সাখাওয়াতের জীবনে সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনাটা যখন ঘটে, তখন তার বয়স ছিল ছিচল্লিশ বছর। সে থাকতো ক্যালগারি শহরে। কানাডার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্র এই শহর, এর ঠিক মাঝখানে বিশ্বখ্যাত ক্যালগারি ইউনিভার্সিটি, যেখানে সে বহুবছর আগে তার পড়ালেখা শেষ করেছিল। মাস্টার্স করে সাখাওয়াত এশহরেই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি নিয়েছিল। ক্যালগারির পাকিস্তানী অধ্যুষিত এলাকায় বাসা নিয়ে, অফিসের পর বাকি সময়ের প্রথম অর্ধেক মসজিদে ব্যয় করে আর শেষ অর্ধেক স্ত্রী-কন্যাকে দিয়ে সুখেই সে জীবনটা কাটাচ্ছিল – ওই দুর্ঘটনাটা ঘটার আগে পর্যন্ত।
ক্যালগারিতে বাঙালির যেমন অভাব নেই, তেমনি অভাব নেই মুসলমান লোকজনের। স্বপ্না বাঙালি কমিউনিটিতে মিশত আর পরিচিত ভাবীদের সাথে দাওয়াত বিনিময় করে ব্যস্ত সময় কাটাত। সাখাওয়াতের সময় কাটত মসজিদে ভলান্টিয়ারিং করে, আর বছরে বার কয়েক তাবলীগের তিনদিনের জামাতে শরিক হয়ে।
সাখাওয়াত ছিল লম্বা-চওড়া মানুষ, রোদে পোড়া গোলগাল মুখমণ্ডলে সযত্নে ছেঁটে রাখা ঠিক চার আঙ্গুল পরিমান লম্বা দাড়িতে সবসময় মেহেদীর রং থাকত, ইন করা শার্টের বোতামগুলোকে চেপে ধরে তার ভুঁড়িটা সমসময়ই নিজের উপস্থিতি জানান দিত। রোজগার ভালো হওয়া স্বত্ত্বেও সে ভাড়া বাড়িতে থাকত, সুদী ব্যাংকার সাথে লেনদেনে গিয়ে নিজের আখিরাত নষ্ট করতে চাইত না। সে বলত সে ষাট-সত্তর বছরের এই জীবনে বাড়ি বানাতে গিয়ে অনন্তকালের ‘আসল’ বাড়ি সে হারাতে চায় না।
দুর্ঘটনাটার ওই বছরটায় হৃদি গ্রেড ফাইভে পড়ত। শুকনা-পাতলা উজ্জ্বল-শ্যামলা বড় বড় চোখের মেয়েটা বাসার সামনে গাছের ছায়ায় ঢাকা ভেতরের রাস্তাগুলোতে নিজের তুলনায় বড় নীল রঙের একটা সাইকেল চালিয়ে বেড়াতে পছন্দ করত। বাসায় ওর সময় কাটত ভিডিও গেম খেলে আর লাইব্রেরি থেকে আনা থ্রিলার বই পড়ে।
ক্যালগারি শহরের অন্যতম আকর্ষণ হল এর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি নদী বো। শহরের ভেতর অনেকগুলো পার্ক আছে যেগুলো বো রিভারের পাড় ঘেঁষে বানানো হয়েছে। গ্রীষ্মের দুপুরে পার্কে পাঁচ-দশটা বাঙালি ফ্যামিলির সাথে পিকনিক করা ছিল সাখাওয়াত পরিবারের প্রায় প্রতি সপ্তাহের রুটিন। নিয়মিত বাঙালি ভাইদের সাথে দেখা হওয়াতে সাখাওয়াতের মনেই হতো না যে সে প্রবাসে আছে। একটা বিষয়েই শুধু তার মনে একটু খটকা ছিল, আর সেটা হল স্বপ্নার পর্দাপ্রথা না মানা। প্রতিবার পিকনিকে এসে সাখাওয়াতের মনে পড়ত যে স্বপ্নাকে হিজাব না পড়ার দায় পরকালে তাকেই নিতে হবে, আর এসব চিন্তা মাথায় এলেই সে ভেতরে ভেতরে ভীষণ মুষড়ে পড়ত।
