমস্যা না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক। মনে রাখবেন, সর্দি-কাশি যেমন স্বাভাবিক জিনিস, অল্প-বিস্তর মানসিক সমস্যাও সেরকম স্বাভাবিক। কারো মানসিক সমস্যা হওয়া মানে এই না যে – সে পাগল হয়ে গেল, আর কখনো ঠিক হবে না।”
“আমার সমস্যা কি ঠিক হবে?”
“অবশ্যই হবে। আমাদের শুধু কারণটা ঠিকভাবে বের করতে হবে, আর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।”
“আপনি তো সবই শুনেছেন, আপনার তাহলে কি মনে হচ্ছে – এসবের কারণটা কি?”
“সেটা আমি এখনও নিশ্চিত নই।”
“নিশ্চিত নন কেন?”
“কারণ, আমি আপনার মনের বাইরের দিকটাই শুধু দেখতে পাচ্ছি। আপনার মনের ভেতরে কি ঘটছে, সেটা সম্পর্কে জানতে হলে আমাকে দেখতে হবে বিভিন্ন অবস্থায় আপনার প্রতিক্রিয়াগুলো। তারপর সেগুলো নিয়ে বসে ভাবনা-চিন্তা করে আন্দাজ করতে হবে আপনার মনের ভেতরের অবস্থাটা, এটা খুব সহজ কাজ না।”
“কিন্তু এটা কিরকম যে, বেশিরভাগ সময়ই আমি সুস্থ থাকি – এই যেমন এখন, আর হঠাৎ হঠাৎ পুরোপুরি অন্য মানুষ হয়ে যাই। এমনকি সেসময় আমি নিজে কি কি করেছি তাও পরে বলতে পারিনা?”
রাফিজ দীর্ঘশ্বাস ফেলল – “আপনি ঠিকই বলেছেন, আমাদের বের করতে হবে আপনার ট্রিগারগুলো অর্থাৎ কি কি জিনিস ঘটলে আপনার এপিসোডগুলো শুরু হয়। এগুলোকে মনোবিজ্ঞানে দ্বৈত ব্যক্তিত্বের লক্ষণ বলে। কিন্তু সেটা বলার মত অবস্থা এখনও কিন্তু আসেনি। যা হোক সেসব তো পরের কথা, আসল কথা হল – আপনাকে আমি যতটুকু দেখেছি তাতে আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে আপনি যে সুস্থ হয়ে উঠবেন। আর আরো নিশ্চিত হলাম আজ আপনার সাথে কথা বলে।”
“তাহলে আমি যে জীন-ভূতের কথা বলেছি, এজন্য আপনি আমাকে পাগল ভাবছেন না?”
“কখনোই ভাবছি না। অনেক সুস্থ মানুষও এগুলো বিশ্বাস করে, নিউটনও প্রেতাত্মা বিশ্বাস করতেন। উনি মনে করতেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রেতের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়।”
“উনি তো অনেক বড় সায়েন্টিস্ট, উনি কি সেটা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন?”
“না, কারণ প্রেতের স্যাম্পল জোগাড় করা খুব কঠিন, পাওয়াই যায় না।” – রাফিজ হেসে বলল। কিন্তু সে লক্ষ্য করল, রুমানার যেন মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
“তাহলে তো আপনি আসলে নাস্তিকদের দলেই?” – সে বলল।
“আমি কোন নির্দিষ্ট দলে নেই,” – রাফিজ হাসতে হাসতেই বলল – “আমার নিজের একটা গল্প বলি। একবার এক রুমমেট পেয়েছিলাম, সে হাত দেখতে জানত। সে আমার অতীত সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছিল, যেটা তার জানার কথা না, সেগুলো আমি তাকে কেন কাউকেই বলিনি কোনদিন। তাহলে সে সেগুলো কিভাবে জানল? আমি অনেক সম্ভাবনা চিন্তা করলাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু বের করতে পারলামনা। এদিকে সে প্রায়ই আমার হাত দেখে এটা-ওটা বলে, বেশিরভাগ সময়ই তা মিলে যায়। তখন আমি ধরে নিলাম, সে কোনভাবে এসব পারে। কিভাবে পারে, এটা জানা হয়তো আমার পক্ষে সম্ভবও না। আসলে সবকিছু মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, কারণ আমাদের মস্তিষ্ক সীমিত, আমাদের ইন্দ্রিয় মাত্র পাঁচটি। আমরা এমনকি আলোর তরংগগুলোর মধ্যে মাত্র সাতটি রং দেখতে পাই, অতিবেগুনী রশ্মি বা অবলোহিত আলো আমরা দেখতে পাই না। এতো সীমাবদ্ধতা নিয়ে সবকিছু বুঝতে পারার আশা করাও ঠিক না।”
রাফিজ একটু থামল। রুমানা মন দিয়ে শুনছিল।
“যেটা বলছিলাম, আমার সেই বন্ধুটার একটা কথা বিশ্বাস করে আমি একবার খুব বড় বিপদ থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম।”
“তাই?” – রুমানাকে আলাদারকম আগ্রহী বলে মনে হল।
“একবার ঢাকার বাইরে পিকনিকে গেল মেসের সবাই। সে যেতে চাচ্ছিল না। পিকনিকের আগের রাতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে কেন যাবে না। সে বলল, এখানে সে বিপদের সম্ভাবণা দেখতে পাচ্ছে। আমি খুব হাসলাম, বললাম – বিপদ যদি লেখাই থাকে, তাহলে তুমি ভবিষ্যদ্বানী করে তাদের সাবধান করলেও হবে, না করলেও হবে। সে কিছু বললনা, চিন্তিত মুখে বসে রইল। পরদিন অবশ্য আমি কি মনে করে যাই নি।”
“পিকনিকে কোন বিপদ হয়েছিল?” – রুমানা বাঁধা দিয়ে বলে।
“আশ্চর্য! হ্যাঁ। বাস এক্সিডেন্ট হয়েছিল। কেউ মারা যায়নি, তবে কয়েকজন মারাত্মক আহত হয়েছিল, কাউকে কাউকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল তিন মাসেরও বেশি।”
“আশ্চর্য, তাই না!”
“হ্যাঁ, এটা আমার জীবনে দেখা অল্প কয়েকটা ঘটনার একটা, যার ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাইনি। আমার সেই বন্ধু বলত – ভবিষ্যদ্বানী করা মেঘ দেখার মত, মেঘ হলে বৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু বৃষ্টি না হয়ে মেঘ কেটে গেলেও কিছু বলার নেই, কিন্তু মেঘ দেখলে ছাতা নিয়ে বের হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।”
“আপনি কি মেঘ দেখলে ছাতা নিয়ে বের হন?”
রাফিজ চমকে ওর দিকে তাকাল, মেয়েটাকে যতটা মনে হয় তার চেয়ে এর বুদ্ধি অনেক বেশি বলেই মনে হচ্ছে।
“ভাগ্য যদি আগে থেকেই লেখা থাকে, তাহলে কেউ ভাগ্য গুনে নিয়েও একই ভুল করার কথা যে ভুলের কথা ভাগ্যে লেখা আছে।” – রাফিজ অন্যমনস্কভাবে বলে।
রুমানা তার দিকে তাকিয়ে ছিল। রাফিজ বলল – “আমার আর কিছু জানার নেই আপাতত:।”
মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। শেষ বিকেলের আলো পড়ছিল তার চোখে-মুখে, সাদা ধরণের পোশাকটাও হয়ে উঠছিল কমলা ধরণের – অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল রুমানাকে। রাফিজের মনে হল, রুমানাকে আজ প্রথম দিনের তুলনায় একটু যেন মোটা লাগছে – প্রথমদিন তাকে কেমন যেন কৃষকায় মনে হচ্ছিল। অথবা আটো-সাটো পোশাকে ওর স্বাস্থ্য ভালো বলে মনে হচ্ছে।
“শেষ একটা প্রশ্ন।” – রাফিজ নিজেও উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল।
“বলুন।”
“স্কুলের শেষের দিকে, ধরেন সামনে যখন আপনার মেট্রিক পরীক্ষা, আপনি কি অসুস্থ থাকতেন?”
“নাতো।”
রাফিজ মাথা নাড়ল।
“আমার স্বাস্থ্য সবসময়ই খুব ভালো।” – রুমানা হেসে বলল – “আমার অসুখ-বিসুখও হত খুব কম। আপনি কি জানেন, আমি স্কুলে মেয়েদের হ্যান্ডবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলাম? অসুস্থ ধরণের হলে কি কেউ সেটা হতে পারে?”
রাফিজ মাথা নাড়ল – “না, তা অবশ্য পারে না।” – সে বলল।
রুমানা ইশারায় বিদায় জানিয়ে বাইরে চলে গেল। বাইরে তখন মাগরিবের আযান হচ্ছিল।
১২.
খুট করে একটা শব্দ হওয়াতে রাফিজের ঘুম ভেংগে গেল। রাফিজ কান পাতল। অনেকক্ষণ ধরেই কি শব্দটা হচ্ছে! একবারের শব্দে তো তার ঘুম ভেঙে যাবার কথা না।
রাফিজ ঘড়ি দেখল, রাত প্রায় একটা বাজে। ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঠিক তখনই শব্দটা আবার হল। এরপর রাফিজ দরজা খোলার শব্দ পেল – ওপাশের ঘরের দরজাটা।
রাফিজ চুপ করে শুয়ে ছিল, সে দেখতে চায় কি ঘটছে। একটা অবয়ব আস্তে করে ঢুকল এ ঘরে, সেটা স্পষ্ট বোঝা গেল। কিন্তু এরপর সে কোথায় গেল, সেটা বোঝা গেলনা।
না, আর অপেক্ষা করা যায়না – রাফিজ বালিশ থেকে পাশের টেবিল ল্যাম্পটার দিকে হাত বাড়ালো। আর ঠিক তখনই শুনতে পেল একটি নারীকণ্ঠ – “প্লীজ, ওটা জ্বালাবেন না।”
“আপনি? এত রাতে?” – রাফিজ সনাক্ত করতে পারল, এটা সেই নীপা নামের মেয়েটি।
“খুব গরম লাগছে, আপনার রুমটাতে বাতাস আছে।”
রাফিজ ভেবে পেলনা কি বলবে। সে আবার ল্যাম্পের দিকে হাত বাড়াল – “ঠিক আছে, একটু আলো দিই।”
“প্লীজ, না।” – মেয়েটি বলে উঠল, একটু জোর দিয়ে। রাফিজ আবার ল্যাম্প থেকে তার হাত সরিয়ে নিল।
“কেন?” – সে জানতে চাইল।
“আমার যখন খুব গরম লাগে, তখন গায়ে কোন কাপড় রাখতে পারি না।”
রাফিজের কাছে কথাটা একটা ধাক্কার মত শোনাল, সে চুপ করে বসে রইল।
“আপনি হয়তো অবাক হচ্ছেন, নজরুল ভাই কিন্তু অবাক হতো না!”
“নজরুল ভাই?”
“হ্যাঁ, উনিও তো মাঝে মাঝে এ ঘরে ঘুমাত – খুব গরমের সময়।”
মেয়েটা মাতালের মত করে কথা বলছিল।
“আর তাছাড়া, বউ যদি মাসের পর মাস পাগলামি করে, কোন পুরুষের ভালো লাগে নিজের বেডরুমে ঘুমাতে?”
রাফিজের হঠাৎ মনে হল – এটা নীপার কোন নাটক নয় তো? নাটকীয়তা করে কোন তথ্য দেয়ার চেষ্টা? নজরুল সাহেবের সাথে কি তাহলে নীপার শারীরিক সম্পর্ক আছে?
“কিন্তু জানেন, নজরুল ভাইকে আজকাল একদম ভালো লাগে না, কেমন যেন জন্তু জন্তু লাগে।”
রাফিজের মনে হল, কেউ একজন ওর বিছানার পাশে এসে বসেছে। এবার সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, লাইট জ্বালাবে। সে দ্রুত ল্যাম্পের দিকে হাত বাড়াল।
আর ঠিক তখনই একটা নরম হাত ওর হাতকে ধরে ফেলল – হাতটা প্রচন্ড গরম, খুব জ্বরে এরকম হয়। মেয়েটা তাহলে প্রচন্ড জ্বরের ঘোরে এসব করছে, এরকম জ্বরে তো ব্রেন হ্যামারেজ পর্যন্তও হতে পারে – ওকে এখনি বরফ পানিতে গোসল দেয়া দরকার।
রাফিজ উঠে বসে ল্যাম্পের দিকে হাত বাড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু গরম হাতটা প্রচন্ড শক্তিতে যেন ওকে ধরে রেখেছে। ক্ষীণকায় একটি মেয়ের গায়ে কি এতো শক্তি থাকা সম্ভব? রাফিজ এবার একটু একটু ভয় পেতে শুরু করল।
“কেন শুধু শুধু আমাকে লজ্জা দিতে চাচ্ছেন?” – ওর কানের একদম কাছে কেউ কথাটা বলল ফিসফিসিয়ে। রাফিজের হৃৎপিন্ড প্রচন্ড জোরে লাফাতে লাগল। তখন সে বুঝতে পারল, একটা শরীর উঠে বসেছে ওর ওপর। রাফিজ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওটা তাকে জড়িয়ে ধরল। শরীরটা অসম্ভব গরম, যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে মেয়েটার সারা গা। রাফিজের মনে হল, একটা আগুনের শিখা তাকে ঘিরে ফেলেছে। এরপর তার আর কিছু মনে নেই।
১৩.
সকালে তার ঘুম ভাঙল প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়ে। সে নিজের গায়ে প্রচন্ড জ্বর টের পেল – শীতে রীতিমত সে কাঁপছে, আর একই সাথে সারা গায়ে ব্যথা। ভাইরাল ফিভারে এরকম হয়, আর সে জ্বরটাও এরকম হঠাৎ করেই আসে।
এরপরই গতরাতের ঘটনাটা তার মনে হল। সেটা মনে পড়তেই মাথাব্যথার সাথে যোগ হল একটা প্রচন্ড হতাশার অনুভূতি।
গতরাতে সে সারা রাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়েছে। প্রচন্ড শীত লাগছিল – শীত আর শরীর ব্যথা। কাল রাতে কি মেয়েটা সত্যি সত্যিই তার ঘরে এসেছিল ? নাকি সে জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছে ?
একধরণের হতাশাই ঘিরে ধরল রাফিজকে। ঘটনাটা যদি সত্যি সত্যিই ঘটে থাকে তাহলে সেটা খুবই হতাশাজনক, আর যদি সেটা না ঘটে থাকে তাহলেও সেটা হতাশাজনক।
যদি সত্যি সত্যিই এটা ঘটে থাকে, তার অর্থ হল – সে তার পেশাগত নৈতিকতা পুরোপুরি হারিয়েছে, এবং তার নিজের ওপর নিজের আর কোন নিয়ন্ত্রণ অবশিষ্ট নেই।
আর যদি সেটা না ঘটে থাকে, তাহলে বোঝা যাচ্ছে – সে বাস্তব আর স্বপ্নের মধ্যে সীমারেখা টানতে পারছে না। অন্য যে কারো কাছে এটা অগ্রহণযোগ্য একটি ব্যাখ্যা হতে পারে, কিন্তু একজন সাইকায়াট্রিস্ট হিসেবে সে জানে – এটা স্কিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ। তাহলে কি তার ছোটবেলার অসুখটা ফিরে আসছে?
তার মনে পড়ল, ইদানীং তার ঘন ঘন এপিসোডও হচ্ছে। সে কি নিজের অজান্তেই হারিয়ে যাচ্ছে স্কিজোফ্রেনিয়ার একটা জগতে? সে যাদের চিকিৎসা করে, তারাও কি এরকম সব কষ্টকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই জীবন কাটায়? কি ভয়াবহ !
রাফিজ অনেক কষ্ট করে উঠে বসল, কাপড়-চোপড় একদম এলোমেলো হয়ে আছে। সে নিজে টের পাচ্ছিল, তার অনেক জ্বর। এরকম সময়ে মাথায় পানি ঢালা খুব জরুরী, কোনমতে শরীরের তাপ কমাতে হবে। সে কোনমতে ধরে ধরে বাথরুমে গিয়ে কলের নিচে গিয়ে বসে পড়ল। প্রচন্ড শীতে তার শরীর কাঁপতে লাগল, কিন্তু সে জোর করে পড়ে রইল কলের ঠান্ডা পানির নিচে।
টানা প্রায় দশ মিনিট এভাবে কাটানোর পর সে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। শরীর-মাথা মুছতে মুছতে ড্রয়ার হাতড়াতে লাগল প্যারাসিটামলের জন্য। ওষুধের পাতাটার নাগাল পাওয়া মাত্র একবারে দুটা বড়ি মুখে পুরে দিয়ে পানি খুঁজতে লাগল এদিক-ওদিক। ঘরের কোনায় ছিল গ্লাস আর জগ। ঢক ঢক করে পুরো একগ্লাস পানি খেয়ে সে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। শীত লাগছিল, কিন্তু কাঁথা গায়ে দিলনা। এলোমেলো চাদরের ওপর কুঁকড়ে পড়ে থাকতে থাকতে একসময় আবার সে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।
দুপুর প্রায় একটার দিকে দরজা নক করার শব্দে তার ঘুম ভাঙল। সে উঠে দরজা খুলেই দেখে, নীপা মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। সে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
“আপনার কি হয়েছে?”
