কাজ, ভিক্ষা আর চুরি

সেদিন আমার সামনে বাংলা সিনেমার একটা অংশ চলছিল। ছবির নাম, গরিবের সংসার। শ্রেষ্ঠাংশে অভিনেতা জসীম আর অভিনেত্রী সাবানা। কোন সন্দেহ নেই যে অনেক পরিশ্রমের ফসল এই সিনেমা যা দেখে বাংলার অগনিত দর্শক নিজের জীবনের পাথেয় খুঁজে পেয়েছে। প্রচুর টাকা ব্যয় এবং আয়ও হয়েছে। তবে আমার দৃষ্টিতে গুরুত্ব পেয়েছে অন্য একটা দিক। সেটা নিয়েই আজ লিখব।

নায়ক গরিব ও সৎ পরিবারের শিক্ষিত ছেলে। পিতৃহীন। সংসারে অর্থ যোগানের তাগিদে ৬/৭ বছর হল মাস্টার্স শেষ করে চাকুরী খুজছে। এখনো বেকার, উপযুক্ত চাকুরী জোটেনি বলে। বাড়ি ফিরে একদিন দেখল, মা অন্যের বাসার কাজে সাহায্য করে টাকা আয়ের ব্যবস্থা করছে। রাগে দুঃখে নায়ক চাকুরী খোঁজা বাদ দিয়ে সন্ত্রাসী বনে গেল, দু’হাতে টাকা কামাই শুরু করে দিল। এ দুঃখ দুর্দশা আমাদের দেশের খুবই পরিচিত ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন হল, নায়ক যদি বাংলাদেশে না থেকে অন্য কোন উন্নত সমাজের দেশে থেকে শুরুতেই কাজের খোঁজ পেত, তাহলে কি হত? এবার তাহলে বলি এক সত্য ঘটনা।

আরিফ বাংলাদেশে সুবিধা করতে না পেরে উন্নত দেশে মাইগ্রেট করল। সেখানে প্রথম যে চাকুরীটা পেল, তা হল বয়স্ক লোকজনদের সাহায্য করার। গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বয়স্ক অসহায়দের নানা কাজে সাহায্য করত, ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে খাওয়া পর্যন্ত, কারণ তাদের আপন কেউ সাথে নেই, আর শরীরে সে ক্ষমতাও নেই। এ কাজ করে যখন আরিফ সৎ ও সুন্দর ভাবে নিজের জীবনকে এগিয়ে নিচ্ছে, তখন তার পরিচিত বাংলাদেশি প্রবাসীদের মতামত ছিল ভিন্ন। কেউ হয়ত নিয়মিত সরকারি দুঃস্থ ভাতার টাকায় জীবন চালানোকে সম্মানজনক হিসাবে বেছে নিয়েছে, আবার কেউ কেউ বহু দিন পর মনের মত চাকুরী পেয়ে আরিফকে বলেছে, “শিক্ষিত মানুষ, কেন ছোট কাজ করছ?”। আরিফ প্রত্যেকের চিন্তাকেই সম্মান প্রদর্শন করে, তাই হাসি মুখে প্রবাসী বাঙালি সমাজ থেকে সরে এসেছে।

দেশের মানুষকে কিভাবে সৎ বানানো যায় এ চিন্তায় আমরা কত রাতের ঘুমই না হারাম করি; গুষ্টি উদ্ধার করি অসাধু ব্যবসায়ি আর অসৎ রাজনিতিকদের। অথচ, মেয়ে বিয়ে দেবার সময় অর্থের খাতিরে শিক্ষকের চেয়ে অগ্রাধিকার দেই অসৎ কর্মকর্তাকে, আর কায়িক শ্রমিক তো সব রকম হিসাবের বাইরে, ভীষণ গর্হিত এক পেশার লোক তারা। অর্থ সংস্থানে সততা আর সচ্ছলতার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন দাম্ভিকতার সুযোগ। এককালের সফল পেশাজীবী বা ব্যবসায়ী যদি বর্তমানে বেকার থাকে বা সরকারি টাকায় বা ঋণে জীবন নির্বাহ করে তাহলে তা আমাদের বাঙালি সমাজে দুঃখের কিন্তু অসম্মানের নয়; তবে যদি সে পরের দোকান সাফ করে পয়সা কামাই করে স্বনির্ভর হয়, তাহলে আর সমাজে মুখ দেখানোরও আর সুযোগ থাকে না।

এক কথায়, বাঙালি সমাজে বেড়ে ওঠা এই আমাদের জন্য, দম্ভের সুযোগ যে কাজে নেই, সে কাজের চেয়ে হাত পেতে টাকা নেয়া বেশি পছন্দনীয়, যদি তা হয় আইনের শাসনওয়ালা দেশে, অর্থাৎ যেখানে অসৎ হবার সুযোগ নেই বললেই চলে। আর যদি তা হয় নিজ দেশে, তাহলে দম্ভহীন কাজের কথা ভাবাও সম্ভব না, প্রয়োজনে খুঁজে দেখতে হবে অসৎ কোন পথ, আর কিছুই না হলে নানা আধুনিক উপায়ে ভিক্ষাবৃত্তিই শেষ ভরসা।

আসলে আমাদের প্রথম ও প্রধান অসততা সমাজ ব্যবস্থায় যার মূল ধারনাগুলো অসততা কিম্বা ভিক্ষাবৃত্তিকে শ্রমের ওপরে স্থান দেয়। তাই দেশের প্রথম শ্রেণীর অপরাধ, আমার নজরে, সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন না আনা, যা আমাদের প্রত্যেককেই নিশ্চিতভাবে অপরাধী করে রেখেছে। তাই আমাদের ভাবতে শিখতে হবে, আমাদের দারিদ্র আর হীনতা আমরাই ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিশ্চিত করি, তার পরই সেটা আমাদের কলংক হয়ে কষ্ট আর দুর্দশা টেনে আনে।

2 thoughts on “কাজ, ভিক্ষা আর চুরি

Leave a reply to সৈয়দ কল্লোল Cancel reply