
জানার আগ্রহ সবারই থাকে। কম বা বেশি। মাঝে মাঝে মনে হয়, জানার আগ্রহই যেন মানুষের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য। জানতে হলে দেখতে হয়, শুনতে হয়, চাখতে হয়, স্পর্শ করতে হয় কিম্বা গন্ধ নিতে হয়। এসব কিছুর পর জানা চলে যায় আরও একটু গভীরে, মনের ভেতরে। মন কি, এটা একমাত্র মন দিয়েই উপলব্ধি করা যায়, তাও আবার যার মন শুধুমাত্র সেই পারে উপলব্ধি করতে। একই বিষয়ে মনের কাছে একের পর এক তথ্য আসতে থাকে শরীরের মাধ্যমে, সময়ের সাথে। মনে গেঁথে যায় এগুলো, ঠিক অনেকটা মালার মত।
মনের ভেতরের মালাও কিন্তু থেমে থাকে না। এক পর্যায়ে একেকটা মালা একেকটা পুঁথি হয়ে নতুন কোন মালার গাঁথুনির অংশ হয়। বাড়তে থাকে মালা, স্তরে স্তরে হতে থাকে দীর্ঘতর। একেকজন মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত জগত অর্থাৎ মনের ভেতরে তৈরি হয় এমনি সুন্দর, অসম্ভব স্বকীয় আর জটিল অজস্র মালা। এই মালা শুধু তারই জন্য, কোন ভাবেই অন্য কারো নয়। তারপরও মানুষ এই মালা অন্যের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে চায়, আজীবন। যার সাথে করে সেও এই মালাকে আপন করে পেতে চায়। পরিবর্তন পরিবর্ধন করতে চায়। বিপত্তিটা বাধে তখন, প্রায় সব সময়ই।
কার মালা কে চেনে, কেই বা গাঁথে ! ভয়ংকর কঠিন এই চর্চা। যে সম্পর্ক চার মাসের, তাতে থাকে কিছু ভাগাভাগি বা শেয়ারিং। চার বছরের মাথায় তা বেড়ে হয় গলাগলি, অর্থাৎ একের গলে অন্যের মালা; মিলে মিশে একাকার। কিন্তু সম্পর্ক যখন ১৬ বছরে গড়ায় তখন যে যার মালা নিয়েই হয়তো খুশি থাকতে চেষ্টা করে, বুঝতে পারে অতিরিক্ত মেশামেশিতে গিঁট লেগে যাবে, ছিড়ে পড়তে পারে, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ সব পুঁথি হারাতেও পারে। সম্পর্কের বয়স যখন ২৬ বছরে পৌঁছে, একে অন্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতে শুরু করে, তবে একটু দূর থেকে; ভাবে, কি সুন্দরই না লাগছে যার যার মালা গলায়। মালা ভাগাভাগির চিন্তা অনেক সময় থাকেনা বললেই চলে।
হয়তো সম্পর্কের বয়স ৪০ বছর হলে নতুন এক গাঁথুনির শুরু হয়। অসম্ভব সুন্দর আর শৈল্পিক এই গাঁথুনি, জটিল তো বটেই। হয়তো প্রথম বারের মত ভিন্ন ভিন্ন জগতের মালাগুলো মিলে তৈরি করতে থাকে নতুন আরেক মালা। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক আবার স্বকীয়। ধীরে ধীরে প্রকৃতিক মন আর মানুষ উপলব্ধি করে অতিপ্রকৃতি। এখানে শুধু সুন্দর আর সুন্দর। এর শেষ নেই যেন। অজানার দিকে এগিয়ে যায় মালার গাঁথুনি। দেখে, শুনে, চেখে, স্পর্শ করে বা গন্ধ নিয়ে যেন কিছুতেই সেই অজানাকে দেখা যায় না। মনের ভেতরের এই মালা নিজের কাছেও হয়ে ওঠে অচেনা। মন বড়জোর এর উপস্থিতি অনুভব করতে পারে, আর উপভোগ করে এর শান্তি।
