হাই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমি লক্ষ্য করেছি, মাঝে মাঝে আমার শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় অন্য কেউ। যখন এটা হয়, আমি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাই, তারপর অনেকক্ষণ পরে যখন আমার সম্বিৎ ফিরে আসে তখন দেখি যে আমি একটা কান্ড ঘটিয়ে বসে আছি যদিও ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, সেসময় জ্যৈষ্ঠ মাসের এক রাত্রে অতর্কিতে লোড শেডিং হয়েছিল। গরম লাগছিলো বলে বারান্দায় বসেছিলাম একা। হাওয়া ছিল খুব কম, তাই বেশ হাসফাস লাগছিলো।
আমি সেই সময়ের কথা বলছি, যখন ইন্টারনেট বলে কিছু ছিল না। রাত বারোটার আগেই বিটিভির অনুষ্ঠান সব শেষ হয়ে যেত, ফলের গভীর রাতের বিনোদন ছিল হয় ঘুম না হয় তোষকের নিচে লুকিয়ে রাখা উত্তেজক ম্যাগাজিন। যখন কারেন্ট এলো, তখন বেশিরভাগ লোক এমনিতেই ঘুমিয়ে পড়েছে, কারণ রাত তখন সাড়ে বারোটা হয়ে গেছে।
পাড়ার নিরানব্বই ভাগ জানালাই অন্ধকার ছিল বলে আমাদের দুইটা বাড়ি পরে তিনতলার যে ঘরে ডিমলাইট জ্বলছিল, সেটা আমার চোখে আঠার মতো আটকে গেলো। ঘরটার ভেতর আলো মৃদু হলেও দুজন মানুষের নড়া-চড়া আমার চোখ এড়াতে পারছিলো না। ছায়া দুটাকে ঘনিষ্ঠ হতে দেখে আমি মনের চোখে আন্দাজ করে নিতে সক্ষম হলাম, ওদের মধ্যে কোনটা নর আর কোনটা নারী।
সেই রাতের পর থেকে প্রতিদিন রাতে বারোটার পর কেউ আমাকে সম্মোহিতের মত নিয়ে যেত বারান্দার ওই কোনটায়। বিড়ালের মতো নিঃশব্দে একটা টুল টেনে বসে থাকতাম, রাত একটা – কখনো কখনো দেড়টা – পর্যন্ত। যদিও আর কোনোদিন ওই দৃশ্য আমি দেখতে পাইনি, তবু প্রতিরাতে রুটিন করে বারান্দায় গিয়ে বসতাম আমি। ওই শয্যা দেখার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় জানার পরও যে আমি ওখানে গিয়ে রাতের পর রাত বসে থাকতাম, এটাই প্রমান করে যে যুক্তি-বুদ্ধি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল না সে রাতগুলোতে, বরং সেই প্রহরগুলোতে আমাকে চালিয়ে নিচ্ছিলো আমার বাইরের তৃতীয় কোন স্বত্ত্বাই।
আমার বন্ধু আব্দুর রাজ্জাক মাদ্রাসায় পড়তো বলে তাকে আমরা – মানে সরকারি স্কুলের পোলাপান গুলা – আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন বলে মনে করতাম। আমাদের বন্ধুমহলের প্রত্যেকেই কখনো না কখনো রাজ্জাকের কাছে গোপন কিংবা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আলাদা করে আলাপ করে পরামর্শ নিয়েছে। এক বিকেলে সে যখন আসরের নামাজের পরে মাঠে এসেছে, তখন আমিও তাকে স্কুলের জামগাছের আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমার পাপকাজ নিয়ে। আমার বিশদ বর্ণনা তাকে অবাক করতে পেরেছে বলে মনে হলো না।
“এগুলি শয়তানের ওয়াসওয়াসা। মাগরেবের নামাজের পরে তুমি তিন-কুল পড়ে শরীর বন্ধ করে নিবা, তাহলে জীন আর তোমার শরীরে ভর করতে পারবে না।”
তাহলে ঐ রাতগুলোতে আমার শরীরের কন্ট্রোল নিয়ে নেয় জীন। নতুন এই তথ্য আবিষ্কারের পর আমার অপরাধবোধ কিছুটা কমলো। যাক, তাহলে ঐসব পাপকাজের জন্য আমি পুরোপুরি দায়ী না, শয়তান জীন আমার শরীরের দখল না নিয়ে নিলে আমার মতো ভালো ছেলে কোনোদিনই ঐসব গোপন জিনিস দেখার জন্য অস্থির হয়ে যেত না।
