বন্য

বিকেলবেলা ঘুম থেকে উঠে লুবনার শীতল কপালে চুমু খেল মুনির, তারপর ডিপফ্রিজের ডালাটা বন্ধ করে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে এল। দরজা লাগানোর সময় সে মোট তিনবার পরীক্ষা করে দেখল তালাটা ঠিকমতো লাগানো হয়েছে কিনা। 

মুনিরের বছর তিরিশেক বয়স। মাঝারি উচ্চতার লোক, শুকনো শরীর, পাতলা নাক, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখের নিচে একটা কাটা দাগ আছে, ছোটবেলায় গাছ থেকে পড়ে কেটে গিয়েছিলো, কিন্তু মোটা চশমার কারণে সেটা তেমন বোঝা যায় না। এনজিও ‘চেতনা’র অফিসে গুছিয়ে কাজ করার ব্যাপারে মুনিরের সুনাম আছে, তার উপজেলায় সে গতবার শ্রেষ্ঠ মাঠকর্মীর পুরস্কারও পেয়েছে। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় নিজের ওপর ওর নিজের যেন কোন নিয়ন্ত্রণই নেই।

রিক্সায় উঠে বসে মুনির মনে করার চেষ্টা করল সে আসলে কোথায় যেতে চেয়েছিল, কিন্তু কিছুতেই সেটা মনে করতে পারলনা। একবার সে ইস্কাটনের কথা বলতে গেল, ইস্কাটনে জামিল থাকে, কিন্তু কেন যেন ওর মুখ দিয়ে বের হয়ে এল মৌচাক মার্কেটের কথা। কেন মৌচাকের কথা বলল তা সে জানে না, আজ সন্ধ্যায় ঐদিকে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনাই তার ছিল না। কেউ যেন ওর মুখ দিয়ে মৌচাকের কথাটা উচ্চারণ করিয়ে নিয়েছে। যেদিনগুলোতে সে নেকড়ে বাঘের স্বপ্নটা দেখে ঘুম থেকে ওঠে, সেদিনগুলোতে তার এরকম হয়।

রিকশা চলতে শুরু করার পরও মুনির কয়েকবার লোকটাকে গাড়ি ঘুরিয়ে ইস্কাটনের দিকে যাওয়ার জন্য বলতে চেষ্টা করলো, কিন্তু গলা পর্যন্ত এসে ওর কথাগুলো আটকে গেলো – যেন কেউ ওকে কথাটা বলতে দিচ্ছে না, যেন কেউ অনেক দূর থেকে ওকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

মুনিরের জীবনে এই অভিজ্ঞতা অবশ্য নতুন নয়, কখনো কখনো তার এরকম হয় – যেন অদৃশ্য কোন শক্তি যেন তাকে দিয়ে একটার পর একটা কাজ করিয়ে নিচ্ছে, যেন দুনিয়া ওলোট-পালোট হয়ে গেলেও যেটা ও ভেবেছে সেটা ওকে করতেই হবে। মুনির অবশ্য বিশ্বাস করে না যে সকালের স্বপ্নটার সাথে আজকের সন্ধ্যার ঘটনাগুলোর যৌক্তিক কোন সম্পর্ক আছে। 

মুনির ছেলেবেলা থেকেই এই নেকড়ে বাঘটাকে স্বপ্নে দেখে। ও দেখে একটা নেকড়ে সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে তার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দোকানে যাচ্ছে, একসাথে জড়াজড়ি করে ঘুমাচ্ছে, এসব। স্বপ্নটা এতো স্পষ্ট থাকে যে ওর মনে হয় ওটা যেন আরেকটা বাস্তবতা। আজও একই স্বপ্ন দেখে ভোরবেলা তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে। সেই মাথাব্যথার রেশটা এই সন্ধ্যা পর্যন্ত রয়ে গেছে। 

রিকশাটা দ্রুতগতিতে চলছিল, তবুও মুনির খোলা হুড ধরে বসে বসে ঘামছিল। সে আকাশের দিকে তাকাল, পশ্চিম কোণে কালো মেঘ জমা শুরু করেছে, তবু ভীষণ গুমোট ভাব চারদিকে। মনে হচ্ছে একটা ভালো ঝড় হবে আজ সন্ধ্যায়, আর সেটার পর যদি এই ভ্যাপসা গরমটা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।  

রিক্সাটা মোড় ঘুরতেই একটা ওষুধের দোকান চোখে পড়ল। লুবনার জন্য এখন থেকেই ও ওষুধ কিনতো। সে এখনো বুঝে উঠতে পারছেনা লুবনা অর্থাৎ তার লাশ কেন ফ্রিজের ভেতরে। তাহলে কি সে নিজেই — ? কিন্তু তাই বা হবে কেমন করে? ওর কিছুই মনে আসছে না আসলে লুবনা কি করে ফ্রিজের ভেতর গেল।

এটা ঠিক যে লুবনার সাথে ইদানিং তার একদম বনিবনা হচ্ছিল না, লুবনা তাকে কথায় কথায় সন্দেহ করতো বলে তার সাথে সম্পর্ক চরম ধরণের তিক্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার অর্থ এই না যে সে নিজের স্ত্রীকে খুন করে ফেলবে। অবস্থা অতটা খারাপ হলে সে নিশ্চয়ই লুবনাকে ডিভোর্স দিতে পারত। কেন খামোখা খুন করে দুই দুইটা জীবন নষ্ট করতে যাবে?