কেন গড়ে উঠে এসব? কিভাবেই বা তা সম্ভব? কিভাবে একাধিক ভিন্নতা নতুন করে কোন প্রকৃতি গড়ে তোলে, তাও আবার প্রাকৃতিকভাবে? কেনইবা ভিন্নতা গুলো একে অন্যকে খুঁজে পায়? অনেক প্রশ্ন। তাও আবার প্রত্যেক মানুষের জন্য এদের জবাব ভিন্ন ভিন্ন। তবু আমরা জবাব খুঁজি, জবাব দেই, জানতে চাই। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখনই জবাবে অমিল হয়, কিম্বা দেখা দেয় কোন ভিন্নমত, বেমালুম ভুলে যাই আমাদের এসব জটিল মালা আর তাদের মারাত্মক স্বকীয়তা। টেনে টুনে ছিঁড়ে হলেও বসাতে চাই নিজের গলায়। শেষমেশ ধুলায় ছড়িয়ে থাকা গোটা কয়েক পুঁথি ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়না।
তাহলে প্রশ্ন আসে, একে অন্যের সাথে মিশে কি যেতে পারে না মানুষ? হয়ত পারে, তবে তা হতে হবে অন্যের স্বকীয়তাকে মেনে নিয়ে, পারলে উপভোগ করে। আপাত দৃষ্টিতে এরকম চিন্তা নিঃসঙ্গ জীবনের বীজ মনে হলেও, মূলত মানুষ তখনই নিঃসঙ্গ হতে শুরু করে যখন তার কাছে স্বকীয়তা মেনে নেয়াটা কঠিন মনে হয়। নিয়মনীতির খোলস ধরে অনেক সময়ই এ ঘাটতি দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকে কারো কারো মধ্যে। ঠিক যেন মরিচার খোলস। দারুণ গতিতে বেড়ে চলে। কখনো কখনো একে ভীষণ কার্যকরী এক স্তর বলেও মনে হয়। তত দিন, যত দিন খেয়ে ফেলার জন্য সামান্য লোহাও অবশিষ্ট থাকে। যখন সব শেষে ভেঙ্গে পড়ে, তখন বাচানোর মত আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
সহজ শিল্প গড়ে উঠতে পারে একই মাপে গড়া উপাদানে। কিন্তু খুব উঁচুমানের শিল্পের খাতিরে অনেক সময় প্রয়োজন পড়ে পরস্পর সহনশীল অসামঞ্জস্য। ঠিক যেমন মহাকাশের চাঁদ ,তারা, সূর্য। শুধু একে অন্যের প্রাকৃতিক ভিন্নতাকেই তারা উপভোগ করেনা, জায়গা করে দেয় কৃত্রিম উপগ্রহকেও। কি বিশাল সেই অসাধারণ সৌন্দর্য। ঠিক যেন একই মনের ভেতর হাজারো ভাবনা, ভিন্ন ভিন্ন, অথচ মালা গেঁথে চলেছে স্তরে স্তরে।

বিবাহ বিষয়ে কাহলিল জিব্রানের একটি কবিতায় এধরণের একটি আইডিয়া এসেছিলো:
“একসাথে গাও, নাচো আর স্ফূর্তি করো
তবে তোমরা থেকো একাকী
বীনার তারগুলো যদিও আলাদা
তবু তো তারা একই সুরে ঝংকৃত হয়।
দাও হৃদয়
কিন্তু একে অপরের হৃদয়কে ধারণ করোনা
কারণ একমাত্র জীবনের হাতই ধারণ করতে পারে
তোমাদের দুজনের হৃদয়।
ভালোবেসে হাত ধরে দাঁড়াও
কিন্তু খুব কাছাকাছি নয়
যেমন মন্দিরের স্তম্ভগুলো পৃথক দাঁড়ায়
আর ওক ও সাইপ্রেস গাছ পরস্পরের ছায়ায় বাড়ে না।”
LikeLike