কিন্তু পরদিন সন্ধ্যায়ই মাগরেবের নামাজের পর কেন যেন আমি তিন-কুল পড়ে নিজের শরীর বন্ধ করতে ভুলে গেলাম। রাতে নিজেকে আবার আবিষ্কার করলাম সেই একই ভুল বারান্দায়। হাল ছেড়ে দিয়ে ভাবলাম, এর থেকে আমার আর কোন মুক্তি নেই, কেননা ওই শয়তান জীন আমাকে সূরা-কালাম পড়ার কথাও ভুলিয়ে দিচ্ছে।
এই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা সবসময় যে অবৈধ আনন্দেরই উৎস ছিল, তা কিন্তু না। ক্লাস এইটের সাথে যেদিন আন্ত:শ্রেণী ফুটবলের ফাইনাল খেলা হচ্ছিলো, আর আমরা এক গোলে পিছিয়ে ছিলাম প্রায় পুরোটা সময়, সাতাশি মিনিটের সময় আমার পায়ে বল এলো। আমরা তিনজন তখন ডি-বক্সে, কিন্তু ক্লাস এইটের বাঘা বাঘা সাতজন ডিফেন্ডার আমাদের গার্ড দিয়ে রেখেছে। আমার একমাত্র বিকল্প হলো গোলকিপারকে মারা, কিন্তু সে হাত-পা ছড়িয়ে এমনভাবে শরীরটা বড়ো করে ফেলেছে যে গোলপোস্টের কোন দিক আমি খোলা দেখছিলাম না। ঠিক ওই মুহূর্তে আমার ভেতর আবার ওই ঘটনাটা ঘটলো, আমার শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলো অন্য কেউ অন্য কোন পৃথিবী থেকে। আমার যখন সম্বিৎ ফিরলো, তখন দেখলাম বলটা প্রতিপক্ষ গোলকিপারের দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে ঢুকে গিয়ে ছুটতে ছুটতে আশ্রয় নিয়েছে জালে, আর আমার ক্লাস সেভেনের বন্ধুরা সব আমাকে জাপ্টে চেপে ধরে মেরে ফেলতে চাইছে।
সে ফাইনালে আমরা টাইব্রেকারে জিতেছিলাম, ট্রফি এসেছিলো ক্লাস সেভেনের ঘরে। কিন্তু আমি কাউকে বলিনি যে আমার ওই গোলটাতে আসলে আমার কোন কৃতিত্ব ছিল না, বরং একটা ঘোরের ভেতর কেউ একজন আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছিল ওই গোলটা।
ট্রফি জয়ের পরদিন দুপুরে বাজারে যাওয়ার পথে দেখা হলো রাজ্জাকের সাথে। তাকে বললাম যে, সেই জীন আমাকে আজকাল ভালো খেলোয়াড় হয়ে উঠতেও সাহায্য করছে। সে ঠিক সেই সময়ে আমার শরীরের ভার নিয়ে নিয়েছে, যে সময় আমাদের একটা ভুতুড়ে গোলের খুব দরকার ছিল।
এবারও তাকে খুব একটা অবাক হতে দেখলাম না। নির্বিকার কণ্ঠে বললো, জিনরাও ফুটবল খেলা দেখে, তাদের মধ্যে অনেকে সেটার ভীষণ ভক্তও বটে। সুতরাং অসম্ভব না যে আমার সাথের শয়তান জীন ফুটবলের কিছু টেকনিক আয়ত্ত্ব করেছে।
যখন কলেজে পড়ি, তখনও মাঝে-মধ্যে অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতাম আমি। তখন রহস্যগল্প পড়ার নেশা ছিল আমার, যেকোনো ধরণের থ্রিলার বা ফিকশন গোগ্রাসে গিলতাম – বাংলাদেশী নাকি ভারতীয়, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী না ভৌতিক, কিছুই বাছ-বিচার করতাম না। এভাবে পড়তে পড়তে একসময় মনে হলো, একইরকম গল্প বারেবার ঘুরে-ফিরে আসছে, একই ধরণের আইডিয়া চর্বিত-চর্বনের কারণে ক্লিশে হয়ে আসছে কাহিনীগুলো। কিন্তু আমার মনে তখন প্রবল তৃষ্ণা নতুন ধরণের রহস্যগল্প পড়ার, যদিও আমার নাগালের মধ্যের বা সংগ্রহের কোন বইই সেই তৃষ্ণা মেটাতে পারছিলো না।
