অস্তিত্ববাদী জাহিদের পরাবাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো

পূর্বকথন

সিদ্ধেশ্বরী লেনের মনোয়ারা ক্লিনিকে গম্ভীর মুখে জন্ম নিলো এক শিশু। বাচ্চারা জন্মানোর পর কেঁদে ওঠে, কিন্তু সে কাঁদলো না। আফতাব সাহেবের ভ্রু জোড়া অনেকটা সময় ধরে ভীষণভাবে কুঁচকে রইলো। ডিউটি ডাক্তার তখন দৌড়ে এলো, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালো – শিশু সম্পূর্ণ সুস্থ আছে, বাচ্চারা জন্মানোর পর কেঁদে ওঠে ঠিকই, কিন্তু না কাঁদা অস্বাভাবিক কিছু না। আফতাব আহমেদ হাফ ছাড়লেন, স্ত্রী হালিমা খাতুনের সাথে পরামর্শ করে ছেলের নাম রাখলেন জাহিদ।

ক্লাস থ্রিতে থাকতে একদিন খাবার টেবিলে বাবার কাছে সে জানতে চাইলো মানুষ বানর থেকে এসেছে কিনা। আফতাব সাহেব ছেলেকে কাছে ডাকলেন। জাহিদ তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার গালে ঠাটিয়ে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে তিনি তাকে বুঝিয়ে দিলেন এই বিশ্বজগতে তার অবস্থান। শুধু তাই না, সেকুলার স্কুলের পরিবেশ থেকে বাঁচিয়ে ছেলেকে তিনি ভর্তি করে দিলেন মারকাজ-উল-ইসলাম (বাড্ডা শাখা) মাদ্রাসায়।

আফতাব সাহেব ছেলেকে কাছে ডাকলেন। জাহিদ তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার গালে ঠাটিয়ে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে তিনি তাকে বুঝিয়ে দিলেন এই বিশ্বজগতে তার অবস্থান। কিশোর জাহিদ একসময় লুকিয়ে লুকিয়ে বিধর্মীদের বই পড়তে শুরু করলো – দেখা যাক, অন্য ধর্মগুলো কিরকম, তাদের ধর্মেও কখনো কখনো অন্যায় করা বৈধ আছে কিনা, এসব। আর সেগুলো ঘটতে গিয়েই সে জানতে পারলো – একদল লোক আছে, যারা কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করে না, এমনকি তারা খোদাকেই মানে না। এরকম কিছু যে থাকতে পারে, সেটা ছিল জাহিদের চিন্তার বাইরে – কিন্তু বিষয়টা তাকে কৌতূহলী করে তুললো।

আলিম পাশ করার আগে থেকেই ইন্টারনেটে ব্লগ লেখা শুরু করলো “সিদ্ধেশ্বরী লেনের নিৎসে” নাম নিয়ে। তার লেখার মূল বিষয় ছিল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার নানা অসঙ্গতি। শুধু সেটাতেই সীমাবদ্ধ থাকলে একটা কথা ছিল – আনুষ্ঠানিক ধর্মগুলোর সূত্র ধরে সে এমনকি ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়েও, সৃষ্টি পরিচালনায় তার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন করা শুরু করলো।

জাহিদ যখন যুবক, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছে মাত্র, হঠাৎ তার জীবনে ঘটতে শুরু করলো একের পর এক অদ্ভুতুড়ে সব ঘটনা।

শুরু হলো অতিলৌকিক অভিজ্ঞতার পথে একজন নাস্তিক জাহিদের অদ্ভুত এক অভিযাত্রা।


গল্প ১:
একটি আয়নার জন্ম ও প্রায়-মৃত্যু সমাচার

কালীমন্দিরের সামনের মোড়টা ঘুরে জাহিদ এক মুহূর্তের জন্য তার দৌড় থামালো। তার বুকটা হাপরের মতো বার বার ওঠা-নামা করছে, এক মুঠো বাতাসের জন্য হা-পিত্যেশ করছে ক্লান্ত আর প্রায় নিঃস্ব হয়ে আসা তার ফুসফুস। এক মুহূর্তের জন্য পেছনে ফিরে তাকালো। ছেলেগুলোর কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না। তারপরও সে কোনোরকম ঝুঁকি না নেয়ারই সিদ্ধান্ত নিলো। বাঁ পা-টা ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে সে ভিড় ঠেলে এগিয়ে চললো আনারকলি মার্কেটের পার্কিংটার দিকে। আর ঠিক তখনি জাহিদের চোখ আটকে গেলো নিচতলার ঘিঞ্জি দোকানগুলোর একটাতে।

কালো কাঁচের দরজাটা দেখে তার মনে হলো, এখানে তো এই দোকানটা চোখে পড়েনি কখনো, এখানে তো এই দোকান থাকার কথা না। দোকানটাতে ঢুকে পড়লো সে সেই পড়ন্ত বিকেলে।

পুরোনো ফার্নিচারের দোকান একটা, যার বড় একটা অংশ জুড়ে আছে ছোট-বড়, নতুন-পুরোনো নানা রকম আয়না। ভেতরে ঢুকতেই নাকে ধাক্কা দিলো পোড়া কর্পূরের তীব্র গন্ধ। শূন্য পরিসরে সেই একমাত্র কাস্টমার, এমনকি কোন দোকানদারকেও দেখা যাচ্ছে না। টিমটিমে অল্প আলোতে প্রাচীন নক্সাকাটা কয়েকটা আলমারি, একটা সোফা সেট, আর অসংখ্য আয়না। সেগুলোর মধ্যে একটা স্টাইলিশ বনেদি তিন-ফিট-বাই-দুই-ফিট আয়নার দিকে তার চোখ আটকে গেলো।

