সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। এক মেঘলা সন্ধ্যা। অফিস আর বাসা দুই জায়গা থেকেই একসাথে পলাতক হয়ে আমরা কয়েকজন প্রৌঢ় এসে হাজির হয়েছিলাম আমাদের সবার অভিভাবক মার্গুব ভাইয়ের বাসায়। কিন্তু সন্ধ্যা হতে না হতেই শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। আটকা পড়ে গেলাম আমরা পাঁচজন শান্তিনগরের পুরোনো ধাঁচের এক বিল্ডিঙের প্রায়ান্ধকার একটা একতলায়। বড়ো বড়ো ফোটায় যেভাবে মুষলধারে বর্ষণ হচ্ছে, আজ সন্ধ্যায় গলিতে হাটু পানি জমবে নিশ্চিত। আজ রাতে নৌকা ছাড়া শান্তিনগর থেকে মালিবাগ মোড় পর্যন্ত যাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
আমরা কয়জন অবশ্য সেটা নিয়ে তেমন চিন্তিত ছিলাম না। আমাদের কারো কোন কাজ নেই। আমাদের যে বয়স, তাতে বাসায় যাবার তাড়া নেই। রাতে বাসায় না ফিরলেও বাসা থেকে কেউ খবর নিবে বলে মনে হয় না। তবে আজ কারেন্টও চলে গেছে সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে, দুই সাইড টেবিলে দুইটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আধো-অন্ধকারে বসে আছি আমরা প্রৌঢ় কয়েকজন অকর্মা।
বৃষ্টির শীতল দৃষ্টি উপেক্ষা করে আর যারা এসেছে আজ তাদের মধ্যে পারভেজ, আসাদ, নজরুল ভাই ছাড়াও এসেছে অচেনা নতুন এক ভদ্রলোক – আসাদের সাথে এসেছে, মনে হয় তার ভায়রা ভাই।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার বছর হিসাব করলে পারভেজ আমার বছর পাঁচেকের ছোট। আসাদও আমার জুনিয়ার। নজরুল ভাই দু’এক বছর সিনিয়ার হবে।
আসাদের আত্মীয় এই ভদ্রলোক আগে কখনো আমাদের আড্ডায় আসে নি, তাই বার বার আমার চোখ চলে যাচ্ছিলো তার দিকে। তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না, যেহেতু তার মুখ ঢাকা ছিল আকাশি রঙের বহুবার ব্যবহৃত একটা মাস্ক দিয়ে। কিন্তু তার চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছিলো, চোখের কারণেই সম্ভবত তাকে এতো চেনা চেনা লাগছিলো আমার।
বাসায় ঢুকে আসাদ তার পরিচয় দিয়েছিলো – উনি মিলিটারিতে ছিলেন, গত বছর স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন। তার মানে তার বয়স ষাটের কাছাকাছি। আমি লোকটাকে লক্ষ্য করতে লাগলাম। বেশ ভারী তার শরীর, চেয়ারে বসেছেন কষ্ট করে। এই লোক যে আর্মিতে ছিল, তার একমাত্র লক্ষণ সম্ভবত তার দৈর্ঘ্য – ভদ্রলোক কমপক্ষে ছয় ফুট লম্বা, আমার মনে হলো। সুতির একটা সাদা হাফশার্ট পড়েছেন, চুল আর্মি কাট, ঘরের এক কোনায় আধো-অন্ধকারে বসে ক্রমাগত ঘামছেন।
আজকে আমাদের পরিকল্পনা ছিল ভুতের গল্প বলা, যেহেতু বৃষ্টি হচ্ছে। আর একটু আগে কারেন্ট চলে গিয়ে কেমন যেন একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে, আজ বরঞ্চ আমরা ব্যতিক্রমী কোন কাজ করবো, স্বপ্ন নিয়ে কথা বলবো।
ভাবি, অর্থাৎ মারগুব ভাইয়ের স্ত্রী, যখন সর্ষে তেল দিয়ে মাখানো এক বাটি চানাচুর মুড়ি আর ছয় কাপ দুধ-চা পাঠিয়ে দিলেন, তখন গল্পের বৈঠকে একটু বিজ্ঞাপন-বিরতি পড়লেও আজকের টপিকটা কেউ ভুলে গেলো না। বোঝাই যাচ্ছে, স্বপ্ন নিয়ে সবারই বলার কিছু না কিছু আছে।
প্রথম কাহিনীটা বললাম আমিই – চরম উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করলাম আমার অত্যাশ্চর্য সেই স্বপ্নটার কথা।
