এটাই কি মৃত্যু? এই শীতল বিছানাটাই কি কবর? মজিদ আরো একবারের জন্য দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো।
মজিদের মনে হচ্ছিলো সে যেন গভীর কোন ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে। তারপরের অংশগুলো যেন স্বপ্ন, যেন স্বপ্নের ভেতর সে দেখছে – তার শরীরটাকে কেউ ধুয়ে দিচ্ছে, কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও, ইত্যাদি। এমনকি তাকে ঠান্ডা জায়গাটায় শুইয়ে দেয়ার ব্যাপারটাও সে এমনভাবে অনুভব করল যেন একটা স্বপ্নের ঘোরে ঘটছে ঘটনাগুলো। তার শারীরিক অনুভূতিগুলো নেই, শুধু কোনভাবে ঘটনাগুলো তার জানা হয়ে যাচ্ছে।
এই তাহলে মৃত্যু! নাকি সে হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় মৃত্যুর দুঃস্বপ্ন দেখছে!
শুয়ে থাকা অবস্থায়ও সে একই জিনিস লক্ষ্য করল – তার মাথা পুরোপুরি কাজ করছে না, তার সব স্মৃতি মনে আসছে না, সব হিসাব কাজ করছে না – ঠিক যেমনটি ঘটে স্বপ্নে। স্বপ্নের ভেতর নিজের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে না মানুষের, শুধু ততটুকু নিয়ন্ত্রণ থাকে যতটুকু চরিত্রবল কারো মনের একদম গভীরে রয়েছে।
অদ্ভুত এই শুয়ে থাকার এক পর্যায়ে সে অনুভব করল কেউ যেন তার পায়ের কাছে বসে আছে। সে ভয় পেল না, কারণ সে তখন নিজেকে সপে দিয়েছে ভাগ্যের হাতে। সে শুধু পায়ের দিকে একবার দেখতে চেষ্টা করল, যদিও বুঝতে পারলনা এটাও স্বপ্নের ভেতর ঘটছে কিনা, নাকি পুরোটাই বিছানায় জ্বরগ্রস্থ হয়ে ঘোরের মধ্যে ভাবা কোনোকিছু !
ওর পায়ের কাছে গুটিশুটি মেরে বসে ছিল ছোট ছোট দুটো মানুষ। মজিদের মনে হল এরা সাদা একধরণের কাপড় পরে আছে, অবশ্য সে বুঝতে পারল না কোন আলো ছাড়া সে কিভাবে এদের দেখতে পাচ্ছে। সে এদের বয়সও বুঝতে পারল না, কিশোর ধরণের চেহারা দুজনেরই।
তোমরা কারা? – সে প্রশ্ন করল। কিন্তু এরা কোন উত্তর দিল না। বড় বড় চোখ করে শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকল।
ওপাশ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে মজিদ কিছুটা শংকিত হল – এদেরকে বোধ হয় তুমি করে বলাটা ঠিক হয়নি। শত হলেও এটা তো খুবই সম্ভব যে তার মৃত্যু হয়েছে – ভাবে-সাবেও তাই মনে হচ্ছে। এখন এরা যদি ফেরেশতা হয়, তাহলে তাদেরকে সম্মান করেই কথা বলা উচিত। আর তাছাড়া চেহারা শিশুসুলভ হলেই যে বয়স কম হবে, এমন কোন কথা নেই – তার নিজের একজন বন্ধু ছিল, পঞ্চাশ বছর বয়সেও তাকে ত্রিশ বছরের বাচ্চা ছেলের মত মনে হত।
আসসালামু আলাইকুম, আপনারা ভালো আছেন? – সে এবার যথাসম্ভব নরম সুরে ডেকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল।
নীরবতার অস্বস্তিটা যখন তার জ্যামিতিক হারে বাড়তে শুরু করেছে, ঠিক তখন ওদের কেউ একজন কথা বলে উঠল, একটি মেয়েলী কণ্ঠ – আপনি ভয় পাবেন না, আমরা আপনার শত্রূ নই।