কৈশোরের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো যেভাবে তাকে টানে, ঠিক একইভাবে পুরোনো জিনিস-পত্রও জাহিদকে আকর্ষণ করে। এসব কারণেই তার ঘর ভর্তি ছোট-খাটো সুভ্যেনির আর কাঠের জিনিস-পত্রে। ওর সংগ্রহের মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন হলো কলকাতায় মারা যাওয়া এক ব্রিটিশ সৈনিকের তামাকের পাইপ।

তবে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা তাকে আকর্ষণ করে, সেটা হলো আয়না। আর একারণেই দোকানটাতে ঢোকার সাথে সাথে জাহিদের মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে – সে ভাবতেও পারছে না, এরকম একটা দোকান ঢাকা শহরে আছে, তাও আবার তার বাসার প্রায় উঠোন পেরোতেই একেবারে সামনের মার্কেটের ভেতর।

ছোটবেলা থেকেই আয়না জিনিসটা তাকে কেন যেন সম্মোহিত করে ফেলে। যে লেখাটা সে পড়তে পারছে, সেটাই আয়নার সামনে ধরলে হয়ে যাচ্ছে দুর্বোধ্য – আয়না জিনিসটা রহস্যময় হওয়ার জন্য একটা শিশুর কাছে এটাই কি যথেষ্ট কারণ না ! প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় থেকে জাহিদ আয়নার সামনে বসে থাকতো ঘন্টার পর ঘন্টা – বাসায় যখন কেউ থাকতো না। তার মনে হতো – কেমন হবে, যদি সে দেখে সে হাত নাড়াচ্ছে কিন্তু আয়নার ভেতরের ছেলেটা হাত নাড়াচ্ছে না ! কি ভয়ঙ্করই না হবে ঘটনাটা ! আয়নার ওপাশটা ছোট্ট জাহিদের কাছে সবসময়ই ছিল অন্য এক সমান্তরাল পৃথিবী, অন্য এক জীবন – কেন কে জানে।

তার বেডরুমের বড় অফ-হোয়াইট দেয়ালটাতে ঝোলানো আছে ছোট-বড় প্রায় ত্রিশটা আয়না – বিভিন্ন সময়ের, বিভিন্ন স্টাইলের আয়না সেগুলো – একেকটা আয়না যেন ধারণ করে আছে একেকটা সংস্কৃতিকে। ওর সংগ্রহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভিকটোরিয়ান আমলের ওক কাঠের একটা আয়না, আর দিনাজপুরের জমিদারবাড়ি থেকে সংগ্রহ করা মেহগনি কাঠের আরেকটা আয়না।

বাকি আয়নাগুলোর কোনোটাই অত পুরোনো না, কিন্তু সেগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা। ওর ঘরে আছে রাশান আয়না, উজবেক আয়না, টার্কিশ আয়না, ভারতীয় আয়না, জাপানিজ আয়না, রোমানিয়ান আয়না।

হয়তো এসব কারণেই ছমছমে ভুতুড়ে সেই পরিবেশে ওই আয়নাটা যেন তাকে সম্মোহিত করে ফেললো, তার মনে হতে লাগলো – ওটা কিনে না নিলে তার জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে। সে যখন ওটার দিকে তাকিয়ে, শূন্য থেকে যেন উদয় হলো এক সেলসম্যান, জাহিদের কাঁধে টোকা দিয়ে বললো – “ওটা সেলে আছে, মাত্র একশো এক টাকা। আপনার জীবন বদলে দেবে, স্যার।”

জাহিদ পেছনে ফিরে দেখে, লম্বা একহারা গড়নের রোগা কালো একটা ছেলে, কথা বলার সময় যার কণ্ঠার হাঁড়ের ওঠা-নামা দেখতে পাওয়া যায়।

আয়নাটার ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলো না জাহিদ। সাত-পাঁচ ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, কিনবে সে ওটা। প্রাচীন টাইপের জিনিস ঘরের ভেতর দেখতে বেশ লাগে।

“এটা কত পুরোনো?” – জাহিদ জানতে চাইলো।
উত্তরে সেলসম্যান কাষ্ঠ হাসি হাসলো – “কেউ জানে না এটা কত পুরোনো। হয়তো অনাদিকাল থেকেই আছে এটা, হয়তো বিশ্বসৃষ্টিরও আগে এর সৃষ্টি, অসম্ভব না বিগ ব্যাং-এর কারণও এই ছোট্ট আয়নাটাই।”

লোকটার হেয়ালি কথার ধরণে জাহিদ হেসে ফেললো – “আর বলতে হবে না। নিচ্ছি আমি এটা।”

সেলসম্যান কিন্তু হাসলো না, হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে এনে বললো – “আমরা কাউকে ঠকাই না। জেনে রাখবেন, সস্তার কিন্তু আবার তিন অবস্থা। হাজার বছরের পুরোনো বনেদি দোকান আমাদের, শুধু লাভের জন্য আমরা ব্যবসা করি না, আপনাকে সাবধান করে দেয়া তাই পবিত্র দায়িত্ব আমাদের।”

“চিন্তা করবেন না, আমি এটা হজম করতে পারবো, কেননা কোন ধরণের বুজরুকিতে আমার ভরসা নেই।” – বলতে বলতে জাহিদ আয়নাটা আনমনে ছুঁয়ে ফেললো, তখন তার দৃষ্টি আবার আটকে গেলো সুপ্রাচীন ওই জিনিসটার ওপর। এমনকি তাকিয়ে থেকে থেকে একসময় সে সময়ের হিসেবও যেন হারিয়ে ফেললো।

বেশ কিছুক্ষন পর সম্বিৎ ফিরে আসতেই আয়নাটা সে যত্ন করে হাতে তুলে নিলো। কিন্তু ওটা নিয়ে কাউন্টারে আসতেই দেখা গেলো, সেলসের ছেলেটা আবার উধাও হয়ে গেছে – যেন এখানে সে ছিলই না কোনোদিন। প্রায় মিনিট পাঁচেক ডাকাডাকি করেও যখন কাউকে আসতে দেখা গেলো না, জাহিদ অগত্যা একশো টাকার একটা নোট আর পাঁচ টাকার আরেকটা নোট কাউন্টারে রেখে আয়নাটা নিয়ে বেরিয়ে এলো।