মুনির যখন মৌচাক মার্কেটের সামনে রিকশা থেকে নামল, তখন এর মধ্যেই ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে রাত পৌনে নয়টা। একটা ঘোরের মধ্যেই মুনির মার্কেটের মূল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল। মার্কেটের বেশ কিছু দোকান ইতোমধ্যে শাটার নামানো শুরু করেছে। যেসব দোকান খোলা, সেগুলোতেও তেমন একটা লোকজন নেই। বাইরের ভ্যাপসা গরমটা মার্কেটের ভেতরে যেন আরো ঘনীভূত হয়েছে, বদ্ধ খাঁচার মতো পুরোনো এই মার্কেটে ওর দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল।  

মার্কেটে ঢুকতেই ক্রোকারিজের দোকানটা ওর চোখে পড়ল। সাদা ডিনার সেটের গায়ে নীল-সোনালী নকশা করা, কালো প্লেট আর গ্লাসের সেট, আর সারি সারি কাছের গ্লাস – বিভিন্ন সাইজের, বিভিন্ন রঙের। গ্লাসের ওই পাশটা থেকে সে কিছুতেই চোখ সরাতে পারছিল না। কিন্তু কেন? মাথার মধ্যে সে যেন একবার লুবনার কণ্ঠও শুনতে পেল, আর ঠিক তখনি তার মনে পড়ে গেল গত রাতের খাবার টেবিলের ঘটনাটা – সেই যে সে লুবনার দিকে গ্লাস ছুড়ে মেরেছিল। যদিও তার মনে পড়লনা ঠিক কি কারণে সে এতো রেগে গিয়েছিল।

কত কারণেই তো ওদের ঝগড়া হয় – কোনো অপমানজনক কথা যেগুলো স্ত্রীরা স্বামীদের এমনিতেই বলে থাকে, কিংবা কোনো অযথা প্রশ্ন – হবে কিছু একটা। কিন্তু গ্লাসের আঘাতে লুবনার মৃত্যু হয় নি, এটা মুনির নিশ্চিত। হালকা কাচের জিনিস, ওটার বাড়ি লেগে একটু কেটে যেতে পারে, কিন্তু মৃত্যু হবে না। তাছাড়া লুবনার রক্তাক্ত গলায় আঁচড়ের দাগ আছে, একপাশে মাংস খুবলে ছিড়ে নেয়ার চিহ্ন আছে।  

মার্কেটের বড়ো গলিটা পার হতেই হলদে আলোয় মুনির লক্ষ্য করলো যে সে কিছু জিনিসকে অপেক্ষাকৃত ঘোলাটে দেখছে – যেমন দোকানের মালপত্র আর বাজারের অলি-গলিগুলো। অন্যদিকে জীবন্ত যেকোনো কিছুকে কেন যেন সে সাধারণ সময়ের চেয়েও বেশি স্পষ্ট দেখতে পারছে – যেমন পোষাপ্রাণীর দোকানে হলুদ আর সবুজ পাখিগুলো, আশেপাশের সবগুলো মানুষ।

পাখির দোকানের সামনেই সে মেয়েটাকে প্রথম দেখল। সারি সারি একঘেয়ে দোকান আর ক্লান্ত ঘর্মাক্ত মহিলা-পুরুষের মাঝখানে পাটভাঙা সবুজ শাড়ি পরা মেয়েটা যখন এসে দাঁড়াল, তখন তাকে মনে হল দুধ-সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে হঠাৎ চোখ অন্ধ করে দেয়া কোনো রঙের বৈপরীত্য। সে যখন পেন্সিল হিলের শব্দ তুলে হেটে যেতে শুরু করল, মার্কেটের সবগুলো আলোর বিন্দু তখন তার দিকে ছুটে গিয়ে তাকে ধরার ব্যর্থ এক চেষ্টা করতে থাকল। মুনিরের একবার মনে হল শারমিনের সাথে মেয়েটার চেহারার ভীষণ মিল আছে।

সাধারণ বাঙালি মেয়েদের তুলনায় ওকে দীর্ঘাঙ্গিনীই বলা যায়। জরি দেয়া কালো হাই হিলের