“আপনি?” – রাফিজ উল্টো প্রশ্ন করল।
“আপনি ঠিকানাটা চেয়েছিলেন, ওটা লিখে এনেছি। এই যে।” – সে একটা ছেড়া কাগজ এগিয়ে দিল।
“আপনার কি কাল রাতে অনেক জ্বর এসেছিল?” – রাফিজ অপ্রাসংগিক শোনাবে জেনেও জিজ্ঞেস করে।
“আমার জ্বর?” – মেয়েটি হেসে উঠল – “আমার জ্বর হতে যাবে কেন?” – তারপর রাফিজের দিকে তাকিয়ে বলল – “মনে তো হচ্ছে আপনারই জ্বর, চোখ-টোখ তো লাল হয়ে আছে!”
রাফিজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল – হ্যাঁ, আমারই জ্বর – বলে সে বিছানার দিকে এগোল। সে ভেবেছিল, মেয়েটা বুঝি ভেতরে আসবে। কিন্তু কাগজটা ড্রয়ারে রেখেই ঘুরে তাকিয়ে দেখে, ও চলে গেছে।
রাফিজ দরজা বন্ধ না করেই শুয়ে পড়ল। দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল হয়ে আসছে, তখন তার জ্বর ছাড়া শুরু করল। প্রচন্ড গরমে তার হাত-পা জ্বালা করা শুরু করল, তারপর খুব ঘাম হতে লাগল। তারপর একসময় আবার সে ঘুমিয়ে পড়ল। এক ঘুমে কাটিয়ে দিল বিকেল পর্যন্ত সময়।
বিকেল যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তখন সে বিছানা ছেড়ে উঠল। প্রচন্ড দুর্বল লাগছিল, কিন্তু কিছু খাওয়া-দাওয়া করা দরকার। সে তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসল।
নামার সময়ই দেখা হল জয়ন্তর সাথে। সে চিন্তিত মুখে তার দিকে তাকাল – “ভাই, আপনি দেখি সারাদিন ঘুমিয়ে কাটালেন, শরীর খারাপ নাকি?”
রাফিজ মাথা নাড়ল।
“আমি কয়েকবার করে গিয়ে দেখে এসেছি, কিন্তু ডাকি নাই। খাওয়ার টেবিলে আসেন, আপনার ভাত গরম করে দিই।”
রাফিজ ড্রইংরুমটায় গিয়ে বসল। সেন্টার টেবিলে আজকের পেপারটা দেখা যাচ্ছে। সে সেটা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগল। তখন রুমানা এসে ঢুকল ঘরে।
“আপনার নাকি জ্বর?” – রুমানাকে বেশ অস্থির দেখাল – “কোন ওষুধ আনাতে হবে? ওরা তো আমাকে কিছু বলল না।”
“আপনি ব্যস্ত হবেন না, আমি ওষুধ খেয়েছি। এখন একটু ভালো ফিল করছি, এজন্যই নেমে এসেছি।”
“তাহলে আর কোন কথা না, আপনি দু’টা খেয়ে নিন।”
এরমধ্যেই জয়ন্ত দরজায় এসে দাঁড়াল – “খাবার দিয়েছি ভাই, আপনি আসেন।”
“জয়ন্ত মামা,” – রুমানা বলল – “আপনি উনার জন্য বাজার থেকে ভালো দেখে দুটা আনারস নিয়ে আসেন, জ্বর হলে আনারস খাওয়া ভালো।”
“আমার শুধু চা হলেই চলবে।”
“চা তো হবেই। ও আনারসও আনুক।”
জয়ন্তর ইশারায় রাফিজ খাবার টেবিলের দিকে পা বাড়াল। রুমানা নিজে এল সাথে সাথে। রাফিজ বসামাত্র নিজ হাতে প্লেটে ভাত তুলে দিল। রাফিজ ভাবল – এই মেয়েটা প্রথমদিন দেখা সেই রুমানার থেকে একদমই আলাদা। আশ্চর্য, তার চেহারাও যেন অন্যরকম।
“আপনারা খেয়েছেন?”
“বহু আগে, আপনি প্লীজ শুরু করুন।”
“আজ আপনার মায়ের সাথে কথা বলব ভেবেছি।” – খাওয়া শুরু করতে করতে রাফিজ বলল।
“সেটা পরেও করা যাবে, আগে আপনি সুস্থ হয়ে নিন।” – রুমানা বলে – “এ ব্যাপারে এখন অস্থির না হলেও চলবে।”
রাফিজ মাথা নিচু করে খাওয়া মুখে পুরতে লাগল। মুখে একদম স্বাদ নেই, কিন্তু সে জানে – তাকে জোর করে হলেও খেতে হবে। অনেকগুলো জরুরী কাজ বাকী পড়ে আছে।
রুমানা ভেবেছিল, এই লোকটা অসুস্থ শরীর নিয়ে আজ আর বের হবে না। কিন্তু সন্ধ্যার পর সে দেখল – রাফিজ ঠিকই জয়ন্তকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে।
১৪.
পর পর কয়েকটা দিন রাফিজের খুব ব্যস্ত সময় কাটল। মাত্র এপিসোড কাটিয়ে ওঠার পরও সে চেষ্টা করল পুরোটা সময় কাজ করতে।
রাফিজ এ কয়দিনে মোট ছয়জনের সাথে বিস্তারিত কথা বলেছে। এর মধ্যে নজরুল-রুনা ছাড়াও আছে রুমানার মা আনোয়ারা বেগম, জয়ন্ত, কাজের মহিলা শরীয়তের মা, আর … নীপা। হ্যাঁ, নীপা – যে নিজেই যথেষ্ট রহস্যময়ী। মেয়েটাকে নিয়ে কি একটা যেন খটকা থেকেই যাচ্ছে রাফিজের মনে, কিন্তু সেটা সে ঠিক ধরতে পারছে না। আশেপাশের আরো কিছু লোকের সাথেও সে কম-বেশি কথা বলেছে।
কাজের ক্ষেত্রে রাফিজ পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করার চেষ্টা করেছে। যুক্তি দিয়ে প্রতিটা ঘটনা যাচাই করার চেষ্টা করেছে। এছাড়া প্রচুর কেস স্টাডির রেফারেন্স নিয়েছে, বেশিরভাগই টেলিফোনে ঢাকায় কথা বলে বলে। ক্লিনিকের নতুন যে ছেলেটা ডাক্তার হিসেবে ঢুকেছে, আনোয়ার আফজাল, সে এ ব্যাপারে তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
এ ধরণের কেসগুলোর জন্য এতোটা সময় ব্যয় করা হয় না সাধারণত, কিন্তু রাফিজ এটার পেছনে যতটা সম্ভব সময় দিচ্ছে। এদিকে রাফিজের নিজের ধারণা, নজরুল হয়তো তাকে এখানে আনার জন্য প্রচুর খরচ করেছেন। যা হোক, এসব নিয়ে রাফিজ কোন চিন্তা করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাকে যে কাজ দেয়া হয়েছে, আপাতত সে কাজটা ভালোভাবে করার দিকেই তার মন দেয়া প্রয়োজন।
রাফিজ দীর্ঘ সময় নিয়ে আনোয়ারা বেগমের সাথেও কথা বলেছে – ভদ্রমহিলাকে সংস্কারাচ্ছন্ন সেকেলে একজন মহিলা বলেই তার মনে হয়েছে। বয়:সন্ধির সময় একটা মেয়ে নিজের দেহে যেসব পরিবর্তন দেখে, সেগুলো সম্পর্কে মেয়েকে কোন তথ্য দেবার প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি। তবে মেয়ের চেয়ে অল্প কিছু বেশি বয়সী নুসরাতকে ইংগিতে বলেছেন যেন এ জিনিসগুলো তার মেয়েকে সে শিখিয়ে-পড়িয়ে দেয়। নুসরাত তার ভাগনী, রুমানার খালাতো বোন।
তবে আনোয়ারা বেগম একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য দিয়েছেন। তথ্যটা রুমানার সেই রান্নাঘরের ঘটনাটা নিয়েই। সৌভাগ্যক্রমে উনার সে ঘটনাটা মনে ছিল। উনি খুব স্পষ্ট করে বলেছেন যে, রুমানার অজ্ঞান হবার সময় রহিমার মা রান্নাঘরে ছিল। রুমানা কি একটা চেয়েছিল, সেটা মহিলা সেটা এগিয়ে দিতেই রুমানা চীৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।
এ তথ্যটা রুমানার দেয়া তথ্যের একেবারে বিপরীত। রুমানার স্মৃতি এক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত তার সাথে প্রতারণা করছে – এটা হয়তো ক্ল্যাসিক্যাল স্কিজোফ্রেনিয়ারই কেস, যেখানে ভিস্যুয়াল হ্যালুসিনেশান কিংবা অডিটরি কিংবা দুটোই একসাথে থাকতে পারে। আর এটাতো স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগীর জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি সম্ভাবণাই।
রাফিজ এ জিনিসগুলোই খুব যত্ন করে লিখে ফেলছিল, এ নোটগুলো এখন লিখে না রাখলে পরে হয়তো ছোটখাট বিষয়গুলো তার মাথা থেকে হারিয়ে যাবে। তাছাড়া কোন কোন বিষয় হয়তো এই মুহূর্তে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না, কিন্তু পরে একসময় সেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও হতে পারে।
সে লিখছিল, আর এসব নানা কথা ভাবছিল। তখনই সে পেছন থেকে শুনতে পেল একটা মেয়েলী কণ্ঠ – “রুমানা ভাবীকে কেমন লাগল?”
রাফিজ চমকে ফিরে তাকাল, নীপা মেয়েটা কোন ফাঁকে যেন পেছনে এসে বসেছে। ফিরে তাকিয়ে সে আরো বেশি চমকে গেল, কারণ মেয়েটার পরণে ছিল শুধু একটা সাদা তোয়ালে।
সে জানলার দিকে মুখ করে লিখছিল, ফলে চেয়ারটা ছিল তার পেছনে। হয়তো মেয়েটা কোনভাবে মাঝখানের দরজা দিয়ে চলে এসেছে, সে টের পায়নি।
সে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু কিছু বলতে পারলনা – এদিকে হঠাৎ করেই কেমন করে যেন তার প্রচন্ড মাথাব্যথা শুরু হয়েছে – একেবারে শূণ্য থেকে। এত বেশি ব্যথা যে তার মনে হচ্ছিল তার মাথা ছিড়ে যাবে।
মেয়েটা হাসছিল, শয়তানি ধরণের হাসি – “কি, বললেন না, কেমন লাগল রুমানা ভাবীর চমৎকার শরীরটা?”
“উনি আমার একজন রোগী।” – রাফিজ দৃঢ় স্বরে বলল।
“তাতে কি? বিয়ের এত বছর পরেও কি টলটলে শরীর, তাই না? আর বয়স কতই বা হবে? আপনার চেয়ে তো নিশ্চয়ই অনেক কম।”
“ওতে কি আসে যায়?”
“আসে-যায়, রাফিজ সাহেব, আসে-যায়। আপনি কি জানেন, ওর এই সুন্দর শরীরটা একসময় কত লোকের ঘুম হারাম করে দিয়েছে?”
“আমার কিন্তু উনাকে মোটেও সেরকম মনে হয়নি।”
“মনে হবে কিভাবে? এসব তো উনি করেছেন নিজের অজান্তে। যখন উনার আটো-সাটো জামাগুলো উনার লতানো গাছের মত বেড়ে ওঠা শরীরটাকে জাপটে ধরে রাখত, তখন কোন পুরুষমানুষের যে মাথা ঠিক থাকত না – সেটা উনি নিজে জানবেন কিভাবে, তাই না? কি আশ্চর্য নিষ্পাপ আমার ভাবী !” – নীপা মুখ বাকা করল।
“নীপা, আপনি সম্ভবত অসুস্থ। প্লীজ ঘরে ফিরে যান, রেস্ট নেন।”
“ও, আমি অসুস্থ? আর সুস্থ সেই মেয়েমানুষটা, যে কিনা স্বামীকে বঞ্চিত করে নিজের শরীরটাকে সুন্দর করে রেখেছে তার পুরনো প্রেমিকের জন্য?”
“পুরনো প্রেমিক?”
“কেন? আপনার সেই পীর সাহেব … হারামী কবীর।”
“আমি পীর সাহেবকে চিনি না। আর পীর সাহেবের সাথে তার প্রেম থাকবে কিভাবে সেটাও বুঝতে পারছি না।”
“আরে, এ তো আর সত্যিকার পীর না। এর বাবা কিছু যাদু-টোনা শিখেছিল, সেইটা দিয়ে পীর সেজেছিল। বাপ মারা যাবার পর পীরজাদা হয়েছে পীর সাহেব। আমি বলি, হারামজাদা হয়েছে হারামী সাহেব।”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এসবের সাথে রুমানার পুরাতন প্রেমের কি সম্পর্ক?”
“ও, আপনার ভাবীসাব আপনাকে এসব খুলে বলেনি, তাই না? সেই যে তার আশেক হারামজাদা কবিরে বাচ্চা একসময় মডার্ন ছিল, জিন্সের প্যান্ট পরত, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানত। আজকে না হয় সে ভোল পাল্টেছে, কিন্তু আমরা তো সবই জানি।”
রাফিজ উঠে দাঁড়াল – “আপনি প্লীজ ঘরে যান।”
“কাছে আসবেন না, বলে দিলাম,” – সে চীৎকার করে উঠল – “মেয়েমানুষ দেখলে মাথা ঠিক থাকে না, তাই না? ভাবীসাবকে দেখে শরীর গরম হয়ে আছে মনে হচ্ছে!”
রাফিজের মাথাব্যথাটা তখন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল।
“আমার একটা খুব গোপন শখ ছিল, যেটা কোনদিন পূরণ হয়নি।” – মেয়েটা হঠাৎ সুর পাল্টে ফেলল।
রাফিজ কিছু বলল না।
“অনেক দুপুরেই আমি এই কল্পনাটা করেছি, একটা অবুঝ কল্পণা।”
রাফিজ চুপ করে বসে রইল – সে ঠিক বুঝতে পারছিল না, কি হচেছ।
“জানেন, আমার স্বামী একেবারেই রোমান্টিক না, সে আমাকে কোনদিন বুঝতে চেষ্টা করেনি।” – মেয়েটা বলে চলল – “আমাকে বিয়ে করেছিল কিছু টাকা-পয়সা পাবে এই আশায়, সেই টাকা দিয়ে ব্যবসা করে বড়লোক হবার পর তারপর আমাকে ভালোবাসবে মনে করে।”
রাফিজ মাথা নিচু করেই বসে রইল, তার মাথাব্যথাটা তখন একদম চরমে পৌঁছেছে।
“জিজ্ঞেস করছেন না যে, শখটা কি?” – সে যেন ছেলেমানুষি করেই কথাগুলো বলছিল – “আমি প্রায়ই ভাবতাম, খুব গরমের এক দুপুরে আমি গোসল করছি আমার ঘরে। আর আমাকে একটা ছেলে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। আমি জানি, সে আমাকে দেখছে, কিন্তু আমি সেটা নিয়ে ভাবছিনা।” – বলে মেয়েটা অদ্ভুতভাবে হাসতে লাগল।
রাফিজের পা মেঝেতে আটকে গিয়েছিল, সে নড়তে পারছিল না। মেয়েটা তখন দরজার হুক লাগিয়ে দিচ্ছিল আর বলছিল – “আপনি কিন্তু আমাকে স্পর্শ করতে পারবেন না, এটা হবে খেলার নিয়মের বাইরে।”
রাফিজের প্রচন্ড তৃষ্ণা পেতে লাগল, সাথে সেই মাথাব্যথাটা। তার মনে হল তার ভয়াবহ জ্বর আসছে – সে মেঝের ওপর হড়হড় করে বমি করে দিল।
বাইরে তখন অস্বাভাবিক এক মার্চ মাসের রোদের ভেতর ছোট শহরটা পুড়ে পুড়ে যাচ্ছে।
১৫.
