অধ্যায় ৩: ঈশ্বর আছেন তার প্রমান কি?
থানায় জিডি করতে করতে মুনিরের বেলা দুইটা বেজে গেল। মুনির দশটায় থানায় গেছে। প্রথমে ঠিক টেবিল খুঁজে বের করতে করতেই বাজল এগারোটা। তারপর দেখা গেল, সেই লোক গেছে কিসের যেন বিল দিতে, আরো দেড় ঘন্টা। ওই লোক আসার পর হাজারটা প্রশ্ন, সন্দেহ – পারভেজ সাহেবের নাম বলার পরও। শেষে মুনির যখন ফোনে উনার সাথে কথা বলিয়ে দিতে চাইল, তখন অফিসার রাজি হল ডাইরি নিতে। নতুন-পুরাতন নথি-পত্রে ঠাসা রুমটা থেকে বের হতে হতে মুনির ভাবল, এ জায়গা থেকে অতীত কোন রেকর্ড এরা কেমন করে বের করে, নাকি বানিয়ে বানিয়ে কিছু লিখে দেয়।
মেসে ফিরে সে দেখে দরজার সামনে মাহমুদ ভাই বসে আছে। মাহমুদকে কোন কারণে মুনিরের বেশ চিন্তিত মনে হল, মুনিরকে দেখেই সে সামনে এগিয়ে এল। মুনির তাকে তার অনলাইন বিপত্তির কথা জানাল। মাহমুদ বলল যে সেও গত দুইদিন ধরে তার ইউটিউব চ্যানেলে হুমকি-ধামকি পাচ্ছিল, আজ আবার সকালে তার নামে একটা ‘বিদায়ী প্যাকেট’ও এসেছে। কে বা কারা প্যাকেটটা মাহমুদের বাসা কাম স্টুডিওর বারান্দায় ফেলে গেছে। মাহমুদের ছোট ভাই পলাশ সাহস করে প্যাকেট খুলে দেখে ভেতরে কাফনের একগজ সাদা কাপড়, আর তার গায়ে লেখা ‘হারামজাদা! চ্যানেল খুইলা বহুত মজা নিসস। এইবার তোরে কাৎরাইতে দেইখা মজা লমু আমরা। ইতি, তোমার বাল্যকালের দোস্ত আজরাইল।’
মুনির বলল যে সে মাত্র জিডি করে এসেছে, মাহমুদেরও জিডি করা উচিত। কিন্তু এতে মাহমুদের চিন্তা কমল বলে মনে হল না।
‘আচ্ছা মুনির, একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমরা নেক্সট অনুষ্ঠানে একটু স্মার্ট কোন মৌলানা ধরণের কাউকে নেই, তারপর প্রশ্নোত্তর পর্বে ইচ্ছে করে ওকে জিতিয়ে দিই। তোর কি মনে হয়, এতে এই গ্রূপটার রাগ কি একটু পড়তে পারে?’
মুনির কাঁধ ঝাঁকাল, সে নিশ্চিত না কিসে কাজ হবে। এটা এখন রীতিমতো ড্যামেজ কন্ট্রোলের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এর চেয়ে খারাপ কিছু তো আর হবে না।’
‘তুই ঠিক বলেছিস, অবস্থা এরচেয়ে আর খারাপ হতে পারে না। ওই পুলিশ-টুলিশ দিয়ে আসলে কোন কাজ হবে না। আর কে বলতে পারে, থানার মধ্যেই ওদের ইনফর্মার আছে কিনা। তাছাড়া পুলিশ তো আমাকে চব্বিশ ঘন্টা পাহাড়াও দিতে পারবে না – মেরে ফেলে গেলে লাশ তুলে নিয়ে খালি একটা ময়না তদন্ত করবে আর পত্রিকার জন্য একটা সংবাদ সম্মেলন। আচ্ছা, তোর কি পরিচিত কোন আধুনিক মোল্লা বা ছাগু আছে যে আমার জন্য এই নেক্সট শো-টাতে অতিথি হতে পারে?’