বাড়তি উচ্চতার কারণে তাকে আরো বেশি ছিপছিপে দেখাচ্ছে। সবুজ শাড়ির সাথে মিলিয়ে সবুজ ব্লাউজ পড়েছে, কিন্তু পেছন থেকে কোমরের দৃশ্যমান ফর্সা অংশটার দিকেই বার বার মুনিরের দৃষ্টি চলে যেতে চাচ্ছে। মুনিরের একবার মনে হলো মেয়েটা যেন আড়চোখে একবার ওকে দেখেছেও। হতে পারে এই মেয়েটা আসলে শারমিনই। 

শারমিন আর মুনির স্কুলে আর কলেজে একই ক্লাসে পড়ত। ভালো বন্ধুত্ব ছিল দুজনের – একজন প্রাইভেটে গণিত পড়লে আরেকজন পড়ত বিজ্ঞান, তারপর দিনের শেষে নোট বিনিময় করত, একসাথে পাশের বাসায় যেত টেলিভিশনে সাপ্তাহিক নাটক দেখতে।

সেই কলেজে পড়ার সময় এক বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের দিন শারমিন লাল পাড় লাগানো সাদা শাড়ী পরে কলেজে এসেছিল। মুনির বোকার মত হা করে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে, শারমিন সেটা লক্ষ্য করে মিটিমিটি হাসছিল। মুনির একরাতে শারমিনকে স্বপ্নেও দেখেছিল – শারমিন যেন একটা সাদা পরী, আর তার সাদা শাড়ীর আঁচলটা ডানা হয়ে গেছে। সেই স্বপ্নের কথা মুনিরের এখনো মনে আছে। 

গয়নার একজন দোকানদার, কলেজ ফেরত এক তরুণী, ফর্সা মতো লম্বা একটা ছেলে ওর দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে রইল, কিন্তু মেয়েটা সবাইকেই উপেক্ষা করে গট গট করে নিজের মতো সামনে এগিয়ে চলল। মুনিরও একটু দূরত্ব রেখে, একটু আড়ালে থেকে ওকে অনুসরণ করতে লাগল। 

কলেজে পড়ার সময়ই শারমিনের বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছিল, তারপর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার আগেই ওর বিয়ে হয়ে যায়। তার বর একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বড়ো চাকরি করতো, অনেক টাকা বেতন। যদিও বিয়ের আগ পর্যন্ত শারমিনকে মুনিরের শুধুই ভালো লাগতো, কিন্তু বিয়েটা হয়ে যাবার পর মুনিরকে সন্ধ্যার রাস্তায়, কিংবা বৃষ্টির দুপুরে, অথবা রাতের অন্ধকারে উদ্দেশ্যহীন এদিক-ওদিক হাটতে দেখা যেত।

মুনির আরেকবার হাতঘড়ির দিকে তাকালো। এসময় কি পুলিশ স্টেশনে যাওয়া যাবে? একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তার অবশ্যই ঘটনাটা থানায় রিপোর্ট করা উচিত। তার ভয় কি? সে তো আর খুন করে নি। আর খুন যদি তার দ্বারা হয়েই থাকে, তাহলে শাস্তি তার প্রাপ্য, সুতরাং সেটা সে মাথা পেতে নেবে। মুনির ভাবল রমনা থানায় যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত হবে, কারণ মৃতদেহ এই এলাকাতেই পাওয়া গেছে। নাকি আবার এটা ধানমন্ডি থানার আন্ডারে পড়েছে? এলাকার এই ভাগাভাগিগুলো মুনিরের কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট না। 

সেই কমবয়সের দিনগুলোতে মুনির তার বিরহ আর স্বপ্নের ঘোর একসময় ঠিকই কাটিয়ে উঠেছিল, আবার পড়ালেখায় মন দিয়েছিল, এমনকি ঢাকা ভার্সিটিতে এডমিশনও পেয়েছিল। এদিকে ভাগ্যের কি চক্র, কেমন করে যেন এই ভার্সিটিতেই সে আবার খুঁজে পেয়েছিল তার সেই পুরোনো শারমিনকে, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে – শারমিন সমাজবিজ্ঞানে, আর মুনির পরিসংখ্যানে। ওদের দুজনকে প্রায়ই একসাথে দেখা যেতো লাইব্রেরিতে, ক্যান্টিনে আর হোস্টেলের পাশের মাঠে।

মার্কেটের বাতাস যেন পুরোটাই বাষ্প হয়ে গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। এদিকে সেই দুপুর একটায় মুনির খাবার খেয়েছে, পানিও খায়নি অনেকক্ষন। একবার সে ভাবল পরীক্ষা করে দেখার জন্য একবার শারমিনের নাম ধরে ডাকে, কিন্তু ঠিক তখনি মেয়েটা ডানদিকের গলিটায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