এভাবে দাম দিতে হলো বলে চার টাকা বেশি দিতে হলো জাহিদ কে, কারণ তার কাছে ভাংতি এক টাকা ছিল না – কিন্তু কি আর করা! ওর অবশ্য ধারণা, তারপরও ওটা কিনে সে আজ ভালোই জিতেছে – আয়নাটা যে আসলে এর অন্তত দশগুণ বেশি দামি, এ বিষয়ে তার নিজের অন্তত কোন সন্দেহ নেই।

যে জিনিস কারো ব্যক্তিগত জীবনে দুর্ভাগ্য বয়ে আনে, বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় সে জিনিসকে ‘কুফা’ বলে অভিহিত করা হয়। জাহিদ যদি সংস্কারে ন্যূনতম বিশ্বাস রাখতো, তাহলে এই আয়নাকে সে নিশ্চিতভাবেই ‘কুফা আয়না’ নাম দিতো, কেননা এই আয়না ঘরে আনার পরদিন সকালেই জাহিদের মা মারা যান। আকস্মিকভাবেই মারা যান তিনি। কোন আপাত কারণ ছাড়াই মারা যান। ডাক্তাররা বলে, হার্ট এটাক, কিংবা স্ট্রোক, কিংবা উভয়ই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই হার্ট এটাক ঠিক এই সময়ই কেন হলো। কেন আয়নাটা মা-র ঘরে রাখার ঠিক পরদিনই এই দুর্ঘটনা ঘটলো। এসব প্রশ্নের আসলে সঠিক কোন উত্তর নেই সম্ভবত কারো কাছে। সে যাই হোক।

সকালে ছয়টার দিকে জাহিদ গিয়েছিলো মায়ের ঘরে মা-কে ওষুধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতে। ঘরে ঢুকতে পথে প্রথমে চোখ পড়ে আয়নাটাতে। সে গতকাল সাইডটেবিলে রেখে চলে গিয়েছিলো। আয়নাতে মায়ের বিছানা খালি দেখে প্রথমে চমকে উঠেছিল জাহিদ, পরে ঘরে ঢুকে দেখে মা বিছানাতেই আছে। তাহলে আয়নাতে কিছু দেখা যাচ্ছে না কেন? মনে হয়, সে গতকাল ঠকে এসেছে। অল্প দামে পেয়ে সাথে সাথে ওটা কিনে নেয়া উচিত হয় নি।

কিন্তু ওই মুহূর্তে আয়নার আচরণ নিয়ে চিন্তার সময় ছিল না জাহিদের, সে মা-কে নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লো – মা এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না। সে কয়েকবারই মা-কে ডাকলো, প্রথমে আস্তে তারপর উঁচু গলায়। কয়েকবার ধাক্কা দেয়ার পর যখন দেখলো, মা নড়ছে না, সে বুঝে ফেললো – ঘুমের মধ্যেই এই ভদ্রমহিলার মৃত্যু হয়েছে, ছিড়ে গেছে পৃথিবীর সাথে জাহিদের ব্যক্তিগত শেষ বন্ধনটা।

সদ্য নীল পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেয়া মাটির কবরের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে পানি আনার অনেক চেষ্টা করলো জাহিদ, কিন্তু কিছুতেই সে এক ফোটা পানিও চোখ থেকে ঝরাতে পারলো না।

কেউ কেউ ওকে লক্ষ্য করে বললো – আহা, মায়ের শোকে পাথর হয়ে গেছে লোকটা – বা এ জাতীয় কিছু একটা।

কিন্তু কিছুতেই কিছু হলোনা জাহিদের। তার শুধু চোখে ভেসে উঠতে লাগলো একটা মৃতদেহ, যেটা পচে গলতে শুরু করেছে। তার চিৎকার করে বলতে মন চাইলো – কাল যাকে তুমি ভুলে যাবে, তার জন্য আজ কিসের শোক কিসের দুঃখ, কিছুতেই আসলে কিছু যায় আসে না। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারলো না, শুধু শূন্যদৃষ্টিতে একবার কবরের কাঁচা মাটির দিকে আরেকবার মেঘযুক্ত আকাশের দিকে তাকাতে লাগলো।

মায়ের শরীরের ভেতর কি ছিল সেই জিনিস, যা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল? কি সেই জিনিস, যা “নড়ে-চড়ে হাতের কাছে, খুঁজলে জনমভর মেলে না”? আত্মা যদি অলীক আর কুসংস্কার হয়, তাহলে মৃত্যুকে কেন উল্টোমুখী করে জীবনকে ফিরিয়ে আনা যায় না? ধর্মে বিশ্বাস না করেও সে কেন আজ মায়ের জানাজা পড়লো, আর সেই নামাজে মায়ের জন্য দোআও করলো? কেমন করে সে সেই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলো যাকে সে বিশ্বাসই করে না? বিচিত্র এসব প্রশ্ন মাথায় নিয়ে জাহিদ কবরস্থান থেকে বেরিয়ে এলো। কিন্তু আয়না নিয়ে তার দুর্গতি সেখানেই শেষ হলো না।

বুধবার সন্ধ্যায় বাবার ঘরে ঢুকে জাহিদের প্রায় ভিরমি খাওয়ার অবস্থা হল। সন্ধ্যার আধো-অন্ধকার বাবার ঘরে, ঘরে তখন লাইট জ্বালানো হয় নি। ওই আবছায়াতে আয়নাটার দিকে তাকিয়ে জাহিদের মনে হলো, ওখানে বিছানা সহ পুরো ঘরটা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বাবাকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ ওই তো বাবা ঘুমিয়ে আছে বিছানায়, কেন যেন বাবা আজ অবেলায় ঘুমাচ্ছে।