***
“মাস তিনেক আগের কথা, ভাইয়েরা। সেদিন ছিল শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। রোকসানা খিচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না করেছিল, উইকএন্ডের বিনোদন আরকি! দুপুরে পেট ভরে খেয়ে অন্য সব বয়স্ক লোকদের মতোই ভালো একটা ভাতঘুম দিয়েছি। প্ল্যান ছিল, সাড়ে পাঁচটার দিকে উঠে আসরের নামাজ পড়বো, মসজিদে আর যাবো না। কিন্তু শরীর ছিল দুর্বল, সারা সপ্তাহের ঘুম মনে হয় একসাথে চেপে বসেছিল চোখে। ছয়টা পর্যন্ত ঘুমিয়েও ঘুমের স্বাদ মিটছিলো না, চোখ খুলে টেবিল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বার বার আবার ঘুমিয়ে পড়ছিলাম।
শেষে সোয়া ছয়টার দিকে মনে হলো – নাহ, এবার উঠে পড়তেই হয়, এখন না উঠলে তো নামাজ কাজা হয়ে যাবে। চোখ খুলে তাকালাম, মনে হলো ঘরে আলো একটু কম মনে হচ্ছে। প্রথমে ব্যাপারটা পাত্তা দিলাম না। কিন্তু আতঙ্ক আমাকে ঘিরে ধরলো, যখন বুঝতে পারলাম আমি বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। মনে হচ্ছে কেউ বিছানার সাথে আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে আমাকে। একটা মাংসপেশীও নাড়াতে পারছিলাম না।
চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার কি তাহলে অতর্কিতে প্যারালাইসিস জাতীয় কিছু হয়ে গেল? আল্লাহ মাফ করুক। মনে পড়লো, আমার বয়স পঞ্চান্ন হয়ে গেছে, এই বয়সে ব্রেন স্ট্রোক করা খুব খুবই সম্ভব। প্রচন্ড ভয়ে চিৎকার করে উঠতে চাইলাম, কিন্তু গলা থেকে কোন স্বর বের হলো না – ফলে আমার আতংক দ্বিগুন থেকে বেড়ে মুহূর্তের মধ্যে তিনগুন হয়ে গেলো।
ওই মুহূর্তে হঠাৎ বেডরুমের দরজাটা আস্তে করে খুলে গেলো। মনে মনে আশা করলাম, হয়তো রোকসানা কোন কাজে ঘরে এসেছে। মোবাইল খুঁজতে, বা কিছু একটা। কিন্তু না, ঘরে ঢুকল এক এক ভদ্রলোক, বয়স্ক মানুষ। ভালো করে তার চেহারার দিকে তাকালাম, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না একে চিনি কিনা। এমনকি তাকে চেনা চেনা বলেও মনে হলো না। ভাবলাম, এ কে? কি করছে সে আমার বেডরুমে? রোকসানাই বা কোথায়? এসব যখন ভাবছি, উনি তখন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। সে হাসির কারণেই কিনা জানি না, তাকে শত্রুপক্ষের কেউ বলে মনে হলো না।
আমার সমস্ত শরীর অকেজো হয়ে গেলেও চোখ ঘুরাতে পারছিলাম, যদিও এতে আমার নিজেকে অসহায় লাগা কিছুমাত্র কমছিল না। ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তাকে মনে হচ্ছিলো প্রায় ছয় ফুট লম্বা। মাথায় চুল কম, ক্লিন সেভ। যে কেউ তাকে দেখলে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর লোক ভাববে।
লোকটা আমার পাশে এসে বসলো, আমার হাতও ধরলো, কিন্তু আশ্চর্য – আমি কিছু অনুভব করলাম না। উনি হেসে বললেন – ‘উঠে বসুন, মঈন সাহেব।‘ কিন্তু আমি বলতে পারলাম না যে, আমার প্যারালাইসিস হয়েছে। ‘ঘুম থেকে উঠেন, মঈন সাহেব, নামাজের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে তো।‘ – বলে তিনি আমার হাত ধরে জোরে টান দিলেন, আর ঠিক তখন আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো।
ঘুম ভেঙে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, পশ্চিমে ঢলে পড়া সূর্যের কমলা আলোয় সারা ঘর কেমন বিষন্ন একাকী হয়ে আছে। হাত নাড়তে পারছিলাম দেখে ডান হাত দিয়ে বা-দিকের বাহুতে চিমটি কেটে দেখলাম জেগে আছি কিনা।
সেদিন কোনমতে তাড়াহুড়া করে সূর্যাস্তের আগে আসরের নামাজ পড়তে পেরেছিলাম। কিন্তু ওই দিনের পর থেকে কেন যেন সারাক্ষন মনটা খারাপ হয়ে থাকে। অকারণেই মনে হতে থাকে, এই পৃথিবীটাতে কোথাও কোন সমস্যা আছে – ওপর দিয়ে মনে হবে, সব ঠিক আছে, জীবনও ঠিকমতোই চলছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কোথায় যেন একটা অস্বস্তি, কোথায় যেন বড় কিছু একটা নেই।“