ইউনিভার্সিটির সেই দিনগুলোতে শারমিন তার বাসায় একদিন দাওয়াতও দিয়েছিল মুনিরকে। ও তখন সে বাসাটায় বলতে গেলে একাই থাকতো, কারণ জহুরুলকে প্রায়ই ঢাকার বাইরে কাজে যেতে হতো। জহুরুল মুনিরকে ছোটভাইয়ের মতো দেখতেন, পাশ করার পর চাকরি-বাকরির জন্য চেষ্টা-তদবির করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। 

দম বন্ধ গরমে যখন মুনিরের মনে হলো যে সে বমি করে দেবে, তখনি মেয়েটা মার্কেটের পেছনের দিকটাতে যেতে শুরু করলো। এ পাশটা একদম নির্জন, এদিকে শুধু দর্জির দোকানগুলো আছে। এখানে গরমটাও একটু কম, হয়তো আশেপাশে কোথাও বড়ো জানলা আছে, ফলে মুনির একটু হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কিন্তু সে থমকে দাঁড়াল, যখন দেখল মার্কেটের পেছনের কলাপসিপল গেটটা দিয়ে মেয়েটা বাইরে বের হয়ে যাচ্ছে।

লুবনার ব্যাপারটা সমাধান করা জরুরি। সবকিছু মনে করতে চেষ্টা করা খুবই দরকার। কিন্তু আজ এই সন্ধ্যায় সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, এই সবুজ শাড়ি কোনোভাবে তাকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। ছোটবেলায় মুনিরের নানী তাকে বলতো সন্ধ্যার সময় বাইরে না থাকতে, মাগরেবের আগে বাইরে গেলে নাকি সন্ধ্যাভ্রম হয়, চেনা পথ ভুলে মানুষ অপরিচিত রাস্তায় চলে যায় – কিন্তু সেসব বহুদিন আগের কথা।   

মার্কেটের পেছনে কয়েকটা ছাপড়া দোকানের পরেই ছোট গলি, আর সেটা বেশ নির্জন। এলাকার লোকজন ছাড়া এদিকে কেউ এতো রাতে যাওয়ার সাহস পাবে না, অথচ মেয়েটা ঠিক সেই ছোট গলিটার দিকেই যাচ্ছে।  

মার্কেট থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতেই ঠান্ডা এক রাশ বাতাস মুনিরের শরীরটা জুড়িয়ে দিলো। মনে হয় কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে, তাই বেশ জোরে-সোরে বাতাস ছেড়েছে। ওর সমস্ত ক্লান্তি এক মুহূর্তে দূর হয়ে গেল, কিন্তু সাথে সাথে মনে ভীষণ এক জেদও চেপে বসল – যেন কোনোভাবেই এই মেয়েকে হারিয়ে ফেলা যাবে না। সবুজ শাড়ির পেছন পেছন সেও সেই ছোট গলিতে ঢুকে পড়ল।

মুনির যখন ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারে পড়ে, সে বছর মার্চ মাসে একটা দুর্ঘটনার মতো ঘটেছিল। ফাইনাল পরীক্ষার কয়েকদিন আগের ঘটনা সেটা। সে সন্ধ্যায় মুনির আড্ডা দিতে এসেছিল শারমিনের বাসায়, জহুরুল শহরের বাইরে কাজে ছিল। লোড শেডিং আর ভ্যাপসা একটা গরম ছিল সে সন্ধ্যায়, ওরা দুজন তাই সন্ধ্যার পর ছাদে চলে গিয়েছিল গল্প করার জন্য। মুনিরের এপর্যন্ত মনে আছে, কারেন্ট আসার পর ওরা নিচে নেমে এসেছিল। কিন্তু এরপর আর কিছু তার মনে নেই। পরদিন সকালে ঘুম ভেংগে দেখেছিল, সে শারমিনদের ড্রইংরুমে শুয়ে আছে – মাঝখানে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো, অস্পষ্ট। সে শারমিনকেও জিজ্ঞেস করেছিল – সেরাতে কিভাবে সে জ্ঞান হারাল, কোন খিঁচুনি হয়েছিল কিনা, গায়ে জ্বর ছিল কিনা, ইত্যাদি। কিন্তু মেয়েটা এ ব্যাপারে ওকে একটা কথাও বলেনি।

পরের বার একইরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল প্রায় মাস তিনেক পর, জুনের শেষ দিকে। সেবারও সন্ধ্যার পর কথা বলছিল সে শারমিনের সাথে, তারপর হঠাৎ করেই তার কোন স্মৃতি নেই। সকালে মুনির আবিষ্কার করে – সে শারমিনের বিছানায় শুয়ে আছে। মুনিরের কাছে স্মৃতি হারানোর ব্যাপারটার চেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিল সম্ভাব্য ভুল বোঝা-বোঝি – মানুষ তো বিশ্বাস করবে না যে ওদের মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর কিছু ঘটে নি! দ্বিতীয়বার এরকম হবার পর মুনির অস্বস্তিতে সে বাসায় যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিল, এমনকি সে ধীরে ধীরে শারমিনের সাথে সব ধরণের যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছিল। আর এখন তো প্রায় বছর দশেক হয় ওর সাথে মুনিরের কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই, যে কারণে সে নিশ্চিত হতে পারছে না যে সামনের সবুজ শাড়ি পরা মেয়েটা আসলে শারমিনই। 