সে ভয়ে ভয়ে বাবাকে ডাকতে লাগলো। কিছুক্ষন ডাকার পর বাবা নড়ে-চড়ে উঠলেন, জাহিদ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। জাহিদ লাইট জ্বালালো, তখন তার দৃষ্টি আপনা-আপনি চলে গেলো আয়নায় – না, ঐতো বাবাকে দেখা যাচ্ছে আয়নায়।

জাহিদ অতীন্দ্রিয় কোন জিনিসে বিশ্বাস করে না, সুতরাং সে ধরে নিলো তার কোন কারণে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। তাই এই সমস্যা নিয়ে চুপচাপ বসে না থেকে সে তখন তখনই ডক্টর রকিবুলের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

“এটা কিভাবে সম্ভব যে ওই আয়নাতে আমি কোন ঘুমন্ত মানুষকে দেখতে পাই না ?” – হতাশ গলায় জাহিদ জানতে চাইলো সাইকোলজির লেকচারার রকিবুল ইসলামের কাছে।

ঘটনা বা দুর্ঘটনার শুরু একটা বিশেষ আয়না ঘরে আনার পর থেকে। তবে গত সপ্তাহ থেকে জাহিদ এ নিয়ে চরম আতংকিত হয়ে আছে, সঙ্গত কারণেই তার এই ভয় পাওয়া।

“ঘরের আর সবকিছু দেখা যায়, শুধু ঘুমিয়ে থাকা লোকটাকে দেখা যায় না।” – জাহিদ অস্বস্তির সাথে যোগ করলো।

জাহিদ আর রকিব প্রায় একই সময়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ঢুকেছিলো লেকচারার হিসেবে – জাহিদ দর্শনে, আর রকিব মনোবিজ্ঞানে। দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ, কেননা দুজন একই প্যানেলকে সাপোর্ট করে, রকিব জাহিদের মাত্র এক বছরের সিনিয়ার – ইন্টারমিডিয়েট পাশের বছর হিসাব করলে। টিচার্স ক্যান্টিনে নানা বিষয় নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করে তারা প্রায়ই। কিন্তু আজকের আলাপের বিষয়টা ছিল একটু অন্যরকম, কিছুটা ব্যক্তিগত।

জাহিদের অদ্ভুত অতীন্দ্রিয় একটা সমস্যা নিয়ে আলাপ হচ্ছিলো আজ। জাহিদ অবশ্য দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এটা তার নিজের মানসিক সমস্যা, সম্ভবত মানসিক চাপ থেকে এর শুরু।

“শুধু ঘুমন্ত মানুষকে দেখতে পাও না?” – ঠান্ডা হয়ে আসা কফির কাপে একটা শেষ চুমুক দিয়ে জানতে চাইলেন কামরুল।
জাহিদ চুপ করে রইলো।

“আর কিছু?” – রকিবুল আবার জিজ্ঞেস করলেন।
জাহিদ একবার কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো, তারপর একটু যেন দ্বিধা নিয়েই বললো – “আর মৃতদেহ।”

“ওই আয়নাতে তুমি ডেডবডি দেখতে পাও না?”
জাহিদ মাথা নাড়লো দেখে তিনি যোগ করলেন – “কিভাবে বুঝলে?”
মা যেদিন মারা যায়, সেদিন সকালের ঘটনা বললো জাহিদ।

“এই আয়না তুমি কোথা থেকে পেয়েছো?” – রকিবুল জানতে চাইলেন, হয়তো তিনি এই জিনিসের সাথে জাহিদের অতীত কোন সম্পর্কের বিষয়ে নিশ্চিত হতে চাইছিলেন।

জাহিদ কি বলবে বুঝে পেলো না, কারণ সে নিজেও নিশ্চিত না আয়নাটার উৎসের বিষয়ে। খুব অদ্ভুতভাবে সে ওটার খোঁজ পেয়েছিলো।

“তার মানে, এই আয়নায় তুমি মূলত ঘুমন্ত আর মৃত মানুষকে দেখতে পাও না।” – সব কিছু শুনে বললেন রকিবুল। উত্তরে নিশ্চুপ জাহিদ মাথা নিচু করে রইলো, যেন তার মানসিক সমস্যা কিংবা মনোবিকারের জন্য সে ভীষণ কোন অপরাধ করে ফেলেছে।

রকিবুল বললেন, এই বিষয়টা একটু জটিল, সুতরাং তাকে এ নিয়ে একটু কেস স্টাডি ঘেটে দেখতে হবে। পরের মঙ্গলবার এ নিয়ে আবার কোথা হবে বলে তিনি বিদায় নিলেন।

টিএসসি থেকে বের হয়ে জাহিদের মনে হলো, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। খুব অদ্ভুত একটা অনুভূতি এটা – মনে হয় কেউ ঠিক ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে, কিন্তু পেছনে তাকালেই দেখা যায় কোথাও কেউ নেই।

মৃত্যুচিন্তার মতো বীভৎস ওই অনুভুতিটাকে উপেক্ষা করে জাহিদ বিরুদ্ধস্রোতের বিপরীতে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলো। সন্ধ্যার রাস্তায় সে ইতস্তত ঘুরে ঘুরে রিক্সা খুঁজতে লাগলো।

ঠিক পাঁচ দিন পর জাহিদ আনারকলি মার্কেটের ওই চিপাগলিতে আবার আবির্ভুত হলো। সেই সেলসম্যানকে যদি খুঁজে পাওয়া যায়, হয়তো আয়নাটা সম্পর্কে আরো কিছু বাড়তি তথ্য জানা যাবে হয়তো, বোঝা যাবে এই আয়না ঘিরে রহস্যটা ঠিক কোথায়।

কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখা গেলো, ওই দোকানটা নেই। অদ্ভুত, পুরো দোকান যেন উধাও হয়ে গেছে ওটা এক রাতের মধ্যে। বা ব্যবসাটাই হঠাৎ গুটিয়ে গেছে – এক রাত্রে? কে বলতে পারে?