“এটাকে মনে হয় স্লিপ প্যারালাইসিস বলে।” – নজরুল ভাই মন্তব্য করলেন – “কিন্তু এটা কোন ব্যাপার না। তুমি অতিরিক্ত টায়ার্ড ছিলে, তোমার মনের একটা অংশ চাচ্ছিলো ঘুমাতে, অন্য অংশ নামাজের ওয়াক্ত নিয়ে টেনশনে ছিল, দুই মিলে এরকম দেখেছো।”
”না রে ভাই”, – আমি বললাম – “ওই স্বপ্নের পর থেকে আমার জীবনটা কেমন যেন ভেজিটেবল হয়ে গেছে। বিশেষ করে ওই দিনের পর থেকেই আমি কোন খাওয়াতে স্বাদ পাচ্ছি না। ধরেন, ভোরবেলা দোকান থেকে পারাটা, ডিমভাজি, আর সুজি নিয়ে খেতে বসলাম – ওমলেট লাগতে শুরু করলো এ-ফোর সাইজের কাগজের মতো, সেই তুলনায় পারাটাকে মনে হতে লাগলো নিউজপ্রিন্ট – ছোটবেলায় টাকা বাঁচানোর জন্য যেগুলিতে আমরা অংক প্রাকটিস করতাম, আর সুজিগুলি যেন একদলা মাটি। অথচ আপনাদের ভাবীর দিকে তাকিয়ে দেখি, সে গোগ্রাসে খেয়ে চলেছে – জীবনে কোনোদিন নাস্তা খায় নি এমন করে। আমাদের মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে আসে রশিদ ডাক্তার, তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এ বিষয়ে। উনি আমাকে পাত্তাই দিলেন না, বললেন – কারো কারো সেন্সরি পারসেপশন দুর্বল থাকে, এটা কোন ব্যাপার না।”
আমার কথা সবাই মন দিয়ে শুনলো। সবাইকে অত্যন্ত গম্ভীর মনে হলো। ফলে বুঝতে পারলাম না, তারা আমার সাথে একমত নাকি দ্বিমত।
***
কিছুক্ষন পর ঘরের ভেতর অস্বস্তির ভাবটা একটু কেটে যেতেই পারভেজ বলে উঠলো – “মঈন ভাই, আপনি তো স্বপ্নের মধ্যে আটকে পড়েছিলেন, আর সেটা থেকে বের হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আর আমি এমন একটা স্বপ্ন দেখেছি, যেই স্বপ্নের ভেতর থেকে যাওয়ার জন্য আমি মরিয়া হয়েছিলাম, কিন্তু থাকতে পারলাম না। আমি চাইছিলাম না যে স্বপ্নটা ভেঙে যায়, কিন্তু সেটা ভাঙলোই, আর আমাকেও বাস্তব জীবনে ফিরে আসতে হলো।“
কারো অনুমতির অপেক্ষা না করেই পারভেজ বলতে শুরু করলো তার কাহিনী।
“আপনাদের তো একদিন বলেছিলাম আমার বস নিরু আহমেদের কথা। আপনারা সেই থেকে আমাকে কত কথা শোনালেন। কিন্তু সত্য তো এই যে, সবাই মনে মনে মন-কলা খায়, দোষ হয় শুধু পারভেজের মতো লোকদের, যাদের কিনা নিজের দুর্বলতা স্বীকার করার মতো সৎসাহস আছে। হ্যাঁ, নিরু ম্যাডামকে আমার ভালো লাগে। তার মতো ডাকসাইটে সুন্দরী মহিলাকে দেখলে যে কারো ভালো লাগবে, তার সাথে আছে তার ব্যক্তিত্ব আর স্নেহ। সে তার টিমকে এমনভাবে আগলে রাখে, যেভাবে বড়বোন আগলে রাখে অপরিণত ছোট ছোট ভাই-বোনগুলিকে। তার সাথে আমার মনের মিল হয়, রুচির মিল হয়, এমনকি সেও আমার মতো ফিল কলিন্সের ব্যালাড পছন্দ করে। তাহলে তাকে আমার ভালো লাগতে বাধা কোথায়? আমি তো আর তার সাথে ইঁদুর-বিড়াল ধরণের প্রেম করতে যাচ্ছি না, এটা নিছকই এক আত্মার সাথে আরেক আত্মার প্লেটোনিক একটা আবেগ।”
“ঘটনা তাহলে প্লেটোনিক পর্যন্ত চলে গেছে?” – খোঁচা দিয়ে বললাম আমি।
“এই যে, শুরু হয়ে গেছে আপনাদের ট্রল। মঈন ভাই, আপনার মতো আমি সবকিছুতে ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যা নিয়ে আসি না। আপনার কাছে তো ভালোবাসা মানেই বিছানার হাতছানি, কিন্তু শরীর দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায় না, কারণ মানুষ শুধু শরীর দিয়ে তৈরী না, তার একটা আত্মাও আছে। শুনেছি ইউরোপের কোন বিজ্ঞানী আত্মার ওজনও বের করেছে, যদিও সেই ওজন খুব অল্প পাওয়া গিয়েছিলো।”
“আরে ভাই, তুমি তো দেখি ধান ভাঙতে গিয়ে শিবের গীত গাইতে শুরু করেছো। আমরা কথা বলছি স্বপ্ন নিয়ে, তুমি চলে গেলে তোমার দিবাস্বপ্নে। ‘১ এর খ’ প্রশ্নের নিচে তুমি লিখতে শুরু করেছো ‘২ এর ক’ এর উত্তর। এ কেমন কথা?” – আমার কথা শুনে মার্গুব ভাই আর আসাদ হো হো করে হেসে উঠলো। নজরুল ভাইই শুধু মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।
