###পথের খোঁজে##০৩#

##০৩##

ট্যাক্সি র‍্যাঙ্কে অপেক্ষা করছে শামসু। ব্রিসবেন শহরের খুব কাছেই  হ্যামিল্টনে থাকে সে। ১১ বছর হয়ে গেছে সে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। প্রথমে সে মেলবোর্ন এসেছিলো আই টী পড়তে। প্রথম সিমেস্টার শেষ হওয়ার পর সে ট্যক্সি চালানো শুরু করেছিল। সেটা ছিল মেলবোর্ন    কমনওয়েলথ গেমস এর বছর। ট্যাক্সি চালিয়ে ২ সপ্তাহে সে অনেক অর্থ আয় করেছিল। হঠাত তার মাথায় চিন্তা এলো – টাকার জন্যই তো বিদেশে আসা। শুধু শুধু ইউনিভার্সিটিকে এতগুলো টাকা দিতে যাব কেন? সেই দিন থেকে টাকা কামানোই তার বেচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্যে পরিনত হয়েছিল। কিন্তু ভিসা টিকিয়ে রাখতে হলে তো ভার্সিটি ছাড়া যাবে না। এখন উপায় কী ? চেষ্টা থাকলে মানুষ পারে না -এমন জিনিস নেই। শামসুর সামনে একটা পথ হাজির হয়েও গেলো।

কোলকাতার এক গরীব মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল ইন্ডীয়ান এক স্টুডেন্ট ইমিগ্রেশন এজেন্ট- নীল। মেয়েটির নাম সেঁতা । সেঁতা অস্ট্রোলিয়ায় এসেছে কুকারী পড়ার জন্য। তার মাত্র ০২ সিমেস্টার বাকী। এরই মধ্যে বাবা মারা যাওয়ায় টিউশন ফী পে করা সম্ভব হচ্ছিল না তার। কিন্তু দেশে ফেরাও সম্ভব নয়- তার গরীব পরিবার তাকে আজীবন এমন খোঁটা দিতে থাকবে যে আত্মহত্যা ছাড়া কোনও পথ থাকবে না । এই খোঁটা গুলো মুলত আসবে অতি প্রিয় মামা -খালাদের কাছ থেকে ।

যা হোক, নীল শামসুকে একটা অফার দিয়েছে। সেটা এরকম- শামসু আর সেঁতা বিয়ে করবে। শামসু আপ্পলাই করবে স্পাউস ভিসা -সেটা পেয়ে গেলে – সে সারাদিন ট্যাক্সি চালাতে পারবে। সেঁতা তার কুকারী কোর্স শেষ করার পর -পার্মানেন্ট রেসিডেন্সীর জন্য আবেদন করবে দু জনের জন্য। এভাবে দু জনেরই উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে । কিছু দুই নম্বরী অবশ্য করতে হবে দু জনকেই যদি তারা স্বামী স্ত্রী হিসেবে একই বাসায় না থাকতে চায়। যেমন -ইঊটিলিটি বিল এ দু জনের একই ঠিকানা ব্যবহার করা, ব্যাঙ্ক এ একটা জয়েন্ট আকাউন্ট খোলা ইত্যাদি। শামসু চাইলেও সেঁতা একসাথে থাকতে রাজী হয় নি – সেঁতা খুবই প্রফেশনাল। সেঁতার টিউশন ফী অনেক অনেক কম -শামসু হিসেব করে দেখেছে- দুই মাসেই সে দুই সিমেস্টার এর টাকা সেঁতাকে দিয়ে দিতে পারবে। নীল সাহেবের ফী ও । সে ভেবে দেখেছে -এটা সবার জন্যই হবে গুড ডীল।

-প্রায় দেড় বছরের মধ্যে তাদের পার্মানেন্ট রেসিডেন্সী হয়ে গেলো। এর একসপ্তাহের মধ্যে ডিভোর্স । পরের ৩ বছরের মধ্যে সিটিজেনশীপ। সেঁতা এখন কোথায় – কী করে – কিছুই জানে না শামসু। তার মনে আছে -নর্থগেট এ একটা রাস্তার নাম- সেপারেশন স্ট্রীট; সেখানে শেষ বারের মতো তাদের সাথে দেখা হয়েছিলো।