ঘুম ভেংগে রাফিজ দেখে, সে মেঝেতে পড়ে আছে। পাশে বমি থেকে উৎকট গন্ধ আসছে। সে হাতড়াতে হাতড়াতে একটা পুরনো পেপার পেয়ে সেটা চাপা দিল বমির ওপর। সে উঠে বসল – শরীর অসম্ভব দুর্বল লাগছে, কিন্তু মাথাব্যথাটা পুরোপুরি সেরে গেছে।
সে মেঝে পরিষ্কার করতে শুরু করল – ভালো করে ঘর পরিষ্কার করে নিজেও গোসল করতে হবে। সে দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিল – সাথে সাথে একরাশ গরম বাতাস এসে ঘরটায় খেলে গেল।
গোসল সেরে বের হতেই ওর খুব ক্ষুধা লাগতে শুরু করল। সে দ্রুত বাইরে যাবার কাপড়টা গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ল – দোকান থেকে কিছু কিনে খেয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু আজকে তাকে বের হতেই হবে, এখনই – অনেক কাজ পড়ে আছে।
একটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার বাকী রয়ে গেছে, অন্যদিকে সময় খুবই কম – যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাক্ষাৎকারটা সেরে নেয়া দরকার।
১৬.
সারাদিন অনেক দৌড়াদৌড়ি গেল রাফিজের ওপর দিয়ে। বিকেলে সে যখন ঘরে এসে ঢুকল, তার মনে হচ্ছিল – সে মাটিতে পড়ে যাবে। কিন্তু সে শরীরের শেষ শক্তিটুকু সঞ্চয় করে হাতমুখটা ধুয়ে নিল। জয়ন্তকে বলা ছিল, সে কয়েকটা বিস্কিট আর এক কাপ চা দিয়ে গেল। সে সেটা পাশে রেখেই কাজ শুরু করে দিল।
রাফিজ ‘ডায়াগনসিস’ শিরোনাম দিয়ে তার সিদ্ধান্তগুলো লেখা শুরু করল। রুনার এক খালাতো বোন আছে – নুসরাত নাম – যে রুনাকে একেবারে ছোটবেলা থেকে চেনে, এর কথাই নীপা তাকে বলেছিল। আর এর সাক্ষাৎকারটাই রাফিজের কাছে খুব জরুরী মনে হয়েছিল।
নুসরাতের সাথে কথা বলে সে এমন অনেক কিছুই জেনেছে, যেগুলো তাকে সিদ্ধান্তে আসতে সাহায্য করেছে। তবে সে নিজেও জানে – ডায়াগনোসিস মানে রোগনির্ণয়, লক্ষণ দেখে দেখে সবচেয়ে সম্ভাব্য রোগটাকে চিহ্নিত করা। নিয়ম মেনে অনুসন্ধান করলে রোগনির্ণয়ে ভুল হবার সম্ভাবণা থাকে না, কিন্তু খুব ভালো অনুসন্ধানও অনেকসময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যকে এড়িয়ে যেতে পারে। এসব সম্ভাবণা মাথায় নিয়েই রাফিজ তার নোটবইতে সম্ভাব্য রোগটা সম্পর্কে লিখতে শুরু করল।
যাহোক, এপর্যন্ত এ কেসে এমন কিছুই রাফিজ পায়নি, যা তাকে খুব বেশিরকম অবাক করেছে – এগুলোর সবগুলোরই গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আছে, কয়েকটা ব্যাপার তো রীতিমত ক্ল্যাসিক কেসগুলোর মত। কতগুলি ব্যাপারের একদম হুবহু রেফারেন্স সে দেখেছে বিভিন্ন বইতে।
তবে রাফিজ চেষ্টা করল যতটা সম্ভব পদ্ধতি মেনে তার লেখাটাকে সাজাতে:
রুমানার প্রথম বৈশিষ্ট্য হল, সে ছোটবেলা থেকে খুব আদরে বড় হওয়া একটা মেয়ে। সে পরিবারের একমাত্র সন্তান, বাবা-মায়ের নি:শর্ত ভালোবাসা ও সমর্থন পেয়েছে সে একদম ছোটবেলা থেকে। সে যা চাইতো, তাই পেতো। স্বভাবে শান্ত বা চুপচাপ ধরণের হলেও সে ছোটবেলা থেকেই ছিল ভীষণ জেদী। এসব তথ্যের সূত্র রুমানার মা আনোয়ারা বেগম।
মেয়েটার দ্বিতীয় উলেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল লজ্জা। সে ছিল ভীষণ লাজুক, বাবা-মায়ের সাথে খুব মিল থাকলেও বাইরের মানুষের ব্যাপারে সে ছিল রীতিমত অসামাজিক। তার বন্ধু-বান্ধব বলতে গেলে ছিলই না, স্কুলের সহপাঠীরা তাকে সুন্দরী ও অহংকারী বলেই জানতো, এবং পারতপক্ষে তার সাথে কেউ মিশতো না। তার অভিভাবক এবং বান্ধবী বলতে গেলে ছিল একজনই – তার মা। মায়ের সাথেই সে তার সমস্ত গোপন কথা আলাপ করত, আর মাঝে-মধ্যে তার খালাতো বোন নুসরাতের সাথে কথা বলত এসব নিয়ে । কিন্তু নুসরাত থাকত অন্য জেলায়, বছরে একবার কি দুবার ছুটিতে বেড়াতে আসতো রুমানাদের বাসায়। এদিকে নুসরাতের সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলে রাফিজ যা বুঝেছে তা হল – সে অত্যন্ত সাধারণ একটা মেয়ে, এবং নানা রকম কুসংস্কারে তার মাথা বোঝাই।
এই দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য এবং পারিপার্শিক অবস্থা বিবেচনা করলে সহজেই একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করানো যায় – সেটা হল, রুমানার খালাতো বোন নুসরাত তাকে শারীরিক ব্যাপারগুলো সম্পর্কে ঠিকভাবে তথ্য দিতে পারেনি, মোটকথা যৌনতা বিষয়ে মেয়েটা বেড়ে উঠেছে খুব অসম্পূর্ণ ধরণের এবং হয়তো বেশ ভুল ধাঁচের ধারণা নিয়ে।
রুমানার তৃতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল ভালো স্বাস্থ্য – সে শারিরীকভাবে বেশ সুস্থ-সবল ছিল। খেলাধূলা খুব পছন্দ করত, নিজেও খেলাধূলা করত। স্কুলে ছেলেদের ফুটবল খেলা দেখতে যেত। রুনার খালাতো বোন নুসরাত এ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়েছে।
পরের এ দুটো বৈশিষ্ট্য থেকে আরেকটি হাইপোথিসিস দাঁড় করানো যায়, সেটা হল – এই মেয়েটার শারীরিক চাহিদা সাধারণ আর দশটা মেয়ের চেয়ে হয়তো বেশি ছিল।
এখানে মনে রাখতে হবে, রুমানার সমস্যার শুরু তার বয়:স্বন্ধির পর থেকে। একটা অত্যন্ত দীর্ঘকায় সবল কিন্তু কুৎসিত লোকের ছায়া সে দেখতে পেত। একইরকম লোক সে স্বপ্নেও দেখত। সে খুব ভয় পেত। এটা থেকে ইংগিত পাওয়া যায় – বয়:সন্ধির সময় যে শারীরিক পরিবর্তনগুলো হয়, সেগুলোর সাথে সমস্যাগুলোর সম্পর্ক থাকতে পারে। সম্ভাবণা থাকে যে, পরিবর্তনগুলোর সাথে যে কোন কারণেই হোক মেয়েটা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি।
আরো মনে রাখতে হবে, বিয়ের পর তার সমস্যার ধরণ বদলে যায়। সে ভয়ংকর চেহারা কম দেখতে থাকে, কিন্তু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে অন্য সমস্যা দেখা দেয় যা পরে আরো বেড়ে যায়।
সব মিলিয়ে সমস্যার কতগুলো সম্ভাব্য ব্যাখ্যা চিন্তা করা যায়:
ভয়ের স্বপ্নের ব্যাখ্যা – একটা মেয়ে, যে খুব লাজুক ও সংস্কারাচ্ছন্ন, যার শারিরীক চাহিদা অন্য দশটা মেয়ের চেয়ে বেশি, কিন্তু বয়োসন্ধির সময় যে ঠিকমত জানতে পারে নি নিজের শরীর সম্পর্কে, তার পক্ষে এরকম ঘটা বিচিত্র নয় যে – যৌনতা তার কাছে একইসাথে আকর্ষণীয় এবং ভীতিকর, এটা তার অবচেতন মনের কাছে কাম্য কিন্তু তার সচেতন মনের কাছে ঘৃণার একটা বস্তু। এই দ্বন্দ্বটা কি প্রকাশ পেতে পারে না একটি দানবের রূপক হিসেবে? এমন একটি দানব যে তাকে শারিরীকভাবে চায়? দানবটা শারীরিকভাবে শক্তিশালী, কেননা শক্তিশালী শরীরকে মেয়েটা অবচেতনভাবে পছন্দই করে। আবার অন্যদিকে দানবটা কুৎসিত, কারণ এই শারীরিক বিষয়টা মেয়েটার কাছে গ্রহণযোগ্য না। খুব সম্ভবত অমীমাংসিত মানসিক দ্বন্দ্বের আপাত সমাধান হিসেবে মেয়েটার অবচেতন মন এই দানবের নাটকটা সাজিয়েছে।
এরকম একটা কেস পাওয়া যায় ডক্টর কোভুরের রেফারেন্স বইতেও।
আর বিয়ের পর যে তার সমস্যার ধরণ বদলে গেল, এটা এই কারণে যে – সেসময় সে এগুলো সম্পর্কে একটু একটু করে জেনেছে। বিয়ের পর পর নজরুল সাহেব ঠিক এক বছর পাঁচ মাস তার স্ত্রীর ভীতি সম্পর্কে কিছু টের পাননি। এটা প্রথম ব্যাখ্যাকেও সমর্থন করে।
তবে এই ব্যাখ্যাগুলোর দূর্বল দিক হল, এগুলো দিয়ে বোঝা যাচ্ছে না – পরবর্তীতে তার স্বপ্নে দানবটার পুনরাবির্ভাব কেন ঘটল। এর একটা প্রতি-ব্যাখ্যা অবশ্য এও হতে পারে যে – নজরুলের সাথে রুমানার সম্পর্কের অবনতি, কিংবা রুনার গভীর সন্দেহ যে নজরুল বাইরের কারো প্রতি আসক্ত। এটার ব্যাপারে আরো জানতে হবে। এখন পর্যন্ত যেটুক বোঝা গেছে, সেটা হল – রুমানার সাথে নজরুলের বিবাহিত জীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। এটা হওয়াই স্বাভাবিক, বিশেষত: রুমানার নানা সমস্যা ভদ্রলোককে বারবার বাধার মুখোমুখি করেছে।
আরেকটা সমস্যার ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত খুঁজে দেখা হয়নি – দু:স্বপ্নের ব্যাপারটা ছাড়াও রুমানার আরেকটা সমস্যা আছে। সেটা হল, কোন এক তথাকথিত দেবী ওর ওপর ভর করে। যদিও এ ধরনের দ্বৈত স্বত্ত্বার বিষয়টা ক্ল্যাসিক পসেশন কেসে রাফিজ পেয়েছে, তবু সে মনে করল এটার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার মত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।
তবে এই দ্বিতীয় সমস্যাটার বিপজ্জনক দিক হচ্ছে, এটা নজরুল সাহেবকেও প্রভাবিত করছে। নজরুল সাহেবের বিষয়টা কি ‘ইনডিউসড হ্যালুসিনেশান’! একজনের ভুল কল্পনা তার আশেপাশের মানুষের মধ্যে একইরকম ভুল কল্পনার জন্ম দিতে পারে – এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য। যদি এটা নজরুল সাহেবের ইনডিউস অর্থাৎ প্রভাবিত হবার ঘটনা হয়, তাহলে চিন্তা নেই। কিন্তু এটাকে রাফিজের নিজের কাছেই খুব গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বলে মনে হল না। ভয় পাবার বিষয়টার মোটামুটি একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো গেলেও আসর হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি পরিষ্কার হচ্ছেনা বলে রাফিজ চিন্তিত হয়েই থাকল।
অবশ্য নুসরাতের কাছ থেকে রাফিজ আরেকটা মজার ব্যাপার জানতে পেরেছে – এটা পীরজাদা কবীর সাহেব সংক্রান্ত। খুবই চমৎকার একটা তথ্য। এটা জানার পর এমনকি রাফিজের মনে হয়েছে, এই পীরজাদা ভদ্রলোকের সাথে দেখা করাটাও আসলে জরুরী।
সে সেটার জন্যই আসলে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
১৭.
গেট পেরোতেই রাফিজ দেখে, দুটা বড় বড় কালো কুকুর একটু দূরেই চেন দিয়ে বাধা। ওদের দেখা মাত্র এরা প্রচন্ড গর্জন করতে শুরু করল।
আনোয়ারা বললেন – “আপনাকে এরা আগে দেখেনি তো, তাই হয়তো এরকম করছে।”
রাফিজের মনে হল, এগুলো ভালো জাতের বিদেশী অ্যালসেশিয়ান।
রাফিজ পীরজাদা কবীর সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছে। আনোয়ারা বেগমকে বলার সাথে সাথে তিনি তাকে এখানে নিয়ে আসতে রাজী হয়ে গিয়েছিলেন।
“এদের নিয়েও কিছু কথা আছে।” – আনোয়ারা যোগ করলেন।
“কি কথা?”
“এরা কিন্তু আসলেও কুকুর না। বুঝতে পেরেছেন তো – কুকুরের রূপ ধরে থাকে, আসলে পীর সাহেব এগুলিকে পোষেন।”
রাফিজ মনে মনে হাসল – এ যুগেও কত সহজে মানুষ বিশ্বাস করে আজগুবি সব জিনিসে। চোখের সামনে দৃশ্যমান দু’টা কুকুর, এরা এমন ব্যাখ্যাতীত কিছু করেনি যাতে মনে হতে পারে এগুলো কুকুর না। তবুও এরা বাস্তব সম্ভাবণাটাকে পাশ কাটিয়ে ভেবে নেবার চেষ্টা করছে যে – এগুলো কুকুর না, কুকুরের রূপ ধরে থাকা কোন অশরীরী।
বাসাটার চারিদিকে লন। মূল ভবনটার সামনে লম্বা টানা বারান্দা। এ ভবনটার সামনের দিকের দেয়াল পুরোটা টাইলস করা। অন্যপাশগুলোতেও দেখা যাচ্ছে জাকজমক করার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি করা হয়নি। এই ভবনটার অনতিদূরে আরেকটা ছোট ঘরের মত আছে, সেটার আবার পুরোটাই টাইলস করা। আনোয়ারা বললেন, ওটা কবীর সাহেবের বাবার অর্থাৎ আদি পীর সাহেবের মাজার। মাজারের দরজার কাছে ফুলের তোড়াও সাজানো আছে।
লনের ঘাস সুন্দর করে ছাটা, একপাশে ফুলের বাগান আছে – বোঝাই যায়, নিয়মিত যত্নআত্তি করা হয় এগুলোর। বারান্দার সামনে প্লাস্টিকের চেয়ার বসানো আছে অনেকগুলো – পুরুষ আর মহিলাদের একটা বড় দল সেখানে বসে অপেক্ষা করছে পীরজাদার সাথে দেখা করার জন্য।
রাফিজ ওগুলোর একটাতে বসতে যাচ্ছিল, আনোয়ারা বাঁধা দিলেন। তখন রাফিজ লক্ষ্য করল, একজন মধ্যবয়স্ক লোক ওদের পথ দেখিয়ে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাফিজ নীরবে সবাইকে অনুসরণ করল। সে এও বুঝতে পারল, আনোয়ারা পীর সাহেবের বিশেষ রোগীদের একজন।
ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল – একপাশে একটা আসনের মত বসানো। আসনের ওপর কালো পোশাক পরা একজন বসে আছেন, মাথায়ও কালো পাগড়ী। বসে থাকা অবস্থায় দেখেও রাফিজ বুঝতে পারল, ভদ্রলোক বেশ লম্বা-চওড়া। চেহারায় একটা নূরানী আভাও আছে।
ভদ্রলোক নিজে তাদের সালাম জানালেন। ওরা উনার সামনে রাখা মাদুরে গিয়ে বসল।
আনোয়ারা রাফিজকে পরিচয় করিয়ে দিলেন পীরজাদার সাথে – “উনি আমার মেয়ের ডাক্তার, ঢাকা থেকে এসেছেন। আপনার সাথে আলাপ করতে চান, রুমানার ব্যাপারটা নিয়ে আরো কিছু জানতে চান।”
পীরজাদা রাফিজের দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা নাড়লেন।
“আমি আসলে এখনো তথ্য সংগ্রহ করছি।” – রাফিজ বলল।
“ভালো, খুবই ভালো কথা। আমি কিন্তু দুনিয়াবী চিকিৎসার বিরোধী না – যারা আমার কাছে আসে, তাদের সবাইকেই আমি এই কথাটা বলি সবসময়ই। তকদিরের সাথে তদবির করা দরকার, এব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।”
রাফিজ হাসল – “সত্যি কথা বলতে কি, আমারও আপত্তি নেই আধ্যাত্মিক চিকিৎসায় – যতক্ষণ পর্যন্ত তা মূল চিকিৎসার প্রতিবন্ধক না হয়।”
পীরজাদা চুপ করে তার দিকে তাকালেন।
“কোনটা যে আসল চিকিৎসা, সেটা বোঝা সবসময় সহজ না।” – উনি মন্তব্য করলেন।
“আপনি যা জানতে এসেছেন, তা জিজ্ঞেস করেন।” – আনোয়ারা যেন একটু তাগাদাই দিলেন।
“আমি আসলে সে জিনিসগুলো সম্পর্কে ধারণা নিতে এসেছি, যেগুলো উনাকে বিরক্ত করে।”
পীরজাদা মুচকি হাসলেন – “আপনি তো এগুলো বিশ্বাস করেন না, তাহলে এসব জেনে কি লাভ হবে আপনার?”
“আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চেয়ে বড় হল রুমানার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়টা। আমি আসলে ধারণা পেতে চাচ্ছিলাম – ওসব সম্পর্কে উনার আশ-পাশ থেকে উনি কি ধরণের তথ্য পেয়ে আসছেন, সেটা জানলে উনার সমস্যার সাথে সেগুলোর সম্পর্ক আমি বের করতে পারব।”
পীরজাদা চুপ হয়ে গেলেন, কিন্তু তার মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল তিনি এসবে কিছুটা বিরক্ত হচ্ছেন।
সেটা লক্ষ্য করেই হয়তো আনোয়ারা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন – “ডাক্তার সাহেব, আপনি বলেছিলেন আপনি জীন-পরীর বিষয়ে কিছু জানতে চান। সেগুলো জিজ্ঞেস করছেন না যে? আমরা যেন খামাখা কথা বলে হুজুরের সময় নষ্ট না করি।”
রাফিজ আনোয়ারার ইংগিতটা বোধ হয় ধরতে পারল, সে বলল – “আমাকে একটা জিনিস বলেন, এদের যদি শরীর না থাকে তাহলে এদের দেখা যাবে কিভাবে?”
পীরজাদার সাথে সেই মধ্যবয়স্ক হুজুরের চোখে চোখে কি যেন কথা হল, তখন সেই অন্য হুজুর পাশ থেকে বলল – “আপনারা কেন বুঝতে চান না ভাই, এরা কাজ করে মানুষের ব্রেইনের মধ্যে, এরা হইল গিয়া শয়তানের খালাত ভাই। শয়তান মানুষের মাথায় কুমন্ত্রণা দেয়, আর এরা দেয় ভয়-ভীতি।”
“শয়তান আর জীন-পরী কি একই ধরণের জিনিস!”
“জীন হইল নিম্নমানের শয়তান। মানুষ আর কুকুর যেমন, সেরকম শয়তান আর জীন। জীন-পরী হইল পশু ধরনের, এইজন্য এরা বিপজ্জনক।”
“তাহলে এদের থেকে রক্ষার উপায় কি?”
“দোয়া-তাবিজ ছাড়া আর কোন উপায় নাই, অবশ্য যদি সেইটা কোন হাক্কানী বুযুর্গ থেইকে নেওয়া হয়।”
“ধরেন, কাউকে অলরেডি জীন আসর করে ফেলেছে, এখন তার উপায় কি? কিভাবে সে এর থেকে মুক্তি পাবে?”
“ওগো তাড়াইতে হয় শয়তান দিয়া, মানুষ যেমন কুকুর তাড়াইতে পারে ঐরকম শয়তান পারে জীন তাড়াইতে।”
“রুমানার ওপর তো জীনের আসর আছে, তাই না?” – রাফিজ বলে।
“অবশ্যই, জীন বা পরীও হইতে পারে।” – সেই ছোট হুজুর সাথে সাথে উত্তর দিল।
“তাহলেতো সেই জীন বা পরীকে শয়তান দিয়েই তাড়াতে হবে। আপনারা কি এমন কোন শয়তানের ব্যবহার করছেন?”
ছোট হুজুর অবিশ্বাসের চোখে রাফিজের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছিল, সে কথা খুঁজে পাচ্ছেনা। কবীর সাহেব তাকে কি যেন ইশারা করায় সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, কিন্তু যাবার সময় সে যে রাফিজের দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে ছিল সেটা রাফিজের দৃষ্টি এড়াল না।
“আপনি একজন অতিথি।” – কবীর সাহেব ঠান্ডা গলায় বলতে শুরু করলেন – “অতিথিকে অপমান করা আমাদের ধর্মে নেই। কিন্তু আপনাকে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এটা কোন বাহাসের জায়গা নয়। কারো কাছে নিজেকে প্রমাণ করার আমার প্রয়োজন নেই। যার দরকার সে আসবে, যে দরকার মনে করে না সে আসবে না।”
রাফিজ লক্ষ্য করল, আনোয়ারা তার হাতের ওপর হাত দিয়ে হালকা চাপ দিচ্ছেন – কথাবার্তা সংযত করার ইংগিত সম্ভবত:। কিন্তু রাফিজ থামলনা, বলল – “আমি তো নিজে থেকে কিছু বলিনি, আপনারা যা বললেন তার সূত্র ধরেই প্রশ্ন করেছি।”
কবীর সাহেবের মুখ থমথমে হয়ে ছিল, তিনি খুব ধীরে ধীরে সময় নিয়ে বললেন – “সবকিছু বোঝার যোগ্যতা সবার থাকে না। আপনার অন্য কোন প্রশ্ন থাকলে সেটা বলুন প্লীজ, বাইরে অনেকে অপেক্ষা করছেন।”
রাফিজ তখন প্রসংগ পাল্টাল, সরাসরি পীরজাদার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল – “আপনাকে যতটা মনে হয়, আপনি কিন্তু ততটা বয়স্ক নন।”
“শুনে খুশী হলাম, আলহামদুলিল্লাহ!” – পীরজাদাকে এবার একটু সহজ মনে হল।
“কিন্তু আপনার বর্তমান ভূমিকাটা একসময় বোধহয় আপনার নিজেরও চিন্তায় ছিল না।”
উনি একটু থেমে গেলেন, তারপর বললেন – “আপনি ঠিক কথাই শুনেছেন। আব্বা যখন এই কাজটি করতেন, তখন আমি এসব থেকে দূরেই থাকতাম। কিন্তু মারা যাবার আগে আব্বা আমাকে বায়াত করে যান, খিলাফত দেন। তারপর আমার ভেতর কোথা থেকে যেন একটা পরিবর্তন আসে। খোদা তায়ালা কাকে যে কখন হেদায়েত নসিব করেন, তা বলা মুশকিল। আমি শুধু তাঁর শুকরিয়া আদায় করি একথা ভেবে যে, আমি তো হেদায়েত পেয়েছি।”
“পুরোপুরি বদলে যাওয়া কিন্তু খুব কঠিন।”
পীরজাদা সরু চোখে রাফিজের দিকে তাকালেন, তারপর হঠাৎই হেসে উঠলেন – “আপনি সম্ভবত লক্ষ্য করেছেন যে আমি স্মোক করি। আপনি সত্যিই বুদ্ধিমান একজন মানুষ।”
“আমি নুসরাতের সাথেও কথা বলেছি, রুমানার খালাতো বোন নুসরাত। আপনি হয়তো চিনতেও পারেন।”
পীরজাদা হঠাৎ আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন।
“নুসরাতের কাছে আপনার অনেক গল্প শুনলাম।”
“এমনিতে আমি কোন অবিশ্বাসী লোকের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করি না, কিন্তু আপনার সাথে কথা বলতে রাজী হয়েছিলাম একমাত্র এই কারণে যে আমি আমার এক বোনের রোগমুক্তি চাই, আর আমি এও বিশ্বাস করি যে দোয়ার সাথে দাওয়ারও গুরুত্ব আছে। দেখেন, এছাড়া আপনার সাথে কথা বলে আমার কোন লাভ নেই। আমি নিজেও বিজ্ঞান পড়েছি, আমার সাথে কথা বলে যদি একজন ডাক্তার আমার কোন বোনের উপকার করতে পারেন দুনিয়াবী তরিকায়, আমার তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু তার মানে কি এই যে আমার এখন নিজের অ্যাডভার্টাইসমেন্ট করতে হবে? আমার তো এর দরকার নেই। তাছাড়া আমি জোর করে কাউকে হেদায়েত করতে পারবনা, তবে খোদা তায়ালা চাইলে যে কাউকে যেকোন সময়ে হেদায়েত করতে পারেন।”
রাফিজ হাসল – “একটা মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব থাকা খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা, এর মধ্যে কোন পাপ নেই।”
“পাপ-পূণ্যের সংজ্ঞা আপনার কাছ থেকে শিখব, এমন ধারণা আপনার কিভাবে হল?”
“আমি হয়তো কাল কিংবা পরশু ঢাকায় ফিরে যাব, কিন্তু এ রহস্যের একটি দিক আমার কাছে অজানা থেকে যাবে, এইটাই আমার আফসোস।” – রাফিজ রহস্য করে বলে।
পীরজাদা নিরাসক্ত ভংগীতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
“রুমানার সাথে যে আপনার চিঠিতে যোগাযোগ ছিল, এটা আপনি বা রুমানা কোনদিন কাউকে বলেননি। শেষপর্যন্ত নুসরাত বেগমের কাছ থেকে এটা জানলাম আমি।”
এবার পীরজাদা হাসলেন, বাকা হাসি – “এটা উলেখ করার মত কিছু, সেটাই তো আজ প্রথম জানলাম।”
রাফিজ বলে চলল – “অথচ এটা যে স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, সেটা মেনে নিতে পারলে হয়তো এই মেয়েটারই ভালো হত। অন্যভাবে বললে, এই স্বাভাবিক জিনিসগুলোকে স্বাভাবিকভাবে নিতে না পারারও কিন্তু অনেকক্ষেত্রে বড়-সড় মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে।”
রাফিজ উঠে দাঁড়াল – “আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম, পীর সাহেব। কিন্তু আপনার মত আমিও রুমানার ভালো চাই। ভেবেছিলাম, আমার চেয়ে আপনার কথা হয়তো সে বেশি শুনবে। যাহোক, এটা আমার একটা ধারণা মাত্র।”
আনোয়ারা এতক্ষণ অবাক হয়ে তাদের কথোপকথন শুনছিলেন, এবার রাফিজের দেখাদেখি তিনিও উঠে দাঁড়ালেন।
পীরজাদা মিটি মিটি হাসছিলেন, রাফিজকে উঠে দাঁড়াতে দেখে হাত তুলে বিদায় জানালেন – “খোদা আমাদের সবাইকে হেদায়েত দিন।”
তারাও পীরজাদাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এল।
“রাফিজ সাহেব, উনার সাথে এভাবে কথা বলবেন জানলে কোনদিন আপনাকে এখানে আনতাম না।” – পীরজাদার খাস কামরা থেকে বের হয়ে প্রথম সুযোগেই এই কথাটা রাফিজকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন আনোয়ারা।
“কিন্তু আপনিও তো রুমানার সাথে তার যোগাযোগের কথা জানতেন না। নাকি জানতেন, বলেননি কাউকে?”
আনোয়ারা চুপ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন – “আপনি কাজটা খারাপ করেছেন, সেটা আপনি বুঝতে পারছেন না।”
আনোয়ারার কণ্ঠে কিছু একটা ছিল, যে কারণে রাফিজ তার দিকে ঘুরে তাকাল।
“উনাদের অনেক ক্ষমতা, উনারা অনেক খারাপ জিনিস আয়ত্ত্বে রাখেন। উনাদের সাথে বেয়াদবীর ফল ভালো হয় না। আপনি না জেনে না বুঝে নিজের ক্ষতি তো করলেনই, আমার মেয়েটারও ক্ষতি করলেন।”
রাফিজ হাসল – “দেখা যাক। আমি নিজের লাভ-ক্ষতি নিয়ে চিন্তা করি না। তবে এটুক বলতে পারি, আপনার মেয়ের যে অবস্থা, এর চেয়ে খারাপ কোন অবস্থা তার হতে পারে বলে আমার মনে হয়না।”
আনোয়ারা গম্ভীর মুখে এগিয়ে গেলেন। গেটের বাইরে তার জন্য একটা স্কুটার অপেক্ষা করছিল, তিনি সেটায় উঠে বসলেন – যাবার আগে রাফিজের দিকে ফিরেও তাকালেন না।
রাফিজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। স্কুটারটা স্টার্ট নেয়া পর্যন্ত সে সেদিকে তাকিয়ে ছিল। ঠিক এসময় কোথা থেকে যেন একরাশ ঠান্ডা বাতাস এসে ধূলাবালি উড়াতে শুরু করল। রাফিজ লক্ষ্য করল, আকাশের এককোনে কালো মেঘের ঘনঘটা। তার কেন যেন মনে হতে লাগল, সামনে খুব বড় কোন বিপদ অপেক্ষা করছে। রাফিজ বিষন্ন মনে বাড়ির পথ ধরল।
১৮.
ঘরে ফিরে একটু ধাতস্থ হতেই রাফিজ তার নোটবইটা নিয়ে বসল – কিছু চিন্তা লিখে ফেলা খুবই জরুরী। আগের লেখাগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই সে নতুন করে আবার লেখা শুরু করল। নুসরাতের সাথে কথা বলে আসলে তার বেশ কিছু ধারণা বদলে গেছে।
তার মানে এই পীরজাদাই ছিল রুমানার স্বপ্নের সেই রাজপুত্র। আশ্চর্য ! নীপা এই কথা তাকে আগেই বলেছিল, সে গুরুত্ব দেয়নি।
নুসরাত বলেছে – রুমানা যেমন ছিল এ শহরের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে, কবীরও সেরকম ছিল এ এলাকার সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলে। ওদের জুটিটা ছিল এখানকার সেরা জুটি। কিন্তু শেষপর্যন্ত সম্পর্কটা বেশিদূর গড়ায়নি, কারণ রুমানা তার চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ করার মত কিছু কথা শুনেছিল বিভিন্ন জায়গা থেকে।
এটাই তার অ্যাসাইনমেন্ট রিপোর্ট করার মত যথেষ্ট। যৌক্তিক ব্যাখ্যাগুলো চিন্তা করলে এখানে তার কাজ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু রাফিজ ভেতরে ভেতরে খুব ভালো ভাবে অনুভব করে, কোথাও একটা সমস্যা রয়ে যাচ্ছে। রাফিজ সমস্যাটা ঠিক ধরতে পারছে না, কিন্তু সমস্যাটা আছে – একটা অসামঞ্জস্য, কোথায় যেন একটা ছন্দের অমিল !
এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে যখন নানা সম্ভাবণা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, ঠিক তখনই চারদিক ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে গেল – কারেন্ট চলে গেছে আবার। ঘর তার অন্ধকার আর গুমোট। সে উঠে দাঁড়াল জানলা খুলে দেবার জন্য।
জানলা খুলে চেয়ারটায় এসে বসামাত্র দরজায় খচ খচ ধরণের একটা শব্দ শুনতে পেল সে। প্রথমে সে ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কিন্তু ক্রমাগত শব্দটা হতে থাকল, আর সময়ের সাথে সাথে যেন সেটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
রাফিজ উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এটা নিশ্চিত, দরজাতেই শব্দটা হচ্ছে। রাফিজ কে কে বলে দুবার আওয়াজ করল। সে আওয়াজ করার সাথে সাথে দরজার শব্দটা থেমে গেল। বিড়াল-টিড়াল হবে – রাফিজ ভাবল।
সে ফিরে আসতে শুরু করেছে, তখন শব্দটা আবার শুরু হল। এবার যেন আরো তীব্রভাবে। রাফিজ আবার দরজার পাশে গিয়ে দাড়াল।
কে ওখানে – বলে সে একটু অপেক্ষা করল। শব্দটা থেমে গেল – তাৎক্ষণিকভাবে, কিন্তু এবার খুব তাড়াতাড়িই আবার শুরু হল।
রাফিজের সমস্যা হল সে কোন ম্যাচ বা মোমবাতি খুঁজে পাচ্ছেনা। তবু সে কি মনে করে দরজা অর্ধেক খুলে বাইরে উঁকি দিল। বাইরে সিড়িতে অন্ধকার মনে হল আরো গাঢ়। কিন্তু ওপাশে যে কেউ নেই তা বোঝা যাচ্ছিল। একবার শুধু মনে হল – দমকা একটা বাতাস সিড়িঘর থেকে ওর ঘরে এসে ঢুকল। রাফিজ এবার তার মোবাইলের স্ক্রিনটা অন করে সে আলোয় কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক দেখার চেষ্টা করল। শেষে কিছু না পেয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
ফিরে এসে চেয়ারে বসামাত্র একটা বাজে গন্ধ তার নাকে এসে লাগল – একটা বোটকা গন্ধ। সে প্রথমে জানলাটা বন্ধ করে দেবার কথা ভাবল, হয়তো বাইরে থেকে দুর্গন্ধ আসছে। কিন্তু জানলা বন্ধ করলে এ গরমে টেকা কষ্টকর হয়ে যাবে।
সৌভাগ্যবশত সে হাতড়াতে হাতড়াতে তোশকের নিচে ম্যাচ আর মোমবাতি খুঁজে পেল। সে একটা মোম নিয়ে টেবিলে দাড় করিয়ে দিয়ে ম্যাচ জ্বালাল। মুহূর্তে ঘরটা আবছা আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠল।
তখন একটা হালকা শব্দ শুনে সে ঘাড় ফিরে এদিক-ওদিক তাকাল। আর তখনই সে প্রথম লক্ষ্য করল যে – ঘরের কোনে দু’টা বড় কালো কুকুর চুপচাপ বসে আছে।
রাফিজের বুঝে উঠতে সময় লাগল, এগুলো কিভাবে ঘরে এল। তখন কুকুর দু’টোর একটা চাপা গর্জন করে উঠল।
জগতের সমস্ত আতংক যেন একসাথে রাফিজের মনে এসে জড়ো হল। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত চেয়ারে বসে কুকুর দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকল। এমনকি ওর একবার এও মনে হল যে, সে একটা কুকুরকে নিচু হতে দেখেছে – লাফ দেবার আগে এরা যেভাবে নিচু হয় অনেকটা যেন সেভাবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে – এরা ঘরে ঢুকল কিভাবে?
সে যখন এসব ভাবছে, তখনই মুহূর্তের ভেতর একটা ভারী শরীর ওর ওপর এসে পড়ল – সে চেয়ার থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল। জন্তুটা তার বুকের ওপর এসে দাঁড়াল নি:শব্দে। রাফিজ টের পেল অন্যটা তার মাথার কাছে ঘুরাঘুরি করছে। আতংকে তার মাথা তখন ফাঁকা হয়ে গেছে। সে হাল ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, কখন ধারাল দুটো দাত তার গলার মাংস ছিড়ে নেবে।
এমন সময়ই তীব্র চীৎকারের মত একটা শব্দ হল জানলার পাশে। মোমবাতি নিভে গেছে ততক্ষণে। রাফিজ হঠাৎ লক্ষ্য করল, জন্তুটা যেন তার বুকের ওপর থেকে নেমে গেছে। সে উঠে বসার সাহস পাচ্ছিল না, কিন্তু ঘরের ভেতর একটা প্রচন্ডরকম হুটোপুটির শব্দ শুনতে পেল। সে কুকুর দুটার গোঙানির শব্দও শুনল যেন।
জ্ঞান হারানোর আগে সে অস্ফুটস্বওে কেন যেন একবার নীপাকে ডাকল।
১৯.
রাফিজ চোখ মেলে দেখে, ঘরটা ফাঁকা। তবে ঘরে যথেষ্ট আলো আছে, সম্ভবত: কারেন্ট চলে এসেছে। সে ঘরে একটা বুনো ফুলের গন্ধ পাচ্ছিল।
সে মেঝেতে পড়ে ছিল, সে অবস্থা থেকে উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না, বরং সারা শরীরে তীব্র ব্যথা অনুভব করল।
“কি? ঠিক আছেন?”
নীপার কণ্ঠ। সে আন্দাজ করার চেষ্টা করল শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে। আচ্ছা, এটা একটা স্বপ্ন নয় তো! আরেকটা দু:স্বপ্ন! দু:স্বপ্নের ভেতর দু:স্বপ্ন! কই, তাকে তো ঘরের ভেতর কোথাও দেখা যাচ্ছে না, তাহলে তার কণ্ঠ রাকিব শুনছে কি করে?
“মরতে তো বসেছিলেন। কাল খবরের কাগজে আসত – চিকিৎসকের রহস্যময় মৃত্যু, চিলেকোঠার ঘর থেকে ঘাড় মটকানো লাশ উদ্ধার।”
রাফিজ ওর হাসির শব্দ শুনতে পেল। সে তখন উঠে বসার চেষ্টা বাদ দিয়েছে, এখন সে শুধু সাদা ছাদটা আর ঘুরতে থাকা সবুজ সিলিং ফ্যানটা দেখতে পাচ্ছে।
“আশা করি, ঐ হারামজাদাটাকে আর জ্ঞান দিতে যাবেন না।”
রাফিজ মনে মনে ওর কথার অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছিল।
“কুকুর দুটোকে চিনতে পেরেছিলেন?”
রাফিজের মনে পড়ল, পীরজাদার ওখানে বড় দুটো কুকুর সে দেখেছিল। কুকুরগুলো কি কালো ছিল! একবার মাত্র দেখেছে ওগুলোকে। হ্যাঁ, এ দুটোর সাথে ওগুলোর মিল আছে। কিন্তু মানুষ কি এতোটা প্রতিশোধপরায়ন হতে পারে, যে পোষা কুকুর লেলিয়ে দেবে !
“পারে, পারে, আর ও তো একটা আস্ত হারামজাদা।”
আশ্চর্য ! নীপা কি ওর মনের কথা বুঝতে পারছে ? তারও কি অতিপ্রাকৃতিক কোন ক্ষমতা আছে?
“আমি আপনার মনের কথা বুঝব না? আমি তো আপনার মনের মধ্যে বসেই কাজ করি, তাই না?”
ঠিক, হ্যালুসিনেশান, আমার আবার হ্যালুসিনেশন শুরু হয়েছে, ঠিক ছোটবেলার মত – রাফিজ মনে মনে ভাবে।
“হ্যালুসিনেশান বলেন আর ভূত বলেন, আমি কিন্তু আপনার ঘাড়েই ভর করে আছি। হিহি হিহি।”
পুরোটাই ভুল, কুকুরগুলো সহ – রাফিজ বিড় বিড় করে বলল নিজে নিজেই।
“কিন্তু হ্যালুসিনেশানটা শুরু করে দিল কারা – এটা বোধ হয় আপনি বের করার চেষ্টা করেননি। আচ্ছা, বলুন তো – সবার কেন হ্যালুসিনেশান হয়না? সব সময় কেন হ্যালুসিনেশান হয় না?”
“আপনিই বলেন, কেন হয় না?” – রাফিজ এবার উঁচু স্বরেই জানতে চাইল, যেন নীপা সত্যি সত্যিই এ ঘরে উপস্থিত আছে – যদিও সে তাকে দেখতে পাচ্ছে না কিছুতেই।
“সবার সাথে হয়না, কারণ আমরা সবার সাথে থাকি না। সব সময় হয় না, কারণ আমরা সব সময় আপনাদের পাশে থাকি না।”
“কিন্তু আমি একটা জিনিস ভেবে পাচ্ছিনা, রুমানা কবীরকে পছন্দ করত কিন্তু বিয়ে করতে রাজী হল না – এটা কেন?” – দুর্বল স্বরে রাফিজ জানতে চায়।
“ঐ যে হারামজাদাকে বিয়ে করতে রাজী হয়নি। আর রাজী হবেই বা কেন? ও তো ছিল একটা লম্পট। সুন্দর একটা চেহারা নিয়ে জন্মেছিল, মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিত। কয়দিনই বা হয়েছে যে সে বুযুর্গ সেজে বসেছে!”
“রুমানার সাথে তার সম্পর্ক কতটুক গভীর ছিল?”
“রুমানাকে সে সত্যিই পছন্দ করত। সে মেনে নিতে পারে নি, ওর বিয়ে হয়ে গেছে। তাই নিজের পোষা জীন পাঠিয়ে ওকে ভয় দেখায়। ভয় দেখিয়ে আমার ভাবিটাকে পাগল বানিয়ে রেখেছে।”
রাফিজের চিন্তা-ভাবনা গুলিয়ে আসতে লাগল। তখন সে যেন আবছাভাবে নীপার অবয়বটা দেখতে পেল। নীপা কি তাহলে সত্যি সত্যিই এসেছে? মেয়েটা তার মুখের ওপর ঝুঁকে এসে যখন তার দিকে তাকাল, তখন রাফিজ মোটামুটি নিশ্চিত হল, এটা ভিস্যুয়াল হ্যালুসিনেশান না। কিন্তু তখনই সে লক্ষ্য করল, নীপার নাকে-মুখে কাটা আর রক্তের দাগ।
“আপনার মুখে কি হয়েছে?”
নীপা হাসল, মলিন হাসি। ওদের তাড়িয়ে দিয়েছি, কিন্তু ওগুলি আবার আসবে। আর পরেরবার হয়তো আমি আপনাকে বাঁচাতে পারব না।
“ওগুলো সত্যি সত্যিই কুকুর ছিল?”
“ওগুলো যাই হোক, সেটা আপনার না জানলেও চলবে। কিন্তু আমি সত্যিই খুব ক্লান্ত।”
রাফিজের মনে হল, মেয়েটার খুব বেশি রক্তক্ষরণ হচ্ছে – অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
“ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে, আর রুমানা মেয়েটাকে পাগল বানাবে। কবীর হারামজাদা রুনার পেছনে লেগেছে, ওকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। এর থেকে বাঁচার উপায় এখন একটাই।”
রাফিজ তার দিকে তাকিয়ে ছিল – মেয়েটাকে শুশ্রূষা করা দরকার, কিন্তু সে নিজেই উঠতে পারছে না।
“আর বাঁচার সেই উপায়টা হল, আপনার মাথা থেকে এসব ধারণাগুলি ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে যে এগুলি শুধুই হ্যালুসিনেশান।”
“অবশ্যই হ্যালুসিনেশান। এমনকি হয়তো এটাও আমি স্বপ্ন দেখছি, কিংবা হ্যালুসিনেশান। আমার স্কিজোফ্রেনিয়ার হিস্ট্রি আছে। তাছাড়া আমার কাছে প্রমাণ আছে রুমানা হ্যালুসিনেশান দেখে।”
নীপা যেন আবার হাসল – “হ্যালুসিনেশান তো অবশ্যই, কিন্তু সে হ্যালুসিনেশানটা কে শুরু করল? কারা শুরু করল? প্লীজ, এটা একবার ভেবে দেখবেন।”
রাফিজ চুপচাপ কি যেন ভাবছিল।
“যত তাড়াতাড়ি এই জিনিসগুলোকে স্বীকার করে নেবেন, তত তাড়াতাড়ি আপনি আপনার চেষ্টা শুরু করতে পারবেন।”
“কিসের চেষ্টা?”
“নিজেকে ওদের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা, রুমানাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা।”
রাফিজ হাসল, তার যুক্তি-বুদ্ধি তখনও পুরোদমে কাজ করছিল – “ধরে নিলাম, ওগুলো সত্য, ভূত-প্রেতও সত্য। কিন্তু এগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে তো আমি এদের শক্তির কাছে অসহায়, তাই না !”
“না, প্লীজ মন দিয়ে শুনুন। ওদের শক্তি মানুষের মনের ওপর, শারীরিক শক্তি তাদের নেই বললেই চলে। আপনার মন যদি কাবু হয়, ওরা আপনাকে দিয়ে নিজেকে খুন করার মত কাজ করিয়ে নেবে। আপনার মন যদি দুর্বল হয়, তাহলে ওরা ভয় দেখিয়ে আপনার হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত করিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সেই আপনিই যদি মন শক্ত করতে পারেন, তাহলে ওদেরকে হারিয়ে দিতে পারবেন। মানুষ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী, মানুষ জীন-পরীর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।”
রাফিজ চুপ করে কি যেন ভাবছিল। শেষে বলল – “ঠিক আছে, আপনি আমাকে বলে দিন, আমাকে কি করতে হবে।”
“আপনার মন অনেক শক্ত। আমার মনে হয়, আপনিই পারবেন এই মেয়েটাকে বাঁচাতে। আপনার কিছু করতে হবে না, আপনি যদি শক্ত মনের মানুষ হন – তাহলে সময় মত আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন কি করতে হবে।”
সে একটু থেমে তারপর আবার বলল – “শুধু একটা জিনিস মনে রাখবেন, আপনি যা দেখছেন তা ওরা দেখাচ্ছে, এগুলো সত্যি নয়।”
“বিজ্ঞানও তাই বলে, এটাই হ্যালুসিনেশান, একটু আগেও আপনাকে বলেছি।” – রাফিজ ক্লান্ত স্বরে বলে।
“সেজন্যই বলছি, আপনি পারবেন। কিন্তু মনে রাখবেন, হ্যালুসিনেশান এমনি এমনি হয় না, এগুলোর পেছনে কাজ করে কিছু অপশক্তি। আপনাকে যুদ্ধ করতে হবে এই অশরীরী অপশক্তিগুলোর বিরুদ্ধেই। মনে রাখবেন, বিজ্ঞান এটুক পর্যন্ত ঠিক বলে যে এসব হালুসিনেশন, কিন্তু বিজ্ঞান এটা বোঝে না যে হালুসিনেশন তৈরী করে অশরীরী ভয়ঙ্কর সব জীবেরা।”
রাফিজ দেখল, মেয়েটা মাটিতে গড়িয়ে পড়ল – ওর সারা শরীরে রক্ত ঝরছে।
রাফিজ শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে উঠে বসার চেষ্টা করল, আর সেটা করতে গিয়েই সে দ্বিতীয়বারের মত জ্ঞান হারাল।
২০.
চোখ খুলে রাফিজের মনে হল, অনেক রাত হয়েছে। কেউ একজন মাথার কাছে বসে আছে, ঘাড় ঘুরাতে গিয়ে মনে হল সে আর কোনদিনই মাথা উঠাতে পারবে না।
“আপনি প্লীজ একটু স্থির হন ভাই, আপনার শরীর বেশ খারাপ।”
রুমানার গলা। রাফিজ আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিল। আরেকটা পায়ের শব্দ শোনা গেল তখন। নজরুল সাহেব ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলছিলেন – “এখন এই কয়টা খেলেই হবে, কি জ্ঞান ফিরেছে?”
“ডাক্তার কি বলল?” – রুমানা জিজ্ঞেস করছিল।
“ও কিছু না, হিটস্ট্রোক। অতিরিক্ত গরমে বা পানিশূণ্যতায় এটা হয়।”
“নীপাকে একটু খবর দেবেন?” – রাফিজ ক্ষীণস্বরে বলে।
নজরুল আর রুমানা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিলেন।
“নীপা কোথায়?” – রাফিজ আবার বলল।
“নীপা কে? কোন নীপা?” – রুমানা একবার রাফিজের দিকে আর একবার নজরুল সাহেবের দিকে তাকাল।
“ঐ যে আমার উল্টোদিকের ঘরে থাকে যে মেয়েটা!” – রাফিজ বলে।
“নীপা বলে তো এখানে কেউ থাকে না।” – এবার রুমানার গলা শোনা গেল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর রাফিজ শব্দ পেল রুমানা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
রাফিজ কিছু বুঝতে পারছিল না। সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে নজরুলের দিকে তাকিয়ে ছিল। নজরুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রাফিজের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল, তবুও সে আরেকবার জিজ্ঞেস করল নীপার কথা।
“আপনি নীপা সম্পর্কে কি জানেন?” – নজরুল উল্টো তার কাছে জানতে চাইলেন।
“সে আপনাদের তিনতলায় ভাড়া থাকে, আমার ঘরটার পাশে। কয়েকবারই আমার সাথে দেখা হয়েছে, কিন্তু তার তো ব্লিডিং হচ্ছিল। সে কোথায়?”
নজরুলকে গম্ভীর দেখাল – “আপনি কি দেখেছেন বা কার কথা বলছেন, আমি জানিনা। তবে আপনার পাশের ঘরে নীপা নামে একটা মেয়ে থাকত, সে ওঘরেই আত্মহত্যা করেছিল।”
রাফিজ চুপচাপ শুনল কথাটা, সে কথাটার অর্থ যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।
“নীপাই আমার সে আত্মীয়া যে আত্মহত্যা করেছিল। তবে আপনিই প্রথম না, আরো অনেকেই বলে যে তাকে দেখেছে।”
রাফিজ কিছু চিন্তা করতে পারছিলনা, তার সব হিসাব-নিকাশ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অথচ গতকালও সে নোট নিচ্ছিল আর ভাবছিল সে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবে ধরতে পেরেছে।
“আপনাকে আগে বলিনি, কারণ আমি নিজে কোনদিন তার প্রেতাত্মা বা ঐ জাতীয় কিছু দেখিনি।”
খুব তাড়াতাড়ি নোটটা নিয়ে বসতে হবে আবার, আগের বিশ্লেষণটা আবার খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তে হবে। দেখতে হবে, কোন কোন জায়গায় তার হাইপোথিসিসটা পরিবর্তন করা দরকার।
“তাছাড়া মূল ঘটনার সাথে এর তো কোন সম্পর্ক নেই, তাই না?”
