শিশুকাল। বাবা-মায়ের আদর আর প্রতিরক্ষা প্রতি পদে। হতাশ হবার কোন পথ নেই। মনে হতো দুনিয়াটা আমার, যা চাবো তাই পাবো। বুঝতেই পারতামই না প্রকৃত দুনিয়া আসলে ঠিক কেমন। বিশ্বাস করে নিলাম পৃথিবীটা আসলে ইউটোপিক, অন্ততঃ তাই হবার কথা। তখন থেকেই সামান্য ভুল কিম্বা ব্যতিক্রমে ভীষণ বিরক্ত বোধ করতাম আমি। যেন ঠিক যা হবার কথা তা না হওয়া এক ধরণের অন্যায়।
শিশুকালের শেষ দিক থেকে পাওয়া শুরু করলাম নিয়মনীতি শিক্ষা। এগুলোর অর্ধেক ছিল ধর্ম আশ্রয় করে, আর বাকি অর্ধেক ছিল সমাজ আশ্রয় করে। অবশ্য অনেক পরে বুঝতে পারি, ধর্মের ওই অর্ধেক অংশও মূলত ছিল সামাজিক ধর্ম। সামাজিক ধর্মের প্রভাবে শিখলাম কিভাবে খুব ছোট খাটো বিষয়কেও বৈধ অবৈধের কঠিন দাঁড়ি পাল্লায় ফেলে জীবন চলতে হয়, নচেৎ ইহকাল পরকাল সবই শেষ! অন্য দিকে সমাজ থেকে শিখলাম কিভাবে যা কিছু আদর্শ নয় তা কতটা তুচ্ছ, ফালতু কিম্বা অগ্রহণযোগ্য।
কৈশোর পুরাটা কেটে গেলো সমাজের নজর বুঝতে। ডাক্তারী কিম্বা ইঞ্জিনিয়ারইং বিদ্যা ভীষণ ভালো, কিন্তু মনোবিজ্ঞান সে তুলনায় সস্তা, আর দর্শন পড়া আর পাড়ার মোড়ে আড্ডা দেয়া প্রায় একই। যৌবনে যখন বুঝতে পারলাম আমার প্রিয়তম দর্শন সমাজে ধর্ষিত, নিরবে পরবর্তী প্রিয় মনোবিজ্ঞানে আশ্রয় নেবার চেষ্টা করলাম। তাতেও লাভ হলনা। বুঝে ফেললাম, হয় ডাক্তার নাহয় ইঞ্জিনিয়ার, অথবা দুটোই। সমাজের মাথায় চড়ে বসার নেশা ঘাড়ে চাপল।
এদিকে মনের গভীরে দরশনের জন্য ভালবাসা কখনো মরেনি; তাই ডাক্তারি পড়েও দরশনকে কাছে পেতে মনোবিজ্ঞান ঘেঁষে থাকলাম। লোকে বলা বলি শুরু করে দিল, আমি ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু সমাজের মাথায় চড়া যার উদ্দেশ্য সে কি আর তা হতে দেয়! অবাস্তবপ্রায় সব গন্তব্য ঠিক করে ফেললাম। পৌছতে পারলে সমাজের নজরের ধার ধরার দরকার থাকবে না, এমনকি বিশ্ব সমাজও হয়তো জেনে নেবে আমাকে। পাড় মাতালের মতো দৌড়াতে থাকলাম গন্তব্যের পথে।
যখন দৌড়ের সুফল পাওয়া শুরু হল, তখন একই সাথে পায়ে পা বাধানো সঙ্গির সংখ্যা বাড়তে থাকল। যতক্ষণ পর্যন্ত হোঁচট খেয়ে দাঁত না ভাঙ্গল, বাধা বাড়তেই থাকল। এক পর্যায়ে নিজ সমাজের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়লাম। দুর্বল থেকে আরও দুর্বল হলাম; এক পর্যায়ে লুকানোর জায়গা খুঁজে পেলাম না। এমন একটা সময়ে স্রষ্টার কৃপায় দুনিয়ার স্বর্গে এসে উপস্থিত হলাম। বলতে পারবনা এতটা পরিবর্তন কিভাবে জীবনে এলো, তবে বুঝে নিলাম, আমার জীবনের মালিক আমি নই, যে প্রকৃত মালিক তার ক্ষমতা হিসাবের বাইরে।
