জীবনের প্রথম টেলিস্কোপ কেনার জন্য যা জানা প্রয়োজন…..

প্রথমেই বলে রাখা ভালো – এই আর্টিকেল এর সাজেশন আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা। আপনাদের আমার সাজেশন এর সাথে একমত হতে হবে – এমন কোন কথা নেই। চলুন তাহলে শুরু করি।

নতুন টেলিস্কোপ দিয়ে চাদের পর সবচেয়ে বেশী যেটা সবাই দেখতে চায় — সেটা হোল শনি গ্রহ। তাই আমি এই আলোচনায় গতানুগতিক অনলাইন ভিডিও গুলোতে  যে সব উপদেশ দেয়া হয় সেদিকে কম নজর দিয়ে শনি গ্রহ কোন টেলিস্কোপে কেমন দেখা যায় — সেটার দিকে বেশী গুরুত্ত দিবো। সেজন্য আমি এখানে কিছু কম্পিউটার সাইমুলেশন করা ছবি দেখাবো যাতে আপনার একটা রিয়েলিস্টিক ধারনা তৈরী হয়।

টেলিস্কোপ আপনি সাধারনতঃ দুটি কারনে কিনবেন – 

  1. ভিসুয়াল অবসারভেশন  এর জন্য ঃ
    •  চাঁদ, গ্রহ , – প্লানেটারী অবসারভেশন। অথবা ,
    • নেবুলা, গ্যালাক্সি – ডীপ স্কাই অবসারভেশন।   
  2. এস্ট্রো ফটোগ্রাফি করার জন্যঃ
    • চাঁদ, গ্রহ , – প্লানেটারী ফটোগ্রাফি  অথবা ,
    • নেবুলা, গ্যালাক্সি – ডীপ স্কাই ফটোগ্রাফি।   

ঊপরের পয়েন্ট থেকে এটা কিন্তু বুঝা যাচ্ছে – এক টেলিস্কোপ দিয়ে প্রপারলী সব কিছু করা  যাবে না — গেলেও সেটা হবে কম্প্রোমাইজ। এই কারনে আমরা বিভিন্ন ধরনের একাধিক টেলিস্কোপ কিনতে বাধ্য হই — স্রেফ শখের বশে নয়। 

ডিসিশন নেবার সুবিধার জন্য অন্য ভাবে এবার বিষয়টাকে বলি —

প্রথমে আপনি ডিসিশন নিন – আপনি কী চান??

  1.  প্লানেটারী অবসারভেশন এবং ফটোগ্রাফি  না-কি-
  2. নেবুলা, গ্যালাক্সি – ডীপ স্কাই ফটোগ্রাফি বা অবসারভেশন

এই শখে যারা নতুন আসতে চাচ্ছেন — প্লানেটারী অবসারভেশন এবং তারপর ফটোগ্রাফিতে যাওয়া হচ্ছে একটি প্র্যাক্টিকাল এপ্রোচ। চলুন এই ব্যাপারটা এবার দেখি–

প্রথমেই দেখি  একটা ভালো টেলিস্কোপ এর ন্যুনতম কী কী বিষয় থাকাটা জরুরী। আমি ইম্পরট্যান্স  অনুযায়ী লিখছি —