রাফিজ কিছু বলল না। এটা বিশ্বাস করা শক্ত যে, সে একটি মৃত আত্মার সাথে এতদিন কথা বলেছে। এটা ঠিক যে, সে ছোটবেলায় কিছু মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছে – বেশ ভালোরকম সমস্যাই ছিল সেগুলো। কিন্তু ওর ধারণা ছিল যে, সেসব অধ্যায় তার জীবন থেকে শেষ হয়ে গেছে। তাছাড়া সে তো জানতোনা যে এখানে নীপা নামের কোন মেয়ে ছিল, তাহলে সে কেন হ্যালুসিনেশানের ভেতর নীপা নামের একটি মেয়েকেই দেখল, আর কেনই বা একই হ্যালুসিনেশান বার বার ঘটল তার জীবনে ধারাবাহিক নাটকের মত।
আর তাছাড়া তার নিজের নিকট অতীতের দিকে তাকিয়ে এত বড় কোন সমস্যার ইতিহাস সে পেলনা, যাতে মনে হতে পারে – সে নিজে হ্যালুসিনেশান জাতীয় সমস্যার সহজ শিকার হতে পারে। পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন গোলমেলে।
“শেষ প্রশ্ন, এটা আপনাদের দুজনের ভালোর জন্যই আমার জানা দরকার।” – রাফিজ দুর্বল স্বরে বলল।
“আমাদের দুজনের মানে?”
“আপনার আর আপনার ওয়াইফের।”
নজরুল গম্ভীর মুখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
“প্রশ্নটা বিব্রতকর, কিন্তু আমাকে সেটা করতেই হবে।”
নজরুল একইরকম ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
“আপনার সাথে নীপা মেয়েটার সম্পর্ক ছিল। তাই না?” – প্রশ্ন করে রাফিজ তাকিয়ে থাকল নজরুলের মুখের দিকে, হয়তো ভদ্রলোকের প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝে নিতে চাইল উত্তরটা।
নজরুল কিছু বললেন না। একইভাবে তাকিয়ে থাকলেন – স্থির।
“এ ব্যাপারটার সূত্র ধরেই কি মেয়েটা আত্মহত্যা করেছিল?”
নজরুল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, যেন এখন এখানে বসে থাকার কোন মানে খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। রাফিজ ভাবলো, সে তার প্রশ্নটার উত্তর পেয়ে গেছে।
“মেয়েটাকে সম্ভবত আপনি বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, আর এজন্যই রুমানা পাগলামি শুরু করলে আপনার মনে জেগে উঠত আফসোস যে কেন আপনি ওকে বিয়ে না করে রুমানাকে বিয়ে করেছেন। একই কারণে রুমানার চেহারায় নিজের অজান্তেই দেখতে শুরু করেছিলেন নীপার চেহারা – একধরণের পরোক্ষ ইচ্ছাপূরণ।”
নজরুল ততক্ষণে রুমের বাইরে পা বাড়িয়েছেন। রাফিজ চোখ বন্ধ করল। কিন্তু একটু পরই শব্দ পেয়ে চোখ খুলে দেখল, ভদ্রলোক ফিরে এসেছেন।
“শুনুন, আমি সত্যিই নীপাকে পছন্দ করতাম। ফুপাতো বোন বলে আর ফ্যামিলির ঝামেলা ছিল বলে বিয়ে করতে পারিনি। এমনকি আমার বলতে আপত্তি নেই যে, ওর সাথে আমার এক ধরণের সম্পর্ক ছিল। সম্পর্কটা শারীরিক না হলেও তাকে আমি কামনা করতাম, আর শেষদিকে সেও সেটা বুঝতে শুরু করেছিল। তবে সত্যি কথা বলতে কি, এর জন্য আমি বিন্দুমাত্রও লজ্জিত না। যার স্ত্রী সন্দেহপ্রবণ অসুস্থ এক মহিলা, তার পক্ষে বাইরের কারো সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা অন্যায় কিছু হতে পারে না। আর নীপাকে আমি পছন্দ করতাম, সেও আমাকে পছন্দ করত।”
“আর সে যে আত্মহত্যা করল, সেটার জন্যও কোন অপরাধবোধ নেই?”
“শুনুন, তার আত্মহত্যা একটা দুর্ঘটনা মাত্র। আমি এতে ভয়াবহ কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু এর জন্য আমি দায়ী নই। তার আত্মহত্যার জন্য একমাত্র দায়ী তার ঐ রাসকেল হাজব্যান্ডটা।”
রাফিজ তাকিয়ে ছিল নজরুলের চোখের দিকে।
নজরুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন – “এখন আপনি যদি এটা রুমানাকে বলতে চান, বলতে পারেন। এর ফলে যা হবে, তাকে আমি ভাগ্য বলে মেনে নেব। আর তা যদি না বলেন, তবে হয়তো মেয়েটার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার একটা সুযোগ থাকবে – যেটাতে আমি পুরোপুরি তাকে সাহায্য করব।”
নজরুল দৃঢ় পদক্ষেপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
রাফিজের খুব ঘুম পেতে লাগল – কোন ঘুমের ওষুধের ফল। অথবা শরীর অত্যন্ত দুর্বল। তখন আবার কুকুর দুটোর কথা মনে পড়ল তার, নীপা তাকে কুকুর দুটোর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল – কুকুরগুলোকে তাড়াতে গিয়ে মেয়েটা নিজে মারাত্মক আহত হয়েছিল, মেয়েটা মরতে বসেছিল। সেই ঘটনার পুরোটাই কি তার মনোবিকার – স্বপ্ন ! নাকি এখন সে যে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে, এটাই স্বপ্ন! কোনটা সত্যিকার বাস্তবতা ওর জীবনে!
২১.
পুরোপুরি সুস্থ হতে রাফিজের প্রায় এক সপ্তাহ সময় লেগে গেল। এলাকায় নজরুল সাহেবের যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, সেটা বোঝা যায় – ক্লিনিকে এসি রুম ছিল তার জন্য, আর ডাক্তার-নার্স সবাই তাকে অতিরিক্ত খাতির-যত্ন করেছে এ কয়টা দিন।
বাসায় ফিরেই রাফিজ নোটবইটা নিয়ে বসল। পুরো ব্যাপারটা গোড়া থেকে আবার চিন্তা করে দেখতে হবে। সন্ধ্যায় সে একটানা সাড়ে তিন ঘন্টা কাজ করল ল্যাম্পের আলোয়। তার নতুন পর্যবেক্ষণগুলো সে গুছিয়ে লিখল নতুন করে।
সে লক্ষ্য করল – তার আগের বিশ্লেষণটা খুব একটা বদলানোর দরকার হয় না নীপার কারণে। সে পুরো সমস্যাটাকে দুটো ভাগে ভাগ করল – এক, রুমানার অস্বাভাবিক আচরণ; দুই, তার নিজের নীপার সাথে পরিচয়। দুটো সমস্যাকে সে আলাদা আলাদা বিশ্লেষণ করার সিদ্ধান্ত নিল।
প্রথমে আসা যাক রুমানার সমস্যাটা নিয়ে, যেটাকে সে ক্ল্যাসিক্যাল স্কিজোফ্রেনিয়ার কেস বলে চিহ্নিত করেছিল। দ্বিতীয় সমস্যাটা নিয়ে সে পরে চিন্তা করবে, কারণ প্রথম সমস্যাটার ওপর এর কোন প্রভাব নাও থাকতে পারে – অর্থাৎ এটা তার একান্ত নিজস্ব সমস্যাও হতে পারে। হতে পারে, এটা তার নিজের স্কিজোফ্রেনিয়ার কেস – যদিও তা হবার সম্ভাবণা খুব কম। সেটা হবার সম্ভাবণা কম একারণে যে – নীপা নামটা তার জানা ছিলনা, আর জানা থাকলেও সে যে পাশের ঘরে থাকত এটা তার জানা ছিলনা।
রাফিজ অন্য একটা সম্ভাবনাও চিন্তা করল – হয়তো এসব তার জানা ছিল, হয়তো কোথাও শুনেছে তারপর ভুলে গেছে, কিন্তু তার অবচেতন সেটা মনে রেখেছে, এবং মস্তিষ্কের অলিগলির ভেতর লুকিয়ে থাকা তথ্যকে কাজে লাগিয়ে একটা কল্পনা সাজিয়েছে। কিন্তু এতে তার অবচেতনের লাভটা কি? কোন সে জিনিস, যা তার অবচেতন মন তার সচেতন মন থেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে? রাফিজ কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারল না। তার শুধু বার বার মনে হতে লাগল – তার দেখা মিথ্যা নয়, এমনকি কুকুর দুটোও মিথ্যা কল্পণা ছিল না।
এবার রাফিজ প্রথম সমস্যাটার দিকে মন দিল। যদি ধরেও নেয়া যায় যে নীপা বলে কারো সাথে তার দেখা বা কথা হয়নি, তবুও রুমানার ব্যাপারটার একটা অমীমাংসিত দিক রয়ে গেছে – যা কোনভাবে তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সেটা হল – রুমানা মাঝে মাঝেই অন্য একটি মেয়ের মত আচরণ করে।
সে তার প্রথম বিশ্লেষণটা পড়ে দেখল, সেখানে রুমানার ভয় পাবার বিষয়টার চমৎকার ব্যাখ্যা আছে – যে ব্যাখ্যার পেছনে আছে রুমানার অতীত, তার শরীর ও মনের দ্বন্দ্ব, আর হয়তো পীরজাদা কবীরের সাথে তার আগেকার যোগাযোগ। কিন্তু সে বিশ্লেষণে একেবারেই নেই, কেন প্রায়ই রুমানা অন্য একটা মেয়ের মত আচরণ করে, কেন সে অন্য একটা মেয়ের গলায় কথা বলে।
এই বিষয়টা পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য আরো কয়েকটা সেশনে বসতে হবে রুমানার সাথে। এমনকি আরেকবার করে কথা বলতে হতে পারে আনোয়ারা, নুসরাত এবং নজরুল সাহেবের সাথে।
এমনকি তার হিসাব থেকে এও বাদ পড়ে গিয়েছিল যে – রুমানা ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় নজরুলকে সন্দেহ করে, তাকে যা-তা বলে গালাগাল করে। সবচেয়ে বড় কথা, সে ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় এমন সব কথা বলেছে – যা শুধু নীপারই জানার কথা।
রাফিজ নোটবইটা বন্ধ করে জানলার বাইরে তাকাল – সেখানে তখন গাঢ় নিকষ অন্ধকার রাজত্ব করতে শুরু করেছে।
২২.
আলো-আধারিতে রাফিজ বুঝতে পারছেনা, সে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে দেখল, ঘরের কোনা থেকে সাদা ধোঁয়ার মত কিছু একটা কুন্ডলী পাকিয়ে উঠছে। ঠিক তখনই সে রুমানার গলার চীৎকার শুনতে পেল।
সে দৌড়ে পাশের ঘরে গেল, যেখান থেকে চীৎকারটা আসছে। এ ঘরে আলো একটু বেশি, ফলে মোটামুটি সব দেখা যাচ্ছে। এখন রাফিজ স্পষ্ট বুঝতে পারল, এটা নজরুল সাহেবের বাসার ড্রইংরুম। আর সে এতক্ষণ তাদের বেডরুমে বসে ছিল। কিন্তু সে মনে করতে পারলনা, অন্ধকারে সে ওখানে কি করছিল।
রাফিজ তখন সামনে তাকিয়ে দেখল, রুমানা বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে আর কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছেনা। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে রাফিজ পেছনে ফিরে তাকাল, আর অবাক হয়ে দেখল ঘরের দরজাটা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাফিজ কি মনে করে প্রাণপণে দৌড়ে গিয়ে দরজার হাতলটা ধরে ফেলল। ভেতর থেকে কেউ প্রচন্ড শক্তিতে দরজাটা টানছে, কিন্তু রাফিজ কাউকে দেখতে পাচ্ছেনা। একপর্যায়ে রাফিজ হ্যাঁচকা এক টানে দরজাটা খুলে ফেলল। আর তখনই সে অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখতে পেল।
রাফিজ দেখে, চেয়ারটা – যেটাতে সে এতক্ষণ বসে ছিল – আপনা আপনি সরে যাচ্ছে ঘরের ভেতরের দিকে, তারপর একসময় সেটা কিছূটা শূন্যে উঠে সেখানেই ভেসে রইল। ভয়ে রাফিজ চীৎকার করতে চাইল, কিন্তু ওর গলা দিয়ে গোঁ গোঁ ছাড়া আর কোন শব্দ বের হলনা। দরজাটা তখন ওর মুখের সামনে ধাম করে বন্ধ হয়ে গেল।
ঠিক তখনই ঐ ঘরটারই বাইরের দিকের দরজাটা হালকা ফাঁক হয়ে গেল, আর রাফিজের মনে হল একটা দমকা হাওয়া ঘর থেকে ঐ ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল। রাফিজ রুমানাকে কি যেন বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না।
রাফিজ ঘুম ভেংগে দেখল, মাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে, উঠে হাত-মুখ ধোয়া দরকার। কিন্তু বিছানা থেকে উঠতে গিয়েই সে হোচট খেয়ে পড়ল। কোনমতে উঠে বাথরুমে গিয়ে মাথায় পানি দিল, তারপর ড্রয়ার থেকে প্যারাসিটামলের পাতাটা বের করে একবারে দুটা ট্যাবলেট মুখে পুরে দিল।
আর ঠিক তখনই চীৎকারটা শুনতে পেল সে। তার মনে হল, শব্দটা আসছে নজরুল সাহেবের বেডরুম থেকে। রাফিজ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে লাগল।
দোতলার বারান্দায় নেমে সে নজরুল সাহেবের বেডরুমের দরজা খোলা দেখতে পেল। হৈ চৈ এর শব্দটাও সেদিক থেকেই আসছে।
রাফিজ ছুটে গিযে দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেল – নজরুল সাহেব ঘরের মাঝখানে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে আছেন, একবার তাকাচ্ছেন শরীয়তের মায়ের দিকে, একবার জয়ন্তর দিকে।
“রুমানা ঘরে দুটো কুকুর দেখতে পাচ্ছে।” – অনিশ্চিত ভংগীতে বললেন তিনি রাফিজের দিকে তাকিয়ে।
“ও মা, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।” – রুমানা আর্তনাদ করছিল।
“কোথায় কুকুর?” – নজরুল সাহেব একবার বললেন।
“ঐ যে, ওখানে।” – রুমানা রীতিমত ঘামছে, দৃষ্টি বিস্ফারিত। সে তাকিয়ে আছে ঘরের কোনার দিকে, তার পুরো শরীর থর থর করে কাপছে।
“আমি কি একটু উনার সাথে আলাদা কথা বলতে পারি?” – কি মনে করে বলল রাফিজ।
“না, না, তোমরা থাকো, ওগুলো আমাকে মেরে ফেলবে।” – রুমানা আর্তনাদ করে উঠল।
রাফিজ ওদের চোখ দিয়ে ইশারা করল চলে যাবার জন্য। নজরুল সাহেব ঘরের শূণ্য কোনাটার দিকে একবার তাকালেন, তারপর ফিরে রাফিজের দিকে তাকালেন। শেষপর্যন্ত তিনি অন্য দুজনকে ইশারা করলেন, তারপর নি:শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন – পেছন পেছন ওরা দুজনও।
ওরা বের হয়ে যাবার পর রাফিজ অবাক হয়ে দেখল – ঘরের কোণে সত্যি সত্যিই দুটো কুকুর বসে আছে আর জ্বলজ্বলে চোখে তাকাচ্ছে।
তার নীপার কথা মনে পড়ল – সে বলেছিল, হ্যালুসিনেশান আপনা আপনি হয়না, হ্যালুসিনেশান তৈরি করে অশরীরী কিছু জীব। তাহলে কি সত্যি সত্যিই এ ঘরে অশরীরী দুটো জীব আছে, যারা একই সাথে রুমানা এবং তার মনে হ্যালুসিনেশান তৈরি করছে !
