একটি আয়নার জন্ম ও মৃত্যু সমাচার

মতি মিয়া বুঝতে পারছিলো তার সময় শেষ হয়ে এসেছে।

ওস্তাদ শমসের আলীর কাছে সে যখন কালো জাদু শেখা শুরু করে, তখন থেকেই সে জানতো এর শেষটা ভালো হবে না। কিন্তু তার যেন কিছুই করার ছিল না, যেন তাকে এটা করতেই হতো।  এ যেন এক নেশা, তাই কিছুতেই এর থেকে তার মুক্তি নেই। অথবা সে যেন এক নাচের পুতুল, আর অন্য কেউ সুতো দিয়ে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাকে।

কফটা বেড়েই চলেছে। একেকবার মনে হচ্ছে কাশির সাথে ফুসফুসটা পুরোটাই বের হয়ে আসবে। শেষবারের মতো চোখ বন্ধ করার আগে আয়নাটা চোখে পড়লো মতির।

বেশ দামি এক আয়না, দেখেই বোঝা যায়। কালো কাঠের ফ্রেমে কি সুন্দর কারুকাজ করা ! আর গ্লাসটা যেন কাঁচ না, গোপন কোন পৃথিবীর গভীর এক দীঘির কাকচক্ষু নিটোল জলপৃষ্ঠ যেন ওটা।

ওস্তাদ শমসের তাকে আয়নাটা দিয়ে গিয়েছিলো পালিয়ে যাওয়ার আগের রাতে। দেয়ার সময় বলেছিলো – “মতি, তরে এইডা দিয়া গেলাম। স্পিশাল জিনিস, মনে রাখিস।”

“স্পিশাল জিনিস?”  

“হ। স্পিশাল জিনিস। এই আয়নার জান আছে।”

“জান আছে?” – মতি অবাক হয়েছিল। অনেক তন্ত্র-মন্ত্র শিখেছে সে ওস্তাদের কাছে, জাদু শেখার জন্য ভয়ঙ্কর জঘন্য সব কাজ করেছে সে জীবনে। কিন্তু এরকম আজব কথা আজ পর্যন্ত শোনে নি সে।

“সব কিছুরই জান আছে। আমরার যেই সাধনা, হের শেষ ঘাঁটি হইলো পাথ্থরের ভিতর থিকা জান টাইনা বাইর কইরা আনা। আমি পারলাম না, তুই পারবি।  তুই এলেমদার আসোত।”      

“সব কিছুরই জান আছে?” – মতির বিস্ময় যেন কাটে না। 

“আমাগো নবীর লগে ওহুদ পাহাড় কথা কইছিলো, জান না থাকলে পাহাড় কথা কইতে পারতো? তুই এইডা যত্ন কইরা রাখবি। মরার আগে তোর সাগরেদরে বুঝাইয়া দিয়া যাবি। পারবি না?”

মতি সেদিন অনিশ্চিতভাবে মাথা নেড়েছিলো। কিন্তু সে সাগরেদ জোগাড় করতে পারে নি। আজকালকার দিনে পোলাপান কষ্ট করতে চায় না, সাধনা তো দূরের কথা। সারাদিন এরা এক যন্ত্রের মধ্যে মাথা গুঁজে পড়ে থাকে, আর শুধু বড় বড় কথা বলে। আরে, অন্ধকার দুনিয়ার জ্ঞানও তো  একরকম বিজ্ঞানই – পরিশ্রম না করলে, ত্যাগ স্বীকার না করলে এর আদ্যোপান্ত তারা জানবে কি করে !

রুমন নামে বড়োলোকের এক ছেলেই শুধু কয়েকদিন মতি মিয়ার সাথে শক্ত করে লেগে ছিল। ছেলেটার সাহস ছিল, গোরস্থান থেকে কবর খুঁড়ে চুরি করে এনেছিল যক্ষা রোগে মারা যাওয়া এক মহিলার মাথা। সেটাতে তখন চামড়া আর চুল ছিল ঝুলে, দিব্যি ওই মাথায় চোলাই মদ ঢেলে ঢক ঢক করে খেয়ে নিলো ছোকরা।

এই নিষ্পাপ চেহারার রুমন ছেলেটাকে নিয়ে খুব আশাবাদী ছিল মতি, কিন্তু সেও টিকলো না বেশিদিন। যেদিন মতি জানতে পারলো, এক মেয়েছেলেকে বশ করার জন্য ছোকরা জাদু শিখছে, সাথে সাথে তাকে সে বের করে দেয়। নারীর নেশা যে ছাড়তে পারে নাই, সে কি সাধনা করবে?