স্বপ্না এমনিতে খুবই ভালো মেয়ে – এর বাচ্চা রাখা, ওর বাসায় রান্না দেয়া, পরিচিত কোনো ভাবীর বাসা বদলানোতে সাহায্য করা – এসব সে সানন্দে করত। সাখাওয়াতের সেজন্য মনে মনে অনেক আশা ছিল যে স্বপ্না একদিন ঠিকই হেদায়েত পেয়ে যাবে, হিজাব করা শুরু করবে, আর সেদিন সেও এ পাপের দায়ভার থেকে মুক্ত হবে। প্রতি শেষরাতে সাখাওয়াত যে চার রাকাআত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ত তার মধ্যে দুই রাকাত সে বরাদ্দ রেখেছিল স্বপ্নার হিজাব আর নামাজে মনোযোগের জন্য দোয়া করতে, আর বাকি দুই রাকাত এই মোনাজাতের উদ্দেশ্যে যে তার মেয়ে এই বৈরী খ্রিস্টান পরিবেশের মধ্যেও একজন শক্ত মনের মুসলমান হয়ে বড় হবে।
পিকনিক শেষে প্রতিবারই অবশ্য বিকেলের নদীর পাশে বসে থেকে সাখাওয়াতের মনে পরে যেত দেশের বাড়িতে ছোটবেলার দিনগুলোর কথা, আর সে মনে মনে খোদাকে শতবার ধন্যবাদ জানাত এই পার্থিব বেহেশতে বাস করার সুযোগ পেয়েছে বলে। সে নদী ভালোবাসত, আর তার দুঘটনার সাথে পানির একটা সম্পর্কও ছিল।
ক্যালগারি থেকে মাত্র দুই ঘন্টা গাড়ি ড্রাইভ করলেই কানাডিয়ান পর্বতমালা। কালো-সবুজ পাহাড়, আর তার মাথায় সাদা বরফ রোদের ভেতর ঝকমক করতে থাকে। পর্বতমালার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে বেশ কয়েকটা পাহাড়ি যদি, আর ভেতরে ভেতরে আছে নীলচে-সবুজ পানির কতোগুলো হ্রদ। পাহাড়ি শান্ত হ্রদগুলোতে ক্যানু নামে একধরণের ছোট নৌকা নিয়ে চড়ে বেড়ানো ছিল হৃদি আর সাখাওয়াতের অন্যতম প্রিয় গ্রীষ্মকালীন এডভেঞ্চার। স্বপ্না পানি পছন্দ করত না – ফলে সে মাঝে মাঝে আসত, আর আর কখনো কখনো বাসায় থেকে যেত। বেশির ভাগ সময়ই বাবা-মেয়ে মিলে মাকে ছাড়াই চলে আসত এই পার্বত্য ভ্রমণে।