“মঈন ভাই, আপনি লোকটা আসলেও সুবিধার না। সবকিছুতে নেগেটিভ চিন্তাধারা আপনার। আমি ‘১ এর খ’ এর উত্তরই লিখছি। মেট্রিক পাশ করার সাথে সাথে আপনি বোধ হয় ভুলে গেছেন, ভূমিকা বলে একটা বিভাগ থাকে ভালো উত্তরের সাথে। যা হোক, যেটা বলছিলাম। এক দিনের কথা। অফিস থেকে বাসায় ফিরলাম কিছুটা মন খারাপ করে। সেদিন আমার মাথাটা একটু বেশিই গরম হয়ে গিয়েছিলো। ভাবছিলাম, নিরু ম্যাডামের সাথে আমার যদি বিশ বছর আগে দেখা হতো, আমি নিশ্চয়ই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারতাম। উনি আমার মাত্র এক বছরের বড়, বাস্তবে এটা কোন ব্যাপারই না।
মঈন ভাই, এভাবে আমার দিকে তাকাবেন না। আমি এখনো আগেকার দিনের লোকেদের মতো স্বামী-স্ত্রীর আধ্যাত্মিক প্রেমে বিশ্বাস করি, সুতরাং আপনার থিওরি এখানে খাটবে না। যাই হোক, সন্ধ্যার পর কিছু খেতে ইচ্ছে হলো না, এক গ্লাস দুধ খেয়ে চোখে ঘুম নেমে এলো। একটু আগে আগেই শুয়ে পড়লাম। আপনাদের ভাবি নিশ্চিত মনে ড্রইং রুমে ওপার বাংলার সোপ অপেরা দেখতে বসলো। সে রাতে স্বপ্নে নিরু ম্যাডামকে দেখলাম।
আপনারা বলবেন, স্বপ্নে একটা মেয়েকে দেখা – এ আর এমন কি। কিন্তু বিশ্বাস করেন, এই স্বপ্নটা ছিল অসম্ভব রকমের বাস্তব। এর প্রতিটা দৃশ্য ছিল বিস্তারিত, পুঙ্খানুপুঙ্খ। এমনকি লেকের পানির ওপর সূর্যের আলো পরে যে চিক চিক করে ওঠে, সেটাও আমি স্বপ্নের ভেতর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। লেকের ধারে উনি আর আমি হাটছিলাম, কিছুটা দূরত্ব রেখে, কিন্তু আমি উনার পুরো উপস্থিতিটা ভীষণ ভীষণ রকম কাছে থেকে অনুভব করছিলাম। তখনি ঘটলো অদ্ভুত এক ঘটনা, ম্যাডাম হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমি তার দিকে তাকালাম, বাতাসে তার চুলগুলো উড়ছিল, সেটা দেখতে পাচ্ছিলাম। উনি বললেন – ‘পারভেজ, যদি বলি এটা একটা স্বপ্ন?’
আমি চমকে উঠলাম। তার কথা শুনে আমারও কেমন যেন সন্দেহ হলো। তাড়াতাড়ি নিজের হাতে চিমটি কাটলাম, কোনোকিছু অনুভব করলাম না। আবার চিমটি দিলাম, এবার আরো জোরে, কোন ব্যথা অনুভব করলাম না। অবাক হয়ে বলে উঠলাম – ‘হ্যা, ম্যাডাম, আপনি তো ঠিকই বলেছেন।‘ উনি মিটিমিটি হাসতে লাগলেন, তার ঠোঁট আর মুখের প্রত্যেকটা পেশি আর তার নড়াচড়া আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম।
অবাক হয়ে বলে উঠলাম, মানে স্বপ্নের মধ্যেই বললাম – ‘ম্যাডাম, এটা যদি স্বপ্ন হয়, তাহলে তো আমরা অনেক কিছু করতে পারি, যেটা সত্যি সত্যি আমরা করতে পারি না।‘ উত্তরে উনি কিছু বললেন না, প্রসন্ন হাসি হাসলেন। কিন্তু আমি সিরিয়াস, বলে বসলাম – ‘আমি কি আপনার হাত ধরতে পারি? একবার, মাত্র একবার?’
উনি হেসে ফেললেন – ‘অবশ্যই পারো। কিন্তু পারভেজ, এটাতো স্বপ্ন, এখানে কোন স্পর্শের অনুভূতি নেই।‘
‘তবু’ – বলে আমি তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার ডানহাতটা আমার দুহাত দিয়ে পাকড়ে ফেললাম। বিশ্বাস করবেন না, অদ্ভুত একটা অনুভূতি ছিল সেটা, কারণ আমি আমার দুহাতের মধ্যে তার হাতের স্পর্শ অনুভব করছিলাম না, কিন্তু আমার মনের ভেতর এমন একটা আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছিলো যেটা জীবনে কোনোদিন আমার হয় নি।
মনে মনে খোদাকে বলছিলাম, আমার ঘুম যেন ভেঙে না যায়। কিন্তু তিনি মৃদুস্বরে বললেন – ‘পারভেজ, আমার হাত ধরে বোধ হয় তুমি ভুল করেছো। এই মুহূর্তে তোমার যে অনুভূতি হচ্ছে, সেটা এক আত্মার আরেক আত্মাকে স্পর্শ করার অনুভূতি। তোমার ট্রেনিং নেই এই অনুভূতি বেশিক্ষন সহ্য করার। এই স্বপ্ন আরো লম্বা করতে চাইলে আমার হাত ছাড়ো, প্লিজ।‘
