মনিরের মনটা আজ বেশ ফুরফুরা! আজ বিকেলে প্রবাসী বাংলাদেশী সংগঠনের আয়োজনে মেলা ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। এই ধরনের অনুষ্ঠান হলে মজার মজার বাংলাদেশী খাবার পাওয়া যায় কিছু ভাবীর কল্যানে । এই ভাবীদের কেওই তার পরিচিত নয়; পরিচিত হবার ইচ্ছাও তার নেই । মনির যাবে খাওয়ার জন্য। বাংলাদেশী খাবার ছাড়াও আরেকটি জিনিস মনিরের বেশ লাগে। সেটা হোল অচেনা মানুষদের আলাপ আলোচনা শোনা । গত চার বছরে ছয়টি অনুষঠানে সে গিয়েছে। এটা হবে সপ্তম অনুষ্ঠান । অফিস থেকে একটু আগেই সে বের হয়েছে তাই। একবার ভাবছে পাঞ্জাবী পরে যাবে, পাঞ্জাবী পরলে সেটা ইস্ত্রী করতে লাগবে। সুতরাং পাঞ্জাবী আর পরা হোল না । জীন্স আর পলো পরে চলল সে।
ক্ম্যুনিটি হলের পারকিং এ গাড়ি রেখে মনির হেটে চলছে হলের দিকে। বাইরে কমপক্ষে ৩০০ গাড়ী; প্রতি গাড়িতে গড়ে চার জন মানুষ আসলেও হাজার খানিক মানুষ এসেছে। বাইরে একদল শিশু ছুটোছুটি করছে। হলের ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল মানুষ আর মানুষ! মহিলাদের মধ্যে শাড়ী পরা- সালোয়ার কামিজ পরা- বোরখা পরা- প্রায় কিছু না পরা -সবই আছে। পুরুষদের মাঝেও দেখা যাচ্ছে – পাঞ্জাবী পরা- জিন্স পরা, শর্টস পরা -এমনকি দু একজন ধুতী পরেও এসেছেন। দু একজন লোক এসেছেন ক্যামেরা নিয়ে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হোল খাবার দোকান রয়েছে প্রায় বিশ থেকে পচিশ টা ! আজ হঠাত কেন যানি মনিরের খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে । এই ছোট্ট একটা শহরে এতো বাংলাদেশী মানুষ থাকে – অথচ সে কেউকেই চেনে না – কথা বলার কেউ নেই -একটু মন খারাপের মতো হোল তার ।
স্টেজে এক ভাবী রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে শুরু করেছেন। হাতে মোবাইল ফোনে তার চোখ। সম্ভবত গানের কথা সেখানে লিখা। প্রি রেকর্ডেড মিউজিক বাজছে। ভাবী অত্যন্ত মন দিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছেন কিন্তু তার চেয়েও বেশী মন দিয়ে সামনের দর্শক শ্রোতারা খাবার খেয়ে যাচ্ছেন আর গল্প করে যাচ্ছেন । এইসব দর্শক শ্রোতাদের বক বকানীর কারনে মনির ঠিক বুঝতে পারছে না কোন গানটি তিনি গাচ্ছেন। তবে রবীন্দ্র সঙ্গীত যে গাচ্ছেন সেটা বোঝা যায় তার মুখের এক্সপ্রেশন এবং কপালের টিপ দেখে। রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়ক/গায়ীকাদের মুখের এক্সপ্রেশনে এক ধরনের অকূলতা থাকে, যাকে দৈন্যতা বললেও ভুল হবে না। ব্যাপারটা মনিরের কাছে খুবই হাস্যকর লাগে। মনিরের ধারনা ঊনি –“আমারো পরানো যাহা চায়” টাইপের কিছু একটা গেয়ে চলেছেন। অডিয়েন্সের বেশী ভাগেরই চাওয়া -পাওয়া ইতিমধ্যে শেষ হয়ে যাবার কথা – আর সে কারনেই মনে হয় উনার গানে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। খেয়েই যাচ্ছে।
