কাঁঠাল

photo credit: google imageপ্রায় দুই দশক পর শফি বাংলাদেশে বেড়াতে গেছে।  বিদেশ থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে গেলে যা হয় –  প্রথম দেড় সপ্তাহ পেট খারাপ নিয়ে কাটিয়ে দেবার পর শরীরটা  যখন একটু চাঙ্গা হয়ে ওঠে , তখন শুরু হয় একটু এদিক – সেদিক ঘোরাঘুরি ।   শফি তাই আজ বিকালে একটু হাটতে  বেরিয়েছে। অনেক বছর কানাডায় থাকায় শফি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো রাস্তা ভর্তি মানুষ , কারন ছাড়াই গাড়ীগুলোর হর্ন বাজানো, ধুঁয়া আর ধুলা মাখা বাতাস -এসবের কথা। কারন শফি সব সময়ে ভালো স্মৃতি মনে রাখার চেষ্টা করে এবং জীবনের যতো নন্সেন্স -সেগুলো ভুলে থাকার চেষ্টা করে। তার বিস্বাস -ভালো স্মৃতি মানুষকে  ভালো পথে থাকতে সাহায্য করে, খারাপ স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকলে সারা জীবন ফ্রাস্ট্রেশন নিয়ে পার করে দিতে হবে; জীবনে  ফ্রাস্ট্রেশন বিলাসীতার  করার  সাধ্য বা ইচ্ছা – কোনটাই  তার নেই।

বাংলাদেশে ল্যান্ড করার পর থেকে কয়েকটা মজার জিনিস শফি লক্ষ্য করেছে। পথে -ঘাটে এমনকি নিজের বাসাতেও মানুষ প্রয়োজনের  তুলনায় অনেক উচ্চস্বরে কথা বলতে পছন্দ করে । আর মোবাইল ফোনে কথা বলা শুরু করলে স্বাধারনতঃ তৃতীয়  বা চতুর্থ  কথা হবে –“ ভাই, আপনি কোথায় ??”

সাইন্স ল্যাবের রাস্তা দিয়ে সে হাঁটছিল এবং লক্ষ্য করছিলো একই দৃশ্য । এত মানুষ ! সবাই হাটছে দ্রুত গতিতে… যেন কিছু একটা মিস হয়ে যাচ্ছে । কিন্তু একজন মানুষকেও  সে চেনে না। এবং তাকেও কেউ চেনে না।  অনেকটা -“Stranger in a strange land” এর মত ।অথচ মনে হয় এই তো  সেদিনও এই রাস্তা দিয়ে রিক্সা বা হেটে যাতায়াত করলে কেউ না কেউ নাম ধরে ডাকতো .. অথবা  সে নিজে ও তো ডেকেছে কতোজনকে। কিন্তু এখন এ কী অবস্থা! মনে হয় অন্য কোনও দেশে পড়ে এসেছে সে।

কিছু ভালো দিক লক্ষ্য করে শফির বেশ ভালো লাগলো. রাস্তায় আগের মতো ভিক্ষুক দেখা যাচ্ছে না।  আরেকটা দিক হোল – রাস্তায় এতো গাড়ী যে, কোন গাড়িই ২০ কি.মি. এর বেশী বেগে চলতে পারছে না একাধারে ৩ মিনিটের বেশী। গাড়ী গুলোর সাইজ অধিকাংশ সময়েই রাস্তার অনুপাতে অনেক বড়। শফি হাটছে আর ভাবছে -ইন্টারেস্টিং!, গত দুই দশকে সরকার ( বা সরকারগুলো) গাড়ির রাস্তা বাড়ায় নি কিন্তূ গাড়ির ব্যাবসা বাড়িয়ে দিয়েছে।  সে একটু  মজা পেল একটা তুলনা মাথায় আসায়। হিপহপ শিল্পী দের কথা তার মনে পড়লো। এরা সাধারনতঃ দেহের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থর তুলনায় অনেক বড় সাইজের জামা  পরতে পছন্দ করে। সভ্য সমাজ এদের নিয়ে হাসা হাসি করলেও এদের কিছু যায় আসে না। অকারনে হর্ন  বাজানোর সাথেও  হিপহপ কালচারটার অনেক মিল পাওয়া যায়। হিপহপ কম্যুনিটি সাধারণত যেখানে সেখানে অনেক জোরে ব্যাটারী চালিত টেপ রেকর্ডার / বা স্পীকার দিয়ে গান শুনতে এবং মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পছন্দ করে । তাদের মতের সাথে অমিল হলে বা কেউ এমনকী তাদের চোখে চোখ রাখলেও এরা ভীষণ ভাবে চটে উঠে, গালাগাল শুরু করে  এবং পারলে মারতে উদ্দ্যত হয়। রাস্তার গাড়ী চালক ভাইদের মধ্যেও সেই একই আচরন দেখতে পেরে শফির বেশ মজা লাগছে। বাংলাদেশটা হিপহপ কান্ট্রিতে পরিনত হয়ে গেছে!

