বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর হল। খুব আনন্দের, খুব শান্তির কথা ! কিন্তু আমি কি স্বাধীন? কবে থেকে? আর যদি স্বাধীন নাই হই, তাহলে অন্য সব স্বাধীনতায় আমার কি লাভ ? ভাবছেন খুবই স্বার্থপর, নেতিবাচকভাবে কথা বলছি, তাই না ? তাহলে শুনুন, কেন বলছি, তারপর বিচার করুন এসব কতটুকু ইতিবাচক বা নেতিবাচক।
ছোটবেলায় নিজের মত করে থাকতে ভালবাসতাম। ঘরের বাইরে গিয়ে হইহুল্লোর করে সময় পার করা খুব বেশি একটা হয়ে ওঠেনি। সময় নিয়ে বোঝার সুযোগ পেলে কাউকে “বন্ধু” উপাধি দিতে মন চাইত, না হলে সঙ্গী। সহজ ভাবে, ছোট বেলা থেকেই সবাই আমাকে কিছুটা অসামাজিক বলে জেনেছে। কিন্তু মজার কথা হল, একবার যখন কাউকে বন্ধু হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছি, সে আর কখনো মুক্তি পায়নি আমার হাত থেকে। শত লাথি গুঁতো খাবার পরও ঠিকই সব ভুলে হাজির হয়েছি তার কাছে, বারবার ! আমার জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা সেগুলোই যেখানে আমি কাউকে বন্ধু হিসাবে মেনে নেবার পর সেই বন্ধুই বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমার ভুল ভেঙেছে।
ওপরের অংশ পড়ার পর হয়তো অনেকেই বলবেন, আমার মত মানুষের এতো অল্পতে বন্ধু না হওয়াটাই ভালো। ঠিক তাই, ঠিক এই কারনেই আমি ছোট বেলা থেকেই একটু ধিরে এগিয়েছি। কিন্তু ব্যক্তিগত এই সতর্কতা আমাকে শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই সুবিধা দিয়েছে, সমষ্টিগত জীবনে নয়; কারণ, সমষ্টিগত জীবনে আমি স্বাধীন নই, অন্তত ছিলাম না। হয়তো ভাবছেন, সমষ্টিগত জীবন কারো জন্যই অতটা স্বাধীন হয় না। না, জঙ্গলের স্বাধীনতা সমষ্টিগত জীবনে আমিও আশা করি না। আমি শুধু ওই স্বাধীনতাটুকু পাওনা মনে করি যা কোন রকম অসম্মান ছাড়া একটা সাধারণ জীবন যাপনের সুযোগ দেয়। কি, ভাবছেন এটা আর এমন কি ! দেখুন তাহলে।
স্বাধীনচেতা শিশু থেকে যখন স্বাধীনচেতা কিশোরে পরিণত হলাম, চারপাশ থেকে নিজের ব্যাপারে অনেক ভালো ভালো ভবিষ্যৎবানি শুনতে পেতাম। খুব ভালো লাগত এসব শুনতে। ভাবতাম, বাহ ! আমার ভবিষ্যৎ তো উজ্জ্বল! কি আনন্দ! কিন্তু আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হল না। বুঝতে পারলাম, ভবিষ্যবানি গুলো আসলে চারপাশের মানুষের স্বপ্ন। সেটাও বা খারাপ কি!! কিন্তু খারাপটা হল তখন যখন অন্যদের স্বপ্ন নিজের অজ্ঞাতেই আমার দুঃস্বপ্নে পরিণত হল। একটু ভেঙে বলি। অন্তরে কোন আগ্রহ না থাকার পরও আমি ধরে নিলাম, সমাজের সপ্নই আমার স্বপ্ন। এতে প্রাথমিক লাভ যেটা ছিল, তা হল, নিজেকে গড়ার প্রায় পুরোটা সময়ই (প্রায় ২৫/৩০ বছর) সমাজ আমার ডান হাতটা ধরে ছিল। আর কে না চায় সেটা ! তবে সে হাত ধরা যদি হাত কড়া হয়, তাহলে?
সমাজ যেটা ধরে ছিল, সেটা আর যাই হক আমার অন্তর বা মনের ডান হাত ছিল না। ফলে সমাজের সুনজর পেতে নিজেকে বেশ কিছু দিন মিথ্যা বুঝ দিয়ে রেখেছি, “এটাই আমার মনের ডান হাত”। বেচারা মন তার নিঃসঙ্গ ডান হাতটাকে হাওয়ায় ঝুলিয়ে পার করে দিয়েছে বহু বছর, কেউ তা ধরেনি, আমি নিজেও না !! জীবনের প্রায় শুরু থেকেই শিক্ষা পেয়েছি, নিজের মত ভালো থাকাটা যথেষ্ট নয়, যথেষ্ট হল অন্য সবার চেয়ে ভালো থাকা। দৌড়ে যে প্রথম হবে তার দৌড়ই সার্থক, বাকি সবই বরবাদ। নিয়মিতভাবে সমাজ মনে করিয়ে দিয়েছে, সবচেয়ে ভালটাই হল প্রয়োজন, তার চেয়ে কম কিছুই নয়। কিন্তু “এক” একটাই সংখ্যা, ফলে, প্রায় সারা জীবনই “এক” এর বাইরে অন্য কোথাও সময় পার করেছি। জেনেছি, আমি পরাজিত। জেনেছি, আমি অপর্যাপ্ত। পেশাগত শিক্ষা বেছে নেবার সময় তাই খুঁজে নিয়েছি এমন পথ যা সমাজ চকচকে চোখে দেখে। অন্তত একটা স্বীকৃতি দিয়ে দাসত্তের জীবনে ইতি টানতে চেয়েছি। কিন্তু লাভ হয়নি। হিমালয়ের অংশ হবার পরও প্রশ্ন এসেছে, এভারেস্ট শৃঙ্গ কবে হব !