দুই হাজার দুই সালে এরকমই এক গ্রীষ্মের দুপুরে সাখাওয়াত, স্বপ্না আর হৃদি এসেছিল কানানাস্কি নদীতে রাফটিং করতে। একটা বড় রাবারের নৌকায় ওরা আটজন উঠবে, আর একজন বোট-ক্যাপটেন ওদেরকে চালিয়ে নিয়ে যাবে খরস্রোতা কানানাস্কি নদীর ওপর দিয়ে। দুই ঘন্টার রাইড, কিন্তু অনেক মজা। স্বপ্না স্টেশনে বসে বই পড়বে বলে জানিয়ে দিল, আর বাবা-মেয়ে যথারীতি লাইফ জ্যাকেট পরে রাফটিংয়ে যাবার জন্য তৈরী হল। ওরা আগে ক্যানু চালিয়েছে, কিন্তু রাফটিং এই প্রথম, তারপর আবার পাহাড়ি নদীতে – ফলে ওদের উত্তেজনার শেষ নেই।
প্রায় দেড় ঘন্টা অপেক্ষার পর ওরা একটা নৌকা পেল। এরমধ্যে তিরিশ মিনিট অবশ্য ইন্সট্রাকশন শোনা, লাইফ জেকেট পরা, মাথায় হেলমেট লাগানো, ইত্যাদি। ঠিক বেলা দুটার সময় ওরা বোটে উঠল। ষোলো-সতর বছর বয়সের কোঅর্ডিনেটর ছেলেটা এই ট্রিপের ক্যাপ্টেনের সাথে যাত্রীদের সবার পরিচয় করিয়ে দিল। ক্যাপ্টেন বছর পঞ্চাশেক বয়সের এক সাদা কানাডিয়ান মহিলা, নাম জেসি মিলার।
জেসি সবাইকে ‘হাই’ বলল। সে একটা লাল হাফ প্যান্ট আর বোটিং কোম্পানির লোগো দেয়া হলুদ হাতাকাটা গেঞ্জি পরেছে। কোঅর্ডিনেটর বলল যে জেসি দারুন একজন এথলেট, একসময় কোন এক রাফটিং টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন টিমের সদস্য ছিল। কানানাস্কি নদী নাকি তার নিজের হাতের তালুর মতোই পরিচিত, এই নদীতে সে দিনে কিংবা রাতে যে কোন সময় চোখ বন্ধ করে বোট চালাতে পারবে। সাখাওয়াতের অবশ্য জেসিকে তেমন ভালো লাগল না, সে একজন পুরুষ ক্যাপ্টেন আশা করেছিল।
কানাডিয়ান এই লম্বা-চওড়া মহিলাগুলোকে দেখলেই সাখাওয়াতের ঘোড়ার কথা মনে হয়। এরা শারীরিকভাবে খুবই সক্ষম, সুস্থ, দীর্ঘজীবী – বেছে বেছে খাওয়া-দাওয়া করে, নিয়মিত জিমে যায়, শরীরের যত্ন নেয়। কিন্তু – সাখাওয়াতের ধারণা – এদের বেশিরভাগই আঠারো বছর বয়সে কিংবা তারও আগে কুমারীত্ব হারায়, তারপর কয়েকটা লিভিং টুগেদার করে, শেষে তিরিশ বছরের সময় বিয়ে করে স্থিতিশীল হওয়ার চেষ্টা করে, মধ্যবয়সে সন্তান নেয়, ছেলে-মেয়ে বড় হতে হতে ডিভোর্স হয়ে একটা বড় কুকুর সাথে নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করে।
এদের আরেকটা যে জিনিস সাখাওয়াতের অপছন্দ সেটা হল – এরা যে শুধু খোলা-মেলা পোশাক পরে তা না, সেটাকে তাদের গর্ব আর অধিকার বলেও মনে করে। অথচ এদের ধর্মেও তো শালীন পোশাকের নির্দেশ আছে, গির্জার নানরা তো বলতে গেলে পুরোই হিজাব করে চলে। আসলে এরা বোধ হয় সত্যিকার অর্থে এমনকি খ্রিস্টানও না। পশু-পাখির মতো জীবন কাটানোর পর কিয়ামতের দিন রবের সামনে দাঁড়িয়ে এইসব মহিলা কি জবাব দিবে, কে জানে!