সেরকম এক তৃষ্ণার্ত রাতে এক কান্ড হলো, মনে হলো আমি অস্পষ্ট একটা কাহিনী দেখতে পাচ্ছি মনের চোখে। স্বপ্নের মতো একটা অনুভূতি ছিল ওটা, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো মনের স্ক্রিনে আমি একটা মুভি দেখতে পাচ্ছি, যদিও সেই প্রজেক্টরটা চালাচ্ছে এক অদৃশ্য শক্তি। আমার মন বলছিলো, এখন আমরা একমাত্র কাজ হচ্ছে মনের ভেতর সেই সিনেমাটা দেখে যাওয়া আর যথাসম্ভব সুন্দর শব্দমালা দিয়ে ওটার বর্ণনাটা কোথাও লিখে ফেলা।
একটার পর একটা দৃশ্য খুব দ্রুত গতিতে আসছিলো বলে হাতের কাছে যে কাগজ পেয়েছিলাম, সেটাতেই লিখে ফেললাম আমার প্রথম গল্প। পরদিন সকালে গল্পটা পড়ে স্পষ্টই বুঝতে পারলাম, এটা আমার লেখা না, কারণ এভাবে আমি চিন্তাই করি না। তার মানে ঘোরের ভেতর আমাকে দিয়ে কেউ লিখিয়ে নিয়েছে এই কাহিনী, যদিও আমি জানি না কে সেই লেখক। রহস্যপত্রিকার মিনহাজ ভাই যখন বললেন, আমার এই গল্পটা প্রয়াত শেখ ফজলুল করিমের লেখার মতো হয়েছে, তখন আমার মনে সন্দেহ উঁকি দিয়ে গেলো – হয়তো তার আত্মাই সে রাতে আমার ওপর ভর করে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে করিম সাহেবের অসমাপ্ত কোন গল্পের প্লট।
আমার ওই গল্পটা রহস্যপত্রিকার এপ্রিল সংখ্যাতে (সাল: ১৯৯৮) ছাপা হয়েছিল। কিন্তু আমি কাউকে বলিনি যে ওটা আসলে আমার লিখা না। আমি আসলে নতুন লেখক হিসেবে অন্যদের মনোযোগকে ছোট করতে চাই নি একেবারে।
ততদিনে মাদ্রাসার বন্ধুদের সাথে সব যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। রাজ্জাককে এই সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার সুযোগ ছিল না। তবুও বুঝতে অসুবিধা হলো না, আমার ওপর শুধু সেই জীনের প্রভাব পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় নি। হতে পারে, সেই জীনই মৃত লেখকদের আত্মা থেকে তাদের অপ্রকাশিত প্লট নিয়ে এসে আমার মাধ্যমে প্রকাশ করা শুরু করেছে। এতে মৃত আত্মাদেরও লাভ, তাদের গল্পটা প্রকাশিত হলো। হয়তো তারা সেটার ক্রেডিট পেলো না, কিন্তু তাদের ভাবনাটা তো দুনিয়ার মানুষ জানতে পারলো। এক দিক দিয়ে চিন্তা করলে তাদের দিক থেকে এটা মন্দের ভালো।
আমার মনে পড়লো, আমার রাশি তুলা রাশি। হয়তো এটাও একটা কারণ যে অন্ধকার জগতের সেই বাসিন্দা কিংবা বাসিন্দারা আমাকে কখনোই পুরোপুরি ছেড়ে যাচ্ছে না।
আমার এই বিষয়টার কথা আমার আশে-পাশের বেশির ভাগ লোকই জানে না, তবে বিয়ের পর পর রোমান্টিকতার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় এক সন্ধ্যায় বলে ফেলেছিলাম শিউলিকে। সে অবশ্য হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলো আমার কথা, মজা করছি ভেবে বলেছিলো – আমার নাকি ডার্ক হিউমারের দক্ষতা ভালো।
কিন্তু এ ধরণের অপার্থিব নিয়ন্ত্রণ যে তার শিকারকে দিয়ে শুধু বিশেষ কিছু কাজই করিয়ে নেয় না, বরং কখনো কখনো কোন কোন কাজ থেকে বিরতও রাখে, তার প্রমান পেলাম আমি গত বছরের শেষের দিকে। হায় খোদা, এ প্রমান যদি কোনোদিন আমি না পেতাম! হায় খোদা, এই অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণের বৈশিষ্ট্যটা আমার যদি কোনোদিন না থাকতো আর আমি আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো হতাম! কেন সেটা হলো না? কেন আমার জীবনেই এই জিনিসটা ঘটতে হলো?