সে দুপুরেই হাইকোর্ট থেকে ফেরার পথে রিক্সায় বসে থেকে জাহিদ অসম্ভব ক্লান্তি অনুভব করছিলো। যতবার কপাল থেকে ঘাম বেয়ে ওর ভারী কালো ফ্রেমের চশমার কাঁচে পড়ছিলো, ততবার তার নিজেকে চরম ব্যর্থ মনে হচ্ছিলো তার।

এই কয়েকদিনে বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে। তারমধ্যে আজকেরটাই মনে হচ্ছে সবচেয়ে বাজে। তার মামলার খারিজের আবেদন নাকচ হয়েছে। অথচ বিগত সরকারের পতনের পর তার মনে হয়েছিল অবস্থার উন্নতি হবে।

আগের সরকার না হয় ধর্মান্ধ ছিল, কিন্তু এখন তো একটা সেকুলার দল ক্ষমতায় এসেছে। এখনো কেন তাকে “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের” মামলা বয়ে বেড়াতে হবে? তাহলে কি সব দলই কোন না কোনভাবে ধর্ম-ব্যবসায়ীদের তোয়াজ করে? না, মনে হচ্ছে, জ্বলন্ত উনুন থেকে জাহিদ গিয়ে পড়েছে ফুটন্ত পানিতেই।

বিকেলে যথারীতি টিএসসিতে দেখা হলো কামরুল ইসলামের সাথে। জাহিদ অস্থির হয়ে অপেক্ষা করেছে তার সেই ব্যক্তিগত বা মানসিক সমস্যাটার বিষয়ে ডক্টর কামরুলের মতামত জানার জন্য।

গো-ধুলির চমৎকার আলোতে মশার দল তাড়াতে তাড়াতে ভদ্রলোক – “তুমি ওই আয়নাতে ঘুমন্ত আর মৃত মানুষকে দেখতে পাও না। গত সপ্তাহে তাইতো বলেছিলে তুমি। কিন্তু ঘুমন্ত আর মৃত মানুষের মধ্যে কোন জায়গাটায় মিল আছে, জানো?”

জাহিদের উত্তরের অপেক্ষা না করে চায়ের কাপে ভদ্রতামূলক ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে তিনি বলে চললেন – “ঘুমন্ত আর মৃত মানুষের মধ্যে কোন জায়গাটায় মিল আছে, জানো? ঘুমন্ত আর মৃত এই দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে মিল হলো – যদি তাদেরকে মানুষ বলা যায় – এদের কারো মধ্যেই চেতনা জিনিসটা নেই। ঘুমন্ত মানুষের মধ্যে চেতনা সাময়িকভাবে এবসেন্ট, আর মৃত মানুষের মধ্যে সেটা চিরতরে মিসিং।

হতেও পারে, তোমার কাছে চেতনা বিলোপ হওয়া আর অস্তিত্ব বিলোপ হওয়া একই কথা। আর এটার কারণেই তোমার বিভ্রমের ধরণটা এরকম, আয়নায় তুমি সবই দেখতে পাও – এই দুই ধরণের জিনিস ছাড়া। এটা তো আর নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব না, কিন্তু এটাই হতে পারে তোমার হ্যালুসিনেশনের ব্যাখ্যা।”

জাহিদ হঠাৎ মাথা তুলে সরাসরি তাকালো কামরুল ইসলামের চোখের দিকে – “কামরুল ভাই, এই যে আপনি বললেন চেতনা। আপনি বোধ হয় কনশাসনেস বোঝাতে চেয়েছেন। ঠিক কি না?”

কামরুল হাসলেন – “আমি জানি তুমি কোন দিকে যাচ্ছো। তুমি যাই মনে করো না কেন, আমি কিন্তু দ্বৈতবাদী। আমি বিশ্বাস করি একটা স্বতন্ত্র অতীন্দ্রিয় জগতে, যে জগৎটা এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সাথে সাথে বয়ে চলেছে সমান্তরাল একটা নদীর মতো। অসম্ভব না যে চেতনা, আত্মা, এসবের বসবাস সেই সমান্তরাল অতীন্দ্রিয় পৃথিবীতে। এমনকি হতে পারে, সেই পৃথিবী আমাদের পৃথিবীর মতোই বাস্তব বিজ্ঞানসম্মত, কিন্তু আমরা তাদের ধরতে বা ছুটে পারি না কারণ সেই জগতের অস্তিত্ব পঞ্চম বা ষষ্ঠ ডাইমেনশনে।”

“কিন্তু আপনি যদি চেতনার অস্তিত্ব মেনে নেন, তাহলে সবগুলো ধর্মের সবগুলো অবাস্তব দাবি আমাদের দাবি মেনে নিতে হবে। ঈশ্বর, জীন-ভুত, সব অদরকারি জিনিস মেনে নিতে হবে, আমরা পিছিয়ে যাবো এক হাজার বছর, ঠিক যেটা এই মৌলবাদীরা চাচ্ছে।” – জাহিদ প্রায় প্রতিবাদ করে বললো।

“তাহলে তোমার মতে চেতনা জিনিসটা কি?” – চশমাটা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে রকিবুল বললেন।
“চেতনা বলে কিছু নেই। ঈশ্বর আর ভুতের মতো সেটাও একটা বিভ্রান্তি।”

“ঈশ্বর আর ভুত এক জিনিস না, জাহিদ। ঈশ্বরের অস্তিত্ব ভুতের অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করে না, কিন্তু মানুষ আর ভুতের অস্তিত্ব নির্ভর করে ঈশ্বরের ওপর। তুমি তো দর্শন পড়াও, তোমার আরো ভালো জানার কথা।”