মনির এক ভাবীর দোকান থেকে কিছু ভুনা খিচুড়ী আর ঈলিশ ভাজা কিনেছে । একটা বসার যায়গা দরকার । একটা টেবিলের দিকে তার চোখ পড়লো। টানা টেবিল- ০৮ টা চেয়ার। এলোমেলো ভাবে তাতে তিনটা চেয়ার খালি। মনির ভাবল – সেখানে বসা যেতে পারে। তাতে অন্যদের আলাপটাও শোনা যাবে।
সে বসেছে যে টেবিলে, সেখানে অন্য চার ভদ্র লোক বসে আলাপ করছেন। একটূ উত্তেজিত টোনে কথা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। মনির টেবিলটাতে বসার অনুমতি চাওয়ার সময় উনারা একটু বিরক্তি বোধ করেছেন মনে হোল -তাদের আলাপে হয়তো ব্যাঘাত ঘটে থাকবে ।
এই সময় একজন প্রায় পরিচিত মানুষের উদয় হোল। লোকটার সাথে একটা চায়নীজ চেহারার মেয়ে। সে সালোয়ার -কামিজ পরা। মাথা থেকে বুক পর্যন্ত একটা ওড়নার মতো কাপড় দিয়ে ঢাকা -স্কার্ফের চেয়ে বড় আবার ওড়নার চেয়ে ছোট। কিন্তু তাকে বেশ লাগছে।
টেবিলের সামনে দিয়ে হেটে যাবার সময় এক ভদ্রলোক “ ওই শামসু ভাই, এদিকে আসেন” বলে ডাক দিলেন । মনির লোকটার এবং তার সাথের অন্য লোক গুলোর চোখ লক্ষ্য করে দেখছিল । মুখে শামসু কে ডাকলেও এরা আসলে সাথের ভিন দেশী মেয়েটিকেই ডাকছিলেন।
শামসু এসে সালাম দিয়ে সবার সাথে তার সাথের চায়নীজ চেহারার মেয়েটাকে পরিচিত করিয়ে দিল বউ হিসেবে। সে বারবার একটা কথা অতি গুরুত্তের সাথে সবাইকে বলছিল তার বউ সম্পর্কে – “ও কিন্তু মুসলমান হইয়া গেছে। প্রথমে ঈসলাম ধর্ম গ্রহন, তারপর বিয়ে করছি.. “
শামসু, মানে স্যামকে মনিরের মনে আছে পুরোপুরি। সে বলেছিল -তার ভিয়েতনামি গার্ল ফ্রেন্ড এর কথা । এই তাহলে সে। স্যামের ধর্মান্তরিত হওয়া- বিয়ের গল্প অন্যরা বিশ্বাস করলেও মনির কিন্তু মোটেই করে নি । মনিরের আজ মনে হচ্ছে স্যামের সাথে কথা বলতে পারলে বেশ হোত। স্যাম নিশ্চয় তাকে মনে রাখে নি।
এবার কয়েকজন ভাবী স্টেজে উঠে নাচা শুরু করে দিলেন। তাদের একজন আবার মোচ লাগিয়ে যুবক সেজেছেন – “ লোঙ্গর তোল তোল সময় যে হোল হোল.” গানের সাথে নৃত্য পরিবেশনা চলছে। লাইটিং হয়েছে দারুন! সাথে ধোঁয়া। এবার গানের সাউন্ড বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে অনেক । ঝাকানাকা অবস্থা আর কী ! মানুষও বেশ উতসাহ নিয়ে সাড়া দিয়েছে নৃত্যে। অনেকেই মোবাইল ফোন বের করে ভিডিও করা শুরু করেছেন। কয়েকজন কে দেখা গেল নিজের যায়গায় দাড়িয়েই হাত পা নাড়া চাড়া করছেন। কিন্তু খুব বেশীক্ষন তারা সেটা চালাতে পারলেন না। নৃত্য সহজ বিষয় না; এটার জন্য ফিটনেস প্রয়োজন।
মনির এসবের ফাকে ফাকে বিভিন্ন দোকান থেকে পছন্দের সব খাবার কিনে তার গাড়িতে রেখে আসলো । সাধারনত মনির এত সময় এসব অনুষ্ঠানে থাকে না । কিন্তু আজ তার বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। হল রুমে ফিরে আসার সময় সে স্যামকে খুজে বের করলো। নিজেই শুরু করলো কথা-
মনিরঃ ভাই আমাকে চিনতে পারছেন? আমি মনির।
স্যামঃ মনির ভাই, ভালো আছেন ? চিনতে পারছি। আপনে মনোযোগ দিয়া খাইতে ছিলেন, তাই ডিস্টার্ব করি নাই। তাছাড়া ঐ টেবিলে যে বদমাইশ গুলা ছিল, সেইজন্য আর বউকে নিয়া বেশীক্ষন দাড়াই নাই।
মনিরঃ বদমাশ বলছেন কেনো ওদেরকে ?