কিন্তু আমার কিছু একটা হয়েছিল, আমি আরো শক্ত করে তার হাত ধরতে চাইলাম আমার মুঠোর মধ্যে। আর তখনি আমার ঘুমটা ভেঙে গেল।”
পারভেজ চুপ করল। তার চেহারা দেখে আমার মায়াই লাগলো – এত করুন দেখাচ্ছিল তার দৃষ্টি, যেন এইমাত্র বিবাহবিচ্ছেদের উকিল নোটিশ পেয়েছে। আমি স্বভাববশতঃ তাকে আরেকটা খোঁচা দিতে যাচ্ছিলাম, অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলাম। শুধু বিড় বিড় করে উচ্চারণ করলাম – “উইশফুল থিংকিং।” যদিও পারভেজ সেটা শুনে ফেললো।
“আপনারা যে যাই বলেন,” – পারভেজ উপসংহার টানছিলো যেন – “আমি বিশ্বাস করি, ওটা স্বপ্ন ছিল, আবার বাস্তবও ছিল। কিভাবে? আমার মনে হয়, স্বপ্নের ভেতর শরীর থেকে আত্মারা বের হয়ে আসে। বলে রাখা ভালো, আমাদের ধর্মও কিন্তু এরকম একটা ন্যারেটিভ দেয়। সব মিলিয়ে আমার ধারণা, সে রাতে এরকমভাবেই আমাদের দুজনের আত্মার দেখা হয়ে গিয়েছিলো পঞ্চমমাত্রার কোন এক পৃথিবীর চতুর্মাত্রিক কোন এক লেকের পাশে। পরদিন উনার সাথে যখন অফিসে দেখা হলো আর আমি ‘শুভসকাল’ বললাম, উত্তরে উনি ‘শুভসকাল’ না বলে এমন রহস্য করে হাসলেন, যেটা দেখে আমি আরো নিশ্চিত হলাম উনিও একই স্বপ্ন দেখেছেন আগের রাতে।”
“তুমি উনাকে জিজ্ঞেস করো নি কিছু?”
“আরে মঈন ভাই। আপনি যে কি বলেন? এসব সেনসিটিভ জিনিস কি অফিসে আলাপ করা যায়?”
“তাহলে কিভাবে এত নিশ্চিত হলে উনিও একই স্বপ্ন দেখেছেন?”
“শোনেন। প্রত্যেক সকালে উনাকে ‘শুভসকাল’ বললে উত্তরে উনিও ‘শুভসকাল’ বলেন। গত চার বছরে কোনোদিন এর ব্যতিক্রম হয় নি, শুধু ওই সকাল ছাড়া। এটাই কি যথেষ্ট প্রমান না যে উনিও – মানে উনার আত্মাও – ওই একই স্বপ্নে ছিলেন?”
বেশ কয়েকজোড়া চোখ হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকালো। আমরা বুঝতে চেষ্টা করছিলাম, সে ঠাট্টা করছে কিনা।
***
“লুসিড ড্রিম।” – ঘরের অন্ধকার কোন থেকে কেউ কথা বলে উঠলো। সবার চোখ ঘুরে গেলো সেইদিকে। আসাদের ভায়রা। কি যেন নাম তার, সেই ভায়রা ভাই।
“পারভেজ ভাই যে স্বপ্নের কথা বললেন, মনে হচ্ছে এটা ছিল একটা লুসিড ড্রিম। বাই দ্য ওয়ে, আপনারা কি কেউ লুসিড ড্রীমের কথা শুনেছেন?”
“লুসিড ড্রিম?” – কোথায় যেন শুনেছি বলে মনে হচ্ছিলো আমার।
“হ্যাঁ, লুসিড ড্রিম। এটা হলো এমন একটা স্বপ্ন, যা আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। মানে, স্বপ্নের মধ্যেই আপনি বুঝতে পারছেন যে এটা একটা স্বপ্ন, আর তখন আপনি এমন জায়গায় যেতে চেষ্টা করলেন যেখানে আপনি যেতে চান, এমন একটা অপরাধ করতে চাইলেন যেটা অনেকদিন থেকে মনে মনে আপনার করার ইচ্ছা। যাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ বেশি, তারা এমনকি স্বপ্নের পরিবেশ আর ঘটনাপ্রবাহও বদলে দিতে পারে।”
“কি বলছেন? এও কি সম্ভব?” – চমকে উঠে আমি বললাম। “যদি আপত্তি না থাকে, প্লিজ শেয়ার করতে পারেন আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে।” – যোগ করলাম।
ভদ্রলোক নড়ে-চড়ে বসলেন, মাস্কটা একটু নামালেন, কিন্তু পুরো খুলে ফেললেন না। আমি কিছুটা অবাক হলাম, কেননা মানুষ কথা বলার সময় আর খাবার সময় অন্তত মাস্ক সরিয়ে ফেলে।
“বছর চারেক আগে আমার বড় মেয়েটা মারা যায়।”
“থাক না, এসব কথা, ভাইয়া।” – আসাদ বাধা দিলো। সে তার চেয়ারে শিরদাঁড়া সোজা করে বসেছে।
“থাকবে কেন? যা হয়েছে, আজ না হলে কাল তা তো আমাদের মেনে নিতেই হবে, তাই না?”