স্যাম প্রতিদিন ট্যাক্সী চালায় ১২ ঘন্টা। ট্যাক্সী ইন্ডাস্ট্রি টা ভারতীয়রা নিয়ন্ত্রন করে সারা বিশ্বেই- সেটা সে জানে। ভারতীয় ড্রাইভারদের হাতে সব সময় একটা লোহার/পিতলের বালা থাকে। তাদের কান ফোঁড়ানো থাকে এবং অধিকাংশদেরই চুল কালার করা থাকে – সাধারনতঃ এরা সোনালী রঙ ব্যবহার করে । শামসু ঠিক তাই করলো । এখনও শামসুর চুল সোনালী , বাঁ কানেএকটা সোনার মোটরের দুল, হাতে বিভিন্ন ধরনের বালা। শামসু এখন স্যাম হয়ে গেছে। স্যাম নামে সে নিজেকে পরিচয় দেয় সবাই কে। বিয়ে করে নি। একটা ভিয়েতনামি গার্ল ফ্রেন্ড হয়েছে তার ; একসাথে থাকে তারা প্রায় দু বছর হয়েছে। কিন্তু এখনো কেনো যানি সেপারেশন স্ট্রীট দিয়ে যাতায়াত করতে হলে তার মনটা একটু খারাপ হয়, সেঁতার কথা মনে পড়ে।

কিছুক্ষন পরে এক বাঙ্গালী চেহারার লোক তার ট্যাক্সি তে চড়লো। বাঙ্গালী সে বুঝতে পারে, কারন সে তার অভিজ্ঞতায় শিখেছে -বাংলাদেশী বাঙ্গালীরা সাধারনতঃ খাটো হয়, চুল কাটে সবচেয়ে সস্তা সেলুনে- কোনও স্টাইল থাকে না। ভুড়ী থাকে বয়স ও শরীরের সাধারন গড়নের সাথে সামঞ্জস্য ছাড়া। এদের মধ্যে দাঁড়ী রাখার একটা প্রবনতা লক্ষ্য করা যায় , এরা সাধারনতঃ দেখতে শ্যাম বর্ণের, এবং টাক্সী ব্যবহার করে খুবই কম। স্যাম(শামসু) দেশী যাত্রী পেলে দরকারের চেয়ে একটু বেশী কথা বলতে পছন্দ করে। সেটা হয়তো বা স্বাভাবিক ; বিশেষ করে স্ত্রী বা গার্ল ফ্রেন্ড – যার সাথে রাত্রী যাপন- তার সঙ্গে দেশী ভাষায় মত বিনিময় না করতে পারাটা ভীষণ দুঃখজনক । কম বয়স্ক যাত্রী পেলে উপদেশ দিতে পছন্দ করে- উপদেশ বলতে নিজের আইডিয়া চাপিয়ে দেয়ার প্রচেস্টা। হাতে বালা, কানে দুল, সোনালি চুল এবং শামসু থেকে স্যাম হয়ে গেলেও অযাচিত উপদেশ দেয়ার বাংলাদেশী অভ্যাসটা তার এখনো আছে।

ট্যাক্সি চলতে চলতে বেশ কিছু আলাপ হয়ে গেছে। স্যামই বলেছে অধিকাংশ কথা। যে ভদ্রলোক গাড়িতে উঠেছেন তিনি আসলেই বাংলাদেশী। নাম তার মনির। গাড়ি ওয়ার্কশপে দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। পেশায় একজন ফাইনানসিয়াল এনালিস্ট। স্যাম জিজ্ঞেস করেছে বলেই মনির এসব বলেছে তাকে। সে খুব একটা বেশী কথা বলার লোক মনে হোলনা স্যামের কাছে। কিন্তু স্যাম তো কম কথা বলার লোক নয়। সুতরাং সে বলেই চলল –

