কন্ট্রাক্ট

নূর আলীর মূর্খতা দেখে জালাল সাহেব অবাক হয়ে গেলেন – সে এত বছর ধরে ঠিকাদারি করছে, অথচ জানেনা কোনটা ‘ঘুষ’ আর কোনটা ‘উপরি’। আসলে এইসব লোক তো রাস্তা থেকে উঠে এসেছে, লেখাপড়া বলতে গেলে জানেই না – ফলে তারা স্বাভাবিকভাবেই এসব সূক্ষ্ম জিনিসের পার্থক্য ধরতে পারে না, আর এজন্যই না বুঝে অযথা দর কষাকষি করতে থাকে।

আরে ঘুষ তো সেটা যেটা অন্যায় কাজের বিনিময়ে নেয়া হয়, যেমন কাজ না করিয়েই বিল পাশ করা, সেটা তো অবশ্যই অবৈধ। তিনি তো সেটা করছেন না – তিনি ঠিকমতো কাজ আদায় করেছেন, ঢালাইয়ের দিন পুরো আট ঘন্টা রোদে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ তদারক করেছেন, ফাঁকি দিতে দেননি। যেহেতু তিনি যথারীতি কাজ আদায় করে নিয়ে তারপর বিল পাশ করছেন, সেজন্য এই পার্সেন্টের ব্যাপারটা বৈধ। জালাল সাহেব অনেকের সাথেই এই ব্যাপারটা নিয়ে মত বিনিময় করেছেন, বেশির ভাগ লোকের মতেই – ‘ঘুষ’ হারাম, কিন্তু ‘উপরি’ হালাল। এই পাঁচ পার্সেন্ট তো ঘুষ না, এটা উপরি – তাই এটা তার প্রাপ্য, তার ন্যায্য হক।

জালাল সাহেবের একবার মনে হলো, নূর আলীকে বান্দার হকের কথাটা মনে করিয়ে দেন – এই দুনিয়াতে কেউ যদি খোদার কোনো বান্দার হক নষ্ট করে, তাহলে আখিরাতের দিন বান্দা সেই হক আদায় করে নিতে পারবে, আর তখন নূর আলীকে কিন্তু তার সওয়াবের বিনিময়েই এই হকের ঋণ শোধ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জালাল সাহেব কিছু বলা থেকে বিরত থাকলেন, এই লোককে দেখে তেমন ধর্মপ্রাণ বলে মনে হয় না।

নূর আলীর ধৃষ্টতা দেখেও জালাল সাহেব অবাক হচ্ছিলেন – ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চার্জ হিসেবে তার ভাগ পাঁচ পার্সেন্ট, এটা তো প্রকৌশলী সমিতিই বলে দিয়েছে, আর সেটাও তো ঠিকাদার সমিতির সাথে আলোচনা করেই ঠিক করা। নূর আলীর যদি আপত্তি থাকে তাহলে তার সমিতির সাথে গিয়ে আলাপ করুক, সবকিছু একটা নিয়মের মধ্যে হোক। কিন্তু এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না যে ঠিকাদারেরা পার্সেন্টেজের অল্প কয়টা টাকা নিয়েও দর কষাকষি করবে।  

প্রত্যেকবার বিল পাশ করার সময় এই বিশ্রী দর কষাকষিটা জালাল সাহেবকে মুখ বুঁজে সহ্য করতে হয়। কিছু বললেই নূর আলী অভিযোগ করে বলে যে – জালাল সাহেব কাজ নিয়ে খুঁত খুঁত করেন, ভুল ধরেন, ফলে তারা কন্ট্রাক্ট থেকে টাকা বের করতে পারেনা। এমন কিন্তু না যে জালাল সাহেব ঠিকাদারদের খামোখা ঘুরান – তিনি সৎ মানুষ, টাকা নেন আর সাথে সাথে বিলও পাশ করে দেন।

আর করবেন নাই বা কেন, ডিপার্টমেন্টে সৎ অফিসার হিসেবে তার একটা নাম আছে। তাছাড়া কোরানেও তো সামুদ জাতির উদাহরণ দিয়ে দেখানো হয়েছে মাপে কম-বেশ করার কারণে কিভাবে খোদা একটা পুরো জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারেন। সুতরাং অফিসের কাজের ব্যাপারে জালাল সাহেব কোনোরকম নৈতিক ঝুঁকি নিতে নারাজ, অসৎ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।   