স্যামঃ কারন আছে। ঐ টেবিলের তিনজনই ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। কিন্তু একজনও মানুষ না। আমারে একদিন বলে – তোমার রিক্সা কোথায় ? আরে , আমি ট্যাক্সি চালাই বইলা মজা লয় আমার সাথে। ফকিরনীগুলা বিদেশে আসছে ঠিকই কিন্তু কোনও উন্নতি হয় নাই মানসিকতার। মানুসরে সম্মান করতে শিখে নাই । টাকা দিয়ে সব বিচার করে … আমি ট্যাক্সি চালাইয়া যা কামাই করি সেইটা দিয়া তোরে দশবার কিনতে পারি…
স্যাম বলেই চলল । মনির বুঝতে পারছে স্যামের বহুদিনের ক্ষোভ এদের প্রতি। কথা বলতে বলতে এক সময় আস্যাম মোবাইল ফোনটা টেবিলে রাখলো। তারপর একটু চুপ হয়ে কিছু একটা পড়া শুরু করে দিল ।

মনির কিন্তু বেশ মজা পাচ্ছে স্যামের সাথে কথা বলতে পেরে। সে একটু আড় চোখে স্যামের মোবাইলে তাকিয়ে দেখতে পায় স্যাম “যুক্তিমনা” নামের এক বাংলা ব্লগ পড়ছে। যুক্তিমনা মনিরও মাঝে সাঝে পড়ে। কিছু ঊঠতি বয়স্ক ছেলে মেয়ে যুক্তি চিন্তার নাম করে অধিকাংশ সময়েই খোড়া যুক্তির প্রবন্ধ লিখে। এদের কয়েকজন আবার ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কু রুচি পূর্ণ আর্টিকেল লিখে নিয়মিত ভাবে। -এইসব লিখলে মনে হয় তাড়াতাড়ি নজরে পড়া যায়। এছাড়া এতে অনেক সময় ইউরোপের দেশ গুলোতে এসাইলাম নেয়ার পথও খুলে যায়। জীবনের তাড়নায় সবাই পথের খোজে বের হলেও একেক জনের পথ হয় ভিন্ন।
গত সপ্তাহে তাদেরই একজন মহানবী(সা) কে নিয়ে যা তা লিখেছে। সেটা আবার বাংলাদেশের ধর্ম প্রান মানুষদের বেশ আঘাত করেছে। তবে মজার বিষয় যেটা মনির লক্ষ্য করেছে- সেটা হোল এইসব ব্লগ সাধারন মানুষের জানা- পড়ার কথা নয় । কিন্তু মানুষ জেনেছে কেননা কিছু ইসলামী সংগঠন এগুলো নিয়ে তান্ডব শুরু করেছে বলে। মনির নিজে খুব একটা ধার্মিক না। তবে তার আল্লাহর প্রতি এবং তার নবীর প্রতি বিশ্বাস এভাবে আছে যে – সে মনে করে – কোথাকার কোন কার্টুনিস্ট বা ব্লগার কিছু বলে বা লিখে তার বিশ্বাস এতটুকুও কমাতে পারবে না । এই কথাটা কথা প্রসঙ্গে তার এক বাল্যকালের বন্ধুকে একবার বলেছিল। সেই বন্ধু তাকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিল – “তাহলে ব্লাশফেমী আইনের তো আর দরকার নেই”।
মনির তাকে শান্ত ভাবে বলেছিল – ভাই আপনি কি একটা উদাহরন দেখাতে পারবেন যে আমাদের মহানবীকে যখন অত্যাচার-ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হোত – ঊনি তাদের জন্য অভিশাপ দিয়েছেন? -শাস্তি তো অনেক পরের কথা। হামজা (রা) তাকে খুন করতে এসে হয়ে গেলেন শক্ত ভক্ত। যে বুড়ী তার পথে কাটা বিছিয়ে রাখতো , তার আসুখে উনি গেলেন তার সেবা করতে । তো তাহলে ব্লাশফেমী আইন কীভাবে সুন্নাহ হতে পারে?