মুনির কিছুক্ষন কি যেন ভাবল।
‘মাওলানা নেই, সাধারণ একজন মানুষ আছে, তবে তার নলেজ ভালো।’
‘কে সে? আমাকে আজকে তার কাছে একটু নিয়ে যেতে পারবি? কারণ আমার কালকেই প্রোগ্রাম। চেষ্টা করে দেখি, আগুনে একটু পানি ঢালা যায় কিনা।’
মুনির রাজি হল। নজরুল সাহেবকে ফোন দিয়ে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার পর উনিও কথা বলতে রাজি হলেন। মুনিরের ভীষণ ক্ষুধা লেগেছিল, ওরা দুজন হালিম মিয়ার রেস্টুরেন্টে মুরগি-ভাত আর চা খেয়ে তারপর তিনটে নাগাদ ইশাদের বাসায় গিয়ে হাজির হল।
নজরুল সাহেব ওদের অপেক্ষাতেই ছিলেন। বাসায় ঢুকে পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর নজরুল মাহমুদকে বসতে বলে মুনিরকে নিয়ে পাশের খাবার ঘরে চলে গেলেন। তারপর গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে বললেন যে এএসপি পারভেজ তাকে ফোন করেছিল।
‘পারভেজ তোমার ব্যাপারটা নজর রাখছে। ও বলল যে ময়মনসিংহের আসে-পাশের কিছু গ্রামে একটা উগ্রবাদী গোষ্ঠী সক্রিয় আছে, এ ব্যাপারে পুলিশের কাছে রিপোর্টও আছে। সলিড ইনফরমেশন পেলে তারা এমনকি ক্রাকডাউনেও যেতে পারে। মোটকথা, বিষয়টা সিরিয়াস। তোমাকে কয়টা দিন সাবধানে থাকতে হবে। দরকার হলে কয়েকটা দিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসো।’
‘আমিও তাই ভাবছিলাম।’
‘আর কোন সমস্যা হলে পারভেজকে সরাসরি ফোন দেবে, অথবা তার সাব-ইন্সপেক্টর হাফিজকে, এই নাম্বারটায়।’
ওরা বসার ঘরে ফিরে দেখে মাহমুদ চুপ-চাপ বসে আছে। নজরুল ওর সামনে গিয়ে বসলেন, তারপর বললেন তিনি সাধ্যমতো মুনির আর মাহমুদকে সাহায্য করবেন।
‘কিন্তু আমাকে কেন নিতে চাচ্ছো? আমি তো কোনো সেলেব্রিটি নই, আমাকে কেউ চেনেও না।’
‘আপনার মত সাধারণ মানুষকেই আমরা নেই। এতে দর্শকরাও অনুষ্ঠানের সাথে একাত্মতা অনুভব করতে পারে।’
‘ইন্টারেস্টিং। তুমি কোন উদাহরণ দিতে পারো? কি ধরণের প্রশ্ন হতে পারে?’
‘অবশ্যই। তাছাড়া আপনি চাইলে অনুষ্ঠান শুরুর আগে আগে আপনাকে আমি এক সেট প্রশ্নও দিয়ে দেব, যাতে আপনি নিজের মত করে উত্তরগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারেন।
আচ্ছা, এবার ধরে নিন আপনি আমার প্রোগ্রামে লাইভ বসা আর আমি আপনাকে প্রশ্ন করছি। আপনি উত্তর দিবেন, আমি পাল্টা প্রশ্ন করব। এভাবে আলোচনা এগুতে থাকবে। রেডি স্টার্ট।
নজরুল সাহেব, ঈশ্বর আছেন এমন কোন প্রমান কি আপনার কাছে আছে?’
‘তুমি তো বাবা কঠিন প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছ। আমার তো মনে হয়, ঈশ্বরের কোন প্রমান হয় না, এটা শুধুই বিশ্বাসের ব্যাপার।’
‘একজন শিক্ষিত যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ কিভাবে এমন এক ঈশ্বরের অস্তিত্ব মেনে নেবে, যাকে কেউ কোনোদিন দেখেনি, যাকে নিয়ে কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় না।’
‘তোমার প্রশ্নে ভুল আছে, কারণ তুমি এখানে ধরেই নিচ্ছো যে যা দেখা যায় না, যাকে পরীক্ষা করা যায় না, তার অস্তিত্ব নেই। তোমার এই ধরে নেয়া তো ভুলও হতে পারে।’
‘যা ধরা ছোয়া যায় না, তাকে যদি আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি, তাহলে তো পৃথিবীর সমস্ত কুসংস্কার, ভুত-প্রেত, অভিশাপ, জাদু-টোনা, ঝাড়-ফুঁক, বুজরুকি, সবই আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। একজন বিজ্ঞানমনস্ক লোক যদি জীন-পরীকে অস্বীকার করতে পারে যেহেতু ওগুলোর কোনো প্রমান নেই, তাহলে সে কেন একই যুক্তিতে ঈশ্বরকে অস্বীকার করতে পারবে না? ঈশ্বরের অস্তিত্বেরও তো কোনো প্রমান নেই।’ ।
‘ঈশ্বর আর ভুত এক জিনিস না। ঈশ্বরে বিশ্বাস করলেই যে ভুতে বিশ্বাস করতে হবে এমন কোন কথা নেই। ভুত বলে যদি কিছু থাকতো, সেটা হতো সৃষ্টির অংশ, অন্যদিকে স্রষ্টা বা ঈশ্বর হল সৃষ্টির বাইরে।’
‘একজন শিক্ষিত লোকের বাচ্চার যদি জ্বর আসে, তাহলে সে কি বলবে যে তার ছেলেকে জিনে ধরেছে? নাকি সে বুঝে নেবে যে ছেলের শরীরে কোনো জীবাণুর সংক্রমণ হয়েছে তারপর ডাক্তারের কাছে যাবে?’