অসৎ তো তারা যারা টাকা নেয় তারপরও কাজ করে দেয় না। পাশের সাব-ডিভিশনে ইঞ্জিনিয়ার মুনিরের কাছে যাক – সে আগাম টাকা নেয়, তারপরও বিল নিয়ে ঠিকাদারদের ঘুরাতে থাকে। সেখানে তো নূর আলীদের কোনো সমস্যা হয় না। অথচ মুনিরের উদাহরণ দিলেই নূর আলী বলে যে ওই সাব-ডিভিশনে কাজ করে ‘আরাম’ আছে – কারণ সেখানে কাজ করলে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না, যেমন খুশি তেমন করা যায়। অবশ্য একটা কথা ভেবে জালাল সাহেব স্বস্তি বোধ করেন – সততার জন্য কিছু মূল্য তো এই দুনিয়ায় দিতেই হবে, এর বিনিময়ে আখিরাতে নিশ্চয়ই ভালো কিছু পাওয়া যাবে। 

জালাল সাহেব আখিরাতের ব্যাপারে সবসময়ই সাবধান থাকতে চেষ্টা করেন, কারণ সামান্য কয়টা বছরের এই পার্থিব জীবনের জন্য লাখো-কোটি বছরের আখিরাত নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। যদিও তার পরিচিত একজন মাওলানা তাকে বলেছে যে উপরি হলো উপহার আর উপহারমাত্রই হালাল, তবুও উপরির টাকা তিনি হাতমোজা পরেই ধরেন, সাবধানের মার নেই।

আখিরাতের কথা ভেবেই কিনা কে জানে – কোনো অনুযোগ ছাড়াই জালাল সাহেব নূর আলীর দেয়া পনেরো হাজার টাকা নিয়ে নিলেন, তারপর বাসায় ফিরলেন। তার বয়স হয়েছে, তার এটুক বুঝ হয়েছে যে সন্তুষ্টির মধ্যেই রয়েছে সুখ – হোক না নূর আলী তাকে তার পাওনা পার্সেন্ট থেকে বেশ কয়েক হাজার টাকা কম দিয়েছে, এগুলি নিয়ে দুশ্চিন্তা করে মনের শান্তি নষ্ট করার কোনো মানে হয় না । ধরে নেয়া যাক, ওই কয়েক হাজার টাকা নূর আলীকে দান করে দেয়া হয়েছে – পরকালে দানের জন্য তো কিছু না কিছু বিনিময় পাওয়া যাবে অন্তত। বাসায় ফিরে স্ত্রীকে বললেন প্যান্টের পকেট থেকে টাকাটা বের করে নিতে – তিনি হাতমোজা খুলে ফেলেছেন, আবার পরতে ইচ্ছা করছে না।

রওশন আরা যখন বিরক্ত মুখে প্যান্টের পকেট হাতড়াচ্ছেন – খালি হাতেই – তখনি জালাল সাহেবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা মনে পড়লো। সাথে সাথে স্ত্রীকে মনে করিয়ে দিলেন যে এই টাকা যেন কোনোভাবেই বেতনের টাকার সাথে মিলিয়ে ফেলা না হয় – বেতনের টাকা হলো শুধুমাত্র খাওয়া-দাওয়া কেনার জন্য।

ধর্মে খাদ্যদ্রব্য হালাল হওয়ার ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশ এসেছে – হারাম টাকা দিয়ে খাওয়া কিনে খেলে চল্লিশদিন পর্যন্ত ইবাদত কবুল হবে না। চিন্তা করা যায়! যদিও মাওলানা তাকে স্পষ্ট ফতোয়া দিয়েছে যে ঠিকাদারের ‘উপহার’ হালাল, তবুও জালাল সাহেব নবীজির সেই শিক্ষার কথা মনে রাখার চেষ্টা করেন – হালাল আর হারামের মধ্যে যেগুলো আছে ‘সন্দেহজনক’, সেগুলোও এড়িয়ে চলা ভালো।

স্ত্রী পাশের ঘরে চলে যেতেই জালাল সাহেব সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসলেন। বাইরে কিন্তু তখন রৌদ্রের তাপ বাড়তে শুরু করেছে।

(ছোট গল্প / মায়িন খান, নভেম্বর ২০২০)

2 thoughts on “কন্ট্রাক্ট

Leave a reply to toufiq Cancel reply