মেয়েটা যখন অন্ধকার গলি পার হয়ে ডানদিকের ছোট রাস্তাটায় গিয়ে উঠল, তখনি ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টির ফোটা মুনিরের ক্লান্ত ঘর্মাক্ত মুখে এসে পড়ছে। রাত প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে, সোডিয়াম লাইটের আলোতে দেয়ালগুলো বিবর্ণ লাগছে। এই রাস্তাটা আগের মতো নির্জন নয়, গলির মাথায় কতগুলো কমবয়সী ছেলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মেয়েটা যখন ছেলেগুলোর সামনে দিয়ে চলে গেল, তখন ওরা সেদিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু কিছু বলল না। বৃষ্টি একটু বেড়েছে, মুনিরের শার্টের হাত আর বুক ভেজা ভেজা লাগতে শুরু করেছে, কিন্তু ওর মাথায় এখন সেটা নেই।

মেয়েটা বাঁদিকের সরু গলিটাতে ঢোকার আগে ওর দিকে একবার ফিরে তাকাল। মুনির তখন মোটামুটি নিশ্চিত যে এটা শারমিনই, আর হতে পারে সেও জানে যে মুনির তাকে অনুসরণ করছে। এ গলিটা এতো ছোট যে দুটা রিক্সা পাশাপাশি যেতে পারবে না। মুনির গলিতে ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তে লক্ষ্য করলো যে ছেলে গুলো এদিকে আসতে শুরু করেছে।

এতক্ষন সে ছেলেগুলোকে কোনো পাত্তা দেয়নি। আরেকবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে ওর ধমনীতে রক্ত চলাচল বেড়ে গেল, এমনকি একসময় সে যেন তার নিজের হৃৎস্পন্দনও শুনতে পেতে শুরু করল। পেছনে মোট পাঁচটা ছেলে, সবগুলো জিনসের প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরা, মাথায় গোল টুপি তিনজনের, মুখে দাড়ি সবগুলোর। মুনির দ্রুত পা চালাল। এরা ছিনতাইকারী হতে পারে। মহিষকান্দি কওমি মাদ্রাসার কথাও তার একবার মনে পড়লো।    

মহিষকান্দি মাদ্রাসা থেকে সপ্তাহ দুয়েক আগে একদল মৌলভী এসেছিল তার অফিসে, তাদের এনজিওর  কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একরকম হুমকিই দিয়ে গিয়েছিল তারা। মুনিরদের এনজিওটা মৃত্যুদন্ড ধরনের বড় শাস্তিগুলো রোধ করার ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরির কাজ করে।

মুনির হুজুরদের জিজ্ঞেস করেছিল এনজিওর ব্যাপারে তাদের আপত্তির কারণটা। উত্তরে তারা বলেছিল – যেহেতু সমাজে এখনো ধর্ষণের মত জিনিস আছে, যেহেতু মানুষ এখনো দুর্বলকে অত্যাচার করে, একে অন্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে, সেহেতু মানুষ সভ্য হয়েছে এমন দাবী করা যায় না। এরা আরো বলছিল – এই আইনগুলো হয়েছিল মানুষের শরীরের জন্য, আর মানুষ আজো সেই মধ্যযুগের মতই শারীরিক রয়ে গেছে। ধর্মের উদ্দেশ্য ছিল, এই আইনগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের আত্মাকে শরীরের উর্ধ্বে উত্তীর্ন করা। যেহেতু আমরা তা করতে পারি নি, সেজন্য ধর্মীয় আইন তুলে দিতে বলা হবে অন্যায়।

মোল্লাগুলোর সাথে সেদিন তার তুমুল তর্ক হয়েছিল। এই পাঁচটা ছেলে ওই কওমি মাদ্রাসার ওদের লোক নয় তো! বাংলাদেশে আজকাল অসম্ভব কিছু না। এদিকে বৃষ্টির ঝাপ্টা বাড়ছে। সারাদিনে একবারও লুবনা বেচারির জ্বরের খোঁজ নেয়া হয় নি। আয়ানের চেহারাটাও একবার মুনিরের চোখে ভেসে উঠল।

কিন্তু যত ভয়ই দেখানো হোক, মুনির কোনোদিন তার অবস্থান থেকে সরে আসবে না – ও সে ধরণের মানুষই না। এই যুগে এসে মৃত্যুদন্ডের মত পাশবিক আইনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার কোন মানে আছে বলে সে মনে করে না। চুরির জন্য হাত কেটে ফেলা, রক্তের বদলে রক্ত, বিয়ের বাইরের সম্পর্ক এমনকি যদি সেটা দুর্ঘটনাবশতও হয় তার জন্য পাথর ছুড়ে হত্যা করা – এসব তো চৌদ্দ-পনর শ বছর আগের নিয়ম। কেন সেগুলোকে আজো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা!  

