ভেদাভেদ

রেসিজম শব্দটা শুনলেই সাদা কালো একটা পতাকা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু এই মানসিকতা কি সাদা কালোতে থামে? ভেবে দেখুন। আমার ধারণা, আমাদের দেশে শৈশব থেকে এগুলো স্কুলে শেখানো হয়। বাবা-মা, শিক্ষক সবাই শেখান। বলা যায় এটা ছাড়া আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা জমেই না।

আরিফ ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হল ঢাকার নামজাদা এক স্কুলে। ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হল। আহ্লাদে গদগদ সবাই। আরিফ সবার মাথার মনি। এক বছর পর ক্লাস ওয়ানে ফাইনাল পরীক্ষায় আরিফ নবম হল। সব বিষয়ে ভালো নম্বর। সামান্য নম্বরের তফাতের জন্য একেক জন একেক অবস্থানে। আরিফের মনটা ভীষণ ভালো সেদিন। সন্তুষ্ট সে তার পড়াশোনায়। কিন্তু প্রথম যে মন্তব্যটা আরিফ শুনল, তা হল, “তোমার ফলাফলে তোমার বাবা-মা খুব কষ্ট পাবেন”। বললেন আরিফের শ্রেনী শিক্ষক। আরিফ অবাক হয়ে গেলো। সে প্রথম হয়নি কিন্তু ভালো নম্বর পেয়েছে, তার বন্ধুরাও তাই, শুধু একজন প্রথম হয়েছে। বাসায় ফেরার পর বাবা মা তাকে তেমন কিছু বললেন না, আরিফ মন খারাপ করতে পারে বলে। তারা এটা বুঝতেই পারলেন না যে, ধনাত্মক কিছু না বলাতে আরিফ খুব অবাক হয়েছে, কারণ, তার ধারণা, সে ভালো পড়াশোনা করে তার ফল পেয়েছে।

এর পর আরিফ আর কোন দিন ভালো ফলাফলকে ভালো চোখে দেখতে পারেনি। ওটা শুধুই তার কাছে বন্ধুদের সাথে মারামারি কাড়াকাড়ি করার মত মনে হয়েছে। আরিফ যখন ক্লাস ফাইভে, তখন সে দেখল বৃত্তি পরীক্ষা যেন সফলতা আর বিফলতার মাঝে এক নিষ্ঠুর দেয়াল কিম্বা এক লিটমাস টেস্ট। সে কি চাপাচাপি আর ভাগাভাগি শিক্ষকদের পক্ষ থেকে। তারা পুরোপুরি বুঝিয়ে দিলেন কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক! আরিফ এটা সহ্যই করতে পারলনা। কচি মনে ভীষণ চাপ পড়েছিল। ফুটন্ত গরম পানির একটা বছর কাটল, জীবনে প্রথম ভয় বা আতংকের পরিচয় পেল আরিফ কোন রকম সন্ত্রাসীর অনুপস্থিতিতেই। শিক্ষক কিম্বা বাবা-মাকে হতাশ করতে আরিফ খুবই অপছন্দ করত; তার চেয়েও বেশি অপছন্দ করত নিজেকে হতাশ করতে। বাধ্য হয়েই কোন রকম পড়াশোনার হাল ধরে ঝুলে থাকল, কিন্তু ভালো ফলাফল তো করা হতই না, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার প্রতিও বিরক্ত হয়ে উঠল দিনে দিনে।

শিক্ষকরা ছিলেন বেশ মজার। কথায় কথায় মনে করিয়ে দিতেন ক্লাসে কার রোল কত, আর পরীক্ষায় কার নম্বরই বা কত! দু একবার মজা করার জন্য আরিফ অসদুপায় অবলম্বন করে পরীক্ষায় মারাত্মক ভালও করেছে; শিক্ষকগন চকচকে চোখে আরিফকে দেখেছে; আর আরিফ শুধুই অশ্রদ্ধার আর কষ্টের হাসি হেসেছে। দশটা বছর ছোট-বড়, কম ভালো বেশি ভালোর এই ধারালো ভেদাভেদ সহ্য করে স্কুল জীবন শেষ হয় আরিফের। না আরিফ বখে যায়নি। নিজের প্রতি অন্যায়ও করেনি। এমনকি পড়ালেখায় যতটুকু ফলাফলের প্রদর্শনী সমাজে বাধ্যতামূলক ছিল তাও ঠিক থাক মতই করেছে। তারপর, সমাজে যখন মূল্যবান হিসাবে পরিচিত হতে শুরু করেছে ঠিক তখন জীবন ত্যাগ করেছে। না আত্মহত্যা করেনি সে। বরং যা করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে তার ফলাফল এক অর্থে জীবন হারানো।