পৃথিবীর স্বর্গে আসার পর বেশ কটা বছর সুস্থ আর স্থির হতে কেটে গেলো। নতুন জন্ম নেয়া শিশুর মতো করেই জীবনকে নতুন করে চিনতে আর গড়তে শুরু করলাম। এখানে আমার পুরাতন শত্রু অর্থাৎ পেছনে ফেলে আসা সমাজ আর তার নিয়ম কানুনের অনুপস্থিতি আমাকে আশ্বাস দিল – আর ভয়ের কিছু নেই। সব ছেড়ে ছুড়ে সুখি হবার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রয়োজনের বাইরে সব বাড়াবাড়ি সতর্কভাবে এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঠিক করলাম, জীবন মানে কোন সুউচ্চ গন্তব্যের দিকে তাকিয়ে হাঁটা নয়, বরং শান্তির সাথে উপস্থিত চারপাশকে উপভোগ করতে করতে হাঁটা।
কিছুদিন পর নিজেকে প্রশ্ন করলাম, উচ্চাকাঙ্ক্ষার তাহলে কি হবে? উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিহীন আমি কি মুলতঃ অপদার্থ নই? যতই নিজেকে বুঝাই যে শান্ত, সৎ আর সুন্দর জীবনই আসল কথা, বাড়তি কিছু হলেও চলে, না হলেও ক্ষতি নেই — কিছুদিন পরপরই আবার সেই শংকা ফিরে আসে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিহীন আমি কি গ্রহণযোগ্য?
দূর পরবাশে নিঃসঙ্গ হবার সুবাদে নিজেকে সময় দেয়ার সুযোগ প্রচুর। কিন্তু বিপত্তি হল তখন যখন বুঝতে পারলাম, আমার মন আমার নিজের সেই অংশটুকুকে শুধু সহ্য করে যা নিখুঁত আর উঁচু মানের, বাকিটাকে নয়। নিজের প্রতি নিজের এমন মনোভাবে স্বভাবতই একটু মুষড়ে পড়লাম। এতদিন অন্যকে দূষিয়ে সময় পার করেছি নিজেকে দুরাবস্থায় পেয়ে। কিন্তু যখন সেই “অন্যরা” পাশে নেই, তখন বর্ণবাদী খলনায়ক আমার নিজের মধ্যেই খুঁজে পেলাম। সত্যি কথা বললে, এই খলনায়ক সম্ভবত শৈশবের পরপরই আমার মধ্যে জন্ম নেয়, জন্মাতে সাহায্য করে পারিপার্শ্বিক শিক্ষা আর পরিস্থিতি। তারপর থেকে সকল ঋণাত্মক প্রভাবের প্রতিনিধি হয়ে এই খলনায়কই শাসন করে আসছে আমার জীবন। দুষ্ট সমাজ শুধু এগিয়ে দিয়েছে উদাহরণ, আর সেই উদাহরণকে আশ্রয় করে আমার ভেতরের এই খলনায়ক আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। এখন স্বর্গে উপস্থিত হয়ে যখন সব পুরাতন সঙ্গ দূরে ঠেলে দিয়েছি, তখন তার কুৎসিত চেহারাটা আমার চোখের সামনে পরিষ্কার ধরা পড়ছে, কারণ এখনতো আর খলনায়কের ভিড় নেই যাতে সে মুখ লুকাবে। বুঝতে পারছি, আমার সকল সমস্যার প্রধান উৎস বাস করে আমারই মাঝে; তাকে অন্য কোথাও খুজতে যাবার কোন প্রয়োজন নেই।

perfect analysis
LikeLike