গত বছর ডিসেম্বর মাসে আমরা পদ্মা ব্রিজ দেখতে যাচ্ছিলাম। ট্রলারের মতো ছোট একটা নৌযান নিয়ে আমরা দুপুরবেলা বের হবো, তারপর বিকেলের দিকে পদ্মা ব্রিজের নিচ দিয়ে সেতু অতিক্রম করে আবার ফিরে আসবো উজানে আধা ঘন্টার ভেতর। আরও আটটা পরিবারের সাথে বোটে উঠেছি আমি, শিউলি, আর মাহিন। মাহিনের বয়স তখন তিন।
সবকিছু পরিকল্পনা মাফিকই এগুচ্ছিলো। কিন্তু পদ্মা ব্রিজের অবয়বটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আমরা সবাই কেমন যেন তন্ময় হয়ে গেলাম, অন্যমনস্ক হয়ে কেউ তুলতে শুরু করলাম ছবি, কেউ সেলফি, আর উত্তেজনার মধ্যে কেউই খেয়াল করলাম না যে মাহিনটা রেলিঙের খুব কাছে চলে গেছে।
রেলিংটা উঁচুই ছিল, কিন্তু মাহিন – হয়তো নদীর পানির স্পর্শ পাওয়ার আশায় দুই রেলিঙের মাঝখান দিয়ে মাথা বের করে দিয়েছে। আমার তখন উচিত ছিল ছুটে গিয়ে ওকে ধরে ফেলা, কিন্তু আমার কি কপাল – ওই মুহূর্তেই আমাকে আবার আক্রমণ করে বসলো আমার সেই অসুস্থতা। কিন্তু এবার সেটা আমাকে দিয়ে কোন অতিমানবীয় কর্ম করালো না, বরং সেটা আমাকে পাথরের মতো স্থির করে দিলো। আমার মনে হলো, সময় স্থির হয়ে গেছে, ফলে আমি আর কোনোদিন আমার জায়গা থেকে দৌড়ে গিয়ে মাহিনকে ধরতে পারবো না। আমার মনে হলো, সময় স্থির হয়ে গেছে, আর পুরো স্থিরচিত্রের মধ্যে মাহিনই একমাত্র প্রাণী যা স্বাধীনভাবে নড়া-চড়া করতে পারছে।
আমার বয়স পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে গেছে। জীবনে অনেক কিছু দেখেছি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিজ্ঞানের ওপর ভরসাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। সুতরাং এইবার কোন আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা না খুঁজে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ওই দুর্ঘটনার পর আমার সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধু আনোয়ার আশফাকের সাথে আমি বেশ কয়েকটা সেশন নিয়েছি। তাকে খুলে বলেছি সে বিকেলে আমার অপারগতার ভেতর আমার কোন দোষ ছিল না, বরং আমার শরীরকে ক্ষনিকের জন্য অকেজো করে দিয়েছিলো অদৃশ্য কোন তৃতীয় শক্তি। সে আমার কথা মন দিয়ে শুনেছে, তারপর খসখস করে প্রেস্ক্রিপশন প্যাডে কি যেন ওষুধের নাম লিখেছে।
শেষে যখন আমার সব কথা ফুরালো, বন্ধু আনোয়ার স্নেহভরা কণ্ঠে বললো – “ভাই, ভাগ্যে যা আছে, তা আমাদের মেনে নিতেই হবে।”
হঠাৎ মনে হলো আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। “আমি মানি না” – আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম – “ফাজলামি করো? এসব ভাগ্য-ফাগ্য আমি মানি না। নিশ্চয়ই কারো চেষ্টার ত্রুটি ছিল। হয় আমার চেষ্টার ত্রুটি – আমার অসুখটার কারণে আমি সময়মতো ছুটে যেতে পারি নি, না হলে শিউলির চেষ্টার ত্রুটি – নদীর মাঝখানে সে ঐটুক বাচ্চার হাত ছেড়ে দিয়েছিলো, নাহলে নৌকার কারিগরের ত্রুটি – সে রেলিং দেয়ার সময় বাচ্চাদের কথাটা চিন্তাই করেনি।”
আমার আচরণের বিপরীতে আনোয়ার কিন্তু মোটেও উত্তেজিত হলো না, তাকে মনে হলো মরা মানুষের মতোই অনুভূতিহীন। নিষ্প্রাণ চোখে আমার দিকে তাকালো সে – “তোমার জীবনের যে কোন পরিস্থিতি হলো তোমার ভাগ্য আর তোমার চেষ্টার গুণফলের সমান। ফলাফল শূন্য হওয়ার জন্য কপাল কিংবা কাজ যেকোন একটার শূন্য হওয়াই যথেষ্ট। এজন্য এসব ক্ষেত্রে নিজেকে দোষ দিয়ে কোন লাভ হয় না।”