গলি ধরে ওরা যত সামনে এগুচ্ছে ততই যেন সেটা আরো সরু হয়ে আসছে। মুনির সামনে দেখলো সবুজ শাড়ি বৃষ্টিতে পুরোপুরি ভিজে গেছে, কিন্তু বৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এমনভাবে হেটে চলেছে যেন কোথাও কিছুই হয় নি। এদিকে ছেলেগুলোর সাথে মুনিরের দূরত্ব ক্রমেই কমে আসছে।

লুবনার অনেক বই পড়ার অভ্যাস ছিল। প্রথমদিন মহিষকান্দির ঘটনা শুনে সে বলেছিল যে এরকম একটা দর্শনের কথা সে কোথাও পড়েছে, যারা বলে – প্রতিটি ব্যক্তির জীবনের মূল্য আছে ঠিকই, কিন্তু কেউ যখন হত্যা কিংবা ধর্ষণের মতো জঘন্য কোনো অপরাধ করে তখন সে তার নিজের ব্যক্তিত্বের অধিকার হারিয়ে ফেলে, ফলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ভুল হয় না। 

মুনির যখন দেখল যে বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে ওরা পাঁচজন তার দিকে অনেক বেশি এগিয়ে এসেছে, তখন সে বাউন্ডারি দেয়ালগুলোর দিকে তাকাল – এগুলো ওর কাঁধ সমান উঁচু, দেয়াল টপকানোর দরকার হলে সম্ভবত সেটা করা যাবে। ছেলেগুলোর কাছে অস্ত্রও থাকতে পারে – ছোট চাকু, রাম দা, কিংবা পিস্তল – কিছুই নিশ্চিত নয়। ওরা ততক্ষনে মুনিরের আট-দশ গজের মধ্যে চলে এসেছে।

বৃষ্টির বেগ তখন আরো বেড়েছে। মুনির মাত্র হাত বাড়িয়েছে দেয়াল টপকানোর জন্য। ঠিক তখনি সে শুনতে পেলো মেয়েটার কণ্ঠ – ‘মুনির, এদিকে চলে এসো।‘

মেয়েটা একটা ছোট গেট খুলে ভেতরে ঢুকছে। মুনির আর সাত-পাঁচ চিন্তা না করে ওর পেছন পেছন গেটের ভেতর ঢুকে গেল। আর সাথে সাথে শারমিন গেটটায় খিল লাগিয়ে দিল।  

দোতলা একটা বাসা। বোঝা যায় তিনতলার কাজ শুরু হয়েছিল, ছাদে অসমাপ্ত কাজের চিহ্ন হয়ে রডগুলো ঝুলে আছে। শারমিন ওকে সাথে আসার জন্য ইঙ্গিত করে দোতলায় উঠতে শুরু করলো। ও তখন ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে, সবুজ শাড়ি থেকে পানি ঝরে পড়ছে। মুনির চুনকাম করা সাদা দেয়ালের ওপর দিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকাল, কিন্তু ছেলেগুলোকে আর দেখতে পেল না।

পুরোনো দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকে শারমিন লাইট জ্বালিয়ে দিল। মুনির বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষন ভেজা কাপড় থেকে পানি ঝরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল, তারপর একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত ঘরে ঢুকে পড়ল। শারমিন দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।

ছোট একটা ড্রইং রুম, একপাশে একটা শোকেস, মাঝখানে বেতের টেবিল আর চেয়ার। মুনীর একটা কাঠের চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়ল। শারমিন ওকে বসতে বলে ভেতরে চলে গেল। একটু পর মুনির পর্দার আড়াল থেকে দেখল মেয়েটা কিছু জামা-কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকছে।

বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এ বৃষ্টি সারা রাতে থামবে কিনা সন্দেহ আছে। লুবনা নিশ্চয়ই ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে, মোবাইলেও চার্জ শেষ। এ কি বিপদে পড়া গেলো! এদিকে ভেজা কাপড়টা যেন গায়ে বার বার চেপে ধরে ওকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে – কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, ও যেন সাংঘাতিক কোনো বিপদে পড়তে যাচ্ছে। 

শারমিন ফিরল মিনিট দশেক পর। সে একটা মেরুন রঙের জামা পড়েছে, ভেজা কালো চুল এলোমেলো হয়ে আছে, কিন্তু সেটাতে যেন ওর সৌন্দর্য দশগুন বেড়ে গেছে। সে একটা তোয়ালে, পাজামা আর গেঞ্জি মুনিরের হাতে ধরিয়ে দিলো, তারপর বাথরুমের দরজাটা দেখিয়ে দিল। বলল, ভেজা কাপড়ে বেশিক্ষন থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। 