মজিদ কিছুটা স্বস্তি পেল, অন্তত: কথা তো বলতে শুরু করেছে। আর কথোপকথন যখন শুরু হয়েছে, তার মানে এখানে কোন না কোনভাবে পার পেয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। জীবনে বহুবার এমন হয়েছে – যেখানে সে কথা বলতে পেরেছে সেখানেই সে কায়দা করে সম্ভাব্য সব বিপদাপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে, বিশেষ করে চোয়ালের জোর না থাকলে ঠিকাদারী ব্যবসার মত ব্যবসা করে টিকতেই পারত না।
থ্যাংক ইউ, আমি এখন তাহলে কোথায়? – গলার স্বরে যথেষ্ট বিনয় ঢেলে দিয়ে সে বলে। বলেই আবার মনে হল, ইংরেজী এরা বোঝে কিনা। আরবীতে ধন্যবাদ কিভাবে বলে কে জানে। সে আরবীতে শুধু একটা বাক্যই জানে – কাইফা-হালুক, অর্থাৎ আপনি কেমন আছেন। সে অস্ফুটস্বরে কাইফা-হালুক কাইফা-হালুক বলতে থাকল।
অবয়ব দুটি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল, কিন্তু কোন উত্তর দিল না। মজিদ আরেকবার আন্দাজ করার চেষ্টা করল এগুলো মেয়ে না ছেলে – মেয়ে হলে আলাদা আদবে কথা বলার দরকার ছিল।
বিচিত্র কথা বলার প্রয়োজন নেই – মেয়েলী কণ্ঠ বলে আবার – আমরা আপনার ক্ষতি করতে আসিনি।
মনে মনে এদের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে মজিদ বলে – মানে আমি জানতে চাচ্ছিলাম, আমার কি মৃত্যু হয়েছে?
আপনার শরীর এবং তৎসংলগ্ন মনের মৃত্যু ঘটেছে – মেয়েকণ্ঠ উত্তর দিল।
মনেরও মৃত্যু হয়েছে? আপনি শিওর বলছেন?
আমরা নিশ্চিত যে আপনার শরীরের সাথে আপনার মনেরও মৃত্যু ঘটেছে।
বলেন কি? আমি তো জানতাম মন চিরজীবী ধরণের জিনিস।
মন একটি প্রবঞ্চনা মাত্র, মন মূলত: শরীরেরই এক্সটেনশান – এটা বৈজ্ঞানিক সত্য।
হতে পারে – মজিদ দুর্বলভাবে বলে – বিজ্ঞানে আমি আবার একটু উইক। মেট্রিকে প্রথমবার যে ফেল করলাম, সেটা বিজ্ঞানেরই কল্যানে। মাত্র সাতাশ পেয়েছিলাম, তাও প্র্যাকটিক্যালের সতর নাম্বার সহ। দ্বিতীয়বার অবশ্য ভুল হয়নি, জায়গা মত সিট ফেলে পরীক্ষা দিয়েছি, একদম অজ গ্রামে – সব মিলিয়ে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছিলাম সেবার। আচ্ছা, আপনারা বোধ হয় ফেরেশতা, তাই না? একজন মুনকার, আরেকজন নকীর। মুনকার কি আপনি? – সে ডানদিকের অবয়বটিকে ইংগিত করল।
আমরা আপনার কাছে পাঠানো দুজন দূত মাত্র, আমরা এসেছি উপরের আকাশ থেকে। আমরা আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, তারপর উত্তর লিখে নিয়ে চলে যাব।
মজিদ আরেকবার স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলল – এরা যতই ভনিতা করুক না কেন, বোঝাই যাচ্ছে এরা মক্তবের কিতাবে পড়া সেই মুনকার-নকীর ফেরেশতাই। সে এ বিষয়টা খুব ভালোভাবে শিখেছিল, তাকে জিজ্ঞেস করা হবে – তোমার প্রভু কে? উত্তরে সে খোদার কথা বলবে। ব্যস, সে চলে যাবে সোজা বেহেশতের ওয়েটিং রুমে। সেখানে সে কেয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। সঠিক উত্তরটি দিতে পারলে শেষ বিচারের দিনেও তার একটা সুবিধা পাবার বিশেষ সম্ভাবণা আছে।
নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর মজিদের যথেষ্টই আস্থা আছে – তার কেন যেন মনে হল, এটা নকল করে মেট্রিক পাশ করার চেয়েও সহজ হবে। সারা জীবন যেভাবেই পার করুক না কেন, শেষপর্যন্ত তো মুসলমান হয়েই মারা গেছে – এখন ঠিকমত উত্তরটা মুখে আসলেই হয়। আর উত্তর মুখে না আসার কোন কারণই নেই, সে তো প্রশ্ন আর উত্তর দুটাই মুখস্ত করে এসেছে ।
শুরুর প্রশ্ন, তুমি আমাদের বল, তুমি তোমার জীবনে তুমি যা যা অর্জন করেছ কিসের জোরে সেসব অর্জন করেছ – অন্য অবয়বটা কথা বলে উঠল এবার, এটা একটা পুরুষ ধরণের কণ্ঠ বলে মনে হল।
মজিদ একটু দমে গেল – এই প্রশ্নটা ঠিক সেভাবে কমন আসেনি। সে কিছুটা বিরক্তও হল এই ফেরেশতাবেশীদের ওপর – তোদেরকে বলা হয়েছে প্রভুর বিষয়ে প্রশ্ন করতে, তোরা সেটা করে চলে যা – তা না, কত রকম ভূমিকা করছে! সে একইসাথে কিছুটা আতংকিতও হল – ফেরেশতারাও যদি সরকারী অফিসারের মত চালবাজ হয় তাহলে সাধারণ মানুষ কার কাছে বিচার চাইবে !
তোমাকে সঠিক উত্তরটি দিতে হবে, এটা খুবই জরুরী – এবার প্রথম অবয়বটি তাকে মনে করিয়ে দিল – জীবনের যা যা অর্জন সেসব কিসের জোরে করেছিলে?
মজিদ এবার মনে মনে হাসল, কমন না পড়লেও প্রশ্নটা একদম কঠিনও নয় – টাকা না থাকলে সে পৃথিবীতে কিছুই করতে পারতনা, যা যা সে করেছে। সুতরাং সঠিক উত্তরটি হবে টাকা। মজিদ একটু সময় নিয়ে তারপর ধীরে ধীরে কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে বলল – টাকা।
অবয়ব দুটি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। মজিদ আশা নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু বহুক্ষণ তারা কোন উত্তর দিল না।
কি? কথা বলছেন না কেন আপনারা?
আরো কিছুক্ষণ নীরবতার পর ছেলেকণ্ঠটি ধীরে ধীরে বলে – পৃথিবীতে তুমি টাকার জোরে সফল হয়েছিলে, প্রথম প্রশ্নের প্রথম অংশটির উত্তর আমরা এভাবে লিপিবদ্ধ করে নিয়েছি। এবার প্রথম প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশ, মৃত্যু পরবর্তী জীবনে তুমি কিসের জোরে মুক্তি পাবে বলে মনে করছ?
আরে বলেন কি আপনারা? – মজিদ হেসে ওঠে – আমি কি এতোই গাধা? টাকার জোরে পরকাল পাওয়া যায় না সে আমি ভালো করেই জানি। সেজন্যই দুনিয়াতে প্রচুর দান-খয়রাত করে এসেছি – দুনিয়া থেকে আখিরাতে টাকা ট্রান্সফার বলতে পারেন। তাছাড়া শেষ বয়সে প্রচুর নামাজ-রোজাও করেছি, এমনকি বছর তিনেক আগে হজও করে এসেছি সৌদি আরব থেকে। এগুলির জন্য আমার যেমন পরিশ্রম হয়েছে, তেমন অর্থব্যয়। এসব তো পরকালের জন্যই, তাই না?
আমরা জানতে চাচ্ছিলাম, সেগুলো আপনি কি উদ্দেশ্যে করেছেন?