সময়মতোই ওদের যাত্রা শুরু হল, সাখাওয়াত জাহাজে ওঠার দোয়াটা দুইবার পড়ল – একবার তার নিজের জন্য, আরেকবার মেয়ের জন্য। বোট চলতে শুরু করার প্রথম পনর-বিশ মিনিট সাধারণ নৌকা চড়ার মতই মনে হল, সাখাওয়াত বুঝতে পারল না, এর জন্য মানুষ এত পাগল কেন। কিন্তু আধা ঘন্টা যেতেই স্রোত বাড়তে শুরু করলো, আর এর আরেকটু পরেই শুরু হল উঁচু-নিচু, বোট একবার আকাশের দিকে মাথা তোলে তো পর মুহূর্তেই গোত্তা খেয়ে পানির ভেতর নাক ডোবায়। প্রতিবার নৌকা বড় একটা ঝাকুনি দেয় আর হৃদি খুশিতে চিৎকার করে ওঠে। শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখার চেষ্টা করতে করতে সাখাওয়াত হাসি মুখে মেয়েকে দেখতে থাকে।
ঠিক সোয়া একঘন্টা পর জেসি নুড়ি পাথরে ঘেরা একটা স্পটে নিয়ে নৌকা ভিড়ালো। মহিলা সবাইকে বলল যে – নৌকা এখানে পনর মিনিট থাকবে, তারপর আবার স্টেশনে ফেরার জন্য রওনা হবে। এই সময়টা যারা চায় তারা আশে-পাশে হাটাহাটি করে আসতে পারে। জেসি বার বার করে বলল, কেউ যেন ভুলেও পানিতে না নামে – কারণ কোন কোন জায়গায় পানির স্রোত খুব বেশি, এতো বেশি যে হাটুপানিতেও যে কারো ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা সম্ভব, আর একবার সেটা হয়ে পড়ে গেলে নদী যে তাকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটা বলা মুশকিল।
জেসি এটাও বলে দিল যে কেউ যেন দৃষ্টির বাইরে না যায় – সে একজন ‘ব্যাড অ্যাস’ মহিলা, কেউ যদি সময়মতো ফিরে না আসে তাহলে তাকে রেখেই ও রওয়ানা দিয়ে দেবে। সবদিক চিন্তা করে সাখাওয়াত এদিক-ওদিক যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইল না, ফলে সে আর হৃদি নদীর পাড়ে বসে রইল। জেসি বোটে বসে রইল আর বাদ-বাকি সবাই এদিক-ওদিক হাটতে চলে গেল। জেসি ওয়াকি-টকিতে ওর বেসের সাথে যোগাযোগ করে জানাল যে ওরা এন্ড পয়েন্টে সময়মতোই পৌঁছেছে।
সাখাওয়াত দেখল বাকিদের কেউ নুড়ি কুড়াচ্ছে, কেউ নদীতে পাথর মারছে। হৃদি নদীর পাড়ে একটা বড় গোল পাথরের ওপর গিয়ে দাঁড়াল, তারপর পাশের পাথরে লাফ দিল, এভাবে দুই পাথরের মধ্যে লাফালাফি করতে থাকল। জেসি সাখাওয়াতকে বলল মেয়ের আরো কাছে গিয়ে তার দাঁড়ানো উচিত।
সাখাওয়াত হৃদির কাছাকাছি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে, আর ঠিক তখনি ঘটল দুর্ঘটনাটা। হৃদি এপাশের পাথর থেকে ওপাশেরটায় লাফ দেয়ার সময় কেমন করে যেন দুই পাথরের মাঝখানে পড়ে গেল। সাখাওয়াত শুধু জেসিকে একবার ‘ও মাই গড’ বলতে শুনল, তারপর দেখল মহিলা প্রানপনে নদীর দিকে দৌড়াচ্ছে। সাখাওয়াত পাথর পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে খুঁজতে লাগল, কিন্তু কোথাও হৃদিকে দেখতে পেল না। সে প্রচন্ড স্রোতের মধ্যে দুই পাথরের একটাকে ধরে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল।
কতক্ষন সে এভাবে দাঁড়িয়ে ছিল তার মনে নেই। ততক্ষনে বাকি লোকজন ফিরে এসেছে, তার মধ্যে পুরুষ চারজন এদিক-ওদিক দৌড়ে যাচ্ছিল – সেটা তার মনে পড়ে। এটাও মনে পড়ে যে একজন সহযাত্রী লোকের কোলে হৃদিকে দেখে সে দৌড়ে গিয়েছিল। কে যেন হৃদিকে কয়েকবার মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস চালুর চেষ্টা করছিল, তারপর হঠাৎ সে কেশে উঠল আর মুখ থেকে পানি বের হয়ে এল।
তখনি ওদের মধ্যে কে যেন বলল জেসিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। সাখাওয়াতের মাথা তখন আর কাজ করছিল না, সে শুধু হৃদিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভেজা বালুর ওপর বসে ছিল।