সেই সন্ধ্যায় জাহিদ মন খারাপ করে বেরিয়ে এলো টিচার্স ক্যান্টিন থেকে। সে আশা করেছিল, কামরুল ভাইয়ের কাছ থেকে একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা পাবে। এখন দেখা যাচ্ছে, এ লোকও বিজ্ঞানীর ছদ্মবেশে ভেতরে ভেতরে একজন বিশাল আস্তিক। রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তি, রাজনীতি থেকে চায়ের আসর – সব জায়গাতেই মূলে রয়ে গেছে একই সমস্যা।

আয়না নিয়ে গবেষনা অবশ্য জাহিদের এমনিতেও বেশিদূর আগাতে পারলো না। সে এর চেয়ে অনেক বড় একটা ঝামেলায় জড়িয়ে গেলো। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের যে মামলাটাতে সে জামিনে আছে, কেমন করে যেন সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয়ে গেল।

কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে কিছুদিনের মধ্যেই তার নাম ধরে গালি দেয়া শুরু হল। ধর্মভীরু এক ইউটুবার তাকে “মুরতাদ জাহিদ” টাইটেল দিলো। এমনকি রাজধানীতে নতুন বাবা-মায়েদের মাঝে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর নাম হিসেবে ‘জাহিদ’ শব্দের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেল।

তার পক্ষেও একটা ছোটোখাটো গ্রূপ দাঁড়িয়ে গেলো, নেটিজেনদের মধ্যে থেকে। এই দলটা তাকে “সিদ্ধেশ্বরী লেনের নিৎসে” বলে অভিহিত করলো, এবং তাকে নৈতিকভাবে সমর্থন করে যাওয়ার অঙ্গীকার করলো। যদিও এই অঙ্গীকার জাহিদকে খুব একটা ভরসা দিতে পারলো না, কারণ পথে-ঘাটে অনেকেই তাকে “নাস্তিক ব্লগার” বলে গালি দিতে লাগলো। জাহিদের মনে হলো, এই সমর্থনটা তাকে সাহায্য করার বদলে বরং আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছে বেশি।

কিন্তু সমস্যা হলো, জাহিদ জানতো না কিভাবে এসব মোকাবিলা করতে হয়। সে কি কোন সংবাদ সম্মেলন করে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করবে – সে ঈশ্বরকে মৃত বলে নি, সে শুধু বলতে চেয়েছে রাষ্ট্র, রাজনীতি এসবের মধ্যে ঈশ্বরের ধারণা অপ্রাসঙ্গিক? নাকি সে বায়তুল মোকাররমে গিয়ে জুমার খুৎবার পর মুসল্লিদের কাছে মাফ চেয়ে আবার ধর্মের সুশীতল ছায়াতলে ফিরে আসবে?

প্রচন্ড চাপের মুখোমুখি হলে এখনো জাহিদ দেখা করে রুনার সাথে, আবারো তাই করলো। জাহিদের একসময়ের প্রেমিকা রুনা সুলতানা পাশ করেছে ফিজিক্স থেকে। ইম্পেরিয়াল কলেজে পিএইচডি করতে যাবে শিগগিরই, সামনের বছর উড়াল দেবে লন্ডনে। প্রচন্ড চাপের মুখোমুখি হলে এখনো জাহিদ দেখা করে রুনার সাথে। রুনা ভালো মেয়ে, সম্পর্কে ভাটা পড়লেও সে এখনো যথেষ্টই করুনার চোখে দেখে জাহিদকে।

সব শুনে বেণী দুলিয়ে সে বললো – “কোয়ান্টাম ফিজিক্স তো বলেই, প্রতি দুইটা সম্ভাবনার একটাকে সঠিক প্রমান করে কোয়ান্টাম অবসার্ভার মানে জাগতিক দর্শক। তার মানে, তুমি যে বেঁচে আছো, তার একমাত্র প্রমান তোমার নিজের সচেতন থাকা, মানে নিজেকে নিজে দেখতে পারা। ঘুমের মধ্যে তুমি নিজেকে দেখতে পারো না, সুতরাং কোয়ান্টাম অবসার্ভার এখানে অনুপস্থিত, তার মানে তুমি তখন অস্তিত্বহীন হতেই পারো, তাই না?”

রুনার দুর্দান্ত যুক্তির সাথে পেরে ওঠা জাহিদের জন্য বেশ কঠিন, বিশেষ করে যখন তার কপালের ওপর ওর চুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। রুনা ছিল সেইসব অল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে একজন, যারা মনে করে যে নিজেকে সবসময় সন্দেহ করার মধ্যেই নিহিত আছে সফলতার গোপন চাবিকাঠি। সে বিকেলে ওর সাথে বেশ অর্থপূর্ণ কিছু কথা-বার্তা হলো জাহিদের, তারপর তারা পরস্পরকে বিদায় জানিয়ে যে যার পথে চলতে শুরু করলো।

সন্ধ্যার রিক্সায় ফিরতে ফিরতে দর্শনের গোলকধাঁধাগুলোর একটা জাহিদের মাথায় ঘুরতে শুরু করলো – অস্তিত্বের জন্য যদি একজন দর্শক জরুরি হয়, তাহলে কেউ যখন ঘুমিয়ে যায় তখন তার অস্তিত্ব কিভাবে টিকে থাকে? কে তখন দর্শক হয়ে ব্যক্তির অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে? নাকি প্রতিটা মানুষের অস্তিত্ব প্রতিদিন সকালে নতুন করে জন্ম নেয়, আগের দিনগুলোর সত্য কিংবা মিথ্যা স্মৃতি নিয়ে?