আর কখনো ফিরে তাকায়নি আরিফ। যে ভেদাভেদ প্রথার শিকার হয়ে আরিফ স্কুল, পড়াশোনা, সমাজ থেকে ছিটকে পড়েছে তা বহাল তবিয়তেই হয়ে চলেছে এখনও। কে মেধাবি আর কে মেধাবি নয় তার বিচার শুধু ভুল ভাবেই আমাদের দেশে করা হয়না, সে ভুল বিচারের ভিত্তিতে ঘৃণা, অসম্মান আর অহংকারের বীজ বুনে দেয়া হচ্ছে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মনে। এখানে কৃষক হলেন শিক্ষক, জমির মালিক বাবা-মা পরিবার, আর পুরো ব্যপারটার তত্ত্বাবধায়ক সমাজ স্বয়ং। যে এটা মানবে না, সে তো সমাজে থাকার অধিকার পর্যন্ত হারায়। কখনো কখনো দুরবল মনের অনেকে হয়তো অন্ধকারেও হারিয়ে যায়।

আরিফ তাই ঠিক করেছিল সে কখনই বড় মানুষ হবে না, কারণ এতে মানুষ হবার নিশ্চয়তা নষ্ট হয়। আর যদি কোনদিন বড় মানুষ হয়েও যায়, সেটা অবশ্যই তার একার কৃতিত্ব হবেনা, হবে না তার একার সম্পত্তি কিম্বা প্রতিপত্তি। আর মানুষ হবার আগেই বড় মানুষ হয়ে গেলে এগুলো বোঝার সুযোগটা আর থাকে না। আর তাতে লাভই বা কি! যার পরনে প্যান্ট নেই তার শরীরে গেঞ্জি না শার্ট তা দেখে লাভ কি!

আধুনিক শিক্ষিত দুনিয়া যখন ভেদাভেদ উপড়ে ফেলে সমতল সমাজ তৈরিতে ব্যস্ত, আমাদের সমাজ তখন বেতন দিয়ে শিক্ষক রেখে ভেদাভেদ শেখায়। স্কুল গুলো ভেদাভেদের এই খেলার জমজমাট আসর। কত মানুষ এই খেলা উপভোগ করছেন যুগের পর যুগ। ইব্রাহীম নবীর মত মহৎ উদ্দেশ্য না থাকলেও সন্তানের জীবন কোরবানি করতে খেলে চলেছেন বাবা মায়েরা। ধ্বংসস্তূপে মুখ থুবড়ে পড়ছে বেশির ভাগ শিশু মন। আর সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে থাকা গুটি কয়েক দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে ভবিষ্যতে সেই একই খেলা চালিয়ে যাবার।

কোথায় আছে আমাদের সন্তানেরা! কি হচ্ছে ওদের নিয়ে! কি হচ্ছে ওরা! বড় মানুষ, ভালো মানুষ, মানুষ নাকি অবিবেচক রোবট! না, যারা বখে যায় আমি তাদের কথা বলছিনা; আমি বলছি যারা বখে যায় না তাদের কথা! ওরা যা হতে চায় তাতে কেন উৎসাহ দিচ্ছেন না। অপরাধ বা অন্যায় না করলেই তো হল। দেখবেন, এক সময় এমন ভালো কিছু হয়তো করবে যা অবিবেচক রোবটের সমাজকেও মুগ্ধ করে দেবে।

One thought on “ভেদাভেদ

Leave a comment