পনর কিংবা বিশ বা তিরিশ মিনিটের মাথায় লাল রঙের একটা হেলিকপ্টারকে এদিকে আসতে দেখা গেল। উদ্ধারকারী সেই হেলিকপ্টার হৃদি আর সাখাওয়াতকে নিয়ে সোজা ফুটহিলস রিজিওনাল হসপিটালে চলে গিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার দুই দিন পর পুলিশ ফোন করে সাখাওয়াতকে জানিয়েছিল যে জেসিকে বাঁচানো যায় নি।
সেদিন খুব অদ্ভুতভাবে জেসির মৃত্যু হয়েছিল। জেসি ছিল দক্ষ সাঁতারু, সে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে খুব সহজেই হৃদিকে খুঁজে পায়, তারপর তাকে ধরে কিনারে নিয়েও আসে। হৃদিকে নদীর পাড়ে শোয়ানোর পর জেসি কেমন করে যেন পিছলে পেছনের দিকে পড়ে যায়, আর সেসময় মাথায় আঘাত লেগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, আর সেই ফাঁকে স্রোত তাকে দ্রুত আবার পানির ভেতর টেনে নিয়ে যায়। ভালো সাঁতার জানার পরও জেসি মারা যায় শুধু মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারানোর কারণে। প্রায় দুই দিন খোঁজাখুঁজির পর জেসির লাশ পাওয়া গিয়েছিল নদীর অনেক ভেতরে এক জঙ্গলের পাশে।
জেসির মৃত্যুসংবাদ শোনার পর সাখাওয়াত ফোন পাশে রেখে দিয়ে ঘন্টা খানেক সোফাতে চুপ করে বসে ছিল। স্বপ্না এসে জানতে চেয়েছিল কি হয়েছে। সাখাওয়াত শুধু বলেছিল ‘কিছু না’। সেদিন সে অফিসও কামাই করেছিল।
পরের সপ্তাহে সাখাওয়াত কানানাস্কি কাউন্টির সাথে যোগাযোগ করে। কানাডাতে ব্যক্তিগত তথ্য খুবই গোপনীয় জিনিস, পত্রিকা ছাড়া জেসির সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু জানা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ওই পক্ষ সম্মতি জানানোর পর কানানাস্কি কাউন্টি পুলিশ সাখাওয়াতকে জেসির ছোট ভাইয়ের ঠিকানা দেয়। রবার্ট পরের উইকএন্ডে সাখাওয়াতের সাথে দেখা করতে রাজিও হয়।
জেসি ক্যানমোর নামে কাছাকাছি একটা শহরে একটা বাড়িতে একা থাকত। গত কয়েক বছরে কোন কারণে নিজেকে সে বেশ গুটিয়ে নিয়েছিল, পরিবারের কারো সাথেই তেমন একটা যোগাযোগ করত না। সামার সিজনে বোট রাইডের ওই কাজটা করে নিজেকে সে ব্যস্ত রাখতে। শীতকালে সালফার মাউন্টেনে স্কি করতে চলে যেত জেসি।
রবার্ট নিজেও ক্যানমোর থাকে। সে জানাল জেসির একমাত্র মেয়ে ডারলিন ভ্যানকুভারে কাজ করে, সে এসেছিল মায়ের শেষকৃত্যে। জেসির প্রাক্তন স্বামী হ্যারিও এসেছিল অনুষ্ঠানে। রবার্ট সাখাওয়াতকে বার বার ‘ডোন্ট ওরি’ বলল, বলল যে দিনের শেষে এটা শুধুই একটা দুর্ঘটনা – হৃদি কিংবা সাখাওয়াতের এখানে কোন ভূমিকা নেই, সে যেন এটা নিয়ে অপরাধবোধে না ভোগে।
সাখাওয়াত রবার্টকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানিয়ে ক্যানমোর থেকে বাসায় ফিরল, কিন্তু সেদিন থেকে সে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল – নিজের মত থাকে, মসজিদে যায়, নামাজ পড়ে, প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় কিন্তু নিজে থেকে কোন কথা বলে না। আগের মতোই পিকনিকে যায়, কিন্তু কুশল বিনিময়ের পর দূরে গিয়ে বসে থাকে আর কি যেন ভাবে। ওই ঘটনার পর ক্যানু নিয়ে হ্রদে নৌকা চালাতে যাওয়া সে একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিল।
ক্যানমোরে জেসির ভাইয়ের সাথে কথা বলে আসার পর মসজিদের ইমাম শেখ আনসার আলীর সাথে সাখাওয়াত দেখা করেছিল। সে জানতে চেয়েছিল কোন মৃত খ্রিস্টানের আত্মার জন্য সে দোয়া করতে পারবে কিনা। আনসার আলী বলেছিল যে মৃত অমুসলিমদের আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করা যাবে না।
‘শেখ, অমুসলিম কেউ মারা গেলে কেন তার জন্য দোয়া করা যাবে না, সেটা কি জানতে পারি?’