বদনামের পাশাপাশি জাহিদের আরেকটা যে জিনিস হলো – ভয়, জীবনের ভয়, সব কিছু হারানোর ভয়। সে যেখানে যেত, জাহিদের মনে হতো কে বা কারা তাকে অনুসরণ করছে – আলোতে ও অন্ধকারে, রাতে ও দিনে। রাস্তায় চলতে গিয়ে মনে হতো, কালো আলখাল্লা পরা কেউ তার পেছনে পেছনে আসছে। রাতে ঘরের লাইট নেভালেই মনে হয়, ঘরের এক কোনায় অন্ধকারটা একটু বেশি জমাট বাধা – কেউ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

পরদিন ছিল এক অদ্ভুত দিন – রাতে ঘুম ভালো হয় নি বলেই কিনা কে জানে – কার্জন হলের সামনে ভীষণ ভয় পেলো জাহিদ। রিক্সার জন্য রাস্তার ধারে অপেক্ষা করছিলো সে। ঠিক সেই সময় সেই নির্জন দুপুরের রোদে ঘামতে ঘামতে তার মনে হলো, তিনজন যুবক তাকে অনুসরণ করছে। ছেলেগুলো ছিল জিনসের প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথায় গোল টুপি। হয়তো ওদের কাছে ধারালো অস্ত্র আছে, হয়তো রাম দা।

জাহিদ কেন যেন ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো, সে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে শুরু করলো। পেছনে ওরা আসছে কিনা দেখার জন্য যেই না সে পেছন ফিরেছে – অনভ্যস্ততার কারণেই হয় তো – ফুটপাতের ধাপ বুঝতে না পেরে হোঁচট খেয়ে ছিটকে মুখ থুবড়ে পড়লো রাস্তায়, আর তার মাথার ডানপাশটা বাড়ি খেলো সামনের ফুটপাতের কোনাতে। মুহূর্তের ভেতর জ্ঞান হারালো জাহিদ।

জাহিদের মনে হলো তার শরীরটা মহাশূন্যের ভেতর ঝুলে রয়েছে। চারিদিকে অন্ধকার, তারমধ্যে একপাশের অন্ধকারটা বেশি গাঢ়। ভালো করে তাকাতেই জাহিদ বুঝতে পারলো, সে আসলে বিশাল এক কৃষ্ণগহ্বরের সীমানা থেকে শুধুই ওটার ভেতর থেকে আরো ভেতরে পড়ে যাচ্ছে, অনন্তকাল ধরে পড়ে যাচ্ছে। একসময় জাহিদের মনে হলো, তার শরীর কেউ টেনে লম্বা করে দিচ্ছে, একসময় সেটা সুতোর মতো সুক্ষ হয়ে যাচ্ছে।

যখন তার মনে হচ্ছিলো সে মরে যাবে, ঠিক তখনই সে নিজেকে আবিষ্কার করলো একটা অসীম বিশাল বদ্ধ ঘরে। ঘরের ভেতর অসংখ্য আয়না, পর পর সাজানো – আয়নাগুলোর ভেতর থেকে আলো আসছে, তীব্র চোখ ধাঁধানো আলো।

জাহিদের খুব ভেতর থেকে কেউ তাকে বলছিলো, ওই আলোটাকে ধরতে পারলেই ও আবার জীবন খুঁজে পাবে, আর ওটাকে স্পর্শ করতে না পারলে সে মৃতই থেকে যাবে। সে এগিয়ে গেলো ডানদিকে ওর ঠিক সামনের মানুষ সমান বড় আয়নাটার দিকে – ভিনিসিয়ান একটা আয়নাটা, কারুকাজ করা কালো কাঠের ফ্রেম, আর তার কাঁচ দীঘির জলের মতো নিটোল।

কিন্তু যেই না ও আয়নাটার সামনে গেলো, জাহিদের নিজের চেহারা ভেসে উঠলো আয়নায় আর আলোর উৎসটা আড়াল হয়ে গেলো। ফলে আয়নায় সেই আলোটাকে ধরতে পারলো না সে।

সে আবার চেষ্টা করলো – এবার আয়নার বাঁ পাশ থেকে, কিন্তু ঘটলো একই ঘটনা – জাহিদের নিজের অস্তিত্বের ছায়াটাই আলো আর তার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াতে লাগলো।

এভাবেই চলতে থাকলো, যেন চলবে তা অনন্তকাল ধরে – জাহিদ যতবারই পরবর্তী আয়নাটার সামনে যায়, কাঁচের ভেতরের ভীষণ তীব্র আলোটা ঢাকা পড়ে যায় ওর নিজের প্রতিবিম্বের আড়ালে। আর জাহিদও পাগলের মতো হাতড়াতে থাকে আয়নার এক পাশ থেকে আরেক পাশ, তারপর একসময় আবার ছুটতে থাকে এক আয়না থেকে আরেক আয়নায়।

আয়না থেকে আরেক আয়নায় মাথা কুটে মরা – এমন করে কতদিন চলেছে, জাহিদের মনে নেই।

কিন্তু একদিন হঠাৎ তার মনে হলো – এভাবে হবে না, এভাবে কোনোদিনই সে এখান থেকে বেরোতে পারবে না।

ও বুঝতে শুরু করলো – এই জায়গা থেকে মুক্তি পেতে হলে আয়নার ভেতর আলোকে খোঁজার চেষ্টা ওর বন্ধ করতে হবে, কেননা ওর নিজের ছায়া সবসময়ই বাধা হয়ে দাঁড়াবে ওর আর আলোর মাঝে।

আলোকে ছুঁতে হলে ওকে সরাসরি তাকাতে হবে আলোর দিকে, কিয়ের্কেগার্দের মতো নিতে হবে “লিপ অফ ফেইথ” – শুধুই বিশ্বাসের ওপর ভরসা করে আলো খুঁজতে হবে সেখানে যেখানে ওটা থাকার কথা না।

জীবনে প্রথমবারের জন্য সেবার জাহিদ যুক্তির সিঁড়িকে পাশ কাটিয়ে গেলো, শুধুই বিশ্বাসের পাখায় ভর করে করে ঝাপ দিলো অনন্ত সম্ভাবনার অতল কালো শূন্যতার এক গহ্বরে।

আয়নার ভেতর আলোর রেখা খোঁজা বন্ধ করে সে যখন ঘুরে দাঁড়ালো, আর তাকালো ওর ঠিক পেছন দিকে, তখন হঠাৎ করেই সে সেখানে দেখতে পেলো একটা হাসপাতালের বিছানা, যেখানে ওর শরীরটা শুয়ে আছে চোখ ধাঁধানো ধবধবে একটা বিছানায়, বেলি ফুলের মতো পবিত্র সাদা একটা পোশাক পরে।

অস্তিত্ববাদী জাহিদ যুক্তিবিদ্যায় তার সমস্ত পার্থিব পারদর্শিতা দিয়েও বুঝতে পারলো না, শরীরের বাইরে থেকে সে ঠিক কিভাবে নিজের শরীরকে দেখতে পাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে কি চেতনা শরীরের বাইরে পা ফেলে? অজ্ঞান অবস্থায় কি মানুষের অস্তিত্ব ঝুলে থাকে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানের কোন ‘নো-ম্যান্স ল্যান্ড’-এ?