  1. ট্রাইপড হতে হবে দারুন মজবুত এবং স্টারডী — এখানে কোনও কম্প্রোমাইজ করা চলবে না। 
  2. টেলিস্কোপটি এস্টাব্লিশড ব্র্যান্ড এর হতে হবে –  Bushnell , Tesco, ALDI, – ebay -alibaba   -এই জাতীয় ব্র্যান্ড দেখলে – উল্টা দিকে দৌড় দিতে হবে — এর কোনও বিকল্প নেই।  নিচের  ব্র্যান্ড গুলাো পরীক্ষিত এবং খবই  ভালো এন্ট্রী লেভেল টেলিস্কোপ এর জন্য –  
    • Sky Watcher
    • Celestron
    • Orion
    • Meade
    • GSO  
  3.   আইপীস হতে হবে কমপক্ষে   K (Kelner) সিরিজ এর। এক মাস পর এই  আইপীস গুলো ফেলে দিয়ে  কমপক্ষে Plossle  আইপীস  কিনতে লাগবে। K (Kelner) সিরিজ  আইপীস গুলো কিছুদিনের মধ্যেই ঝাপসা হতে শুরু করবে। এছাড়া এগুলোতে সব কিছু হলুদ দেখা যায়। সুতরাং ফ্রী হিসেবে কিছুদিন ব্যবহার করা যেতে পারলেও প্রকৃত মজা এইসব জাঙ্ক দিয়ে পাওয়া যাবে না। কোনও টেলিস্কোপের সাথে যদি   S – আইপীস থাকে — যে কোনও মূল্যে সেই ব্র্যান্ড থেকে দূরে থাকতে হবে– এইগুলোর মধ্যে এমনকি কোনও গ্লাস এলেমেন্ট নেই.. লেন্স প্লাস্টীকের তৈরী.. a great rip off…!!! 
  4. একজন প্রোফেশনাল  একাউন্ট্যান্ট  হিসেবে Return on Investment আমার জন্য জরুরী।  আপনার প্রথম টেলিস্কোপটি হতে হবে ” গুড ভ্যালু ফর টাকা” । এজন্য নীচের বিষয়গুলির দিকে মনযোগ  দিন …
  • ক্রয় খরচঃ টেলিস্কোপ টাইপ অনুযায়ী এর দাম / এপারচার  দারুনভাবে ওঠানামা করে।  আশা করি যারা এই লেখা পড়ছেন তারা  ইতিমধ্যে  জানেন – যে ধরনেরই টেলিস্কোপ হউক  না কেনো- একটা ব্যাপার সবার বেলাতেই প্রযোজ্য – এপারচার যত বড় .. ততোই ভালো।  কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে – ক্রয় মূল্য/ এপারচার কিন্তু টেলিস্কোপের ডিজাইন ভেদে দারুন ভাবে তারতম্য করে। নীচের গ্রাফটি দেখুনঃ 

আনন্দের সাথে লক্ষ্য করে দেখুন – ডবসোনিয়ান এবং সাধারন রিফ্লেক্টর এর ক্রয় মূল্য/ এপারচার সিগ্নেফিক্যান্টলী কম!!! সতরাং এই পয়েন্ট থেকে আমাদের সেলেকশন কিন্তু সহজ হয়ে গেলো। আমাদের প্রথম টেলিস্কোপ হবেরিফ্লেক্টর অথবা ডবসোনিয়ান😜😜😜।   

  • ট্রাইপড  এবং মাউন্ট  টাইপঃ  আগেই বলেছি – এইখানে কোনও আপোস করা যাবে না। রিফ্লেক্টর টেলিস্কোপে  সাধারনত দুই ধরনের মাউন্ট ব্যবহার করা যায়ঃ  
    • আল্ট -য়াজিম্যুথাল মাউন্টঃ এটি খুব সহজ ভাবে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সমস্যা হোল – কমদামী বেগিনার টেলিস্কোপের সাথে যে মাউন্ট আসে — সেটা খুবই অ -ব্যবহারযোগ্য! খুবই নাজুক– একটুতেই নড়ে যায়। কিন্তু হাজার খানেক ডলার খরচ করলে দারুন আল্ট -য়াজিম্যুথাল মাউন্ট পাওয়া যাবে।  নীচের ছবিতে একটা উদাহরন দেখতে পাবেন বেগিনার টেলিস্কোপের আল্ট -য়াজিম্যুথাল মাউন্টঃ 
রিফ্লেক্টর টেলিস্কোপ  আল্ট -য়াজিম্যুথাল মাউন্ট