‘ব্রাদার, যাদের জন্য দোজখ নিশ্চিত হয়ে গেছে, তাদের জন্য দোয়া করা আমাদের ধর্মে নিষেধ।’
‘অমুসলিমরা সবাই দোজখে যাবে, এটা কি নিশ্চিত?’
‘হ্যা, মুসলমান ছাড়া বাকি সবাই দোজখে যাবে, এটা নিশ্চিত।’
পরিচিত সবাই স্বপ্নার কাছে জানতে চাইত সাখাওয়াতের অবস্থা, স্বপ্না বলত – হয়তো এটা সাময়িক বিষন্নতা, সময়ের সাথে তো এসব কিছুই ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে বছর গড়িয়ে যাওয়ার পরও সাখাওয়াতের কোন পরিবর্তন হল না – সারাদিন কি যেন চিন্তা করে, কথাবার্তা কম বলে, আর মাঝে-মধ্যে এই ইমাম সেই শেখের কাছে গিয়ে বিচিত্র সব ধর্মীয় বিষয় নিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। এমন কি অফিসের কাজেও ওর মন কমে গেল, নানা অজুহাতে প্রায়ই ছুটি নিতে থাকল। সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার পদে তার একটা প্রমোশন প্রায় হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেটা শেষপর্যন্ত আটকে গেল আর তার বদলে তার এক কলিগ পজিশনটা পেয়ে গেল। সাখাওয়াতকে অবশ্য এ নিয়ে একেবারেই চিন্তিত বলে মনে হল না।
আরো কয়েক বছর এভাবে কাটানোর পর মসজিদের এক লেবানিজ ব্রাদার তাকে বলল যে তার কাছে একজন আধুনিক মাওলানার খোঁজ আছে, সাখাওয়াতের কোন প্রশ্ন থাকলে ওই মাওলানারা সাথে সে কথা বলে দেখতে পারে। মাওলানা শরীফ আয়ুব অন্য শহরে থাকে, কিন্তু তার ফোন নাম্বার পাওয়া গেল। প্রাথমিক কথা-বার্তার পর শেখ শরীফকে সাখাওয়াতের ভালো লাগল, কারণ দেখা গেল উনি বিজ্ঞান আর যুক্তি দিয়ে ধর্মকে বোঝার চেষ্টা করে। তবে এই ভদ্রলোকও অন্য মাওলানাদের মতই বলল যে খ্রিস্টানরা দোজখে যাবে, তাদের ব্যাপারে কোন আশা নেই।
‘কিন্তু যে অমুসলিম আরেকজনের জন্য প্রাণ দিল, সে যদি বেঁচে থাকত তাহলে তো পরবর্তী কোন একসময় সে হেদায়েত পেয়ে মুসলিমও হয়ে যেতে পারত।’
‘সে নিশ্চয় তার জীবদ্দশায় কোন না কোন একসময় খোদার ডাক পেয়েছে, কিন্তু শোনে নি বা শুনতে চায় নি।’
‘একজন ভালো অমুসলিম কেন বেহেশতে যেতে পারবে না?’