স্যাম গভীর মনোযোগ দিয়ে ব্লগ পড়া শেষ করতে পারলো না। ফোনে মেসেজ এসেছে। স্যাম সেটা পড়ছে আর রিপ্লাই করছে। কোনও কথা নেই ।
স্টেজে এবার একজন কবিতা আবৃত্তি শুরু করেছেন। ভাবী নয়, এবার এক ভাই সাহেব। “অমল কান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল … অমল কান্তি রোদ্দুর হতে পারে নি…” কবিতাটা মনিরের পছন্দ। সে মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কিন্তু এবার স্যাম কথা বলে উঠলো-
স্যামঃ আমার ছোট ভাই ব্লগ লেখে । ভালই লেখে, কিন্তু হঠাত কইরা মাথা খারাপ হয়ে গেছে মনে হয়। ওই যে বাংলাদেশে যে মউলানারা খেপছে ।। সেইটা আমার ভাইয়ের লেখা পইড়া। আরে মউলানারা আবার কবের থিকা ব্লগ পড়া শুরু করলো কইতে পারেন ? আর এইসব পুলাপাইন কী লিখছে না লিখছে এই গুলা নিয়া এত লাফালাফী করার কী আছে? আজকে এইসব লিখছে, দুইদিন পর আল্লাহ চাইলে দেখবেন এরাই খাদেম হইয়া গেছে। আল্লাহ চাইলে কী না হয়? রাস্তায় চিল্লা পাল্লা না কইরা এদের জন্য দোয়া করলেই কিন্তু হয়!
মনিরঃ ভাই লাফালাফী করার সুযোগ দিলে তো লাফালাফী করবেই । তাছাড়া আপনি লিখলে আপনার যেমন আধিকার আছে মত প্রকাশের , তেমনি সাধারন মানুষেরও তো আধিকার আছে আপনার লিখা পড়ে যেন তারা আঘাত না পায় , তাই না? এই সব ব্লগ আমি পড়ি , তবে গুরিত্ত দেই না। এই ব্লগারদের সমস্যা হোল এরা খুবই আত্ম কেন্দ্রিক। খালি নিজের আধিকারের কথা ভাবে, নিজের ভালো লাগা ভাবে- কিন্তু যুক্তিবাদী মুক্ত চিন্তার মানুষ হতে হলে তো খালি নিজের কথা ভাবলেই হবে না তাই না? তা আপনার ভাই কোনটা ।। নাম কি?
স্যামঃ নাম রাকীব। লিখে রকফেস্ট নাম দিয়া। এই নামের মানে কী আমার জানা নাই হা হা হা।।
মনিরঃ ও আচ্ছা । ভাই ভালো থেকেন ; আজ যাই । আবার দেখা হয়ে যাবে কোথাও কখনো।
মনির স্যামকে একবার বলতে চেয়েছিল সে রাকীবকে চেনে। কিন্তু সে বলে নি । বেশী পরিচয়ের দরকার নেই । এতে নেটওয়ার্ক বেড়ে যাওয়া শুরু করবে। সেখান থেকে শুরু হবে দাওয়াত খাওয়া এবং দাওয়াত দেয়া। এভাবেই বাংলাদেশী অন্যান্য মানুষদের মতো সে তার জীবন শেষ করতে চায় না। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত জীবনটা অনেক বড় এবং সুন্দর মনিরের কাছে।
মনির বাসায় ফিরে সন্দেশ খাচ্ছে তৃপ্তি ভরে । প্রতিটা কামড়ের আগে সে বড় বড় চোখ করে সন্দেশটার দিকে তাকাচ্ছে। স্যাট টিভি ছেড়ে বাংলাদেশী নিউজ দেখা শুরু করলো সে। হুজুরদের হুঙ্কার -ব্লগারদের মৃত্যু দন্ড চায় তারা। কিছুদিন আগে তারা কাদিয়ানীদের আমুসলিম ঘোষণা করার দাবীতে চিৎকার করছিল । অমুসলিম ঘোষণা করলে কী করা হবে কাদিয়ানীদের সেটা মনিরের খুব জানতে ইচ্ছে করে। তাদেরকে কী মেরে ফেলা হবে ?
হঠাত করে মনিরের মনটা খারাপ হয়ে গেল ভাবতে ভাবতে। রাকীবের কথা বারবার মনে হচ্ছে তার।
চলবে…।

interesting ghotona probaho…probasher bangla onusthanguli hubohu eirokom hoi
LikeLike