একুইটরিয়াল মাউন্টঃ   এ ধরনের মাউন্ট  অপারেট করা বেশ কঠিন নতুনদের জন্য। কিন্তু একবার বুঝে ফেললে এটা খুবই মজার এবং স্থায়ী । কেননা, ফটোগ্রাফি করতে হলে এই মাউন্ট ব্যবহার করতে লাগবে কস্ট এবং পারফরম্যান্স এফেসীয়েন্সীর জন্য। এই মাউন্ট বিভিন্ন গ্রেড আনুযায়ী পাওয়া যায়। EQ 3 এর নীচে নামা যাবে না এবং যত উপরে ওঠা যাবে তত লাইফসাইকেল কস্ট (cost) কমবে ।  নিচের ছবিতে  দেখুন একুইটরিয়াল মাউন্টঃ 


একুইটরিয়াল মাউন্টঃ ORION Telescope 

ডবসোনিয়ান মাউন্টঃ  এটি আসলে এক বিশেষ ধরনের আল্ট -য়াজিম্যুথাল মাউন্ট। এটি ব্যাবহার করা সবচেয়ে সুবিধাজনক। একটি  রিফ্লেকটর টেলিস্কোপ এই বিশেষ ধরনের   -য়াজিম্যুথাল মাউন্ট এর উপর রাখা হয় বলেই এই রিফ্লেক্টর টেলিস্কোপটিকে বলা হয় – ডবসোনিয়ান টেলিস্কোপ– আর কিছু নয়। দেখুনঃ একটি ২০০ মি.মি. রিফ্লেক্টর ডবসোনিয়ান বেস এ রাখা হয়েছে  বলে – এর নাম ডবসোনিয়ান টেলিস্কোপ! 

ডবসোনিয়ান মাউন্ট

নতুন প্রথম টেলিস্কোপ হিসেবে ডবসোনিয়ান টেলিস্কোপ এর তুলনা হয় না. এটি নিউটোনিয়ান রীফ্লেক্টর হওয়ায় ক্রয় মূল্য/ এপারচার সস্তা- ভিউইং কয়ালিটী অসাধারন- অপারেশন সুপার সহজ!  

টেলিস্কোপ এবং মাউন্ট  হোল, এবার এপারচার সাইজের দিকে মন দেয়া যাক।

  • শনি গ্রহ কেমন দেখা যাবে – অ্যাপারচার সাইজঃ 

অ্যাপারচার সাইজ নিয়ে অনেক গনিত করা যাবে। কিন্তু সেদিকে এখন যাবার সময় নয়। কেননা আমরা জীবনের প্রথম টেলিস্কোপ কিনতে যাচ্ছি। গনিত টনিত করে অনেকেই টেলিস্কোপ কেনেন, তারপর স্বপ্ন অনুযায়ী কিছু দেখতে পারেন না বলে এই দারুন নেশাটা থেকে চির বিদায় নেন। তাই  আসুন দেখি কীভাবে এর একটা সমাধান পাওয়া যায়।

নিচের সিমুলাশনটি দেখুন – বাস্তবে আপনার অভিজ্ঞতা  এর চেয়ে খারাপ হবার সম্ভাবনা বেশী থাকবে.. কতটা সেটা নিরভর করবে – লাইট পোলুশন, বাতাসের কোয়ালিটি, হিউমিডিটী, আইপীস , ট্রাইপড ও মাউন্ট এর কয়ালিটীর উপর। 

এখানে প্রতিটী সিমুলিশনে ১২মি.মি.আইপীস ও ১২মি.মি. আইপীস + ২ক্স বারলো লেন্স ব্যবহৃত হয়েছে।

প্রথমে ৭৬/৭০০ মি.মি টেলিস্কোপ দিয়ে আসলে শনিগ্রহ আদৌ দেখা যাবে কি না… দেখা গেলে কতটুকু দেখা যাবে।