আসাদ মনে হয় হাল ছেড়ে দিলো, সে আবার তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। ভায়রা ভাই শুরু করলেন তার স্বপ্ন কাহিনী।
“রুদাবা নিজে ছিল ডাক্তার।” – ভদ্রলোক বলে চললেন – “তার ড্রপ বিট হতো, কিন্তু খুব একটা পাত্তা দেয় নি। জিজ্ঞেস করলে বলতো, এগুলো ঠিক হয়ে যায়। বাঙ্গালোরে একটা সেমিনারে গিয়ে ফেইন্টও হয়ে গিয়েছিলো, তারপরও সাবধান হলো না। যেদিন মারা যায়, সেদিন রোজার দিন ছিল। সে রোজাও রেখেছিলো। রোজা রেখেই হাসপাতালে গেলো ডিউটি দিতে। দুপুরে ব্রেকের সময় বললো, বুকে পেইন হচ্ছে। ওর কলিগরা সাথে সাথে তাকে আইসিইউতে নিলো, কিন্তু নিতে নিতেই শেষ। মাত্র ছাব্বিশ বছর হয়েছিল বয়স, বেঁচে থাকলে এখন ত্রিশ হতো।
রুদাবা মারা যাওয়ার পর আমি বেশ ভেঙে পড়েছিলাম। কিছুতেই মানতে পারছিলাম না, সে নিজে ডাক্তার হয়ে, হাসপাতালে বসে থেকে, নিজেকে বাঁচাতে পারলো না। এটা কেমন কথা! আমার দিন-রাত সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো, রাতে জেগে থাকি, দিনে ঘুমাই, সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙলে মনে হয় কেন ঘুম থেকে উঠলাম। এরকমই এক সন্ধ্যায় ঘুম থেকে জেগে আবার চোখ বন্ধ করেছি, আবার ঘুমের ভেতর পালিয়ে যাওয়ার জন্য। তখনই একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। দেখি আমার বিছানার পাশে মেয়েটা এসে বসে আছে। সে হাসছে।
আমি তার দিকে তাকাতেই সে বললো – ‘বাবা, তুমি মাঝে মাঝে কি যে সব পাগলামি করো! এই পৃথিবী তো একটা স্বপ্ন ছাড়া কিছু না। তুমি আছো এক স্বপ্নে, আমি আরেকটাতে, এই যা তফাৎ।’ আমি তাকে ছুতে গেলাম, কিন্তু তখন আবার আমার ঘুম ভেঙে গেলো। কিন্তু ঘরের মধ্যে ক্রিম টোয়েন্টি ওয়ানের কমলালেবু ধরণের একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম। বেঁচে থাকতে ক্রিম টোয়েন্টি ওয়ান ছিল রুদাবার সবচেয়ে পছন্দের প্রসাধন।
আমি আমার ছোটবেলার এক বন্ধুর সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বললাম। সে ডাক্তার, কিন্তু ধর্ম-কর্ম করে। সে বললো, মৃতদের আত্মা নাকি স্বপ্নে জীবিতদের সাথে দেখা করতে ও কথা বলতে আসতে পারে, মানে খোদার অনুমতি পেলে। সে আরো বললো, ঘুমের মধ্যে আমরাও একধরণের মৃতই হয়ে যাই, সাময়িকভাবে আর কি। সুতরাং দুইয়ে মিলে এটা অসম্ভব না যে ঘুমন্ত মানুষ স্বপ্নে মৃতদের পৃথিবীতে চলে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করতে পারে।
সেই দিনের পর আমার মধ্যে জীবন সম্পর্কে কেমন যেন একটা উৎসাহ ফিরে এলো। আমি স্বপ্ন নিয়ে গবেষণা করা শুরু করলাম। এখন তো ইন্টারনেটের যুগ, ঠিকমতো ঘেটে-ঘুটে লেখা-পড়া করতে পারলে ইন্টারনেটে যা তথ্য আছে তা দিয়ে আপনারা একটা রকেট পর্যন্ত বানিয়ে ফেলতে পারবেন। তো সেই সময়েই আমি লুসিড ড্রিমিং সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। এও জানতে পারি যে কিছু নিয়ম মেনে প্রাকটিস করলে যে কোন বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে লুসিড ড্রিম চর্চা করা সম্ভব, মানে নিজের স্বপ্ন নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা সম্ভব।
বিষয়টা খুব একটা কঠিন কিছু না কিন্তু। কোন সম্মোহন-টম্মোহন করতে হয় না। শুধু নিয়ম করে নিজের স্বপ্নগুলো একটা ডাইরিতে লিখে ফেলতে হয়, ডিটেল সহ লিখতে হয়, তারপর ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওগুলো একবার করে মন দিয়ে পড়তে হয়। টানা একমাস এরকম করতে পারলে একসময় নিজের স্বপ্নগুলো নিজের মনে পড়তে শুরু করে, স্বপ্ন আর বাস্তবের তফাৎ করা তখন সহজ হয়ে যায়। এ পর্যায়ে মানুষ বুঝতে পারে সে স্বপ্ন দেখছে, আর বুঝতে পারলে সে ধীরে ধীরে স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণও করতে পারে।”
বলে ভদ্রলোক একবার নিশ্বাস নিলেন।
“আপনি কি এখন স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে ফেলেছেন?” – বরাবরের মতো আমিই প্রশ্ন করলাম আমাদের বিশেষায়িত আড্ডার পক্ষ থেকে।
“হ্যাঁ, পারি।” – উনি মাথা নেড়ে বললেন।
“আপনি আপনার বড় মেয়েকে আর কখনো স্বপ্নে দেখেছেন?” – আমি নিজের আগ্রহ লুকাতে ব্যর্থ হয়ে বললাম – “নিশ্চয়ই দেখেছেন। আর সেক্ষেত্রে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন সেই স্বপ্ন? আটকে ফেলতে পারেন নি আপনার মেয়ের স্মৃতিকে আপনার স্বপ্নের মধ্যে?”