এতদিনে আমার মজ্জায় সমাজ শিক্ষা ঢুকে গেছে। সমাজের মত করে বড় হতে হলে দাসত্ব মেনে নেয়া হবে – এই ভেবে নিজের মত করে বড় হবার পথ খুঁজলাম। ভুলেই গেলাম যে, এই বড় হবার দৌড়টাই দাসত্বের প্রধান চিহ্ন। ভুলেই গেলাম সৃষ্টির সৌন্দর্য থেকে শুরু করে জীবনের নুন্ন্যতম শান্তির চাহিদা পর্যন্ত সব কিছু। বাড়ছিলাম (বড় হচ্ছিলাম) অনেকটা দ্রুত ফুলে ওঠা বেলুনের মত। ভেতরে শুধু বাতাস হলে কি হবে, বড় তো ! বিপত্তি বাধালো নিয়তি। বেরসিক কিছু চাপে আমার বড়ত্বের বেলুন বাতাস ছেড়ে দিল। চুপসে যাবার পর বুঝতে পারলাম, এতদিন যা করেছি তার কিছুই নিজের জন্য নয়, কিছুই নয়। সবটাই অন্যের চোখের কিম্বা মনের জন্য।
নিজের ভেতরের চাওয়া কি সেটাও ভুলে গেছি আজ। শুধুই ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠি আর ভাবি, “বড় হতে হবে আমাকে, সমাজে বড় হতে হবে” ! তাই ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে শেষ মেশ যখন নিজেকে প্রশ্ন করি – কি চাই আমি? জবাব পাই, “মৃত্যু পর্যন্ত শান্তিতে বাঁচতে, বড় কোন ক্ষতি থেকে দূরে থাকতে, আর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কল্যাণকর সাধারণ কাজে জড়িয়ে থাকতে” । এ আর এমন কি ! তাহলে এতদিন আমি এতো কষ্ট করে কি করেছি ? নিজের এই তিনটা চাওয়ার মধ্যে বড়জোর অর্ধেকটা পূরণ করেছি। অথচ নিজেকে আটকে না রাখলে এই তিনটার মধ্যে প্রায় আড়াইটাই এমনিতেই পূরণ হওয়া সম্ভব। অথচ বড় হবার জংলি নৃত্তে এতটাই উন্মত্ত ছিলাম যে, শান্তি, নিরাপত্তা আর কল্যান – প্রায় সবটাই ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলেছি।
তবে আর নয়। স্বাধীন হতে চাই আমি। এতদিন আমার সবচেয়ে বড় শত্রু ছিলাম আমিই যেখানে শিক্ষক ছিল সমাজ। জীবনটা যেদিন শেষ হবে, আমি বা আমার সমাজ – কেউই সেদিন তাকে ঠেকানোর ক্ষমতা রাখব না। বরং যেমন ভাবে জীবনটাকে পার করেছি, মৃত্যুটাও হয়তো একই ভাবে হবে ঠিক সময় মত। তাহলে কিসের আশায় এতদিন ছুটেছি? কি ভালো জমিয়েছি নিজের জন্য যা মৃত্যুতেও সাথি হলে লাভ হবে ? সমাজ চিরকালই শিখিয়েছে – আরও বড় হওয়া দরকার, কখনো প্রশ্ন করেনি ভালো আছি কিনা, কিম্বা আমি সত্তিকার অর্থে কি চাই। আজ আমি যখন নিজকে যখন প্রশ্ন করি – কি চাই আমি? জবাব আসে, যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট আমি। তাহলে কেন পেছন থেকে সমাজের সাবধান বানী ভেসে আসে – সময় নষ্ট কর না, ঝাপিয়ে পড় !
সমাজ নামের যে চতুস্পদ আমাকে তাড়া করে ফিরছে সে কিভাবে আমার কল্যান চাইতে পারে? তাড়া করা কখনই কল্যানের পথ হতে পারে না। শিক্ষা কিম্বা প্রশিক্ষণেরও নয়। তাই এ দৌড় এখানেই শেষ হতে হবে, এখনই। আর কখনই আমি দৌড়াতে চাইনা। আমি কৃতজ্ঞ, আমি থেমেও যাইনি, আবার থেমে যায়নি আমার নিঃশ্বাসও, দৌড়ের উন্মাদনায়। প্রাণটা ভরে তাই আজ শ্বাস নিতে চাই আর ধন্যবাদ দেই – স্বাধীনতার সুখে।