‘শোনো ব্রাদার – ধরো তোমার এক বন্ধু আছে যে তোমার জন্য জান-মাল সব দিয়ে দেয় এমন, কিন্তু যে বাবা তাকে সবকিছু দিয়েছে তার সাথে সম্পর্ক রাখে না, বেয়াদবি করে – তাকে কি তুমি ভালো বলতে পারবে? পারবে না, কারণ সে যার সম্পদ দিয়ে মাতবরি করছে তার সাথেই সে গাদ্দারি করছে।’
সাখাওয়াত জেসির ঘটনাটা খুলে বলার পর শেখ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে তারপর বলল – ‘যে কোনদিন ইসলামের কথাটা শুনে নি, কিয়ামতের দিন তার আশা আছে – তাকে হয়তো নতুন করে ঈমানের পরীক্ষা করা হবে। কিন্তু এই মিডিয়ার যুগে একজন কানাডিয়ান ইসলামের কথা শুনে নি, এটা বিশ্বাস করা কঠিন।’
‘শেখ, তুমি মিডিয়ার কথা বলছো? মিডিয়া কি কোনদিন ইসলাম সম্পর্কে ঠিক তথ্য দেয়? হয়তো জেসি ইসলাম সম্পর্কে কোনদিন ভালোভাবে জানতেই পারে নি।’
‘হ্যা, সেটা হওয়া সম্ভব।’
পরের কয়েক বছরে সাখাওয়াত বেশ মুটিয়ে গেল, তার ডায়াবেটিস আর হাই ব্লাডপ্রেশার দেখা গেল। স্বাস্থ্যগত কারণে তাকে কাজ থেকে দু-দুবার লম্বা ছুটি নিতে হল, ফলে বাসার রোজগারও অর্ধেক হয়ে গেল। স্বপ্না বাধ্য হয়ে একটা কাজ খুঁজে নিল, সংসারটা তো চালাতে হবে। ততদিনে সাখাওয়াত কোরানের বিভিন্ন ধরণের তাফসীর খুঁজে নিজেই পড়াশোনা শুরু করেছে – কোথাও যদি অমুসলিমদের বেহেশত-দোজখ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়। কিন্তু কোন তাফসীরকেই তার পুরোপুরি নিরপেক্ষ মনে হল না। অন্যদিকে সে নিজে এতটা জানে না যে ভেবে ভেবে কোরানের অর্থ বের করে নিবে।
এভাবে আরো বছর কয়েক যাওয়ার পর একদিন তাবলীগের বাঙালি ‘সাথী’ মোশাররফ ভাই – যে সাখাওয়াতের বৃত্তান্ত জানত – মসজিদে মাগরিবের নামাজের পর তাকে ডেকে পাশে বসাল।
‘ভাই, আমরা সবাই বুঝি আপনি একজন বিধর্মী মহিলাকে বেহেশতী মনে করতে চাচ্ছেন। কিন্তু আপনি তো জানেন, আপনি ইসলামের নতুন নতুন ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। দ্বীন যেরকম আছে সেরকমই আপনাকে মেনে নিতে হবে।’
সাখাওয়াত বার বার মাথা নাড়ল।
‘কিন্তু সে যদি কোন মুসলমানকেকে বাঁচাতে গিয়ে মারা যায়, তাহলে তো ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গেল, তাই না?’