শেষ নিশ্বাস ত্যাগের আগে কয়েক মুহূর্তের ভেতর সবগুলো দৃশ্য যেন সিনেমার দৃশ্যপটের মতো ভেসে উঠলো মতি মিয়ার চোখের সামনে।

আয়নাটা নিয়ে সে চেষ্টা কম করে নি। একজন কালো জাদুকর যা যা করতে পারে, তার সবই সে করেছ। কিন্তু আফসোস – না সে তার প্রেতসাধনার ফলাফল দেখে যেতে পারলো, না তার পরিশ্রমের ফসল কারো হাতে তুলে দিয়ে যেতে পারলো। 

ওস্তাদ বলেছিলো, এই সাধনার অগ্রগতির সাথে সাথে আয়নার ভাব বদলাবে।

যতদিন আয়নায় মতি তার নিজের চেহারা দেখতে পাবে, ততদিন তার বুঝতে হবে – তার কোন অগ্রগতি হয় নি, আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই সে রয়ে গেছে আধ্যাত্মিকতার অতি দরিদ্র ও নিম্নস্তরে।

যেদিন সে আয়নায় তার মৃত বাবা কিংবা মায়ের ছবি দেখতে পাবে, সেদিন সে বুঝতে পারবে যে তার ভেতর ভালোর দিকে আধ্যাত্মিক রূপান্তর শুরু হয়েছে। এটা তারই শুভ ইঙ্গিত।

আয়না যদি কোনোদিন তার সাথে কথা বলে উঠে, সেটা হবে খারাপ ইঙ্গিত – অর্থাৎ সে আধ্যাত্মিকতা ছেড়ে রওনা হয়েছে দুনিয়াবী এলেমের দিকে। সাধনার জন্য খুবই মন্দ ইঙ্গিত সেটা।

যদি সে কোনোদিন আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে না পায়, তাহলে বুঝতে পারবে – তার সাধনা পূর্ণ হয়েছে, সে সত্যের সেই স্তরে পৌঁছাতে পেরেছে যে স্তরে সচরাচর কেউ পৌঁছাতে পারে না।

মতি মিয়া চিরদিন আয়নায় নিজের চেহারায় দেখতে পেয়েছে। শত চেষ্টা স্বত্ত্বেও সাধনায় কোন উন্নতি করতে পারে নি। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙে প্রথমেই সে যে কাজ করেছে সেটা হলো আয়নায় উঁকি দিয়ে দেখা, আয়নায় নিজের চেহারার জায়গায় অন্য কিছু দেখা যায় কিনা। কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হয় নি। আর আজ তো তার জীবনের শেষ দিন।

মতি মিয়া চোখ বুজে ফেললো, সব ভুলে নিজের শরীরের দিকে মন দিতে চেষ্টা করলো। তার মৃত্যু শুরু হয়ে গেছে, পা থেকে মৃত্যুযন্ত্রণা অমোঘ নিয়তি হয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার বুকের দিকে।

আয়নাটা মতির খাটের পাশেই থাকে। সে সেটার দিকে শেষবারের মতো তাকালো বড় আশা নিয়ে, আর তখনি দেখলো সেই অদ্ভুত দৃশ্য।

মতি দেখলো তার পা থেকে কোমর পর্যন্ত আয়নায় দেখা যাচ্ছে না। তার শরীরের যে অংশটাকে মৃত্যু গ্রাস করেছে, ঠিক সেই অংশটাই আয়না থেকে উধাও হয়ে গেছে।

মুহূর্তের ভেতর পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেলো মতির কাছে। এই দুনিয়াতে মানুষের অস্তিত্ব একটা ভ্রম মাত্র। আর মৃত্যু হলো সেই ভ্রমের সমাপ্তি।