তার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে আমার রাগ চক্রবৃদ্ধি হরে বাড়ছিল বলে খারাপ কিছু হওয়ার আগেই দ্রুত ওর চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম আমি, সোজা এসে নামলাম বেইলি রোডে খোলা আকাশের নিচে। বাইরে তখন টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
সে রাতে বিজ্ঞানের ওপর আমার আস্থা আবার কমে গেলো বলে পরেরদিন বিকেলে ঠিকানা খুঁজে হাজির হলাম বংশালের পীর সাহেবের কাছে। লোড শেডিং হয়েছিল বলে তার অন্ধকার ঘরে সেদিন মম জ্বালিয়ে দোআ-তাবিজ লেখার কাজ করছিলো তার সাগরেদেরা। আমি তার নূরানী চেহারা দেখে কেন যেন আমার চোখে পানি এসে গেলো। তিনি মাথা নিচু করে কি যেন জপ করছিলেন। আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বললাম – “হুজুর, যে জীন আমার পা দুইটা আটকে রাখলো, আমার মেয়েকে বাঁচানোর জন্য দৌড়ে যেতে দিলো না, তার হাত থেকে আমাকে বাঁচান।”
তিনি চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন, কিন্তু সেই চোখে আশ্বাসের কোন চিহ্নই আমি দেখতে পেলাম না। বরং মনে হলো আমাকে দেখে তিনি নিজেই ভীষণ চমকে উঠেছেন।
অনেকদিন কেউ যদি আপনার সাথে কাজ করে, তাহলে তার সাথে আপনার একটা টেলিপ্যাথিক সংযোগ হয়ে যায়। সে কিছু বলার আগেই আপনি বুঝে ফেলেন, আপনার সাথী ঠিক কি চাচ্ছে। উনার অস্বস্তিটা ঠিক সেভাবেই হয়তো তার সঙ্গীদের ভেতর সংক্রমিত হয়ে গেলো, ফলে তাদের মধ্যে সবচেয়ে মোটা-তাজা দু’জন তাৎক্ষণিকভাবে উঠে দাঁড়ালো। তারা দু’জন দু’পাশ থেকে আমাকে ধরে আমার অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও প্রায় জোর করে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো আমাকে।
ওদের মধ্যে সবুজ পাঞ্জাবি আর ময়লা সাদা পাগড়ি পরা যে ছিল, সে বললো যে – পীর সাহেব আমার চিকিৎসা করবেন না। কেন করবেন না, সেটাও বলা বারণ আছে পুরাতন কিতাব অনুযায়ী।
বংশালের হুজুর আমার চিকিৎসা না করলে আমার কিছু যায় আসে না। অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতামূলক এই আধুনিক বিশ্বে উনার চেয়ে অধিকতর আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন কাউকে খুঁজে বের করা আমার জন্য কোন ব্যাপার না। কিন্তু হুজুরের চেম্বারে আমি বার বার ফিরে যেতে লাগলাম জানার জন্য যে কেন তিনি আমার চিকিৎসা করবেন না।
রহস্যগল্প যেভাবে মানুষকে টানে, উত্তর জানার পরও যেভাবে মানুষ পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে যায় সস্তা নিউজপ্রিন্টে ছাপানো এসব পেপারব্যাক বইয়ের, সেভাবে বার বার আমি যেতে লাগলাম উনার অন্ধকার পৃথিবীতে, যদিও প্রতিবারই ব্যর্থ হতে লাগলাম। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র আমি নই, দুই সপ্তাহের মধ্যে সেটা প্রমান করে আমি বলতে গেলে তার গ্যালারিতে একজন নিয়মিত দর্শক হয়ে উঠলাম। আমি সহজে ছাড়বো না বলেই হয়তো একদিন তিনি আমাকে ভেতরে ডেকে পাঠালেন। সেদিন তিনি দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে ছিলেন। আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন – “ভাই, আপনার সমস্যা সমাধান করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনি আমাকে মাফ করবেন।”
“কিন্তু কেন, হুজুর?” – আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম।
“কারণ আপনার ওপর কোন জীন আসর করে নি। কিন্তু আপনি এগুলি বুঝবেন না। বুঝলেও বিশ্বাস করতে পারবেন না।”
“তবুও বলেন, প্লিজ। আমার মরহুমা মেয়েটার কথা চিন্তা করে বলেন, হুজুর।”
তিনি বড় করে শ্বাস নিলেন – “জনাব, আপনি আপনার যে শরীর দেখছেন, এইটা তো আসল শরীর না।”
“মানে?”