মুনির উঠে দাঁড়াল – ‘শারমিন, আমার আজ যেতে হবে। একটা বড় ঝামেলায় পড়েছি,  আরেকদিন আসব।’  

শারমিন দরজার কপাট লাগিয়ে দিয়ে বলল – ‘মনে হয় না, খুব সহজে তুমি এখন বের হতে পারবে, আর তাছাড়া তুমি তো জানো না ছেলেগুলো বাইরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে কিনা।’   

মুনির কয়েক সেকেন্ড কি যেন ভাবল, তারপর শারমিনের হাত থেকে শুকনো কাপড়গুলো নিয়ে পাশের বাথরুমে চলে গেল। জহুর ভাইয়ের জামা-কাপড় ওর একটু ঢিলেঢালা হলো, কিন্তু তারপরও শুকনো কাপড়ে সে কিছুটা স্বস্তির নিঃশাস ফেললো। বাথরুমের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে দেখল সামনের গলিতে ইতোমধ্যে এক হাটু পানি জমে গেছে। সে যদি এখন থেকে কোনোমতে বের হতেও পারে, বাসায় সহজে ফিরে যেতে পারবে বলে মনে হয় না।

ড্রইংরুমে ফিরে মুনির দেখলো শারমিন চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। সে ট্রেতে করে এক গ্লাস পানি, এক কাপ চা, একটা প্লেনকেক আর কিছু চানাচুর-মুড়ি এনে রেখেছে। সেই পুরোনো দিনগুলোতেও বৃষ্টি হলে ওরা এরকম চানাচুর মুড়িই মাখিয়ে খেত।

শারমিন জানতে চাইল ছেলেগুলোকে দেখে কেন সে এতো ভয় পেয়েছিল। মুনির বললো যে সে ভেবেছিল ছেলেগুলো কোনো কারণে ওকে টার্গেট করেছে। মহিষকান্দি মাদ্রাসার সিনিয়র হুজুরদের সাথে ওর সাম্প্রতিক গন্ডগোলের বিষয়টাও সে খুলে বলল শারমিনকে। জানাল যে আজকাল দাড়ি-টুপি পড়া কাউকে দেখলেই তার মনে হয় যে এরা ওর পেছনে লেগেছে, ওর এনজিওর কাজকে থামানোর জন্য ওকে মারধর করতে পারে কিংবা মেরেও ফেলতে পারে।

শারমিন সব শুনলো, চায়ে একবার চুমুক দিলো, তারপর কাপটা একপাশে রেখে বললো – ‘আমি কিন্তু বহুদিন ধরে অপেক্ষা করেছি তোমাকে একটা প্রশ্ন করবো বলে।’

বাইরে তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

‘তুমি কি তোমার সেই সাময়িকভাবে স্মৃতি হারানোর কারণ বের করতে পেরেছ? যে ঘটনার পর তুমি আমার কাছ থেকে পালিয়ে গেলে।’ 

কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকে মুনির – ‘ও, সেই ঘটনা, হ্যাঁ, একজন সাইকায়াট্রিস্টের সাথে কথা বলেছি আমি। মনে হয়, এটা একধরণের অ্যামনেসিয়াই।’

‘আমার একটা জিনিস মনে হয়, জানো’ – শারমিন ওর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে – ‘নারী-পুরুষের সম্পর্কের মূল কারণটা শারীরিক।’

মুনির কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে – ‘শরীরকে অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু ওটাই সবকিছু নয়। আর তোমাকে আমি একেবারেই আলাদাভাবে দেখি। হেসো না, আমি এখনো প্লেটোনিক ভালোবাসায় বিশ্বাস করি, আমি মনে করি যে কাছাকাছি না এসেও কাউকে ভালোবাসা সম্ভব।’

শারমিন হাসছিল – ‘তুমি নিজের সম্পর্কে কতটুকুই বা জানো! সেই দুই রাতে তোমার আসলে কি হয়েছিল, তুমি তো এটাও বলতে পারো না, তাই না?’

মুনিরের কপালে ভাজ পড়ে। বাইরে বৃষ্টি মনে হচ্ছে আরো বেড়ে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে শারমিন ওর একেবারে পাশে এসে বসল – ‘তুমি ওয়্যারউলফের কথা শুনেছ?’

মুনির মাথা নাড়লো – সে জানে না, আর এসবে বিশ্বাস করারও প্রশ্ন আসে না।

‘আমি অবাক হচ্ছি তুমি জানো না শুনে। বিদেশিরা বলে ওয়্যারউলফ বা নেকড়েমানব। আমাদের গ্রামদেশে হয়তো এটাকে বলবে জিনে ধরা। মূল ব্যাপারটা কিন্তু একই, পৃথিবীর অনেক মানুষই পূর্ণিমার রাতগুলোতে পশুতে বদলে যায়। যদিও বৃষ্টির জন্য বোঝা যাচ্ছে না, আজ কিন্তু পূর্ণিমা।’

‘তা তুমি এসব জানো কি করে?’