আমার আবেগতাড়িত কথা শুনেই হয়তো উনি হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতেই বললেন – “অবশ্যই দেখা হয়েছে। কিন্তু ওকে তো ফেরাতে পারবো না, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমিই বরং থেকে যাবো ওই স্বপ্নের ভেতর। রুদাবাও বললো সে আমাকে সাহায্য করবে। মেয়েটা আসলে আমার দুরবস্থা সহ্য করতে পারছিলো না। সেই আমাকে আশ্বাস দিলো, ওর দুনিয়ায় – মানে যেখানে স্বপ্নের মাধ্যমে আমি মাঝে-মধ্যে যেতে পারতাম – সেখানে ওই স্বপ্নের ভেতর আমাকে থেকে যেতে সাহায্য করবে। হলোও তাই। বৃহস্পতিবার বিকেলে আমি স্বপ্নটা দেখতে শুরু করলাম, তারপর সেটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকলো।”
“তারপর?” – আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো – “তারপর আপনি জেগে উঠলেন কিভাবে?”
“কে বলেছে, আমি জেগে উঠেছি?” – অদ্ভুতভাবে হাসলেন ভদ্রলোক। তার চোখ দেখে মনে হলো, স্বয়ং শয়তান হাসছে ওই দু’চোখের আড়াল থেকে।
“মানে?” – বোকার মতো হেসে বললেন মারগুব ভাই।
“মানে খুব সহজ। আমি যে স্বপ্নে আটকে পড়েছি, সেই স্বপ্নে আপনারাও আটকে পড়েছেন। তফাৎ শুধু একটাই, আমি বুঝতে পারছি যে আমি স্বপ্ন দেখছি, আর আপনাদের কেউ সেটা বুঝতে পারছেন না।”
তার কথা শুনে সবাই কিছুক্ষন চুপ – প্রত্যেকে কি যেন ভাবছে মনে মনে – তারপর হঠাৎই আবার হো হো করে হেসে উঠলাম আমরা সবাই। ভদ্রলোককে নিরস মনে হলে কি হবে, তার ডার্ক হিউমার চমৎকার – না ভেবে পারলাম না।
“আমাদের এই সম্মিলিত স্বপ্ন থেকে জেগে উঠবো কবে আমরা?” – মজা করে প্রশ্ন করলো পারভেজ।
“কোন এক বিকেলে, বা কোন এক সকালে, অথবা রাত্রে, বা দুপুরে – হঠাৎ করে দেখবেন, কেউ আপনার নাম ধরে ডাকছে, আকাশের ওপর থেকে। আপনি জেগে উঠে দেখবেন, আপনি কেয়ামতের বিশাল একটা মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন, গনগনে সূর্য আপনার মাথায় অনেক তাপ দিচ্ছে।”
তার তুলনাটা চমৎকার হয়েছে বলে আমি হাত তালি দিয়ে উঠলাম, কিন্তু আর কেউ আমার সাথে যোগ দিলো না। ফলে মোমবাতির অস্পষ্ট আলোর সেই ঘরে সব মিলিয়ে আমার তালিটা বড্ডো বেসুরো শোনালো।
“আমার যেতে হবে, ভাই। ওষুধের সময় হয়ে গেছে।” – শাহাদাত নামের সেই রহস্যপুরুষ আচমকা উঠে দাঁড়ালেন, যেন এ পৃথিবীতে তার মিশন শেষ হয়েছে, এখন ফিরে যাবেন নিজস্ব নীড়ে।
“কিন্তু বাইরে যে বৃষ্টি হচ্ছে, ভাইয়া।” – তার ভায়রা-ভাই আসাদ হাহাকার করে উঠলো।
“বৃষ্টিতে আমার কিছু হবে না, তুমি সেটা ভালো করেই জানো।” – বলে রহস্যময় হাসি হেসে উঠলো তার চোখ দুটো। এখনো তার মুখে রং-চটা মাস্ক, ফলে তার ঠোঁটে ঝিলিক দিয়ে যাওয়া হাসি দেখার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য হলোনা আমাদের কারো। উনি উঠে হন হন করে হাঁটা শুরু করলেন, ভায়রা আসাদ অপ্রস্তুতভাবে একবার উনার দিকে আরেকবার আমাদের দিকে তাকালো।
আমাদের বিস্মিত চোখগুলোর সামনে থেকে উনি হাওয়া হয়ে যাওয়ার পর আমিই প্রথম লক্ষ্য করলাম যে খোলা দরজা প্রায়-ঝোড়ো বাতাসে বার বার খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। দরজাটা লাগানোর জন্য উঠে গিয়ে সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দেখি, তিনি তখনো সিঁড়িতে নামছেন, অর্ধেক সিঁড়ি নেমে পরের অর্ধেকে পা রেখেছেন বলে তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম। এই প্রথম তাকে দেখলাম মাস্ক নামিয়ে নিয়েছেন। আর সেটাই ছিল সে সন্ধ্যায় আমার দ্বিতীয়বার চমকে ওঠার জন্য যথেষ্ট। কেননা তার চেহারা দেখার সুযোগ পাওয়া মাত্র আমি স্পষ্টই বুঝতে পারলাম কেন তার উজ্জ্বল চোখজোড়া এই এতক্ষন আমার এত চেনা চেনা লাগছিলো।
হ্যাঁ, এই সেই লোক। এই সেই লোক, যে আমার ঘরে ঢুকে পড়েছিল, আমার ওই অদ্ভুত স্বপ্নে – যে স্বপ্নে থেকে জেগে উঠতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো, কয়েকদিন আগে শুক্রবার বিকেলে।
আজব তো! এই লোককে তো জীবনে কোনোদিন দেখিনি আমি, আজই প্রথম তার সাথে পরিচয় হলো, আসাদের ভায়রা ভাই, কোনোদিন চিনি না তাকে। তাহলে তার সাথে দেখা হওয়ার বহুদিন আগেই তাকে আমি স্বপ্নে দেখলাম কিভাবে? এ তো রীতিমতো অসম্ভব কিচ্ছা-কাহিনী, প্রকৃতি কি এই প্রায়-অসম্ভব ঘটনা দিয়ে আমাকে কোনকিছু ইঙ্গিত করার চেষ্টা করছে? খোদাই জানে, আমরা এই দুনিয়ার আর কতটুকুই বা বুঝি!
