পুনর্জন্ম  

ছোট ভাই তারেকের সাথে বয়সে কয়েক মিনিট বড় খালেদের প্রথম দেখা হয় মায়ের পেটের আধো-অন্ধকার জগতে।

তারেক সেদিন তার পেটের সাথে লেগে থাকা নাড়িটা টিপে টিপে নিজের দিকে খাওয়া টেনে নেয়ার চেষ্টা করছিলো। খালেদের অবাক দৃষ্টি লক্ষ্য করে ছোট ভাই তারেক ব্যাখ্যা করেছিল – “কয়েকদিন পরই তোমার আর আমার প্রসব হয়ে যাবে, আমাদের ক্ষণস্থায়ী এই জীবন দু’টা শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং এই সুন্দর দুনিয়াটা যতটুকু সম্ভব উপভোগ করে নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।”

বড় ভাই খালেদ মাথা নেড়ে বলে – “আমি তো মনে করি, প্রসবের পরেও একটা জীবন আছে। থাকতেই হবে।”

“তোমার এই ভাবনার কারণ?” – গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করে তারেক।

“আমাদের এই ভ্রূণ জীবনের পর আর কোন জীবন যদি না থাকতো, আমাদের এই অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে যেত। আমাদের বর্তমান এই বেঁচে থাকা কোনোভাবেই উদ্দেশ্যহীন হতে পারে না।”

তারেক মন দিয়ে বড় ভাইয়ের কথা শুনলো, তারপর গম্ভীর মুখে বললো – “এসবই কুসংস্কার। প্রসবের পরবর্তী আরেকটা জীবন আছে, এই দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। প্রসবের পর যদি কোন জীবন থাকত, তাহলে কেউ না কেউ ফিরে এসে বলত সে জীবনের কথা! কেউই ফিরে আসেনি। তার মানে, প্রসবেই সবকিছুর সমাপ্তি, প্রসবেই একটা ভ্রূণের জীবন শেষ হয়ে যায়।“

খালেদ প্রতিবাদ করে বলল – “আমি বিশ্বাস করি, এই অন্ধকার দুনিয়ার বাইরে অবশ্যই আরেকটা দুনিয়া আছে। হতে পারে, এই দুনিয়াতে আমরা সেই ভবিষ্যতের দুনিয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।”

“তোমার সেই পরকালের জীবন কেমন হবে বলে তোমার ধারণা?”

“আমি ঠিক জানি না, কিন্তু সম্ভবত সেখানে এখানের চেয়ে অনেক বেশি আলো থাকবে। আমরা হয়তো পায়ে হাঁটতে পারব, আর মুখ দিয়ে খেতে পারব। হয়তো এমন কিছু অনুভূতি ওখানে আমাদের থাকবে, যা এখানে আমাদের প্রয়োজন হয় না।”

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল তারেক – “হাসালে, ভাই। এই দুর্বল পা দিয়ে হাঁটা কোনোদিনই সম্ভব না। আর মুখ দিয়ে খাওয়ার কি প্রয়োজন, যখন এই নাড়ির ভেতর দিয়ে আমাদের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি আপনা-আপনি আমাদের কাছে চলে আসে?”

“হতে পারে, সে জীবনে তখন আমাদের আর নাড়ির প্রয়োজনই থাকবে না।“ – খালেদ জোর দিয়ে বলে – “আমার ধারণা আমরা এক মায়ের কাছে যাব, যিনি প্রসবের পর আমাদের মায়া-মমতা দিয়ে যত্ন করবেন। আর এই মুহূর্তে আমরা তাঁর মাধ্যমেই বেঁচে আছি। তিনি না থাকলে আমাদের অস্তিত্বই থাকত না।“

তারেক জোরে হেসে উঠল – “তোমার ধারণার ভিত্তি কি, ভাই? মা বলে কেউ যদি থাকতেনই, তবে এখন কোথায় তিনি?”

খালেদ শান্তভাবে বলল – “আমার ধারণা পুরোপুরি ভিত্তিহীন না। কখনো কখনো, যখন সব কিছু একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখন মন দিয়ে শুনলে মা-র কণ্ঠস্বর শোনা যায়। মনে হয়, ওপরে কোথাও থেকে তিনি আমাদের দুজনকে ডাকছেন।”

“এসবি তোমার দুর্বল মনের কল্পনা মাত্র। আমি যাঁকে দেখি না, তাঁর অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করতে পারি না।“

সেদিনের পর থেকে খালেদ আর তারেক একজন অন্যজনের দৃষ্টিভঙ্গিকে সহ্য করে নিয়ে আধো-অন্ধকার এক পৃথিবীতে একসাথে অপেক্ষা করছে তাদের পূর্বনির্ধারিত গন্তব্যের জন্য।

[ডাচ ক্যাথলিক যাজক Henri Nouwen-এর উপাখ্যান “The Parable of the Twins” অবলম্বনে]

Leave a comment