শারমিন আরো একটু গা ঘেঁষে বসে, তারপর প্রায় শোনা যে না এমনভাবে ফিস ফিস করে বলে – ‘যদি বলি, ঐ দুরাতে তুমি সেরকমই হয়ে গিয়েছিলে!’

মুনির এটাকে তামাশা ভেবে স্বস্তির হাসি হাসে। শারমিন কিন্তু একটুও হাসে না, সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে মুনিরের চোখের দিকে।

‘আমি যদি সত্যি সত্যিই সে রাতগুলোতে পশুতে পরিণত হই, তাহলে তো তুমি আজ বেঁচে থাকতে না, তাই না?’ – মুনির বলে। 

‘এর কারণ হচ্ছে’ – হিস হিস করে কথাগুলো বলেই মেয়েটা তার গায়ে একটা খামচি বসিয়ে দেয়, একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে – ‘আমি নিজেও ওই রাতগুলোতে পশুতে বদলে যাই।’

মুনির প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও অল্পসময়ের ভেতর নিজেকে সামলে নিল। কিন্তু তখন মেয়েটা তার গলায় হঠাৎ কামড় বসিয়ে দিলো, ঠিক যেভাবে নেকড়ে তার শিকারকে কামড়ে ধরে।

আর ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। হঠাৎ করেই মুনিরের মনে হতে শুরু করল, তার শরীরে যেন কিছু একটা পরিবর্তন আসছে। মনে হতে লাগল, ওর শরীরের লোমগুলো পশুর লোমের মত বড় বড় হয়ে যাচ্ছে, আর দাঁতও যেন মুখ থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে – ঠিক একটা নেকড়ের মত।

শারমিন তখন হাসতে শুরু করে। বিস্ময়ভরা চোখে ওর হাসি দেখতে দেখতে মুনিরের সকালের সেই নেকড়ে বাঘের স্বপ্নটার কথা তার মনে পড়ল, যেটা দেখে সে অনেক মাথাব্যথা নিয়ে জেগে উঠেছিল।

তার এটাও মনে পড়ল, গতরাতে গ্লাস ছুড়ে মারার পর যখন লুবনা ওকে হুমকি দিয়েছিল যে সে থানায় যাবে আর নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করবে, তখন সে কিভাবে মেয়েটাকে খামচে ধরেছিল আর গলাতে কামড়ও দিয়েছিল। 

‘আমি তো আগে থেকেই জানি, তুমি কি’ – শারমিন হাসতে হাসতেই বলে – ‘তোমাকে বার বার বলারও চেষ্টা করেছি, কিন্তু তুমি বুঝতে পারো নি . . .’

মুনির তখন নিজের শারীরিক পরিবর্তনগুলোকে থামানোর চেষ্টায় ব্যস্ত।

‘তুমি বুঝতে পারোনি যে তুমিও আমাদের দলেরই লোক, আমাদের মতই একজন . . .’  – ততক্ষণে শারমিনের নিজের চেহারাও বদলাতে শুরু করেছে।

মুনির যখন বুঝতে পারল যে শারমীনের কথাই সত্যি, অর্থাৎ সত্যি সত্যিই সে চিরদিনের মত আটকা পড়েছে নেকড়েবাঘের মতো একটা কিছুর শরীরে – তখন সে আকাশ ফাটিয়ে আর্তনাদ করে উঠল, কিন্ত সে আর্তনাদটাও শোনাল নেকড়ের কান্নার মতই।

‘প্রয়োজনে আমি আত্মহত্যা করব’ – মুনির নিজের কান-মাথা চেপে ধরে বলল – ‘তবু এই শরীর থেকে মুক্ত হব।’

শারমিন হাসল, নেকড়ের হাসি – ‘তোমার মৌলভী বন্ধুদের কাছে যাও, তারা যদি দয়া করে তোমাকে পাথর ছুড়ে হত্যা করে . . . সত্যি কথা বলতে কি, মৃত্যু ছাড়া এটা থেকে মুক্তির আসলেও আর কোন রাস্তা নেই তোমার কিংবা আমার’ – শেষ কথাগুলো বলার সময় কেন যেন ওর চেহারা থেকে হাসি মুছে যায়।

‘তাও যদি হত’ – মানুষ থেকে বন্য জন্তুতে পরিণত হবার কষ্টকর শারীরিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মুনির ভাবল। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্বাভাবিক পূর্ণিমার রাতে বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া ঢাকা শহরের নিভৃত এক ফ্ল্যাটে পাশবিক উন্মাদনায় মিলিত হয়েছিল একটা নেকড়ে বাঘ ও একটা বাঘিনী।

(রহস্য গল্প / মায়িন খান, এপ্রিল ২০২১)

Leave a comment