“আপনার-আমার আসল শরীরগুলি নড়ে-চড়ে বেড়াচ্ছে তৃতীয় আসমানে, যেদিন আমরা মারা যাবো সেদিন সেই শরীরে ফিরে যাবো আমরা।”
“কি যা তা বলছেন? আমার শরীরে ভর করেছে আমারই আরেক আত্মা?”
“ভর করে নাই, রিমোট কন্ট্রোলের মতো আপনার শরীর নিয়ন্ত্রণ করছে সে। আপনি কি জীবনেও একবার আপনার নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে দেখেন নি?”
আমি বুঝতে পারছিলাম না, উনি কি বলছেন। চকিতে মনে পড়ে গেলো, বেশ কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি, আয়নায় আমার ছবিটা যেন ঠিক সেভাবে আসছে না – কোথায় যেন একটা সমস্যা, যদিও সমস্যাটা ঠিক ধরতে পারছি না আমি। দ্বিধান্বিত হয়ে প্রায় ছুটে বেরিয়ে এলাম কবরের মতো দম বন্ধ হয়ে আসা ওই নোনাধরা সাদা চুনকাম করা বাসা থেকে।
বিকেলের রোদ পড়ে সিটি কর্পোরেশনের ইলেক্ট্রিসিটির খাম্বাগুলোর ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর দেখাচ্ছিল। ফুটপাত ধরে হেটে যেতে যেতে আড়চোখে খেয়াল রাখছিলাম দেয়ালের ওপর আমার কালো ছায়াটার দিকে। কিন্তু কেন যেন মনে হতে লাগলো, আমি যেন ছায়াটার হাঁটার গতির সাথে ঠিক তাল মেলাতে পারছি না – বার বার সে কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকছে। সব মিলিয়ে নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে শুরু করলাম আমি সেই শেষ বিকেলে।
সন্ধ্যানাগাদ বাসায় ঢুকে দ্রুত ছুটে গেলাম বাথরুমের বড় আয়নাটার সামনে। এটা এমন একটা বিষয়, শব্দমালা সাজিয়ে-গুছিয়ে যেটা ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন ও জটিল। তবে আমার মূল সন্দেহটা হলো, আয়নায় আমার ছায়াটা আমাকে ঠিক অনুসরণ করছে না, একটু যেন আগে আগে সে রিএক্ট করছে, কিন্তু ঠিক আমার সাথে সাথে করছে না।
ভিডিওতে জুড়ে দেয়া অডিওতে যখন সময়ের একটু হেরফের হয়ে যায়, তখন ঠোঁটের সাথে কথাগুলো যেমন মিলতে চায় না, দেখতে ভীষণ অস্বস্তি হয়, ভেতরে ভেতরে সেরকম একটা অনুভূতি হতে থাকে আমার।
আমার মাথা যখন চক্কর দিতে শুরু করেছে, আর আমার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে, তখন যেন দেখতে পেলাম আয়নায় আমার ছায়াটা হো হো করে হেসে উঠলো – আয়নার এপাশে আমি নিজে হেসে ওঠার কয়েক সেকেন্ড আগেই।