বিস্ময় গোপন করে আমি আবার আড্ডায় ফিরে এলাম। কাউকে কিছু বললাম না। জানি, কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে না, নানা রকম বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করবে – বৃথাই সময় নষ্ট। আর তারা আমাকে বিশ্বাস করলেও ভাববে, আমার মাথা নষ্ট হওয়া শুরু করছে, নিজের উদ্যোগে নিজের মানহানির ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কিছু না।
***
সে সন্ধ্যায় আমাদের গল্পগুলো আর জমলো না। সবারই নানা কাজের কথা মনে পড়ে গেলো। বৃষ্টির ঝাপ্টা কমে এসেছিলো, কারণ যত গর্জে তত বর্ষে না। আবার বৃষ্টির বেগ বেড়ে যাওয়ার আগেই আমরা সবাই একে একে বেরিয়ে পড়তে চাইলাম।
আমি বের হলাম সবার শেষে। মার্গুব ভাই আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন – “তোমাকে এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন? আরে, এই লোক তো স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগী ছিল। ইদানিং সেরে উঠছে । তার কথা পাত্তা দেয়ার কোনো দরকার নেই, বোকা ।” বের হওয়ার পথে ভাবীর সাথে দেখা হলো। তাকে মুড়ি-চানাচুর আর চায়ের জন্য বিশেষ ধন্যবাদ দিলাম। বললাম, আমার মা ঠিক এরকম মুড়ি মাখাতো, যখন বেঁচে ছিল।
বাইরে বের হয়ে দেখি, গলিতে আসলেও পানি জমেছে, তবে অবস্থা অতটা ভয়াবহ না যতটা ভেবেছিলাম। রাস্তায় লোকজন বলতে গেলে নেই। পানি ডিঙিয়ে হাটতে হাটতে – কেন জানি না – বারবার আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলাম। মোড় ঘোরার সময় স্ট্রিটলাইট একবার নিভে যেতেই অজানা আশংকায় আঁতকে উঠলাম, তারপর আবার মুহূর্তের ভেতর আলো ফিরে আসার কারণে যেন জীবন ফিরে পেলাম।
গল্প এবং আতঙ্ক সম্ভবত কোরোনাভাইরাসের মতোই সংক্রামক। হঠাৎ মনে পড়লো, আজকাল কোনোকিছু অনুভব করছি না – স্বপ্নে যেমন নিজের গায়ে চিমটি কেটে কোনোকিছু টের পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনি কোনো স্পর্শ অনুভব করছি না। বিশেষ করে সেই বিকেলের পর থেকে, যে বিকেলে আমার সেই অদ্ভুত স্বপ্নে আটকে পড়েছিলাম আমি। সন্দেহ ঘনীভূত হলো, আমি কি সে বিকেলে আসলে ঘুম থেকে জেগে উঠতে পেরেছিলাম, নাকি আমার এই জীবন ওই স্বপ্নেরই পরবর্তী একটা পর্ব শুধু। আসলেও আমি যে ঘুম থেকে জেগে উঠেছি, তার প্রমান কি? নিজের মনে অনেক যুক্তি-তর্ক করেও এর কোন প্রমান বের করে আনতে পারলাম না। সে রাতে সিদ্ধেশ্বরী পৌঁছে যখন গেটের তালা খুলছি, ততক্ষনে আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি – শাহাদাত সাহেব প্রাক্তন-স্কিজোফ্রেনিক হলেও মনে হয় ঠিক কথাই বলেছেন, আমরা সবাই আসলে একটা দীর্ঘ স্বপ্নের ভেতরই আটকে পড়ে গেছি। আর তা যদি ঠিক হয়, তাহলে অসম্ভব না যে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত এ স্বপ্ন থেকে আমার মুক্তি নেই। কোনই মুক্তি নেই।