স্যামঃ ভাই, গত দশ বছর যাবত আমার গাড়ির সব কাজ আমি নিজের হাতেই করি। গাড়ি ওয়ার্কশপে দেই না। ওরা খালি তেল চেঞ্জ করা ছাড়া আর কিছুই তো করে না। এই কাজ করতে অদের টাকা দিমু ক্যান? নিজেরটা নিজেই কইরা ফালাই। অনেক টাকা সেভ হয়…। আরো অনেক কিছু সে বলেই যাচ্ছে যার মূল হচ্ছে কী করে টাকা সেভ করতে হয়। কিছু মানুষ আছে যারা মাঝে মধ্যে ভালো রেস্টুরেন্ট এ ডিনার করতে যায় -স্যাম এর মতে এরা আস্ত গাধা ছাড়া আর কিছুই না । একবেলা বাইরে খাওয়ার টাকা দিয়ে যে পরিমান বাজার করা যায়, সেটা দিয়ে তিন দিন খাওয়া যায়…

গাড়ী মনিরের বাসায় চলে এসেছে। স্যাম মিটার দেখছে ভাড়া কতো হোল সেটা দেখার জন্য। কিন্তু মুখ তার থেমে নেই। সে জিজ্ঞেস করলো – ভাইয়ের বাড়ীটা তো বেশ! নিজের বাড়ী না ভাড়া ?

মনির এবার তাকে থামিয়ে দিয়ে ভাড়া দিতে দিতে বলল – স্যাম সাহেব, আমি ইচ্ছা করলে আমার বউকে কল করতে পারতাম আমাকে বাসায় নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু আমি টাক্সি নিয়ে আসলাম। ধরেন, সবাই যদি আপনার মতো টাকা সেভ করা শুরু করে, সব কাজ নিজেই করা শুরু করে, নিজেই সব সময় ড্রাইভ করা শুরু করে- তাহলে আপনার ট্যাক্সি ব্যাবসার কী হোত? আপনি কিন্তু বেকার হয়ে পড়তেন, তাই না? সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে দিন চালাতে হোত। আসলে কি জানেন- জীবনটা খালি নেয়ার জন্য নয়- সমাজকে কিছু দিতেও হয়। সবাই মিলে আগাতে হয়। ভালো থাকবেন।

স্যাম তার গাড়ী নিয়ে নিকটস্থ ট্যাক্সি রাঙ্কে গিয়ে বসে রইলো পরের খ্যাপের অপেক্ষায়। রাস্তার ইল্টো পাশের কাবাব এর দোকান থেকে একটা বড় কাবাব রোল-যাকে এরা সুভলাকি বলে, নিয়ে সে গাড়ীর ভেতরে বসে খেতে থাকলো। সুভলাকি তে প্রচুর কাচা পিঁয়াজ আর টক দই দেয়া হয়ে থাকে বলে গাড়ীতে একটা বীভৎস গন্ধ তৈরী হয়। একটা অজানা কারনে অধিকাংশ ট্যাক্সি ড্রাইভাররা সেটা বুঝতে পারেন না । স্যাম সাহেব ও না। সে এক মনে সুভলাকিটা খেয়ে চল্লো।

মনির সাহেব গাড়ী থেকে নেমে তার ঘরে ঢুকে পড়লেন। স্যাম সাহেবকে সে ১০ ডলার টিপস দিয়েছে- এটা অবশ্য অস্ট্রেলিয়ানদের প্রথা না- কিন্তু মনির সব সময়ই টিপস দিতে পছন্দ করে- সেটা ট্যাক্সি হোক বা রেস্টুরেন্ট এবং সে কখনো ১০ ডলারের নীচে টিপস দিতে পারে না; তার লজ্জা হয়। মনির ঘরে ঢুকে সোজা গোসল করতে চলে গেল। সে আসলে বিবাহিত নয়। স্যামকে বলার জন্যই সে বউ এর কথা বলেছে। হট ওয়াটার ছেড়ে দিতে গিয়ে তার মনে হোল মিশার কথা। অনেক দিন ওর সাথে কথা হয় নি। একটু সময় করে ফোন দিতে হবে ওকে।

চলবে…

পরের পর্বঃ ২৩/০৮/২০২০

One thought on “###পথের খোঁজে##০৩#

Leave a reply to সৈয়দ কল্লোল Cancel reply