শনিগ্রহ ৭৬/৭০০ টেলিস্কোপ সাইমুলেশন 

এবার দেখুন শনিগ্রহ ৯০/১০০০ টেলিস্কোপ সাইমুলেশনঃ

শনিগ্রহ ৯০/১০০০ টেলিস্কোপ সাইমুলেশন

শনিগ্রহ ১৩০/১৩০০ টেলিস্কোপ সাইমুলেশনঃ

শনিগ্রহ ১৩০/৬৫০ টেলিস্কোপ সাইমুলেশন

শনিগ্রহ ২০০/2০০০ টেলিস্কোপ সাইমুলেশনঃ

শনিগ্রহ ২০০/2০০০ টেলিস্কোপ সাইমুলেশন

আশাকরি  উপরের সিমুলাশনগুলো থেকে ডিসিশন নিতে পারবেন  – কতো ফোকাল লেংথ টেলিস্কোপ আপনার জন্য প্র্যাক্টিক্যালঃ দাম- কোয়ালিটী-পারফরমেন্স বিবেচনার পর।

  • বহনশীলতাঃ সবশেষে যেটা গুরত্তোপূর্ণ সেটা হোল – টেলিস্কোপ বহনশীলতা। এটা খুবই গুরত্তোপূর্ণ  কেননা -এমন অসংখ্য উদাহরন পাওয়া যাবে (আমি নিজেই একজন উদাহরন) যে, ২৫০মি.মি. টেলিস্কোপ কিনে পড়েছেন মহা বিপদে! এত্ত ওজোন যে শেষ পর্যন্ত গ্যারাজেই পড়ে ধুলো কুড়াচ্ছে বেচারা!  নীচের ছবিতে দেখুন -আমার ২০০মি.মি. ডবসোনিয়ান প্রথম ছবি ডান পাশে ! আমি মনে হয় না ৫ দিন এটা  ব্যবহার করেছি। ডান পাশেরটা ২০০মি.মি. টেলিস্কোপ.. এটা ২য় সপ্তাহে বিক্রী করে দিয়েছি  … ওজোন ..ওজোন…ওজোন! 
ডবসোনিয়ান ও আমি…

আমার কয়েকটা টেলিস্কোপঃ

অনেকটা পথ পাড়ি দেবার পর আমার বর্তমান অতি প্রিয় দুটি টেলেস্কোপ এর ছবি দিলাম নীচে ;লক্ষ্য করুন- কতো ছোট এগুলো উপরের দুটির তুলনায়!

আশাকরি বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাচ্ছি– বড়াই দেখানোর জন্য বড় টেলিস্কোপ কিনে যদি সেটা ব্যবহারই না করতে পারলেন — এর চেয়ে বোকামি আর কীই বা হতে পারে! 

এবার  রিফ্রাকটর টেলেস্কোপ নিয়ে একটা কথা বলিঃ–    

সস্তা রিফ্রাক্টর কেনার চেয়ে কোকা কোলা বোতলের মধ্য দিয়ে চাঁদ দেখা শ্রেয় .. অন্ততঃ টাকাটা তো সেভ করলেন😋😋😋।  রিফ্রাক্টর টেলেস্কোপ যদি কিনতেই  হয় – অন্তত পক্ষে ED Doublet কিনবেন। 

ঊপসংহারে, এস্ট্রনোমি একটি চ্যালেঞ্জিং বাট রিওারডিং হবি। আপনি সিরিয়াস হলে একটা টেলিস্কোপে জীবন পার করবেন – এমনটি হবে না। তাই ধীরে কিন্তু কুশলী হয়ে চলুন। 

-সৈয়দ ঊদ্দীন, ২০২০   

2 thoughts on “জীবনের প্রথম টেলিস্কোপ কেনার জন্য যা জানা প্রয়োজন…..

  1. এম এল না হয়ে ওটা এম এম হবে। একটু সংশোধন করে নিলে মনে হয় ভাল হবে।

    Like

Leave a reply to সৈয়দ কল্লোল Cancel reply