এক মুহূর্তের জন্য একটা অদ্ভুত হতাশা রাফিজকে ঘিরে ধরল – কারণ, এই অশরীরী জীবের ধারণা তার শিক্ষা কিংবা বিশ্বাস কোনটার সাথেই সে খাপ খাওয়াতে পারছিল না। তার ভেতর চরম একটা দ্বন্দ্ব কাজ করতে শুরু করল। কিন্তু সাথে সাথে সে এটাও বুঝতে পারল – এটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সময় না। তার মনের খুব গভীরে কেউ বলতে লাগল – এখন সিদ্ধান্ত নেবার সময়।
রাফিজ সিদ্ধান্ত নিল, সে অশরীরী জীবের ধারণাটাকে সত্য ধরে নিয়ে কাজ করবে – ঠিক যেমনটা বিদেহী কিংবা কল্পিত নীপা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলো। আসলে মুহূর্তের একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের মধ্যে সে কিভাবে যেন বুঝতে পারছিল, এই ধারণাটা পরীক্ষা করে দেখার মধ্যে হারানোর কিছু নেই।
সে রুমানাকে বলল – “এগুলো আপনার কল্পনা, আপনি চোখ বন্ধ করুন।”
“কি বলছেন আপনি এসব?”
“এখন এমন একটা সময়, যখন আপনার আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। আপনি চোখ বন্ধ করুন – আমি ঘরের কোনায় যাচ্ছি।”
রাফিজ সত্যি সত্যিই ঘরের সেই কোনাটার দিকে এগুতে শুরু করল। সে এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে দেখতে পেল, রুমানা চোখ বন্ধ করেছে – সম্ভবত রাফিজকে ওদিকে এগিয়ে যেতে দেখে সে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল।
অথচ রাফিজ নিজে ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ভয় পেতে লাগল, কারণ সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল কুকুর দুটোকে। সে বিড় বিড় করে বলতে লাগল – “কুকুর নেই, কুকুর নেই।” কিন্তু ঠিক সে মুহূর্তে কুকুর দুটো গর্জন করে উঠল।
“আসলেও কুকুর নেই, রাফিজ।” – নীপার কণ্ঠ। রাফিজ খুব বিস্মিত হয়ে ফিরে তাকাল, আর দেখতে পেল, ঘরের ভেতর নীপা বসে আছে। যেখানটায় রুমানা বসে ছিল, ঠিক সেখানটায়; যে পোশাকে রুমানা বসে ছিল, ঠিক সেই পোশাকে।
রাফিজ একবার কুকুর দুটোর দিকে, তারপর একবার নীপার দিকে তাকাল। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ তাকে বলছিল – এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে, এখন করতে হবে ঠিক সেই কাজটা যা তার করার কথা ছিল।
সে দেখল, কুকুর দুটো নিচু হচ্ছে – শিকার ধরার আগে পশু যেভাবে নিচু হয় সেভাবে। আগেরবার কুকুরগুলোর আক্রমনের ঘটনার কথা চিন্তা করে চরম আতংক ভর করল তার মনে। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ তাকে বলছিল – এখন আতংকিত হবার সময় না।
ঠিক তখন সে বুঝতে পারল, নীপা খাট থেকে নেমে এসেছে। কিন্তু মেয়েটাকে এর আগেরবার কুকুর দুটো প্রায় মেরেই ফেলেছিল, এবার সেটা হতে দেয়া যাবে না।
“আমরা দুজন মিলে ও দুটোকে আজ চিরদিনের মত শেষ করে দেব।” – নীপার কথা শুনে রাফিজ কিছুটা বিস্মিত হল, কিন্তু তার মাথা ততক্ষণে আবার কাজ করতে শুরু করেছে । মুহূর্তের মধ্যে সে চিন্তা করে নিল – যেহেতু নজরুল বা জয়ন্ত বা শরীয়তের মা ও দুটোকে দেখতে পায়নি, তার মানে সত্যি সত্যি কোন কুকুর ওখানে নেই। এটা অবশ্যই তার কল্পনা, বা স্বপ্নের মত কিছু একটা। স্বপ্নের ভেতর যত ভয়ংকর জিনিসই দেখা যাক না কেন, শেষ পর্যন্ত সেটা কোন ক্ষতি করতে পারে না।
এটুক ভাবার পর সে মনে বেশ শক্তি অনুভব করল, সে দুই পা এগিয়ে গেল কুকুরগুলোর দিকে।
এই স্বপ্ন কোন অশরীরীর তৈরি করা হোক বা না হোক, তাতে কিছুই যায় আসে না – কারণ সবকিছুর পরও এটা কল্পণার বেশি কিছু নয়।
আর এটা যদি কল্পনা হয়, তাহলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তিও তার নিজেরই আছে। সে কুকুরগুলোর দিকে তাকিয়ে কল্পনা করার চেষ্টা করল, এখানে কিছু নেই। কিন্তু সেটা সহজ হলনা, কারণ একটা কুকুর ততক্ষণে তার দিকে এগোতে শুরু করেছে।
সে এবার কল্পনা করার চেষ্টা করল, এখানে দুটো চেয়ার আছে। এতেও কাজ হলনা, কারণ চোখের সামনে যা দেখতে পাচ্ছে তা কিভাবে অবিশ্বাস করা যায় !
এবার হঠাৎ কি মনে হতেই সে চীৎকার করে বলে উঠল – আরে, এ দুটো তো কুকুরের মূর্তি, কি সুন্দর মূর্তি, সত্যিকার কুকুরের মত, মূর্তি, মূর্তি …
সে পাগলের মত বার বার ‘মূর্তি’, ‘মূর্তি’ বলে চীৎকার করতে লাগল। তখন সে অবাক হয়ে দেখতে পেল, কুকুর দুটো নড়ছেনা, যেন সত্যি সত্যিই ও দুটো মূর্তি। সে বুঝতে পারল – তার মন এ ধারণাটা গ্রহণ করেছে যে এ দুটো মূর্তি হতে পারে। তার সাহস শতগুণ বেড়ে গেল, সে আরো দুই পা এগিয়ে গেল ও দুটোর দিকে আর বলতে লাগল – নীপা, লাথি দাও মূর্তিতে, লাথি দাও, কুৎসিত বিশ্রী মূর্তি, লাথি মেরে ভেংগে দাও।
বলতে বলতে সে নিজেই লাথি মারতে লাগল সামনের কুকুরটার ওপর তার সারা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে, আর কি আশ্চর্য, এর মাথাটা ভেংগে টুকরো হয়ে উড়ে গিয়ে পড়ল দূরে।
তখন সে লক্ষ্য করল, অন্য কুকুরটা দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটার সামনে। সে লক্ষ্য করল – নীপা নয়, রুমানা সেখানে দাঁড়িয়ে, এবং সে ভয়ে থর থর করে কাপছে।
রাফিজ বুঝতে পারল, এখন নীপা আর রুমানার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করার একদম সময় নেই। হতে পারে, রুমানার ওপর নীপা ভোর করে ছিল এতক্ষন। হতে পারে, নীপাই এতদিন তার ভাবীর ওপর সময় সময় আসর করেছে তার ভাবীকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। যাই হোক না কেন, এটা নিয়ে পরে বিশ্লেষণ করা যাবে । সে দ্রুত চলে এল দ্বিতীয় কুকুরটার সামনে, তারপর টান দিয়ে ওটাকে তুলে ধরল আছাড় মারার ভংগীতে। কিন্তু আছড়ে না ফেলে সে চীৎকার করে বলল রুমানাকে – “রুমানা, দেখেন, এটা একটা মূর্তি, আপনি দেখেন, আমি মূর্তিটার ঘাড় মটকে ধরেছি, আপনি এটাকে ভেঙে ফেলেন, এটাই আপনার সুযোগ, চিরদিনের জন্য ভেংগে ফেলেন আপনার দু:স্বপ্নটাকে।”
“আমি পারবনা, আমি পারবনা।” – রুমানা তখনো প্রচন্ড আতংক চোখে নিয়ে তাকিয়ে ছিল ওটার দিকে।
“আপনাকে পারতেই হবে, আমি তুলে ধরে রাখতে পারছিনা, প্লীজ।”
রাফিজ প্রচন্ড একটা ধাক্কা অনুভব করল, হাত থেকে পুতুলটা ছিটকে পড়ে গেছে। হ্যাঁ, রুমানা ধাক্কা দিয়েছে ওটাতে, রুমানাই ধাক্কা দিয়েছে। রাফিজ দেখল, পড়ে গিয়ে এটাও টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
অদ্ভুত এক আনন্দ ভর করল রাফিজের ওপর, কিন্তু রুমানার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল – মেয়েটা পড়ে যাচ্ছে। সম্ভবত ওর শরীর এই আতংকের ভার নিতে পারেনি।
রাফিজ ছুটে গিয়ে ধরে ফেলল মেয়েটাকে, ঘরের কোনা থেকে পুতুল দুটোর ভাংগা টুকরোগুলো ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে।
২৩.
কাল রাফিজ ফিরে যাবে – এখানে তার কাজ মোটামুটি শেষ বলেই মনে হচ্ছে। তার মন বলছে, রুমানার আর কোনদিন কোন সমস্যা হবেনা – যদিও তার নিজের সব হিসাব মেলেনি।
সন্ধ্যার পর পর শেষ এপ্রিলের প্রচন্ড গরমে ছটফট করছিল সে। শেষটায় বাথরুমে গিয়ে মাথায় দুই মগ পানি ঢেলে এসে একটু স্বস্তি পেল। কিন্তু পর পর দুটা হাঁচি দিয়ে তার মনে হল, এই ভর সন্ধ্যায় গোসল করাটা তার বোধহয় ঠিক হয়নি।
তার প্রথম সমস্যাটার সমাধান হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে – রুমানার সমস্যা। কিন্তু তার দ্বিতীয় সমস্যাটা এখন পর্যন্ত অমীমাংসিতই রয়ে গেছে – তার নিজের অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতাগুলো, যেগুলো এ মফস্বল শহরটায় এসে তার হয়েছে। সে এখন পর্যন্ত মেনে নিতে পারছে না যে, একটি মৃত আত্মার সাথে তার দীর্ঘদিন ধরে কথা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, সেই মৃত আত্মা তাকে এমন কতগুলো তথ্য দিয়েছে – যা সে আগে থেকে জানত না, কিন্তু যা আবার সত্য। এটা তার পক্ষে মেনে নেয়া খুব কষ্টকর।
বসে বসে সে এসবই ভাবছিল, আর একটা অস্বস্তি তার মনের ভেতর খচ খচ করছিল।
ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দটা স্পষ্ট করে শুনতে পেল রাফিজ। সে প্রথমে ভাবল, এটা হয়তো বাতাসের কোন কারুকাজ, কিংবা একেবারে ওর শোনার ভুল। কিন্তু তার পরই আবার স্পষ্ট দুই দুই বার শব্দটা শুনল সে।
সে জানতে চাইল – কে। কিন্তু কোন উত্তর এলোনা।
রাফিজ চুপ করে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন আবার পর পর দু’ বার শব্দটা হল।
সে আবার জানতে চাইল – কে। কিন্তু এবারো কোন উত্তর নেই।
রাফিজ দরজা খুলে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর বিস্মিত স্বরে বলল – “নীপা?”
রাফিজ দেখল, যাকে সে নীপা বলে জানত ঠিক সে অবয়বটাই দরজার বাইরে অপেক্ষা করছে – যেন ভেতরে প্রবেশের অনুমতির জন্য।
রাফিজ বলে উঠল – “ওরা আমাকে বলেছে, নীপা আত্মহত্যা করেছে, তাহলে আপনি কে?”
অবয়বটি ততক্ষণে ভেতরে চলে এসেছে। রাফিজ দরজা লাগিয়ে দিল।
“আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না, তাই না?” – অবয়বটা রিনরিনে স্বরে হাসছিল।
“খুব সম্ভবত: আপনি আমার হ্যালুসিনেশন, আমার পুরনো অসুখটা বোধ হয় আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।”
নারী অবয়বটা আবার হেসে উঠল – “আপনার আগেরটাও অসুখ ছিল না, এখনকারটাও না।”
রাফিজ চুপচাপ শুনছিল। সে দ্রুত চিন্তা করে নিল – এটা যদি তার অসুখ হয়ে থাকে, তাহলে এই কথাগুলোও তার অংশ হওয়া সম্ভব।
“কিন্তু আপনার সাথে আমার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে, প্রতিবার একই চেহারা, একরকম ঘটনা। আপনি যদি প্রতিদিন একই স্বপ্ন ধারাবাহিক পর্বের মত দেখতেন, তাহলে কি আশ্চর্য লাগত না?” – মেয়েটা বলল নীপার কণ্ঠে, বলল এমনভাবে যেন রাফিজের কথা শুনতে পাচ্ছিল।
“তা লাগত।” – রাফিজ হাসল।
“আপনার ঐ হ্যালুসিনেশানও নিশ্চয়ই ধারাবাহিকভাবে স্বাভাবিক ঘটনার মত ঘটে না।”
“তা অবশ্য ঘটে না।” – রাফিজ মাথা নাড়ল।
“আপনার অনেক বুদ্ধি, কিন্তু আপনার জ্ঞান খুবই অল্প।” – শেষপর্যন্ত সে বলে।
“জ্ঞানের চেয়ে বুদ্ধির ওপর আস্থা রাখাটাই কি বেশি নিরাপদ না?” – রাফিজের ঐ মুহূর্তে কেন যেন মাথাব্যথা শুরু হল।
“আমার তিনশ বছরের জীবনে আপনার মত জিনিস খুব কমই দেখেছি।” – সে বলে – “এই মাথাব্যথাও কি মিথ্যা!”
“যেহেতু আপনি আমার কল্পনা, তাই এসব কথা আমার কাছে মূল্যহীন।”
“আমি যে আপনার মস্তিষ্কের বাইরের একটি আলাদা স্বত্ত্বা, তার প্রমাণ দিচ্ছি।” – মেয়েটা হঠাৎ বলে ওঠে।
“প্রথম প্রমাণ হল, আমি নীপা আর নজরুলের গোপন সম্পর্কের ব্যাপারে যা বলেছি, সেটা সত্যি ছিল। আপনি তার প্রমাণও পেয়েছেন। যেটা আপনার মাথায় আসার কথা না, সেটা সম্পর্কে আপনি কিভাবে পুরোপুরি নির্ভুল একটা অনুমান করলেন। এটাতো কোনভাবেই আপনার মাথায় আসার কথা না, তাই না?”
রাফিজ হাসল – “ওটা ছিল একটা চমৎকার বিশ্লেষণ, যা আমার মস্তিষ্ক বের করে এনেছে অসংখ্য কেস স্টাডির সমন্বয় করে।”
“দ্বিতীয় প্রমাণ হল, রুমানা আর পীরজাদার অতীত সম্পর্কের কথা আমি আপনাকে বলেছি। পরে আপনি নুসরাতের সাথে কথা বলে সেটার প্রমাণ পেয়েছেন।”
“ওটাও আমার চমৎকার একটি বিশ্লেষণ ছিল, যেটা আমার অবচেতন মন বের করে রেখেছিল কিন্তু কোন কমপ্লেক্সের কারণে আমি সচেতনভাবে সেটা আগে বুঝতে পারিনি।”
“তৃতীয় প্রমাণ হল, আপনি আমার বুদ্ধি ব্যবহার করে কুকুর দুটোকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন।”
“যেকোন ভুল কল্পণার সাথে আমরা সায়কায়াট্রিস্টরা এভাবেই কাজ করি।” – রাফিজ বলে।
“আমি জানতাম, আপনি এরকম বলবেন। এজন্য আরো প্রমাণ আমি ভেবে রেখেছি, আর এই প্রমাণটা একেবারে অকাট্য। আপনি নুসরাতের কথা জেনেছিলেন আমার কাছ থেকে। এমনকি আমি আপনাকে তার ঠিকানাও দিয়েছি। উনার কাছ থেকে আপনি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পেয়েছেন, যেগুলো আপনার পরবর্তীতে কাজে লেগেছে। আমি যদি আপনার কল্পণাই হতাম, তাহলে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ায় যে – আপনার সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মহিলার ঠিকানা আপনি নিজের বিকৃত একটি মস্তিষ্ক থেকে পেয়েছেন। ঠিক কিনা?” – বলে মেয়েটা মিটিমিটি হাসতে লাগল।
“হয়তো এটার কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে, ব্যাখ্যাটা আছে এবং সেটা আপনার ব্যাখ্যা থেকে আলাদা, কিন্তু কোন কারণে আমি সেই ব্যাখ্যাটা ধরতে পারছিনা।” – রাফিজ বলল।
মেয়েটা জোরে হেসে উঠল – “চমৎকার আপনার পাশ কাটানো, কিন্তু অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? আর কতদিন আপনি নিজের সমস্যাকে অস্বীকার করে যাবেন?”