‘ভাই, বাইরে থেকে মনে হয় এক মানুষ আরেক মানুষকে বাঁচাচ্ছে, কিন্তু বাঁচায় তো আল্লাহই, মানুষতো উসিলা।’
‘আমার মাথায় কিছুতেই একটা হিসাব মিলছেনা – একটা মেয়ে খ্রিস্টান ঘরে জন্ম নেয়ার কারণে যদি ইসলাম সম্পর্কে জানতে না পারে, তাহলে তার দোষটা আসলে কোথায়।’
‘শোনেন ভাই, আল্লাহ তো আল-আদিল। তিনি কোন না কোনভাবে সবার সাথে ন্যায়বিচার করবেন, এটা আমাদের বিশ্বাস রাখা চাই, ভাই।’
বছর তিনেকের মধ্যে সাখাওয়াতের স্বাস্থ্যের আরো অবনতি হল। ছোটো-খাটো একটা স্ট্রোকের পর জানা গেল, তার হার্টে বেশ কিছু ব্লক আছে। ওপেন হার্ট সার্জারির পর তাকে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে কাজে ইস্তফা দিতে হল। ইন্সুরেন্স থেকে সে কিছু টাকা পেত, কিন্তু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য ছিল, ফলে তাদেরকে আঠারো বছরের পুরোনো বাড়ি ছেড়ে ছোট একটা সরকারি অনুদানের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠতে হল। সৌভাগ্যক্রমে হৃদি ততদিনে একাউন্টিংয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে ছোট একটা কাজে ঢুকেছে, সে প্রতি মাসে বাবা-মাকে কিছু কিছু টাকা পাঠাতে শুরু করল।
হার্ট স্ট্রোকের দুই বছরের মাথায় আবার সাখাওয়াতের কিডনি ফেল করা শুরু করল। সমস্যাটা ধরা পড়ার তিন মাসের মধ্যে অবস্থার এতটা অবনতি হল যে তাকে সপ্তাহে তিনদিন করে ডায়ালাইসিস শুরু করতে হল। এভাবে আরো দেড় বছর শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে টানা-হ্যাচড়া করার পর বোঝা গেল যে সে আর বেশিদিন এ পৃথিবীতে টিকবে না।
এরকমই একদিন সে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পড়ে ছিল। হৃদি সেদিন কাজ থেকে ছুটি নিয়ে বাবাকে দেখতে এসেছিল, সে কোনোভাবে বুঝতে পেরেছিল যে তার বাবা আর বেশিদিন বাঁচবে না। বাবাকে প্রায় মৃত্যুশয্যায় দেখে হৃদি চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না, কিন্তু তার বাবা তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল।
‘বাবা, আমি কাঁদছি, আর তুমি হাসছো?’
সাখাওয়াত মেয়েকে কাছে ডেকে ফিস ফিস করে বলল – ‘মা, আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি।’
‘কোন প্রশ্ন, বাবা?’
‘এতো বছর ধরে যেটা খুঁজেছি। আচ্ছা হৃদি, তোর কি মনে হয় মা? জেসি কি দোজখে যাবে?’
‘আমি জানি না, বাবা।’
সাখাওয়াতের হাসি এবার বেশ বিস্তৃত হল।
‘আমার সাথে আল আজহার ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসরের কথা হয়েছে। গত জুমাবারে সে নিজে থেকে এসেছিল আমাকে দেখতে। সে আমাকে বলে গেছে, আবু লাহাব, ফেরাউন এরকম কয়েকজন ছাড়া আর কারো ব্যাপারে বলা যাবে না, কে বেহেশতে যাবে আর কে দোজখে যাবে। আল্লাহ যাকে খুশি তাকেই বেহেশতে দিয়ে দিতে পারেন।’
হৃদিকে এই জটিল ধর্মতত্ব নিয়ে তেমন চিন্তিত বলে মনে হল না, শেষ বিকেলের আলোয় বাবার হাত ধরে হাসপাতালের বেডের পাশে সে শুধুই বসে রইল। পরে রাত আটটার দিকে সে বাসায় ফিরে গেল, এর কিছুক্ষন পর স্বপ্না কেবিনে এল রাতে থাকবে বলে। ভোর চারটার দিকে সাখাওয়াত মারা গেল।
উনিশটা বছর একটা দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণা করে চিন্তিত জীবন কাটালেও মারা যাওয়ার সময় সাখাওয়াতের ঠোঁটের কোণে ঠিকই তৃপ্তির একটা হাসি লেগে থাকল।
(ছোট গল্প / মায়িন খান, জুন ২০২১)

Good one!
LikeLiked by 1 person