পরকালে ভালো থাকার উদ্দেশ্যে, আবার কি উদ্দেশ্যে? আপনারা বোকার মত একই প্রশ্ন বারবার করছেন কেন? – সে বিরক্তি প্রকাশ না করে পারে না।
অবয়ব দুটি আবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কিন্তু ততক্ষণে মজিদের ধৈর্যের বাধ একেবারেই ভেংগে গেছে – জানিনা, আপনারা পুরুষ জাতি না মহিলা জাতি, কিন্তু আপনারা মূল প্রশ্ন বাদ দিয়ে যেভাবে উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন শুরু করেছেন তা খুবই সন্দেহজনক।
অবয়ব দুটি তবু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
মজিদ এবার প্রায় চীৎকার করে বলে – আপনারা যে প্রশ্ন করার কথা সেটা না করে উল্টা-পাল্টা আলাপ করছেন কেন?
কোন প্রশ্ন? কোন প্রশ্ন করার কথা আমাদের? – তাদেরকে বিস্মিত মনে হল।
কেন? সেই যে, আমার প্রভু কে? যার উত্তরে আমি খোদার কথা বলব।
সে দুজনের মুখভংগী তবুও পাল্টালো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারা বলল – সে প্রশ্নই তো আপনাকে আমরা করলাম, তাই না?
এবার মজিদকে বিস্মিত দেখায়।
তার উত্তরে প্রথমে আপনি বলেছেন অর্থ-সম্পদের কথা, তার পর বলেছেন আপনার দান-খয়রাত ইত্যাদির কথা। সম্পদ নিশ্চিত করেছে আপনার পার্থিব জীবন, আর কর্ম নিশ্চিত করবে আপনার পরকাল।
মজিদ চুপ হয়ে যায়।
আমরা আপনার উত্তরের ভেতর কোথাও ঈশ্বরের নামটি পাইনি।
আমি তো একবারও বলিনি এগুলির পিছনে খোদা নেই, আমি তো শুধু সামনের কারণগুলাই বললাম – মজিদ এবার বেশ আহত স্বরে বলে।
সম্ভবত ব্যক্তিগত জীবনে আপনি সামনের কারণগুলোর ওপরই বেশি নির্ভর করেছেন, ঈশ্বরের কথা ততটা ভাবেননি। এটা নতুন কিছু নয় – একসময় আপনার পূর্বপুরুষেরাও একইভাবে দেব-দেবীর পূজা করত, তাদের ওপর নির্ভর করত, তাদেরকে সফলতার মাধ্যম মনে করত।
তাহলে আমার নামাজ-রোজা, দান-খয়রাত? বলতে চাচ্ছেন সেগুলো কোন কাজে আসবে না? আশ্চর্য তো!
কর্ম তো আর ঈশ্বর নয়, কর্ম নিজে কাউকে মুক্তি দিতে পারে না। অন্যদিকে ঈশ্বর স্বয়ংসম্পূর্ণ, আপনি তার পূজা করলেন কি না করলেন তাতে তাঁর কিছুই যায় আসে না। তবে আপনার কাজ-কর্ম যদি হয় ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে, তবে সেটা তিনি পছন্দ করলেও করতে পারেন। কর্ম ঈশ্বরকে পাবার পথ, আপনি পথকে গন্তব্য মনে করলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না।
মজিদ ভাবতে লাগল – এরমধ্যেই তার সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগতে শুরু করেছে। এমনকি সে যে কি বুঝতে পারছে না সেটাও বুঝতে পারছে না। শেষপর্যন্ত সে আশা করল – হয়তো এটা আসলেও একটা স্বপ্ন, হয়তো এই অদ্ভুত ঘুম থেকে জেগে ওঠার একটা সুযোগ সে পাবে।
(উদ্ভট গল্প / মায়িন খান, ফেব্রূয়ারি ২০১১)

“আপনি পথকে গন্তব্য মনে করলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। ” -excellent!
LikeLiked by 1 person
Excellent one!
LikeLike