“সমস্যা? আমার? আমার কি সমস্যা?”
“আপনি একবার অন্তত: তর্কের খাতিরে ধরে নেন যে আমরা আছি, আর আপনি ছোটবেলা থেকেই আমাদের দেখতে পান। একবার আপনি সেটা ধরে নিয়ে চিন্তা করেন, আপনার ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পাবেন।”
রাফিজ চুপ করে কথাগুলো শুনছিল।
“আপনি একবার নিজের কাছে স্বীকার করে নেন যে, এগুলি আপনার অসুখ না, বরং এটা আপনার একটা বৈশিষ্ট্য মানে গুণ যে আপনি আমাদের দেখতে পান, ছোটবেলা থেকেই দেখতে পান। কিছু কিছু মানুষের এই গুণটা থাকে, খুব অল্প কিছু মানুষের – আপনি সেই অল্প কিছু মানুষের একজন। আর তাছাড়া আপনি হয়তো নিজেও জানেন না যে, আপনি একজন উল্টো মানুষ।”
“উল্টো মানুষ?”
“আপনার মা যখন আপনাকে প্রসব করেন, তখন আপনার মাথা আগে বের না হয়ে আপনার পা আগে বের হয়েছিল। অর্থাৎ মায়ের গর্ভে আপনি উল্টো হয়ে বেড়ে উঠেছেন। এ ধরণের মানুষের কিছু কিছু আধ্যাত্মিক ক্ষমতা থাকে।”
“রাফিজ বিস্ময় বোধ করে।” – এটা তো আমি জানতাম না।
“আপনি আপনার জন্মের সময় কাছে ছিল এমন কাউকে জিজ্ঞেস করবেন একথা – আজই জিজ্ঞেস করবেন। যদি এটা সত্য হয় তাহলে সেটা হবে আমার অস্তিত্বের মানে আমাদের অস্তিত্বের আরেকটা অকাট্য প্রমাণ।”
রাফিজ হাসল – “আপনি যদি সত্যিই অশরীরী কিছু হয়ে থাকেন, তাহলে তো এবাসায় আপনার ঢুকতে পারার কথা না। এ বাসা তো হুজুরের দোআ-তাবিজ দিয়ে বেঁধে রাখা।” – সে কৌতুক করে বলে।
“এসব দোয়া-তাবিজে আমাদের কিছু হয় না। একসময় হত, তখন আমাদের আগের জেনারেশন ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তাদের সামনে দোয়া পড়লেও ভয় পেত, মন্ত্র পড়লেও ভয় পেত। কিন্তু আজকাল আমরাও বিজ্ঞান জানি, এমনকি আজকাল আমাদের মধ্যেও বহু নাস্তিক আছে। তাদেরকে এইসব তদবীর দিয়ে কিছুই করা যাবে না, বুঝলেন?”
“অশরীরী একটা স্বত্তাকে একজন দেখে, কিন্তু অন্যজন দেখে না কেন?”
“ওরাতো আর সত্যি সত্যিই আপনার সামনে আসে না, ওরা আপনার মাথার ভেতরে বসে কাজ করে। এক ধরণের জীবানু আর কি! ছবিটা আপনার মাথার ভেতরে বসে ওরা বানায়। ওরা তো রক্ত-মাংসের কেউ না আসলে।”
মেয়েটা হাসছিল – “আপনি আমার সাথে চুটিয়ে প্রেম করছেন, কিন্তু আপনি আমার অস্তিত্বই স্বীকার করতে চাচ্ছেন না। আশ্চর্য !”
“অশরীরীর সাথে প্রেম কি করে সম্ভব!”
“কেন? বিলকিস পরী তো সোলেমান বাদশাহকে বিয়ে করেছিল, এটা তো ইতিহাসের মতই সত্যি।”
রাফিজ মনে মনে হিসাব করছিল – যতবার এর সাথে দেখা হয়েছে, হয় তার ঠিক আগে সে ঘুমিয়ে ছিল, কিংবা দেখা হবার পর সে জ্ঞান হারিয়েছে।
কি আজগুবি কথা – বেশ কিছুক্ষণ ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করে তারপর সে বলল – “তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি নীপা না, নীপার আত্মা? নীপার আত্মা আত্মহত্যার পর পৃথিবীর বুকে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে, অতীতের বাড়িওয়ালার স্ত্রীকে অশরীরী জীবের হাত থেকে বাঁচাচ্ছে, এমনকি কারো কারো মনে হ্যালুসিনেশান তৈরি করে বেড়াচ্ছে?” – নিজের ব্যাখ্যায় সে নিজেই হেসে উঠল হো হো করে।
“আমি নীপার আত্মা, সেটা কখন বললাম?” – মেয়েটা বলে উঠল – “অতৃপ্ত আত্মা বলে কিছু নেই, আছে শুধু জীন আর পরী।”
“পরী একটি মৃত নারীর পরিচয় নিয়ে কেন আসবে?”
“কারণ ঐ পরিচয়ের মালিক মারা গেছে, তাই নাম-ধামের স্বত্তাধিকারের প্রশ্ন আর নেই।” – সে খুব নিশ্চিত ভংগীতে বলল।
“যাহোক, শেষ প্রমাণটা দেই।” – একটু থেমে সে বলে – “প্লীজ চোখ বন্ধ করুন।”
রাফিজ তাকিয়ে রইল।
“প্লীজ চোখ বন্ধ করেন, একটা মজার জিনিস দেখাই। এটা দেখলে হয়তো আপনি বিশ্বাস করবেন যে, আমি স্রেফ আপনার মস্তিষ্কের একটি কল্পনা নই।”
রাফিজ চোখ বন্ধ করল। কয়েক সেকেন্ড মাত্র, তারপরই আবার কি মনে করে চোখ খুলল।
সে দেখল, নীপার সাজ পাল্টে গেছে – ওর গায়ে একটুও কাপড় নেই।
“আমি তো আপনাকে চোখ খুলতে বলিনি।”
“এটাই কি আপনার সেই প্রমাণ?”
“আপনি তো কখনো নীপাকে এভাবে দেখেননি, তাহলে এটা কিসের স্মৃতি!”
“আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমি একজন সাইকোলজিস্ট। আমি খুব ভালো করেই জানি, এটা কল্পনা করে নেয়া সম্ভব।”
নীপা উঠে এসে সোফায় ওর পাশে বসল – “এত ডিটেইল কি কল্পণা করা সম্ভব?”
রাফিজ উঠে দাঁড়াল – “আপনি আমার কল্পনা, সুতরাং আপনার বোঝার কথা এসবে আমি কনভিন্সড হবার মত লোক নই।”
রাফিজ হঠাৎ অনুভব করল – ওর পাশে কেউ নেই। ঠিক পর মুহূর্তেই আবার সে লক্ষ্য করল, উল্টো পাশের সোফাটায় নীপা বসে আছে – একটা গাঢ় লাল রঙের শাড়ী পরনে। কেন যেন ওকে দেখে মায়া লাগল রাফিজের।
মেয়েটা মাতালের মত হাসছিল।
এবার আমি প্রমাণ করে দিচ্ছি যে আপনি আমার কল্পণা।
রাফিজ খুব তীব্রভাবে চেষ্টা করতে লাগল রুমানার কথা চিন্তা করতে। আশ্চর্য, তখন অবয়বটার চেহারাও পাল্টে যেতে লাগল। আরো আশ্চর্য, একসময় সেটা সত্যি সত্যিই হয়ে গেল রুমানা – যেন রুমানাই দাঁড়িয়ে আছে ওর ঘরে।
রাফিজ হাসছিল – বিজয়ের হাসি।
“আপনার অনেক সাহস।”
রাফিজ তখনো হাসছিল, কিন্তু তার অল্প অল্প মাথা ব্যথা হচ্ছিল।
“আচ্ছা এমনকি হতে পারে না, যদিও এইসব ঘটনা আপনার কল্পনা, কিন্তু এই কল্পনাগুলো আমি তৈরি করে দিচ্ছি?” – মেয়েটা বলল।
রাফিজ কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল – “থিওরেটিকালি এটা সম্ভব।”
এবার মেয়েটার হাসির শব্দ শোনা গেল, নীপার কণ্ঠে। চেহারা রুমানার, কণ্ঠ নীপার। কিন্তু রাফিজের কল্পণাশক্তি এতো প্রবল নয় যে একই সাথে চেহারা আর কণ্ঠ বদলে দেবার চেষ্টা করবে।
“থিওরেটিকালি না, বাস্তবেও এটাই সত্য।” – মেয়েটা বলছিল – “আগেকার লোকরা আমাদের পরী বলত, জ্বিনের স্ত্রীলিংগ। এখন আর আমাদের কোন নাম নেই। কিন্তু যা আছে, তা তো আছেই।”
রাফিজ লক্ষ্য করছিল, তার প্রচন্ড মাথাব্যথা হচ্ছে। তবুও সে জোর করে রুমানার চেহারা মনে করার চেষ্টা করে যেতে থাকল।
“এই যে রুমানার চেহারাটা কল্পণা করে নিতে আপনার চেষ্টা করতে হচ্ছে, কিন্তু নীপার চেহারা দেখছেন কল্পণা ছাড়া। এটাও কি একটা প্রমাণ না যে কোন একটা শক্তি নীপার চেহারা নিয়ে আপনার কাছে আসছে?”
“আমার ব্যাখ্যাটা হল – নীপাকে দেখাচ্ছে আমার অবচেতন মন, কোন অজানা ফ্রয়েডীয় দ্বন্দ্বের কারণে। আর আমার সচেতন মন যুদ্ধ করছে অবচেতনের সাথে। ব্যাখ্যাটা কেমন লাগল?”
রুমানা উঠে দাঁড়াল, তারপর খুব কাছে চলে এল রাফিজের। ঐ মুহূর্তে রাফিজ মাথাব্যথাটা আর নিতে পারলনা, সে হাল ছেড়ে দিল – আর মুহূর্তের মধ্যে রুমানা হয়ে গেল নীপা, তথাকথিত নীপা।
তখন নীপা হাসতে শুরু করল – “বুঝতে পেরেছি, আপনি সহজে আপনার অবস্থান থেকে সরে আসবেন না। তবে ভালো করে চিন্তা করবেন, দেখবেন মনের খুব গভীরে আপনি জানেন আমি সত্য। শুধু শুধু তর্ক করে কি লাভ? চলুন কিছুক্ষণ প্রেম করি, আমি মিলার চেহারা নেব – আপনার মনে হবে, আপনি আপনার বিগত স্ত্রীর সাথে প্রেম করছেন।”
সে মিটিমিটি হাসতেই থাকল।
“মিলার কথা থাক।”
“ওহ, সরি, ওটা তো আবার স্পর্শকাতর ব্যাপার।” – সে হাসতে লাগল শয়তানের মত – “তাহলে রুমানার চেহারা নিই, ওর মত সুন্দর একটা মেয়ের সাথে প্রেম করার অনুভূতিটা কল্পণা করে দেখেন। আচ্ছা, সত্যি করে বলেন তো, ওর সাথে প্রেম করার ইচ্ছা একবারও কি আপনার হয়নি?”
রাফিজ ওর দিকে তাকিয়ে ছিল, সে প্রচন্ড ক্লান্ত বোধ করছিল।
“স্বপ্ন যদি চমৎকার হয়, হোক না সেটা স্বপ্ন, তাই না?”
রাফিজ মাথাব্যথা আর ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেলল। বেশ কিছুক্ষণ সে শুয়ে ছিল এভাবে, লম্বা একটা সময়।
তারপর রাফিজ চোখ খুলে দেখে পুরো রুম ফাকা, কিন্তু কেমন যেন ধোয়াটে একটা আবহাওয়া – বেশ গুমোট হয়ে আছে ঘরটা। আর একটা আতরের গন্ধ যেন আসছে কোথা থেকে।
রাফিজ ডাকল – “নীপা।”
তার নিজের কাছেই এটা পাগলামি মনে হচ্ছিল, তবুও সে ডাকল – “নীপা, আমি জানি আপনি শুনতে পাচ্ছেন।”
“ও, তাই নাকি?” – রাফিজ চমকে উঠল, কে যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলছিল একদম তার ঘাড়ের কাছ থেকে।
“আমি তো আপনার হ্যালুসিনেশান, আপনি চাইলেই আমাকে দেখতে পারেন, তাই না?”
রাফিজ আবার তীব্রভাবে চেষ্টা করতে লাগল রুমানার কথা চিন্তা করতে, তখন অবয়বটা একটা চেহারা পেতে শুরু করল – যেন ঘরের ভেতরের গুমোট সেই ধোয়াটা জমাট বেধে একটা আস্ত মানুষে পরিণত হচ্ছে।
রাফিজ আবারো হাসতে শুরু করল।
“আপনার অনেক সাহস।” – অর্ধেক তৈরি হওয়া অবয়বটা বলল।
তারপরই প্রচন্ড একটা ঝাপটা এসে রাফিজকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে ফেলল দেয়ালটার ওপর। রাফিজ জ্ঞান হারাল।
২৪.
সকালবেলা সামনের উঠোনটায় নজরুল সাহেব আর রুমানা হাটছিল আর গল্প করছিল। নজরুল হাত-পা নেড়ে কিছু একটা বলছিলেন, রুমানা একটু পরপর হেসে উঠছিল। সব মিলিয়ে খুব চমৎকার একটি দৃশ্য।
রাফিজের মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল। দুজন কি নিশ্চিন্ত মনেই না গল্প করছে – সুখী দম্পতির মত! ওদের দেখে কে বলবে, আটচলিশ ঘন্টাও পার হয়নি – ভয়াবহ একটা রাত পার করে এসেছে ওরা।
তবে রাফিজের কেন যেন মনে হল – এই মেয়েটার আর ভয় বিষয়ক কোন সমস্যা হবে না আর কোনদিন।
রাফিজকে দেখে নজরুল হাসিমুখে এগিয়ে এলেন।
“ও তো মনে হয় ভালোই আছে, আপনি তো মিরাকল করে ফেলেছেন।” – রাফিজ এখানে আসার পর প্রথমবারের মত নজরুলের মুখে অন্তরংগ হাসি দেখল। প্রত্যুত্তরে সেও হাসল।
“আর কবীর সাহেব?” – সে জিজ্ঞেস করল।
“ঐ হারামজাদার আমি বারোটা বাজাচ্ছি। ও এই এলাকায় কিভাবে থাকে আমি দেখে নিব। ওরে যদি আমি রাস্তার মধ্যে ন্যাংটা করে না পিটিয়েছি, তাহলে আমার নাম নজরুল না। আমরা করি ঠিকাদারী ব্যবসা, দুনিয়ার মানুষ আমাদের ভয় পায়, জীন-ভূত তো কোন ছাড়!”
বলে নজরুল হো হো করে হাসতে লাগলেন।
বহুদিন পর একজন মানুষকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখে রাফিজের সত্যিই খুব ভালো লাগলো।
আজ সকালে রাফিজ ফোন করেছিল তার মামাকে, তার মামা নিশ্চিত করেছেন – সে আসলেও উল্টোভাবে জন্মেছিল। এই তথ্যটা তার মস্তিষ্ক কিভাবে জানলো, সে ভাবতে লাগলো।
আরো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে – যেমন, সে বারবার একই মেয়েকে কেন ভুল কল্পণার মধ্যে দেখবে, এটার ব্যাখ্যা সে বের করতে পারছে না। হ্যালুসিনেশানে একেকবার একেকটি ভুল দেখার ঘটনা ঘটবে, কিন্তু একই ভুল ধারাবাহিকভাবে বার বার দেখার কেস সে মনে করতে পারল না।
সব মিলিয়ে রাফিজের কেন যেন মনে হল – তার নিজের সামনে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ একটা দুঃসময়। ঝড়ের আগে যেমন চারদিক হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়, রাফিজও যেন তার নিজের আত্মার ভেতর এরকম অস্বাভাবিক একটা শান্ত ভাব লক্ষ্য করছিল।
সে কিভাবে যেন জানে, তার অতীতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলো আবার ফিরে আসতে যাচ্ছে, সে সম্ভবত: আবার ফিরে যাচ্ছে এক বিচিত্র জগতে – সেটা স্কিজোফ্রেনিয়া হোক বা না হোক। এখানে নীপা নামের একটি অনুষংগও যোগ হচ্ছে – একটা অমীমাংসিত রহস্য হয়ে।
অবশ্য সে আর আগের মত এসব নিয়ে ভীত নয় – সে এখন নিজের জন্য অন্য একটা জগত তৈরি করে নিয়েছে, এমন একটা জগৎ যেখানে জীবন আর মৃত্যু স্মৃতির মত। সুতরাং সম্ভাব্য সেই দু:স্বপ্নের প্রহরকে সে মনের একেবারে ভেতর থেকে একরকম স্বাগতই জানাল।