নিউ মার্কেট এর বইয়ের দোকান গুলোর সামনে এসে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়লো শফি। কোনায় একটা সিডি র  দোকান ছিল এবং এখনো আছে দেখে সে এগিয়ে চলল দোকানের দিকে – হয়তো পুরানো মালিক কে পাওয়া যাবে(নাম মনে নেই তার, চেহারা মনে আছে)। কিন্তু সেখানেও সব অপরিচিত মানুষ। এবং দেখা গেল হিন্দী গানের সিডি দিয়েই শোকেস  গুলো ভরা।  শফির মনে আছে,  ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই দোকান থেকেই সে আজম খানের সব এল্বাম কিনেছিল।

শফি এবার মনে মনে ঠিক করলো বাসায় ফিরে যাবে। আবার হাটা শুরু হোল। এবার ঢাকা কলেজের ফুটপাথ ধরে হাঁটা । রাস্তার ওপাড় হলেও দৃশ্যাবলীর কোনও পরিবরতন হোল না। সে যখন ধানমন্ডী পুলিশ ফাড়ির সামনে এসে রাস্তা পার হবার অপেক্ষা করছিলো- এমন সময়ে কে একজন “শফী ভাই” বলে পেছন থেকে ডাক দিল।

শফি তাকিয়েই চিনতে পারলো মানুষটা কে। নাম তার মনু। মনু শফীর ছোট বেলার খেলার বন্ধু- শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত মতিঝিল কলোনীর বন্ধু। ভালো ফুটবল খেলত সে। কিন্তু একটু বদ মেজাজী ছিল বলে কেঊ তাকে পছন্দ করতো না। শফী নিজেও তাকে পছন্দ করতো না। বিশেষ করে কলেজে ওঠার পরে  সে হেরোঈন আসক্ত হয়ে পড়েছিলো। তারপর আবশ্য শফির বাবার চকুরীতে বদলী হবার কারনে শফিদের চলে যেতে হয়েছিলো ধানমন্ডীতে ; এরপর  থেকে তার সাথে খুব একটা যোগাযোগ ছিলো না শফির। তবে সে শুনেছে -মনু একজন ধান্ধাবাজ টাইপের মানুষ।

যা হউক দেখা হয়ে যাওয়ায় মুহূর্তেই অতীতের সব মনে পড়ে গেল শফির। শফি লক্ষ্য করতে থাকলো মনুর মুখভঙ্গী এবং চোখের নড়ন চড়ন। শফি পেশাগত কারনে  ধান্ধাবাজ মানুষের কিছু জেনারেল ট্রেইট সম্পর্কে ট্রেনিং নিয়েছিল। মনুর মুখে চাপা দাঁড়ি। চোখে সম্ভবত সুরমা দিয়েছে। পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল , একটা জীন্স এবং একটা নীল রঙের হাফ শার্ট পরা। খুব একটা ধীরতা তার নাড়া চড়ার মধ্যে- যেন চার্চের পুরোহিত অথবা, বাংলাদেশী পীর -ফকীর।

ধান্ধাবাজ মানুষ মিথ্যা কথা বলার সময় চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না, মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে কথা বলে। কথায় কথায় তারা বলবে –“সত্য কথা বলতে কী… “ ইত্যাদি।

মনুর সাথে তার কথা শুরু হোল – খুবই উৎসাহী আর  উদ্দীপনায় ভরা মনে হোল মনুকে কথা বার্তার সময়ে।

মনুঃ আরে ভাইয়া! আপনি ?? কোথায় ছিলেন এতদিন ?

শফিঃ ভালো আছি ভাই। আমি তো অনেক দিন পরে বাংলাদেশে আসলাম… সব কেমন অচেনা  লাগতেসে। এটলিস্ট একজন চেনা মানুষ পাওয়া গেল।। তা তুমি আমাকে আপনি করে কথা বলতেস ক্যান … সমস্যা কী? আর এখানে যাও কই ??

মনু তার চেহারাটা হঠাত করেই খুব মন মরা টাইপ বানিয়ে ফেলল। ঊদ্দীপনা নিমিষেই মিলিয়ে গেলো তার মুখ থেকে। এবার সে মিন মিন করে বলে চলল-

“ ভাই, কী আর বলবো-  আসছিলাম আমার একমাত্র ছেলেটার জন্য একটা কাঠাল কিনতে। তা কাঠালের যা দাম! “ বলে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল মনু।

শফিঃ তোমার ছেলের বয়স কতো? একটাই ছেলে-মেয়ে ?