‘সে ডাক্তারের কাছে যাবে, কারণ বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে জ্বর জীবাণুর কারণে হয়, সুতরাং ভুতের প্রতিষ্ঠিত বিকল্প ব্যাখ্যাটা হচ্ছে জীবাণু। ঈশ্বরের কিন্তু বিকল্প কোনো ব্যাখ্যা নেই।’
‘বিজ্ঞানই কি ঈশ্বরের বিকল্প ব্যাখ্যা নয়? বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলো তো এই জগৎকে ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট।’
‘বিজ্ঞান ঈশ্বরের বিকল্প ব্যাখ্যা নয়। বিজ্ঞান শুধুমাত্র এই দৃশ্যমান জগৎকে ব্যাখ্যা করতে পারে, এই জগতের বাইরের কোনোকিছুকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। আর ঈশ্বর হচ্ছেন এই জগতের বাইরে, এই জগতের নিয়ম তার জন্য প্রযোজ্য হয় না।’
‘বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে যদি এই জগৎকে ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে একই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে কেন এ জগতের বাইরের সেই ঐশ্বরিক জগৎকে ব্যাখ্যা করা যাবে না?’
‘বিজ্ঞান ঐশ্বরিক জগৎকে ব্যাখ্যা করতে পারবে না, কারণ সেই জগৎ ম্যাটার, এনার্জি কিংবা কোয়ান্টাম ফিল্ডের জগৎ না। সেই জগৎ সৃষ্টির বাইরের এক আধ্যাত্মিক জগৎ, যেখানে সৃষ্টিজগতের নিয়মগুলো নির্ধারিত হয়। তুমি তুমি ম্যাথ আর ফিজিক্সের সূত্র প্রয়োগ করে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে সেই জগৎকে, যেখানে কিনা ম্যাথ আর ফিজিক্সের সূত্রগুলোই নির্ধারিত হয়েছিল?’
‘নজরুল সাহেব, আমরা আবার আগের সেই প্রশ্নে ফেরত যাচ্ছি। আপনি যে আধ্যাতিক জগতের কথা বলছেন, সে জগৎটা যে আছেই তার প্রমাণ কি?’
‘সে জগতের কোন প্রমাণ নেই। এটা একটা বিশ্বাস মাত্র। ঈশ্বরের ধারণা বল আর আধ্যাতিক জগতের ধারণা বল, এসবই মানবজীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের অনুমান।’
‘একজন বিজ্ঞানমনস্ক লোক কেন ঈশ্বর নামে শুধু একটা অনুমানকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে?’
‘কেউই ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে বাধ্য না। ঈশ্বর বলে যদি কেউ থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতাও দিয়েছেন, যেন সে স্বয়ং ঈশ্বরকেও অস্বীকার করতে পারে।’
‘আপনি বলছেন মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে বাধ্য না। তাহলে ধর্মগুলো কেন বলে যে মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে বাধ্য?’
‘আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এটা ধর্মের অপব্যাখ্যা বা ভুল ব্যাখ্যা, আমি এরকম কোন কিছু আমার ধর্মে পাই নি।’
মাহমুদ সোজা হয়ে বসল – ‘নজরুল সাহেব, পারফেক্ট, আপনি পারবেন। ইশ, আজকের কথাগুলো যদি রেকর্ড করতে পারতাম, খুব কাজে লাগত!’
নজরুল হাসলেন – ‘আমি তোমাদেরকে একটা গল্প বলি, এতে হয়তো বিজ্ঞান আর ধর্মের আলাদা আলাদা ভূমিকার ব্যাপারটা সবার কাছে পরিষ্কার হবে।
ধরো, একজন কৃষক একটা বীজ লাগিয়ে দূরে কোথাও চলে গেল, তারপর সেখান থেকে একসময় একটা গাছ হল। অনেকদিন পর যখন গাছটা বড় হল, তখন একজন বিজ্ঞানী সেটাকে আবিষ্কার করলেন। বিজ্ঞানী গাছটাকে পরীক্ষা করলেন, এর ফল খেয়ে তৃপ্ত হলেন, তারপর তার সমস্ত মেধা খরচ করে বের করে ফেললেন কিভাবে গাছটাতে ফল ধরে, কিভাবে গাছটা জীবিত থাকে, সব কিছু। তিনি কি দাবি করতে পারবেন, কৃষক বলে কেউ নেই, যেহেতু আম গাছের পুরো প্রক্রিয়াটা কোনো কৃষক ছাড়াই তিনি ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন? বিজ্ঞানও জগৎকে ব্যখ্যা করে ঠিকই, তার মানে কখনো এটা হতে পারে না যে স্রষ্টা বলে কেউ নেই।’
মুনির এতক্ষন মন দিয়ে দুজনের আলোচনা শুনছিল, এবার তাকে মুচকি হাসতে দেখা গেল। শেষ পর্যন্ত কথা হল আগামীকাল অনুষ্ঠান শুরুর ঘন্টা দুয়েক আগে মাহমুদ গাড়ি নিয়ে আসবে নজরুলকে নিতে, মুনির থাকবে তার সাথে।
(চলবে)

Ma Sha Allah vai Ma Sha Allah
LikeLiked by 1 person
thank you, this made my day. hope you’ll like the upcoming episodes
LikeLike
Please…honestly I’m eagerly waiting. I check your posts everyday brother😊. Btw can you give me your fb ld link? If you have a problem with this then you don’t have to give me brother.
LikeLiked by 1 person