মতির কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো, এই আয়নাকে সে সারাজীবন ভুল বুঝেছে। এই আয়না আসলে সত্যকে তুলে ধরে। কেউ যদি এই দুনিয়ার জীবনকে আসল বলে বিশ্বাস করে, সেই বিশ্বাস অনুযায়ী সে আয়নাতে নিজেকে দেখতে পায়। অন্যদিকে প্রকৃত বিশ্বাসী আয়নায় নিজেকে অনুপস্থিত দেখে, কারণ সে একমাত্র খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে।

মতি মিয়া চিৎকার করে উঠতে চাইলো, নিজের ভুলের জন্য খোদার কাছে অনুতাপ করতে চাইলো, কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যদিও অনেকে বলে মৃত্যু কণ্ঠনালী পর্যন্ত না পৌঁছানো পর্যন্ত তওবার দরজা খোলা থাকে।

মতি মিয়ার চোখ বেয়ে অঝোরে নেমে এলো অশ্রু। তা মনে হচ্ছে কেউ যেন তার শরীরের মাংস আর চামড়া টেনে ছিলে নিচ্ছে। দম বন্ধ করে সে অপেক্ষা করতে লাগলো যন্ত্রনাটা বুক পর্যন্ত আসার জন্য। তারপরই তো সব শেষ হয়ে যাবে, যদিও সেই যন্ত্রণার রেশ তাকে তারা করে ফিরবে মৃত্যু-পরবর্তী পঞ্চাশ বছর।

আয়নাটা তখন যেন মতি মিয়ার দিকেই অপলক তাকিয়ে ছিল।    

আয়না।

পুরোনো প্রাচীন এক আয়না।

কারুকাজ করা কালো কাঠে বাধাই করা এই আয়না, কথা থেকে এসেছে কেউ নিশ্চিত না। 

স্মৃতি আর বিস্মৃতির একটা অদ্ভুত একটা চক্রের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো আয়নাটা, ছোট ছোট অসংখ্য জীবনকে অনুভব করতে পারছিলো সে – নিজের ভেতর।

কোন জীবনে সে এক যুবক, অফিসে যাওয়ার আগে চুল আচড়াচ্ছে।

আরো কোন এক জীবনে সে এক অষ্টাদশা কুমারী, ঠোঁটে লিপস্টিক মাখছে আর কি ভেবে যেন মিটি মিটি হাসছে। 

অন্য কোন জীবনে আবার সে এক বৃদ্ধা, নিজের বিগত যৌবনের কথা ভেবে যে হু হু করে কেঁদে ওঠে। 

আরো এক অদ্ভুত জীবনে সে হয়েছিল বাউল, জলসার প্রস্তুতির জন্য যে গাইছিলো রহস্যময় এক গান –

“কে কথা কয় রে, দেখা দেয় না;

নড়ে-চড়ে হাতের কাছে,

খুঁজলে জনম ভর মেলে না”

এরকম আরো কত জীবন! মিনিট খানেকের জীবন, তবুও কত মধুর এ বেঁচে থাকা, কত চাঞ্চল্যকর কিছু না কিছু একটা অনুভব করতে পারা !

প্রতিবার যখন এরকম একটা কিছু হয়, আর সে জীবন খুঁজে পায়, আয়না ভাবে – আমার ভেতর কে যেন নড়াচড়া করে ! আমি বোধহয় জীবিত তাহলে, এ কাঠ নিয়েই আমার শরীর; আর নড়াচড়া করছে যে জিনিসটা – ঐটাই আমার আত্মা।

কিন্তু ভেতরে নড়াচড়া করা জিনিসটা যেমন হঠাৎ করে আসে, তেমনি হঠাৎ করেই চলে যায়। ফলে রহস্যের সেই আয়না বার বার জীবিত হয়, তারপর আবার অতর্কিতেই বার বার আবার মরে যায়।

জীবন-মৃত্যুর অবিরাম এক চক্রের এই রহস্যটার পাঠোদ্ধার বেচারি আয়না কিছুতেই করে উঠতে পারে না।

Leave a comment