মনুঃ হ্যাঁ ভাই, একটাই, ১৩ বছর বয়স। একটারেই তো তিন বেলা খাওাইতে পারি না রে ভাই… তবে ছেলেটা আমার ভীষণ ভক্ত। সারাদিন বাবা বাবা করে। আর তার ফুপুর ভক্ত। বাবা আর ফুপু …

শফিঃ সারাদিন বাবা বাবা করে মানে কি? সে স্কুলে যায় না? আর তুমি কাজে যাও না ??

মনু যেন ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। সে এবার কান্নার সুরে সুরে বলতে শুরু করলোঃ

“ ভাই আমার কোনও কাজ নাই! কভীড-১৯ এর কারনে চাকুরী গেছে। হাতে কোনো পয়সা নাই … এর মধ্যে ছেলেটা আবদার করলো- কাঠাল খাবো। আমার কাছে সত্যি কথা বলতে কী জাস্ট ৩০ টা টাকা আছে। সেটা দিয়া ভাবছি কাঠাল কিনবো। কাঠালের যা দাম – তাতে একটা কিনলে হাতে আর কোনও টাকা থাকবে না। …”

শফি তাকে থামিয়ে বলল -তোমার ছেলেটা তো বেশ অদ্ভুত! এই বয়সের বাচ্চারা সাধারনতঃ কাঁঠাল পছন্দ করে না!

মনু সে প্রসঙ্গে না গিয়ে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে থাকলো তার টাকার সমস্যার কথা। শফি কিন্তু বুঝতে পারছে মনু এখানে ধান্ধা করার চেষ্টা করছে। তা না হলে এতো বছর পর দেখা হওয়ার পর মানুষ অন্য আলাপ করবে এটাই স্বাভাবিক। টাকা টাকা করার কথা  তো না… দারীদ্রের কথা বলার কথা না… আত্মসম্মান বলে একটা জিনিস থাকার কথা। কিন্তু শফি আবার এটাও ভাবল -ওর ছেলেটা হয় তো আসলেই কাঁঠাল প্রেমিক। মনু হয় তো আসলেই আর্থিক সমস্যায় পড়ে আছে। বাইবেল এর একটা লাইন মনে পড়ে গেল তার-“..who am I to judge?..”

শফি মনুর ছেলেটার কথা ভেবে পকেট থেকে চার হাজার টাকা বের করে মনুকে দিয়ে বলল-

“মনু, এই টাকাটা রাখো, ছেলের জন্য কাঁঠাল কিনে বাসায় যাও; চাকুরীর চেষ্টা চালাইয়া যাও।। কিছু একটা পেয়ে যাবা”

শফি লক্ষ্য করলো মনু যেন টাকাটার অপেক্ষাতেই ছিলো। তার মধ্যে কোনও দ্বিধা দেখা গেলো না টাকাটা নেয়ার সময়। মনু বলল –

“ ভাই, এইটা একটা আল্লাহর দেখানো মীরাকল। তা না হইলে আজকে আপনার সাথে দেখা হয় ?!! আমি টাকাটা নিতাম না ; খালি ছেলেটার জন্য নিলাম। আমি আমার বউ আসমা আর ছেলেকে সব সময়ে  বলি -আমার হয় তো ধন নাই, কিন্তু আমার আছে মন…”

শফি একটু মুচকি হেসে তাকে থামিয়ে বলল –

“ তোমার যে ধন নাই সেটা তো ভাই জানতাম না! অন্য লোক জন এই খবর জানে??”

মনু কে আর কথা বাড়াবার সুযোগ না দিয়ে “দেখা হবে” বলে শফি আবার হাঁটা শুরু করলো। সে হাটছে আর কাঠালের কথা ভাবছে – কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। আবার সে মনুর কথা ভাবছে- মনু কতটা ধান্ধাবাজ কিন্তু বোকা- সে কী আসলেই বোকা না কী শফি নিজেই বোকা? মনুর কথার মায়াজালে পড়ে কতগুলা টাকা খসে ফেলল!

শফি মনে মনে হাসতে  লাগলো -মনু যদি আসলেই ধান্ধাবাজ হয়ে থাকে এবং তার দেয়া টাকায় সে বাসায় কাঁঠালটা কিনে নিয়ে যায় – তাহলে সেটা হবে পারফেক্ট উদাহরন –“অন্যের ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়ার” । কিন্তু  হঠাত করে তার মন একটু খারাপও হোল – মানুষগুলো এমন হচ্ছে কেন? বাসার প্রায় কাছে চলে এসেছে শফি… হঠাত মনে হোল – যে দেশের জাতীয় ফল খেতে প্রথমে হাতে তেল মাখতে হয় -সে জাতির আর আশা কী!!

-সৈয়দ কল্লোল(২০২০)

One thought on “কাঁঠাল

Leave a reply to সৈয়দ কল্লোল Cancel reply