বিভিন্ন টিউব আর তারের জালে বন্দি জাহিদের শরীরটার ওপর একজন ডিউটি ডাক্তার ঝুকে কি যেন দেখছিলেন। ওর মাথার কাছের মনিটর দেখে কি একটা দেখে নিয়ে তিনি লিখতে শুরু করলেন তার হাতের সাদা চার্টটাতে।

জাহিদ তখন অনুভব করা শুরু করেছে যে, ওই শরীরটা আসলে জাহিদ না, ওটা শুধুই হাড়-মাংসের একটা পিন্ড – অন্য সব প্রাণীদেহের মতোই সাধারণ ছোট-খাটো দুর্বল একটা দেহ, যদিও ওটাকে মানুষ সাধারণত জাহিদ বলে ভুল করে থাকে।

সে আরো বোঝা শুরু করেছে যে – যদি জাহিদ বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব থেকেই থাকে, যদি সে একটা আস্ত বিভ্রম না হয়ে থাকে – তাহলে সত্যিকার জাহিদ আসলে এখানে একটা শূন্যতার ভেতর ঝুলে আছে, আর অন্য কোন আধ্যাত্মিক বাস্তবতা থেকে দেখতে পাচ্ছে নিজের ফেলে আসা শরীরকে – যেভাবে ময়লার ঝুড়িতে পুরোনো কাপড় ফেলে দেয়ার পর আমরা দেখতে পাই সেটার সমাপ্তিকে।

সত্তরের দশকের মতো খোঁপা করে রাখা চুলে বড়ো একটা কাটা ঢোকাতে ঢোকাতে প্রৌঢ়া নার্স বললেন – “আজ উনচল্লিশ দিন হলো, ডাক্তার সাহেব।”
ডাক্তার হতাশভাবে মাথা নাড়লেন – “রাহেলা, আপনি তো জানেনই – মাথায় আঘাত পেলে মানুষ সেন্সলেস হতে পারে, কোমায়ও চলে যেতে পারে।”
“হতে পারে, কিন্তু তাই বলে এতগুলো দিন ধরে?” – নার্স ভদ্রমহিলা ভুরু কুঁচকে বললেন।

জাহিদের সপ্তম ইন্দ্রিয় তখন তার চেতনার খুব গভীর থেকে কেউ তাকে জানিয়ে দিতে শুরু করেছে, জীবিত হতে হলে কোনোভাবে ওকে ওর ফেলে আসা ওই শরীরের ভেতর ঢুকে যেতে হবে।

এটা দর্শনের কোন জার্নাল হলে ওকে উপসংহারে লিখতে হতো – সৃষ্টি হিসেবে মানুষ একটা নিরেট বর্ণিল পাথরের মতোই মৃত, যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ জীবনকে তার ভেতর জায়গা করে নিতে দেয়। আর যে মানবদেহকে জীবনকে ফুঁকে দেয় মায়ের গর্ভের ভেতরে, সে দৃশ্যমান পৃথিবীর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে – আর এজন্য সেই মহাশক্তিমান কোনোভাবেই মৃত হতে পারে না।

নিজের অবস্থাটা বোঝার সাথে সাথে জাহিদের আত্মার ভেতরটা কেমন করে যেন পাহাড়ি হ্রদের মতো শান্ত হয়ে গেলো, সে কৃতজ্ঞ এক চেতনা নিয়ে তার পুরো চল্লিশ দিনের অপেক্ষা পূর্ণ করলো। তারপর এক অতিলৌকিক অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথে নিজের শরীরের দিকে উড়ে উড়ে এগুতে শুরু করলো সেভাবে, ঠিক যেভাবে পশ্চিমের মেঘ থেকে ঠান্ডা একটা বাতাস ভীষণ গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরকে জুড়িয়ে দেয়ার জন্য বয়ে বয়ে চলে।

পরিশিষ্ট

সিদ্ধেশ্বরী লেনের মনোয়ারা ক্লিনিকে গম্ভীর মুখে জন্ম নিলো এক শিশু। বাচ্চারা জন্মানোর পর কেঁদে ওঠে, কিন্তু সে কাঁদলো না। আফতাব সাহেবের ভ্রু জোড়া অনেকটা সময় ধরে ভীষণভাবে কুঁচকে রইলো। ডিউটি ডাক্তার তখন দৌড়ে এলো, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালো – শিশু সম্পূর্ণ সুস্থ আছে, বাচ্চারা জন্মানোর পর কেঁদে ওঠে ঠিকই, কিন্তু না কাঁদা অস্বাভাবিক কিছু না। আফতাব আহমেদ হাফ ছাড়লেন, স্ত্রী হালিমা খাতুনের সাথে পরামর্শ করে ছেলের নাম রাখলেন জাহিদ।

ক্লাস থ্রিতে থাকতে একদিন খাবার টেবিলে বাবার কাছে সে জানতে চাইলো মানুষ বানর থেকে এসেছে কিনা।

শুরু হলো অতিলৌকিক অভিজ্ঞতার পথে একজন নাস্তিক জাহিদের অদ্ভুত এক অভিযাত্রা।

Leave a comment